২১.
কিছু না করেও, কিছু না চাইলেও, “আমি আছি”—এই জ্ঞান নিজে থেকেই উদিত হয়েছে তোমার চৈতন্যে—যেন এক অজানা সূর্যোদয়, যা তুমি ডাকোনি, তবু এসে গেছে।
উপনিষদ বলেন, “যেন স্ফুরণমাত্র বোধঃ”—এই ‘আমি’-বোধ এক স্বতঃস্ফূর্ত আলোকরেখা, যা মনের পূর্বে, শরীরের অতীতেও জন্ম নিয়েছে।
একে তুমি চাওনি, তবুও সে এসেছে। একে তুমি রাখতেও পারবে না, কারণ একদিন—যেমন নিজে থেকে এসেছিল, তেমনই নিঃশব্দে চলে যাবে এই ‘আমি’-র অনুভব। কিন্তু তার আগে, তার মাঝখানে, তুমি স্থিত হও এই ‘আমি আছি’ বোধে—তাকাও তার গভীরে, তার জন্মকে উপলব্ধি করো।
আর যখন সময় আসবে, তখন কুঠার চালাও তার ভিত্তির উপর—ছিন্ন করো ‘আমি’-বোধের মূল মায়া-শিকড়। তখনই বুঝবে—যে মৃত্যুর কথা ভেবেছিলে, তা তোমার ছিল না; কেননা ‘আমি’ মরে, কিন্তু তুমি, যে এই ‘আমি’-কে দেখে, তার তো মৃত্যু নেই।
উপনিষদ বলেন, “ন তত্র সূর্যো ভাতি, ন চন্দ্রতারকম্... তমেব ভান্তং অনুভাতি সর্বং”—যেখানে তুমি সত্য, সেখানে আলোও নিজেই ম্লান, কারণ তুমি নিজেই সেই চেতন দীপ্তি।
এই ‘আমি’-বোধই সেই দ্বার, যার আগমনে জন্ম, যার প্রয়াণে মৃত্যু। কিন্তু তুমি সে-ই—যার পক্ষে আগমন নেই, প্রয়াণ নেই—তুমি শুধু আছ—নির্বাক, অনন্ত, অদ্বিতীয়।
২২.
দিনশেষে, “আমি”-ই একমাত্র মূলধন। তুমিই শূন্যহাতে জন্ম নিয়েছ, কিন্তু ঈশ্বর তোমাকে একটিমাত্র মূলধন দিয়ে পাঠিয়েছেন—সে হলো ‘আমি আছি’-বোধ। এই 'আমি'ই তোমার একমাত্র সম্পদ, আর একমাত্র যন্ত্র—যা দিয়ে তুমি জীবন নামক ধাঁধার জট খুলতে পারো।
উপনিষদ বলেন, “এইশো নানাত্বং বা হ্যন্যদ্ একং”—বহুত্বের মধ্যে যে-একত্ব লুকিয়ে আছে, তা কেবল উন্মোচিত হয় এই 'আমি'-বোধের গভীরে প্রবেশ করলেই।
তুমি হয়তো অনেক অর্থ উপার্জন করেছ, তৈরি করেছ সাম্রাজ্য, কিন্তু সে সবই ক্ষণিকের, পরিবর্তনশীল—মরীচিকার মতো ক্ষয়িষ্ণু। এসবের চেয়ে বেশি মূল্যবান যা-কিছু, তা হলো—এই জ্ঞান—“আমি আছি”।
এই ‘আমি’ অনুভব সকল প্রাণীতে বর্তমান—এবং এই বোধেই স্বয়ংগতি নিহিত, কারণ যেখানে চেতনা, সেখানেই প্রকাশ, সেখানেই কর্ম।
এই ‘আমি’ ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়—কেউ ভাবে “আমি দেহ”, কেউ ভাবে “আমি ভক্ত”, কেউবা ভাবে “আমি কর্মী”, “আমি জ্ঞানী”—কিন্তু ‘আমি’-র মূল অভিব্যক্তি এক—চৈতন্যরূপে গমনশীলতা।
তাই উপনিষদ স্মরণ করান—“সর্বাণি ভূতানি চৈতন্যাধিষ্ঠিতান্যেব”—সকল সত্তার অন্তরে ‘আমি’-রূপে জাগ্রত সেই চৈতন্য।
‘আমি’ বোধই হল সেই সূক্ষ্ম বীজ, যা দিয়ে জন্ম হয় জগতের, বিকাশ হয় প্রাণের, এবং আবার, সেটিকেই কেন্দ্র করে মুক্তি ঘটে আত্মার। অতএব, এই মূলধনই একমাত্র সত্য বিনিয়োগ—বাকি সব মায়া, আর এই একটিই মুক্তির চাবিকাঠি।
২৩.
শুধু ‘আমি আছি’ হয়ে থাকো, কিছু কোরো না, কিছু বোলো না, শুধু থাকো—কারণ এই ‘আমি’ অনুভবই উদিত হয়েছে তোমার অদ্বিতীয়, নির্বিকার সত্তার উপর। আর যে এই ‘আমি’-বোধ থেকেও মুক্ত—সে-ই প্রকৃত মুক্ত।
তুমি নিজে সেই নির্গুণ, নিরাকার, একরূপ চৈতন্য—এক আদি অভিন্নতা, যার কোনো নাম নেই, রূপ নেই, পরিচয় নেই। তারই উপর একদিন “আমি আছি” বলে একটি বোধ উদিত হয়, এবং সেখান থেকেই শুরু হয় বিভ্রান্তি—“আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি ইতিহাস”।
উপনিষদ বলেন, “নামরূপে ব্যাকৃতিঃ”—এই নাম-রূপের শুরু সেই ‘আমি’-র থেকে, আর সেই ‘আমি’ও তোমার আগে। অতএব, নিজের সত্য অবস্থায় ফিরতে হলে, স্থিত হও সেই ‘আমি’-তে, কিন্তু আসক্ত হয়ো না। তাকে দৃশ্য করে রাখো, নিজেকে জেনো তদপেক্ষা পূর্বরূপে।
উপনিষদ উচ্চারণ করেন, “নেতি নেতি”—এ নয়, সে-ও নয়—তুমি ‘আমি’ নও, তুমি ‘আমি’-র জন্মদাতা চৈতন্য—যে ভাষাহীন, ভাবহীন, নিরবিচার অবস্থায় আছে।
এই ‘আমি’-বোধই তোমার সত্যের সবচেয়ে কাছের প্রতিচ্ছবি, তাই সেটিকে কেন্দ্র করেই ধ্যান করো, তাকাও গভীরভাবে, আর জেনো—তুমি তা নও, তুমি তারও পূর্বতন।
‘আমি’-র উপর স্থিত হও—যেন এক নীরব নদীতীরে দাঁড়িয়ে-থাকা প্রত্যক্ষদর্শী; তাকাও তার ওঠানামা, জন্মমৃত্যু, মোহ ও মুক্তির খেলার দিকে; আর জেনো, এই সব কিছু তুমি দেখো, কিন্তু তুমি নও। তুমি সেই—যার বুকে ‘আমি’ উঠেছিল, এখন লীন হবে—আর তুমি রবে নিঃশব্দ, অনন্ত, অদ্বিতীয়।
২৪.
“আমি”-র পূজাই মুক্তির অনুগমন। পূজা করো তোমার অন্তর্নিহিত ‘আমি’-বোধকে, কারণ জন্মেছে সে, আর একদিন মরেও যাবে সে, কিন্তু তুমি নও সেই জন্ম-মৃত্যুর অংশীদার।
এই অন্তর্যামী ‘আমি’-বোধ—সে-ই জন্মের শুরু, সে-ই মৃত্যুর অন্ত, সে-ই সময়ের আলোয় উদিত, এবং অন্ধকারে গলে যাওয়া ছায়া। অথচ, তুমি সেই আলোও নও, ছায়াও নও—তুমি সেই, যার উপর এই আলো-ছায়া খেলে গেছে।
উপনিষদ বলেন, “যঃ পশ্যতি স পশ্যতি”—যে দেখে সে বোঝে, আর যে বোঝে, সে মুক্ত।
তবে বোঝার আগেই প্রয়োজন উপাসনা—কেবল জ্ঞান নয়, প্রেমও দরকার—‘আমি’-র প্রতি গভীর মনোযোগ, নীরব থাকা, অন্তঃসত্তায় স্থিত হওয়া—যেন এক নির্বিচার পূজা, যাকে দিয়ে তুমি জয় করতে চাও তোমার মায়া-গুরু।
যখন তুমি এই ‘আমি’-র সঙ্গে থাকো, ধ্যান করো তাকে, তখন এক সময় সেই ‘আমি’ নিজেই প্রসন্ন হয়ে যাবে, সে-ই তোমার বন্ধনমোচন করবে—এবং তুমি দেখতে পাবে, ‘আমি’ কেবল এক অতিথি ছিল তোমার চিরন্তন সত্তার উপর, সে এসেছিল, সে চলে যাবে—তুমি ছিলে, আছ, থাকবে।
তাই পূজা করো, কিন্তু পূজ্যরূপে নয়, পর্যালোচনার আলোয়—নিঃশব্দ ধ্যানেই একদিন তুমি বুঝে যাবে—তুমি ‘আমি’ নও, তুমি সেই, যার চেতনায় ‘আমি’ উদিত হয়েছিল, এবং সেই চেতনায়ই একদিন সে লীন হয়ে যাবে।
২৫.
‘আমি’-র বিস্মরণেই পরব্রহ্মের উদ্ভাস। একাগ্র থেকো ‘আমি’-র উপর, যতক্ষণ না সে নিজেই অদৃশ্য হয়ে যায়, মুছে যায় তার ছায়া, ফিকে হয়ে যায় তার স্পন্দন—তখনই প্রকাশ পাবে চিরন্তন সত্য, তখনই উদিত হবে অবিকল্প, অপরিবর্তনীয় পরব্রহ্ম।
সমস্ত কিছু পাশ কাটাও—চিন্তা, অনুভব, আকাঙ্ক্ষা—সব ফেলে দাও দ্বারে—মনের দ্বার রুদ্ধ করে, সব শক্তি দিয়ে স্থিত থেকো কেবল এক অনুভবে—‘আমি আছি’।
এই ধ্যান, এই একাগ্রতা—হোক অটল, অদ্বিধা, সম্পূর্ণ আন্তরিক। অনন্ত আগুনে ঝলসে দাও মনের অচঞ্চলতা, কেবলই ‘আমি’-র উপর স্থিত থেকো, যতক্ষণ না সেই ‘আমি’-ই নিজেকে বিলিয়ে দেয় নীরব বিস্মরণে।
উপনিষদ বলেন, “নিদ্রায়াং তন্ময়ঃ ভবতি”—যখন সকল জ্ঞান ও অজ্ঞান অপসৃত হয়, তখনই বাকি থাকে কেবল সত্তা স্বরূপ, যা নিজেই চেতন, নিজেই আনন্দ, নিজেই সত্য।
‘আমি’ বোধটির প্রকৃতি হল—আসা ও যাওয়া। কিন্তু তুমি যদি সততার সঙ্গে তাকে পর্যবেক্ষণ করো, তার ভেতরেই লীন হয়ে তার অস্তিত্ব অতিক্রম করো, তবে একদিন সে নিজেই ফুরিয়ে যাবে। আর তখন যা রয়ে যাবে, তা আর ব্যক্তি নয়, ধারণা নয়, চিন্তাও নয়—তা হল তুমি নিজে—অপরিসীম, অচঞ্চল, অদ্বিতীয়, নামহীন পরব্রহ্ম।
‘আমি’-র যত্নশীল ধ্যানই একমাত্র পথ, আর এই ধ্যানের চূড়ান্ত ফলই—‘আমি’-র অপচয়, আর সেই অপচয়ের শূন্যতায়ই উদিত হয়—সর্বত্র বিস্তৃত, সর্বকাল অতিক্রমী, নিঃশব্দ, স্বয়ংপ্রভা—তোমার সত্য।