নির্জন গহনে: ১




১.

‘আমি আছি’—এ-ই প্রথম উদয়, এ-ই চিরস্থায়ী, সদাউপস্থিত।

সমস্ত চিন্তাকে ত্যাগ করো, কেবল এই 'আমি আছি'-ভাবেই স্থিত হও।

তুমি কি সচেতন আছ যে তুমি আছ?

এই 'আমি থাকা' বা 'আমি আছি', এই অনুভবটি তোমার অস্তিত্বের মূলে—এর উপরই সমস্ত জ্ঞানের ভিত্তি রচিত।

কিছুই তো হতো না যদি তুমি না থাকতে। প্রথমত, তোমার 'থাকার' বোধই সমস্ত কিছুর পূর্বশর্ত। তুমি না থাকলে অভিজ্ঞতার কোনো অর্থ নেই।

দ্বিতীয়ত, জীবনের সমস্ত অনুভব শুরু হবার আগেই—কে আগে এসেছিল? এই ‘আমি আছি’ বোধটিই তো সব কিছুর প্রথম জাগরণ; সেই সূচনার মুহূর্তে ফিরে যাও, যখন প্রথম অনুভব হয়েছিল—'আমি আছি'—পূর্ণ হতে চাইলে শূন্য হ‌ও।

এই বোধ এখনও আছে—চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়, সদালভ্য। এটি কখনও চলে যায়নি। এ-ই মূল চিন্তা। বাকি সব ভেসে-আসা ছায়া মাত্র। তাই সমস্ত চিত্তবিকার হটিয়ে ফিরে এসো এই 'আমি আছি' বোধে—সেখানেই স্থিত হও।

‘আমি আছি’—এই অস্তিত্ববোধকে গভীরভাবে উপলব্ধি করো। যত স্পষ্ট হবে এই অনুধ্যান, তত দ্রুত ঘটবে তোমার মুক্তি। এই ভাবটি মূলত ঋষি-মুনি বা আত্মজ্ঞ যোগীর বাণীর অনুরণন—‘আমি’ ভাবটি বর্জন করে কেবল আত্মার স্বরূপে স্থিত হও।

২.

কেবল নিজেকে স্থাপন করো ‘আমি আছি’-র অনুভবে, আর অবিচল থেকো সেখানে। যা-কিছু এই ‘আমি আছি’-র সঙ্গে মেলে না, তা অকপটে পরিত্যাগ করো।

যতভাবে পারো, ‘আমি আছি’-কে চিনে নাও—তারপর শুধু থাকো সেই চেতনায়।

নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো ‘অস্তিত্বের অনুভব’-এ, আর কোথাও সরে যেয়ো না।

যখনই তুমি অন্য কিছু ভাবতে শুরু করো, জানবে—‘আমি আছি’-র উপর কিছু যোগ হয়েছে—যা তার মৌলিকতা নষ্ট করেছে, তাকে মিথ্যা করেছে।

যে-কোনো অনুভব ‘আমি আছি’-র সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু জুড়ে দেয়—যেমন ‘আমি দুঃখিত’, ‘আমি জ্ঞানী’, ‘আমি কিছু’—সবই বিকৃতি।

‘আমি আছি’ + কিছু = অপবিত্রতা। এগুলো চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে। তাই প্রত্যাখ্যান করো সমস্ত ‘আমি সহ’-ভাব—কেবল ‘আমি আছি’-তে স্থিত থেকো। কারণ বাকি সবই প্রপঞ্চ, অবাস্তব সংযোজন, এবং আত্মাকে আচ্ছন্ন করে মিথ্যাত্বে।

“আমি আছি”—এটি এক প্রাথমিক বোধ, কিন্তু তাতেই নিহিত রয়েছে চরম মোক্ষের বীজ। এ বোধ যখন নির্জন, নির্জলা, নির্ভরশূন্য হয়—তখনই তা ভেদ করে অদ্বৈত চৈতন্যের দ্বার।

৩.

‘আমি’-র মূল থেকে খুলে ফেলো সব বিশেষণ, সব তকমা। ‘আমি এই’, ‘আমি সেই’, ‘আমি অমুক’—এ সবই চাপানো আবরণ। এগুলো ব্যক্তিত্বের পোশাক, আত্মার নয়—সমাজের হাতে-গড়া পরিচয়ের খাঁচা, যা বন্দি রাখে তোমার অসীমতা।

অনবরত, ধৈর্যের সঙ্গে করো এক মৌন সাধনা—আলাদা করো ‘আমি’-কে ‘এই’ বা ‘সেই’-এর ভ্রান্ত মিথ্যা থেকে। শুধুই অনুভব করো—‘আমি আছি’। এইটুকুই যথেষ্ট।

মনে রেখো, এটি কোনো মুখের কথা নয়, এটি এক কঠিন যোগ। কেবল চিন্তার স্তরে নয়, অস্তিত্বের প্রতিটি স্তরে গড়িয়ে দিতে হবে এই উপলব্ধি। কারণ যা তুমি নও, তা তুমি হয়ে গেছ শুধুই অভ্যাসে।

চিরন্তনের পথে এই অভ্যাসই সবচেয়ে বড় বাধা। তাই, সরিয়ে দাও সব অভিধা, সব লেবেল, সব চিন্তার আবরণ। রেখো না কিছুই, কেবল তোমার নিঃশব্দ উপস্থিতি—‘আমি’—যার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, যা শুধু আছে—আলোয়, মৌনে, অস্তিত্বে।

৪.

‘আমি আছি’—একমাত্র এই বোধই নিঃসংশয়। এ নিঃসত্ত্ব, নির্লিপ্ত, নির্ব্যক্তিগত। সমস্ত জ্ঞানের উৎস, মূল, কেন্দ্রবিন্দু এই ‘আমি’—এই মৌন উপস্থিতি। একে আঁকড়ে ধরো, বাকিটা সব স্বপ্নের মতো হারিয়ে যাক।

যেদিন প্রথম অনুভব করেছিলে—‘আমি আছি’, সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত—এই অনুভব অপরিবর্তিত। ভাষা তখন ছিল না, চিন্তা ছিল না—তবুও তুমি ছিলে। সেই মৌন, শব্দহীন অনুভবেই নিহিত তোমার সত্য।

পরে এল নাম, পরিচয়, ভাষা, সমাজ—এসব ছিল ‘আমি’-র উপরি আবরণ। এসেছিল, আবার চলে গিয়েছে—চলে যাবে। কিন্তু ‘আমি আছি’—এই মৌলিক উপলব্ধি একচুলও বদলায়নি। এ-ই একমাত্র স্থায়ী, চিরন্তন, অবিনাশী সত্তা।

এই ‘আমি’ কার‌ও ব্যক্তিগত নয়—এটি সবার মধ্যে সমভাবে জাগ্রত। এটি পূর্ব-ভাষিক, পূর্ব-চিন্তন—এ এমন এক মৌল অনুভব, যা জাগার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকাশিত হয়। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বোধ থেকে জন্ম নেয় সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত বুদ্ধি, সমস্ত অভিজ্ঞতা। সুতরাং, যদি তুমি সত্য চাও—এই ‘আমি’-কেই ধারণ করো। সব কৃত্রিম ধারণা, সব পরিচয়, সব জানার অহংকার—ধীরে ধীরে বিসর্জন দাও।

শুধু রয়ে যাও—এই জাগ্রত নিঃশব্দ উপস্থিতিতে, যেখানে তুমি শুধু ‘আছ’। তুমি আর কিছু নও, আর কিছু হতে চাও না।

৫.

"আমি আছি"—এই অনুভবটিই একমাত্র নিশ্চিত জ্ঞান, এইটিই সর্বসত্তার মূল। এই "আমি" জ্ঞানেই নিহিত রয়েছে সমগ্র অস্তিত্ব, কারণ "আমি" না থাকলে আর কিছুই নেই।

যখন তুমি অনুভব করো—“আমি আছি”, তখনই সমস্ত বিশ্ব জাগে। তার পূর্বে কিছুই নেই, কারণ সেই "আমি"-এর বোধই সকল উপলব্ধির আধার।

এই "আমি-ভাব" একটাই—সে সবার মধ্যে অভিন্ন, সর্বত্র বিরাজমান; তা-ই তো একমাত্র সর্বসত্তা, যা ভেদহীন, নিঃশর্ত, নির্ভরযোগ্য।

বাহ্যিক সব ধারণা, পরিচয়, বোঝা, মনস্তাপ—সব ছুঁড়ে ফেলে ফিরে এসো এই নিখাদ "অস্মিতা"-র আশ্রয়ে। এটাই মনে প্রশান্তি এনে দেয়, চিন্তার রোগ সারিয়ে তোলে।

মনই ব্যাধির কেন্দ্র, আর "আমি"—তার ঔষধ। "আমি"-এর উপরে চাপানো সমস্ত পরিচয়, স্মৃতি ও আকাঙ্ক্ষা আসলে এক মানসিক রুগ্নতা। কিন্তু এর মধ্যেও একটি গূঢ় ইঙ্গিত আছে—এই নিখাদ "আমি-আছি"-এরও এক অতীত কিছু আছে—যেন এই "আমি" অনুভবটিও এক সত্তার দ্বারপ্রান্ত—তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে আরও এক নিঃশব্দ, অদ্বিতীয় সত্তা, যা বুদ্ধির অতীত।

"আমি আছি"—এই জাগতিক অনুভবও মিথ্যা নয়, তবে আংশিক। তা মূল সত্তার প্রতিচ্ছবি মাত্র। যতক্ষণ না "আমি"-কে আলিঙ্গন করে তার পারাবার পেরোও, ততক্ষণ মুক্তি অসম্ভব। সেই 'পারাবার'—যেখানে "আমি" শব্দটিও মুছে যায়, আর বাকি থাকে কেবল নির্মল, নিরাকার, নিরব, অস্পর্শযোগ্য সত্যস্বরূপ।
Content Protection by DMCA.com