আহ্! ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! একটা জন্তু আমার ঊরুর মাঝের স্থানটিতে বসে মাংসপিণ্ডটা খুব ধীরে ধীরে ছিঁড়ে খাচ্ছে৷ কী ভয়ংকর! এই দৃশ্য নিজের চোখে দেখাটাও বিশ্রী রকমের অসুস্থ মানসিকতায় পৌঁছে দেবে আপনাকে। আমার গা শিউরে উঠল!
ডানহাতটাও এখন অসাড় হয়ে এসেছে। কোনোমতেই কাজ করছে না। আশ্চর্যজনকভাবে, সেই সুঘ্রাণটা বেশ অনেকক্ষণ হয়েছে পাচ্ছি না; বরং পচা একটুকরো মাংসের দুর্গন্ধ ঘরভর্তি ছড়িয়ে আছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আহ্ ঈশ্বর, আমাকে ওঠার শক্তি দাও!
চাঁদের আলোখানি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল…সেই ধীর গতির গোঙানির আওয়াজটা হঠাৎ জোরে জোরে ভাসছে—যত বার আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলছি, ঠিক তত বার আওয়াজটা আরও প্রকট হতে থাকল!
দুটো হাত সম্পূর্ণভাবে অকেজো মনে হলেও, এবার পায়ের দিকটায় কিছুটা বল এসেছে, এমনটা অনুভূত হতে থাকল। প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে…উঠে দাঁড়ালাম। কী করে উঠে দাঁড়িয়েছি জানি না! তবে, মনে হচ্ছিল, উঠে দাঁড়ানো হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তৎক্ষণাৎ শরীরে চাদরটা প্যাঁচ লাগিয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়ালাম।
আমি কি সত্যিই ঠিক আছি? এতক্ষণ যা হয়েছে, তার সবই কি একটি অযাচিত অনুভূতি? না কি সত্যিই এসব ঘটেছে?
সে যা-ই হোক, এসব নিয়ে পরে গবেষণা করা যাবে। আগে ঠিকঠাক দাঁড়াতে হবে। আর ওই বিশ্রী জন্তুটিই-বা কোথায়? ওটিকে এক্ষুনি মেরে ফেলতে হবে।
পুরোপুরিভাবে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে; খানিকটা অস্বস্তি আর থেকে থেকে পায়ের গোড়ালিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।
মেঝেতে তাকিয়ে দেখি…ঘন গাঢ় রক্তে মেঝের একপাশ ভেজা—যা আমারই শরীর থেকে গড়িয়ে পড়ছে ক্রমাগত। কিন্তু, কোথা থেকে গড়িয়ে পড়ছে এই রক্ত, আমি বুঝতে পারছি না। মাথার পেছনের অংশে হাত দিতেই, আমার আর বুঝতে বাকি রইল না—এই রক্তের সূত্রপাত কোথা থেকে!
রক্ত গড়াতে থাকলেও, আমার কোনো প্রকারের যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে না—আমি খোঁড়াতে খোঁড়াতে খুব ধীরেসুস্থে সুবিধাজনক একটা স্থানে এসে বসলাম।
ওখানে কতখানি ক্ষত হয়েছে বা আদৌ কী হয়েছে, তা দেখার পরিস্থিতিতে আমি নেই। ড্রয়ার খুলে প্রথমে ব্যান্ডেজটা হাতে নিয়ে, খুব শক্ত করে অর্থাৎ ওই মুহূর্তে যতটুকু জোর আমার শরীরে ছিল, তা দিয়েই মাথার পেছনপাশ-সহ এঁটেসেঁটে ব্যান্ডেজটা বেঁধে ফেললাম।
ভীষণ দমবন্ধ লাগছে। অনেক দিন পর সেলফোনটা হাতে নিলাম! দেখি, হাজারটা ফোনকল আর মেসেজ এসে পড়ে আছে। এত এত মেসেজের ভিড়েও আমার চোখ একটা মেসেজে গিয়ে আটকে গেল। অচেনা একটা নম্বর!
কেউ একজন লিখেছে—”সুপর্ণা! তুই কোথায়? তুই যেখানেই থাকিস, আমার সাথে যোগাযোগ কর।” শেষে ছোট্ট করে একটা ঠিকানা দেওয়া। এই কথাটি আমাকে বেশ অনেকক্ষণ ভাবাল। আমাকে সচরাচর কেউই ‘তুই’ ডাকে না। ‘তুই’ সম্বোধনে এতটা অধিকারবোধ নিয়ে কেবল একজনই আমায় ডাকত…
বুকের ভেতরটা যেন আচমকা হাওয়ায় শীতল হয়ে আসছে! মুচকি হেসে ফোনের সিমটা খুলে দরজার দিকে ছুড়ে ফেললাম।
সেদিন দুপুরে সেই কুৎসিত কুকুরটা ময়লার গাদা থেকে বেরিয়ে আমারই পিছু নিয়েছিল, বিষয়টা আমি এড়িয়ে গিয়েছিলাম।
পায়ের কাছে যে-ক্ষতটা হয়েছে, তা বেশ গভীর। মাঝেমধ্যেই ওখান থেকে পচা এক গন্ধ আসে, যদিও মাথার পেছনের অংশটা ঠিকই সেরে উঠেছিল।
এখন আমার আর বুঝতে বাকি রইল না—পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে জন্তুটা আসলে সেই পচা গন্ধটাকেই উপভোগ করছে। আমি সাবধানে পা ছাড়িয়ে সামনে এগোতে থাকলাম।
ভোরের আলো অনেকটাই স্পষ্ট; দেখা যাচ্ছে, কুকুরটা আমার পেছন পেছন ঘরে ফিরছে—আমার সাথেই, আমারই ঘরে। নোংরা হলেও, ওর মুখটা ভীষণ মায়াময়! আমিও অবচেতনভাবেই চাইছিলাম, ও আমার পিছু নিতে থাকুক।
আমার কেন জানি না ভীষণ কান্না পাচ্ছে। গলা চেপে ধরে ছুটে আসছে যন্ত্রণার আকুতি। আমি জানি, রোজ রাতে এই মায়াবী মুখের নোংরা জন্তুটি আমার ভীষণ কাছাকাছি অবস্থান করে—আমি এতে ভয় পাই না, বরং স্বস্তি পাই।
(সব শেষ)