কখনো মুখ ফুটে চেয়ে, কখনো গল্পে-কবিতায় কিংবা কোনো লেখার মাঝপথে বা সমাপ্তিরেখায় কতবার আমায় চেয়ে চেয়ে একটা সময় নিশ্চুপ হয়ে যাও। তখন কি বুঝতে চেষ্টা করো, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার ধরনটা আসলে কী?
তোমায় যে ভালোবাসি, সে তুমি জানো; এখানে তোমার প্রশ্নের অবকাশ নেই, এ-ও তুমি জানো। কিন্তু তুমি বুঝতে পারো না, এই ভালোবাসা, ভালোবাসার ঠিক কোন পর্যায়ে পড়ে! কেন এখনও আমি তোমার স্পর্শাতীত দূরত্বের একজন! তোমার গলার খাঁজে আমার মুখটা কেন এখনও বাঁধা পড়ল না?
শব্দের দূরত্ব ঘুচল না, আমার স্বর আজও তোমার শ্রবণসীমার বাইরেই রয়ে গেল; অথচ তুমি আমায় 'বাবুই' বলে ডাকতে! ভোরের আলোয় আমি কেমন, বিকেলের ছায়ায় তুমি কেমন, সন্ধের মিয়ানো দীপে আমি, রাতের ঘনত্বে তুমি... একটা গোটাদিনে, দৃষ্টির সীমান্তে মুখোমুখি তুমি আমি মিলে আমরা কেমন, দু-জনের কখনও দেখা হলো না! এই অপেক্ষার শেষ লাইনে দাঁড়ি কখন পড়বে, কেউ জানি না!
এই প্রশ্নগুলো, এই ভাবনাগুলো, তোমায় কি খুব ভাবায়? তুমি কি খুব রাগ করো? অভিমান হয়? মনে কি হয়, এতগুলো বছর কেটে গেল…আর কত?
মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে হয় খুউব, সময় নিয়ে আরও একটু ভাবি…যদিও বেশিরভাগই ইচ্ছে হয়, না ভাবি আর। কত জায়গায় পড়েছি, মানুষ নাকি কল্পনায় সবচাইতে সুখী! কল্পনায় যতদূর ইচ্ছে যাওয়া যায়, যতটা ইচ্ছে বাড়াবাড়ি করা যায়—সেখানে অসম্ভব বলে কিছু নেই।
আমি কল্পনা করতে জানি না। তোমায় নিয়ে আমি কখনও কল্পনায় মেতে উঠিনি। এর কারণ, কল্পনা এবং তার অসীম জগত, দুই-ই আমার কাছে মিথ্যে, অস্তিত্বহীন। কিন্তু তুমি! তুমি তো আমার একমাত্র সত্য! একমাত্র অস্তিত্ব! তোমায় আমি কোনো মিথ্যে জগতে নিয়ে যেতে চাই না। তোমার প্রতি আমার সমস্ত অনুভূতি আমি সত্যমতেই অনুভব করতে চাই। জোর করে কোনো অনুভূতি আমি তোমার এবং নিজের উপর বসাতে চাই না—এ যে আমি করতেই শিখিনি! তোমার এবং নিজের প্রতি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত অপরাধবোধের নোটিশ আমি ঝুলিয়ে দিতে চাই না। তুমি আমার সবচাইতে ভালো বন্ধু। আর তোমায় ভাবতে, তোমায় পড়তেই আমি ভালোবাসি—কল্পনা…সে দূরেই থাকুক।
আমি ব্যক্তি হিসেবে ভীষণ স্বার্থপর এবং এটা সত্য। আমি কখনও নিজের জীবনে, নিজের একান্ত সময়ে অংশীদারিত্ব পছন্দ করতাম না। অথচ, আমি তোমায় আমার একজন আপন মানুষ, বন্ধু এবং সবসময়ের অংশীদার ভাবতে ভালোবাসি। এই অংশীদারিত্ব তোমার অজানা, অপ্রকাশিত! এই অংশীদারিত্বে তুমি আর আমি পাশাপাশি দুই আত্মা।
ভাবছ, এই অংশীদারিত্ব তবে কেমন? এটা অংশীদারিত্ব, দখলদারিত্ব নয় গো…যে, নিজের উপস্থিতি বোঝাতে ক্ষণে ক্ষণে প্রকাশ্যে আসবে। আমরা শুধুই ভাগ করে নিতে শিখেছি, হস্তক্ষেপ করতে নয়। পৃথিবীর মানুষ এই চারের মাঝে গুলিয়ে ফেলে, তাই তো ভালোবাসার নাম একটা সময় 'যন্ত্রণা' হয়ে যায়। প্রেমে পড়ার অনুভূতি অনন্য, কিন্তু এভাবে ভালোবাসতে পারার অনুভূতি স্বর্গীয়।
তোমায় নিয়ে আমি বিন্দুমাত্রও কট্টর নই, এটা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় বিষয়। বরং গতানুগতিক প্রেমিকার মতো ভাবতে গেলে, নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়ি! এত বোকা, অর্থহীন, এত হাস্যকর বিষয়গুলো নিয়ে সময়ের এত অপচয় করেও, কীভাবে কেউ ভাবতে পারে, আমার বুদ্ধিতে কুলোয় না! তুমি হাজারবার প্রেমে পড়ো। না পড়লেই বরং মনে হয়, ছেলেটা দেখছি বাঁধাকপি খাওয়া শুরু করেছে!
অ্যাই, পড়ার সময় তুমি যে হাসছ আমি দেখছি! আর লেখার সময়, আমি যে হেসেছি, এটা কাউকে বোলো না, কেমন?
জানো, তোমার কাছে সত্য বলতে আমি কখনও দ্বিধান্বিত হইনি। ওই সত্য, যা কোনো-না-কোনো সময় তোমাকে বলতে হবে, তেমন সত্য আমার পাঠে জমানো নেই। অথবা তুমি যদি জেনে যাও এবং সেটা আমার ভয়ের কারণ, এইরকম একটা ভয়ংকর অনুভূতি, তুমি আমাকে কখনোই দাওনি; আমি তোমার কাছে তাই একটা খোলা বই। তুমিও আমার কাছে সেই খোলা বই, যে বইয়ের সরলতম লাইন এবং জটিলতম লাইন, উদ্ভাসিত এবং ঝাপসানো প্রত্যেকটা অংশ পড়তে আমি ভালোবাসি। যে বই খুলতে আমাদের কারুরই একে অপরকে প্রবঞ্চনা করতে হয়নি; বিশ্বাস করাতে হয়নি কাউকেই…"খোলা বইয়ে কোথাও দাগ কাটব না, একবার খুলেই দেখো!"
আত্মার প্রতি আত্মার ভালোবাসাটা আমাদের কয়েক জনম আগ থেকে বোধ হয় জন্মেই ছিল! একে অপরকে মিথ্যে বলা, প্রবঞ্চনা দেওয়া, এসব আমাদের কাছে গুরুত্বহীন, অপ্রয়োজনীয়।
এই মুহূর্তের আগ অবধি, আমি কখনও উপরে তোমায় লেখা কথাগুলো, ভাববার উপযোগীও মনে করিনি। এর কারণ, আমরা দু-জনেই সরল এবং ভেতর থেকেই মুক্ত মানুষ। সম্পর্কের ওসব জঞ্জাল আমাদের ভাববার জন্য বড্ড অনুপযোগী, হাস্যকর এবং অর্থহীন সময় অপচয় বই আর কিছু নয়।
তোমাকে-না আমি চিনতে চাইনি কখনও, বরং তোমাকে আবিষ্কার করতে চেয়েছি এবং করেছি। তাই তোমার প্রতি, তোমার কথা ও কাজের প্রতি আমার সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোলাগার প্রতিদিনই পুনর্জন্ম হয়। তোমার প্রতি আমার দৃষ্টি শুধুই যে ভালোবাসার, তা নয়—স্নেহের, মায়ার, মুগ্ধতারও বটে। এই যে আমি এত বলছি, এত বলছি…এ কেবল তুমি মুখোমুখি বসে নেই বলেই। আমার দৃষ্টি তোমায় তার সীমানায় পেলে, নির্বাক হয়ে দেখবে, অন্তর দিয়ে ছোঁবে—ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া, এসব অনুভূতির এভাবেই শব্দহীন প্রকাশ ঘটবে।
আচ্ছা, সেই শব্দহীন আমায়, তোমার ভালো লাগবে?