নির্জন গহনে: ৩



১১.

“আমি আছি”—এই অনুভবটি তো তোমার সত্য স্বরূপের উপর আপনা-আপনিই উদিত হয়েছে। তুমি চাওনি, আহ্বান করোনি—তবুও সে এসেছিল নিঃশব্দে, শব্দহীনভাবে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

যখন এল, তখন কোনো ভাষা ছিল না, কোনো নাম, পরিচয়, ভাবনা, চিন্তা ছিল না—ছিল কেবল এক অনির্বচনীয় বোধ—“আমি আছি”, যাকে তুমি তখনো ভাষায় ধরোনি, কিন্তু ছিল তা—অবিকল, নিখুঁত, প্রত্যক্ষ।

এই নিঃশব্দ, শব্দাতীত “আমি আছি”-কে যদি তুমি গভীর মনোযোগে দেখো, অনুভব করো, তবে তুমি তাকে ধরতে পারো— আর সে-ই হয়ে দাঁড়ায় এক সেতুবন্ধন, যা তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে তোমার প্রকৃত, নিরুপাধি, নিঃশেষ স্বরূপে।

এই “আমি আছি” একধরনের সূক্ষ্ম দ্বার—যা জন্মায় তোমার মধ্যে, কিন্তু তোমার নয়, তাকে চেনো, তাকে উপলব্ধি করো, তারপর তারও অতীত হও—তাহলেই ফিরে পাবে নিজস্ব স্বরূপ, সেই অদ্বিতীয় ব্রহ্মজ্যোতি।

১২.

“আমি আছি”—এই বোধই তোমাকে এনেছে জগতে, এবং এই “আমি আছি”-ই তোমাকে নিয়ে যেতে পারে জগতের ঊর্ধ্বে। এটাই দ্বার—এই “আমি আছি”-ই সেই পথ, দাঁড়িয়ে থাকো এর দুয়ারে—এই দরজা সবসময় খোলা!

এই “আমি আছি”-বোধই সেই অনুরণন, যার মধ্য দিয়ে তুমি প্রবেশ করেছিলে অস্তিত্বের নাট্যমঞ্চে। ভাষাহীন, নামহীন, আকর্ষণহীন এক বোধ—যা ছিল তোমার প্রথম আত্ম-অভিজ্ঞান।

আর এই একই দ্বার দিয়েই ফিরে যাওয়া যায়, যাবার আর কোনো পথ নেই—“আমি”-র মাঝেই লুকিয়ে আছে মুক্তির পথ।

কিন্তু তুমি সেটা জানতে পারবে না—যতক্ষণ না তুমি যথেষ্ট সময় ধরে এই “আমি আছি”-তে স্থির হও, তাকে গভীরভাবে অনুভব করো, চেতনায় ধারণ করো। তখনই তুমি বুঝবে—এই দ্বার কখনও বন্ধ ছিল না, বরং তুমিই ছিলে অস্থির, তুমিই ছিলে বিমুখ।

এখন ফিরে এসো সেই “আমি আছি”-তে, যার স্তব্ধ কেন্দ্রে গৃহফেরা নিশ্চিত—কারণ এ দ্বার ব্রহ্মলোকে যায়, যেখানে “আমি” নেই, তুমি নেই, আছে কেবল অদ্বিতীয় স্বরূপ—নিঃশব্দ, নির্মল, মুক্ত।

১৩.

"আমি আছি" বলার আগে তো তোমার 'থাকা' দরকার—এই থাকা, এই উপলব্ধি-শূন্য সত্তা, সেটিই সমস্ত দৃশ্যমানতার মূল শিকড়।

'আমি' হওয়ার জ্ঞান যখন উদিত হয়, তখন তা কোনো ভিত্তির উপরেই উদয় হয়—একটি শব্দহীন অনুভব, যেটি ভাষার আগেই ছিল।

তুমি যখন ভাষা শিখলে, তখন এই 'আমি' শব্দটি রূপ নিল; কিন্তু তারও আগে, নিঃশব্দ আত্মবোধটি ছিল।

এই শব্দহীন ‘আমি’ অনুভবের সঙ্গেই যেন অবগাহন করল আকাশ, দিগন্ত, জগত—এই ‘আমি’ অনুভবই সকল প্রত্যক্ষ বাস্তবতার মূলে।

অতএব, ‘আমি আছি’—এই জ্ঞানটি নিজেই একটি মায়াবী প্রতিচ্ছবি, যার উদয় হয়েছে এক পরম নির্বিকল্প চৈতন্যে; সেই চৈতন্যই একমাত্র সত্য, বাকিটুকু অভিব্যক্তির মায়া।

১৪.

“আমি আছি”—এই অনুভবই জীবন নামক ঘটনাবলির একমাত্র স্থায়ী সূত্র, এক নিরবচ্ছিন্ন দড়ি, যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় চৈতন্যের অভিজ্ঞান।

জন্ম, গর্ভাবস্থা, শৈশব—এসবই সেই সময়, যখন এই ‘আমি’ ছিল ঘুমন্ত, মৌনী, গভীর অনস্তিত্বে লীন। তবুও সে ছিল—যেন "সুষুপ্তস্থানে একঃ স্বপ্নাহীনঃ"—নিদ্রার ভেতরে জেগে-থাকা একমাত্র চৈতন্য, আত্মা।

প্রায় তিন বছর বয়সে, অচেতনভাবে জাগে এই মৌন অনুভব—‘আমি আছি’, কিন্তু তখনও ভাষাহীন, চিন্তাহীন। উপনিষদ বলে, "অবিদ্যায়া মিথ্যাজ্ঞানং ভবতি"—এই ‘আমি’-র ওপর তখনই চেপে বসে শব্দ, নাম, রূপ, পরিচয়।

“আমি” থেকে জন্ম নেয় “আমি এই”, “আমি তেমন”, “আমি আমার”—এক বিশাল নির্মাণের ভিত হয়ে দাঁড়ায় এই নিষ্কলুষ ‘আমি’-র উপর।

এই নির্মাণ, এই পরিচয়, এই “আমি বাবা”, “আমি নারী”, “আমি সফল”, “আমি ব্যর্থ”—সবই মায়ার বুনন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে, সব পরিবর্তনের মাঝেও অটুট থাকে সেই প্রথম অনুভব—‘আমি আছি’।

এই ‘আমি’-র অভিজ্ঞতাই জন্ম দেয় সময়ের, ইতিহাসের, জগতের। কিন্তু তুমি যদি এর মাঝেই ফিরে চাও তার মূলের দিকে, তবে জানতে পারো—
"নেতি নেতি", এই আমি নয়, এই পরিচয় নয়, এই ভাব নয়।

অতএব, ফিরে এসো সেই নিঃশব্দ ‘আমি’-তে, যেখানে কোনো বর্ণনা নেই, নেই বিভাজন—
"আত্মা’বা আর্থান্ অনুপশ্যতি"—যেখানে আত্মা কেবল আত্মাকেই দেখে, আর কিছু নয়।

এই ‘আমি’ অনুভবেই প্রথম ধাপে প্রতিষ্ঠিত হও, কিন্তু এখানেই থেমো না—এই অনুভবকেও পেরিয়ে যাও; কেননা, সত্য তাতঃ পরঃ—“আমি”-রও অতীতে যে আছে, সেই চিরচেতন, নির্গুণ, নিঃশেষ তুমি।

‘আমি আছি’ বলার মুহূর্তেও জানতে হবে—সেই আমি কে? এই প্রশ্নই তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আত্মজিজ্ঞাসায়, যেখানে সত্তা নিজেই চৈতন্য, চৈতন্য নিজেই ব্রহ্ম।

১৫.

“আমি আছি”—এই অনুভব, এই চেতনা, এই জানাশোনা—সবই যা-কিছু তুমি অনুভব করো, তার সমষ্টিমাত্র। কিন্তু এই ‘আমি’ সময়বদ্ধ—সে জন্মে, সে বিকশিত হয়, সে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়; আর যা সময়বদ্ধ, তা তো অসত্য—উপনিষদ বলে, "যৎ পরিবর্তনীয়ং, তৎ অনৃতম্"—যা পরিবর্তিত হয়, তা মিথ্যা।

এই ‘আমি’ অনুভবই যেন তোমার জীবনের ঘটনাগুলোর একমাত্র সেতুবন্ধন, কিন্তু এই সেতু নিজেই স্বপ্নবৎ—"সর্বং হি এতম্ মায়াময়ম্"—যেমন স্বপ্নে জগত উদয় হয়, তেমনি এই ‘আমি’ও আকস্মিকভাবে উদিত।

একদিন, ঠিক যেমন হঠাৎ করে এলো, তেমনি হঠাৎ করেই মিলিয়ে যাবে এই ‘আমি’—এবং তুমি চেয়ে দেখবে, সে ছিল না, আর তুমি তাতে লিপ্তও ছিলে না—তুমি ছিলে তার সাক্ষী, দূরবর্তী—সংযুক্ত নয়।

“আমি” না থাকলে কিছু দেখা যায় না, কিছু অনুভব করা যায় না—সে চেতনার ভিত্তি। কিন্তু এই চেতনাও যদি আসত-যেত হয়, তবে সে কি তুমি? তুমি তো সেই, যিনি এই চেতনার ওঠানামা দেখতে পান, যার জন্য চেতনাও ঘটে।

উপনিষদ বলে, "দ্রষ্টা দ্রশ্যযোগে সত্তা নহি"—দ্রষ্টা ও দৃশ্য এক নয়। তুমি সেই দ্রষ্টা, যার চেতনার পটভূমিতে “আমি” উঠছে, নামছে, গলে যাচ্ছে নিজের ছায়ায়।

অতএব, তুমি ‘আমি’ নও। তুমি তার আগে—তুমি সেই অচিন্ত্য চৈতন্য, যা কেবল থাকে, কিন্তু নিজেকে বলে না, “আমি আছি”।

তুমি সেই—"একম্ এবাদ্বিতীয়ম্"—এক, অদ্বিতীয়, যার কোনও নাম নেই, যার কোনও ‘আমি’ নেই,
যার চেতনায়ই এই ‘আমি’-বোধ এসেছে ও গেছে, আর যে চেতনা কখনও যায় না।

‘আমি’ বলার মধ্যেও যে নীরবতা থাকে, সেই নীরবতাই তুমি। ‘আমি’ ভাবনার উঠা-পড়ার মাঝেও যে চুপ করে চেয়ে থাকে, সেই দর্শকই ব্রহ্ম। অতএব, “আমি” নয়, “আমি”-র পূর্ববর্তী চেতনাই তোমার স্বরূপ।
Content Protection by DMCA.com