৬.
"আমি আছি"—এই অনুভব চিরনবীন, চিরজাগরূক। এ এক অভ্রান্ত উপস্থিতি, যা যুক্তির ঊর্ধ্বে, যা নিজেই নিজের সাক্ষ্য।
জীবনের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি মোড়ে, তুমি তাকেই সঙ্গে পেয়েছ—পরিবর্তনহীন, নিঃশব্দ এক সঙ্গী। সম্পর্ক, চিন্তা, মানুষ, পরিস্থিতি, ধারণা—সব কিছুই এসেছে-গেছে, বদলেছে, রূপান্তরিত হয়েছে, কিন্তু “আমি আছি”—এই সত্তার অনুভব কখনও বদলায়নি, কখনও হারায়নি।
এ অভিজ্ঞতা যুক্তিনির্ভর নয়—এ অনুভব প্রত্যক্ষ, কারণ তুমি তা-ই। এবং, যখন এই "আমি আছি"-বোধও বিলীন হয়? তখন যা রয়ে যায়, তা হলো চূড়ান্ত সত্য—নির্বিকল্প, নিরাকার, সর্বভিত্তিক আত্মস্বরূপ।
এই “আমি আছি”-রও পরপারে আছে সেই পরম—যা বর্ণনার অতীত, অনুভবের সীমাহীনতায় উদ্ভাসিত। এখন ইঙ্গিতটি আর কুয়াশাময় নয়, এটি স্পষ্ট—“আমি আছি”-রও অতীত যে আছে, সে-ই একমাত্র পরম, যাকে বলা যায়—অদ্বিতীয় ব্রহ্ম।
৭.
সমস্ত মনোযোগ দাও এই “আমি আছি”-তে—যা কালাতীত, শব্দের ঊর্ধ্বে, অনির্বচনীয় উপস্থিতি। এই “আমি আছি”—সকল জীবের অভিন্ন আত্মবোধ, আবার ফিরে এসো এর কাছেই, বার বার, নীরবে।
স্মৃতির পথ বেয়ে ফিরে যাও সেই মুহূর্তে—যখন তুমি প্রথম অনুভব করলে যে “তুমি আছ”—কোনো ভাষা ছিল না, কোনো পরিচয় ছিল না, তুমি কি জানাতে—কে তুমি? কার সন্তান? কোথায় আছ?
এসব কিছু ছিল অনুপস্থিত, ছিল না কালের ধারা, ছিল না মানসিক গল্প—কিন্তু ছিল এক অনাদি উপলব্ধি—“আমি আছি”—স্থান ছিল, কিন্তু সময় ছিল না।
সেই কালহীন “আমি আছি” কোনো জাতি, ধর্ম, পরিচয় বা ভূগোল জানত না—শুধু জানত নিঃশব্দ, অনন্ত এক উপস্থিতি।
এ বোধ ব্যক্তিগত নয়, সর্বজনীন—প্রত্যেকের অন্তরে জাগ্রত এক শাশ্বত ধ্বনি। ফিরে এসো সেই শব্দহীন বোধে, যেখানে তুমি কোনো একক ব্যক্তি নও, বরং স্বয়ং আত্মার অনন্ত প্রতিধ্বনি।
৮.
“আমি আছি”—এই বোধটিকে আঁকড়ে ধরো, কিন্তু কেবল আঁকড়ে ধরার জন্য নয়—এর সীমারেখা টপকে যাবার জন্য; কেননা “আমি আছি”-রও পরপারে আছে প্রকৃত শান্তি, যেখানে নেই কোনো সত্তা, নেই কোনো পরিচয়—শুধু নিঃশেষ নিরুপাধি আনন্দ।
এই মুহূর্তে যা তোমার আছে—তা হলো এই “আমি আছি”-বোধ, এটিই একমাত্র সেতু, যার মাধ্যমে তুমি যেতে পারো পারাপারের সেই তটে—যেখানে “আমি”-ও নেই, “তুমি”-ও নেই—আছে শুধু এক নির্জন, অনন্ত সত্তা।
ভাবো তো, এই “আমি আছি” তোমাকে কী দিয়েছে? দেহের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সে বানিয়েছে তোমাকে “ব্যক্তি”— আর সেই ব্যক্তিত্ব এনেছে দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম, দুঃখ ও সীমাবদ্ধতা।
এখন ফিরে যাও উলটো পথে, “আমি আছি”-র কেন্দ্রে ফিরে এসো, তারপর তাকেও অতিক্রম করো—যেখানে নেই কোনো “আমি”, নেই কোনো “আমার”—সেখানে তুমি চিরশান্ত, চিরসুখী।
৯.
সমস্ত কিছু ছেড়ে দাও—সব জ্ঞান, সব চেতনা, সব অনুভব—শুধু এইটুকু আঁকড়ে ধরো—“আমি আছি”। “আমি আছি”-র মধ্যেই আছে সমস্ত সৃষ্টি ও প্রলয়ের রহস্য, যখন তা চলমান হয়, তখন সৃষ্টি হয় জগৎ; যখন তা নিস্তব্ধ হয়, তখন তা বিলীন হয়ে যায় পরমে।
তাকিয়ে দেখো, অনুভব করো এই “আমি আছি”-র আন্দোলন, কেমন করে এই আন্দোলনেই জন্ম নেয় দ্বৈততা, বিভ্রান্তি, দুঃখ, বাসনা, সময় ও আমি-বোধ। এই কল্পনাশক্তিই গড়ে তোলে “আমার” জগৎ—আর তাতেই শুরু হয় অশান্তি ও যন্ত্রণা।
এখন ফিরে এসো সেই কেন্দ্রে, যেখানে “আমি আছি”—শুধু “আমি আছি”-র মধ্যেই বিশ্রাম নেয়। যখন “আমি” আর নিজেকে অন্য কিছুর সঙ্গে যুক্ত করে না, তখন তা স্তব্ধ হয়ে যায়, বিলীন হয়ে যায় নিজ-উৎসে।
তখন আর কিছু থাকে না—থাকে না কোনো ব্যক্তিত্ব, কোনো ইতিহাস, কোনো খেলা। থাকে শুধু এক শুদ্ধ, নিরুপাধি চৈতন্য—সেই পরম, সেই অদ্বিতীয় সত্য।
১০.
“আমি আছি”—এই বোধ থেকে মুক্তিই প্রকৃত অমরত্ম, আর সেই মুক্তি লাভের একমাত্র পথ—এই “আমি আছি”-তেই অবস্থিত থাকা, তাকে গভীরভাবে দেখা, উপলব্ধি করা, ও অতিক্রম করা। শুনতে সরল, দেখতে সহজ, এমনকি আচারগতভাবে কাঁচা—তবু একেই বলে সাধনা, আর এই পথেই ঘটে মুক্তি।
জন্মের সময় “আমি আছি” বোধ সুপ্ত থাকে, ধীরে ধীরে, প্রায় তিন বছর বয়সে সে মাথা তোলে—তখনই গড়ে ওঠে দেহ-অভিজ্ঞতা, পরিচয়, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে একাত্মতা। এই “আমি আছি”-বোধই দেহের পঞ্চভূতের সারাংশ—যা গঠিত খাদ্যদেহে, যা সীমাবদ্ধ, ক্ষয়যোগ্য।
যতক্ষণ এই “আমি” দেহের সঙ্গে একাত্ম, ততক্ষণ মুক্তি অসম্ভব, মৃত্যু অনিবার্য; কেননা দেহের অন্তে “আমি” ভাবও বিলীন হয়, আর জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ঘুরে ফিরে চলে আত্মভ্রম।
কিন্তু যদি তুমি স্থিরভাবে এই “আমি আছি”-র দিকে তাকাও, তার গভীরতা বোঝো, তার মায়াজাল চিনে ফেলো, তাকে অতিক্রম করো—তবে তুমি স্পর্শ করতে পারো অমৃতত্ব, সে-ই চিরন্তন সত্তা, যা দেহেও নেই, মৃত্যুতেও নয়, কালেরও নয়।
হাজারো সাধনপথের মাঝেও এই একমাত্র সরল পথ—“আমি আছি”-র সান্নিধ্যে থাকা, তাতে স্থিত হওয়া, এবং শেষে সেই সত্তাকেও পিছনে ফেলে থাকা—যেখানে ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছু নেই।