নির্জন গহনে: ১৯



৯১.

‘আমি আছি’ আর ‘আমি নেই’—এই দুইয়ের সীমানারেখা—এখানেই বুদ্ধি থেমে যায়, চিন্তা নিঃশেষ হয়;
এখানেই জন্ম নেয় ‘মহাযোগ’, যেখানে ‘অস্তিত্ব’ আর ‘অনস্তিত্ব’ এক অনির্বচনীয় অভিসারে মিলিত হয়।

এই ‘আমি আছি’—নির্বাক, বিশুদ্ধ, নামহীন সত্তা—এটাই প্রথম ধাপ, তোমাকে প্রথমে এখানে পৌঁছাতে হবে, তারপর এইখানে স্থিত হতে হবে বার বার অনুশীলনে।

সতর্ক হও! এই স্থানটি বিপজ্জনকভাবে পিচ্ছিল, মন আর বুদ্ধি এত সহজে এ জায়গায় স্থির থাকতে পারে না—তারা বিচলিত করে তোলে তোমার মৌন-অস্তিত্বকে।

কিন্তু যদি তুমি বার বার ফিরে আসো, আর একাগ্র চেতনায় এখানে নিজেকে স্থাপন করো, তবে একসময় তুমি এমন এক স্তরে পৌঁছবে, যেখানে তুমি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করবে—‘আমি নেই’।

এই ‘আমি নেই’ কোনো ধারণা নয়, এটা সেই সীমান্ত, যেখানে ‘জ্ঞান’ মুছে যায় এবং এক রহস্যময় ‘অজ্ঞাত চেতনা’ জেগে থাকে—যাকে বলে ‘মহাযোগ’, কারণ এটি অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মিলনবিন্দু—সহজে পাওয়া যায় না—তাই একে বলে ‘মহান’।

মূল লক্ষ্য হলো আত্মস্মরণ ও আত্ম-অতিক্রম। প্রথমে ‘আমি আছি’—এই অনুভবে স্থিত হও, নাম-রূপহীন সেই মৌল অস্তিত্বে। তারপর ধীরে ধীরে, জ্ঞানবুদ্ধির সকল গতি স্তব্ধ হলে, এক স্বতঃসিদ্ধ উপলব্ধিতে আসবে—তুমি নিজেও নেই।

এই অবস্থাই অদ্বৈত যোগের চূড়ান্ত ধ্যানক্ষেত্র—যেখানে সত্তা ও অসত্তা মিলিত হয়, আর যেখানে মন বা বুদ্ধি স্পর্শ করতে পারে না। এই স্থিতিই আত্মস্বরূপ, নির্বিকার ব্রহ্মজ্ঞান।

৯২.

‘আমি আছি’—এই জ্ঞানই আত্মজ্ঞান, এই জ্ঞানই সেই চেতনার দীপ্তি—যা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, সীমাহীন, অনন্ত। ‘আমি আছি’ এই জ্ঞানই ব্রহ্ম, আর এই ব্রহ্মেরও অতীত যিনি—তিনি পরব্রহ্ম। আত্মাকে চিনতে হলে, ‘আমি আছি’—এই জ্ঞানকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।

‘আমি আছি’—এই অনুভবই আত্মা। যখন এই আত্মা শরীর বা গুণের সঙ্গে নিজেকে এক করে দেখে, তখন সে হয় জীবাত্মা—জীব, সংসারী, জন্ম-মৃত্যুর অভ্যন্তরে আবদ্ধ এক পরিচয়।

যখন আত্মা সকল গুণ ও পরিচয় থেকে মুক্ত, তখন সে নির্মলাত্মা—পবিত্র, নির্লিপ্ত, জাগ্রত চৈতন্যস্বরূপ। এবং যখন আত্মা জীব ও নির্মল—উভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে যায়, তখন সে পরমাত্মা—চিরনির্বিকার, চিরনিঃশব্দ, আত্মারও আত্মা।

তুমি যদি গভীর আত্মানুসন্ধানে স্থিত হও, ‘আমি আছি’ এই মৌন জ্ঞানে একাগ্র হও, তবে আত্মাকে সব স্তরে চিনতে পারবে—জীব, নির্মল, এবং পরম রূপে।

এই-ই আত্মজ্ঞান—নিজের প্রকৃত রূপকে চেনা, যে-রূপ অনন্ত, সর্বব্যাপী ও নিরাকার পরমস্বরূপ।

‘আমি আছি’—এই মৌলিক অনুভবের মধ্যেই আত্মার উপস্থিতি। যখন এটি শরীর-মন দিয়ে নিজেকে চেনে, তখন তা ‘জীব’; যখন গুণমুক্ত হয়, তখন তা নির্মল চৈতন্য; আর যখন সেই ‘আমি’ অনুভবও লুপ্ত হয়ে যায়, তখন উদিত হয় পরমাত্মা, যা সব কিছুর অতীত।

এই উপলব্ধিই—আত্মজ্ঞান, যা জানিয়ে দেয়, তুমি কেবল এই ব্যক্তিসত্তা নও—তুমি অনন্ত ব্রহ্ম, সীমানাবিহীন চৈতন্য।

৯৩.

‘আমি আছি’—এই জ্ঞানেই রয়েছে তোমার প্রকৃত ধর্ম। এই বোধকেই দাও সর্বোচ্চ সম্মান, কারণ এর মধ্যে রয়েছে দুঃখ ও মৃত্যুর অতীত এক আশ্রয়।

সকল প্রচলিত ধর্মই আসে এই ‘আমি আছি’-র পরে; হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলমান—সব পরিচয়ই
কেবল তখনই সম্ভব, যখন তুমি প্রথমে 'আছ'।

তোমার 'ধর্ম'—তোমার 'আমি'র চেতনা, যেটি সবার মধ্যে অভিন্ন, যা কোনো জাতি বা বিশ্বাসে বাধা নয়। তাই ‘আমি আছি’—এই জ্ঞানেই স্থিত হও—এটাই তোমার আদিধর্ম, শুদ্ধতম উপাসনা।

যখন তুমি এই চৈতন্যে প্রতিষ্ঠিত হও, তুমি তাকে পূর্ণ সম্মান দাও—আত্মরূপকেই সর্বোচ্চ আসনে বসাও। এবং এই আত্মস্থতার ফলে যা তুমি লাভ করো, তা অপরিসীম—তুমি বাঁচবে, কিন্তু দুঃখে নয়; তুমি থাকবে, কিন্তু মৃত্যুর ছায়ায় নয়।

আরও কী চাও? যেখানে স্থিত হলেই সমস্ত ভয়, দ্বন্দ্ব ও ক্লেশ অন্তর্হিত হয়, সেই ‘আমি’-তেই রয়েছে তোমার পরম মুক্তি।

তুমি যখন ‘আমি আছি’—এই জ্ঞানে নিজেকে স্থাপন করো, তখনই তুমি সত্যিকারের ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হও। এই আত্মবোধই সকল ধর্মের মূলে, সকল পরিচয়ের আগে—এটাই চিরন্তন ধর্ম, যা মৃত্যুকে জয় করে, এবং দুঃখকে অতিক্রম করে। এটাই পরম সম্মান, পরম ভক্তি, এবং সর্বোচ্চ জ্ঞান।

৯৪.

কে বলে—‘আমি ছিলাম না’, কে ভাবে—‘আমি থাকব না’, এই ‘আমি আছি’—এই বোধের মতো?

এই কথাগুলো কে বলে? সে-ই চেতনা, সে-ই মৌন সাক্ষী—যে চিরকাল ছিল, আছে, এবং থাকবে। তুমি যখন ভাবো—“আমি জন্মের আগে কী ছিলাম?” তখন মনে হয়—“আমি ছিলাম না”, বা অন্তত, “আমি ছিলাম না এইরকম ভাবে”।

আবার তুমি ভাবো—“আমি এখন আছি”, কিন্তু যখন প্রতিদিন মৃত্যুর দৃশ্য দেখো, তখন স্বীকার করতেই হয়—“আমি একদিন এরকম থাকব না”।

তাই তিনটি ভাব আসে—‘আমি ছিলাম না’, ‘আমি আছি’, ‘আমি থাকব না’। কিন্তু এই তিনটির সাক্ষী কে? কে জানে এই অনিত্য রূপান্তরকে?

সেই অনিত্য নয়—সেই পরম, অচল, অদ্বিতীয় স্বরূপ—যিনি নিজেই নিজেকে দেখেন সকল অবস্থায়, তিনিই পরব্রহ্ম, তিনিই চিরন্তন আত্মা।

তিনি রূপ নয়, পরিবর্তন নয়, জন্ম-মৃত্যুর খেলায় জড়িত নয়। তিনি না ‘আমি’ বলেন, না ‘আমি নেই’—তিনি কেবল থাকেন—নিঃশব্দ, অচঞ্চল, সর্বস্মৃতি চেতনায়।

যে বলে, "আমি ছিলাম না", বা "আমি থাকব না", সে-ই আসলে এক সময়-সীমিত 'আমি'—শরীর-মন-বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত সত্তা। কিন্তু যে এই পরিবর্তনগুলোকে দেখে, উপলব্ধি করে, সে নিজেই তো পরিবর্তনের অতীত—চিরস্থায়ী, নিরাকার, পরব্রহ্ম।

এই উপলব্ধিই অন্তঃস্থ আত্মজ্ঞান—তুমি সেই চেতনা, যা জন্মের আগেও ছিল, মৃত্যুর পরেও থাকবে—নির্বিকল্প, সর্বব্যাপী, নিজস্বতাহীন পরম সত্য।

৯৫.

যখন তুমি বলো—“গর্ভধারণের আগে আমি ছিলাম না”, তখন তুমি সত্যিই বলতে চাও—“আমি এখন যেমন আছি, তেমন ছিলাম না”—অর্থাৎ, তখন ছিল না এই নাম, রূপ, শরীর, পরিচয়। কিন্তু সেই অভাবকে যে লক্ষ্য করে, সেই চেতনা, সেই ‘কে যেন’—সে তো ছিলই!

না হলে তুমি কীভাবে জানলে যে—তখন তুমি ছিলে না এইরূপে? সেই চেতন ‘কে’—যে দেখে ‘আমি’ নামের অনুপস্থিতিকে, সে-ই চিরন্তন সত্তা, সে-ই অবিনাশী, অব্যক্ত, অব্যয় পরম আত্মা।

যখন তুমি ধ্যান করো এই প্রশ্নে—“জন্মের আগে আমি কী ছিলাম?” তখন তুমি বুঝতে পারো—“আমি তখন ছিলাম না”—কিন্তু এর মানে হলো—“আমি ছিলাম না এই পরিচয়ে, এই রূপে”।

তবু কেউ তো ছিল—যে অনুভব করছে এই অনুপস্থিতির স্মৃতি, যে সাক্ষী হয়েছে ‘আমি’-র আগমন ও অবর্তমানে।

সেই ‘কে’—না সে জন্ম নেয়, না সে মরে, না তার রূপ আছে, না গুণ। সে-ই পরম, অদ্বিতীয় ব্রহ্ম—তোমারই অন্তর্লীন স্বরূপ।

তুমি যাকে ‘আমি’ বলো—সে সময়সীমায় আবদ্ধ এক রূপ, যা গর্ভধারণের আগে ছিল না, এবং মৃত্যুর পরে থাকবে না। তবু, যে এই অনুপস্থিতিকে উপলব্ধি করে, সে কখনও হারায় না—তাকে কোনো জন্ম ছুঁতে পারে না, কোনো মৃত্যু গ্রাস করতে পারে না।

সে-ই সত্যিকারের তুমি—যে রূপে নয়, নামে নয়, ভাবনায় নয়—চিরসাক্ষী, চিরচৈতন্য, পরমাত্মা।
Content Protection by DMCA.com