দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ২০



দ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে ঈশ্বর ও জীব আলাদা সত্তা। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপী, আর জীব তাঁর অধীন। তাই ভক্তের ডাকে ঈশ্বরের “সাড়া দেওয়া” এখানে একতরফা দয়া নয়; এটি ভক্তির প্রতিদান। জীব যখন অহং ত্যাগ করে, নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের হাতে সঁপে দেয়—তখন আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ঈশ্বরের করুণা প্রবাহিত হয়। এই দৃষ্টিতে আহ্বান মানে আত্মবিলোপ, আর সাড়া মানে ঈশ্বরের আশ্রয়ে শান্তি।

বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত এক ধাপ এগিয়ে বলে—ঈশ্বর দূরে নন, তিনি জীবের অন্তরে অন্তর্যামী রূপে উপস্থিত। ভক্ত যখন ঈশ্বরকে “ডাকে”, ঈশ্বর বাইরে থেকে আসেন না; বরং ভক্তের অন্তরের অজ্ঞান, মলিনতা ও আসক্তির পর্দা সরে যায়, আর অন্তর্নিহিত চেতনা জেগে ওঠে। এখানে সাড়া মানে ঈশ্বরের আগমন নয়, ঈশ্বরীয় উপস্থিতির উপলব্ধি। যেমন সূর্য কখনও নিভে যায় না, কেবল মেঘ সরলে আলো দেখা যায়—তেমনি ভক্তির আহ্বানে অন্তরের মেঘ কেটে গেলে ঈশ্বরের দীপ্তি নিজেই প্রকাশ পায়।

গৌড়ীয় ভাবধারা এই জ্ঞানের সঙ্গে প্রেমের উষ্ণতা মিশিয়ে বলে—সাড়া আসলে রসস্পন্দন, প্রেমের অনুরণন। ঈশ্বর ও ভক্ত এখানে দুটি নয়, একই প্রেমের দুই তরঙ্গ। যেমন বাঁশির ফাঁক দিয়ে ঠিক উপায়ে বাতাস গেলে সুর ওঠে, তেমনি ভক্তের হৃদয়ের শূন্যতায় নাম প্রবাহিত হলে করুণার সুর বেজে ওঠে। ঈশ্বরের সাড়া বাইরে থেকে নয়, ভক্তের অন্তর থেকেই ধ্বনিত হয়—যেন হৃদয়ই তাঁর বাজানো বাঁশি।

তাই “ভগবান আসেন না”—এই উক্তি বাহ্যিকভাবে নয়, চেতনার স্তরে বিচার্য। ঈশ্বর আসেন তখনই, যখন আহ্বান সত্য হয়—যখন জ্ঞান, প্রেম ও কর্ম একসঙ্গে সুরে বাঁধা পড়ে। মীরার মতো একাগ্রতা ও প্রেমে ডাকা মানে নিজের চেতনার কেন্দ্রেই ঈশ্বরকে সক্রিয় করা। তখন দেবতা আর দূরের নন; তিনি হয়ে ওঠেন অন্তরের সাড়া-দেওয়া চেতনা। ডাকা ও ধরা, আহ্বান ও অনুগ্রহ, ভজনা ও দর্শন—সবই তখন এক লীলার দুই দিক; ভক্ত ডাকে, ঈশ্বর সাড়া দেন, কিন্তু প্রতিধ্বনি একই সুরে ফিরে আসে—ভক্তির সুরে, যা আসলে চেতনারই মধুর অনুরণন।

“কৌন কেহতা হ্যায় ভগবান খাতে নহিঁ, বের শব্‌রীর কে যায়সে খিলাতে নহিঁ”—এই পঙ্‌ক্তিটি একাধারে কাব্যিক ও দার্শনিক। এর সহজ শব্দগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে ঈশ্বর-জীব সম্পর্কের এক গভীর সত্য। বাহ্যত এটি শব্‌রী নামক এক নিরক্ষর-সহজ-সরল ভক্তিপরায়ণার গল্প, কিন্তু দর্শনের দৃষ্টিতে এটি এক আধ্যাত্মিক অর্জনের প্রতীক।

এখানে ঘোষণা করা হয়েছে—ঈশ্বরকে আহ্বান বা তুষ্ট করার পথ কোনো বাহ্যিক দান, আচার বা বিধির মধ্যে নয়; ঈশ্বর সাড়া দেন কেবল হৃদয়ের সত্যতায়, প্রেমের নির্মলতায়। এই লাইন তাই শুধু বিশ্বাসের প্রকাশ নয়, বরং এক দার্শনিক উন্মোচন—যেখানে দূরের, নিরাসক্ত, মহাশক্তিমান ঈশ্বর রূপান্তরিত হন এক সাড়া-দেওয়া, প্রেমগ্রাহী চেতনায়। ভক্তি এখানে কেবল অনুভূতি নয়; এটি সত্যের এক নতুন উপলব্ধি, যেখানে ঈশ্বর ও জীবের ভেদ মুছে গিয়ে প্রেমই হয়ে ওঠে চেতনার ভাষা।

শব্‌রী—রামায়ণের সেই সরল অরণ্যবাসিনী—ছিলেন অনপাঠ্য, অনাড়ম্বর, অথচ হৃদয়ে নির্মল ও নিখুঁত ভক্ত। প্রতিদিন তিনি বনের ফল (বের বা বড়ই) সংগ্রহ করে একে একে চেখে দেখতেন—যেটি পাকা, সেটি রাখতেন শ্রীরামের জন্য, আর কাঁচা হলে ফেলে দিতেন—যেন রামের মুখে কেবল মাধুর্যের স্বাদ লাগে। সমাজের চোখে এটি ছিল অশুদ্ধ ও অনুচিত, কিন্তু রাম সেই ফল আনন্দভরে গ্রহণ করেছিলেন। কারণ শব্‌রীর নিবেদন ছিল কেবল ফল নয়, তার হৃদয়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ।

এই কাহিনি ভক্তিযোগের মূল মন্ত্র শেখায়—ভক্তি মানে নিখাদ প্রেম, যেখানে দান ও গ্রহীতার ভেদ মুছে যায়। ঈশ্বর দূরের কোনো পরমাত্মা নন, যিনি কেবল যজ্ঞ, বেদপাঠ বা বিশুদ্ধ আচারে তুষ্ট হন; তিনি সাড়া দেন হৃদয়ের সত্যতায়। ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে বাহ্য আচার নয়, অন্তরের প্রীতি, স্বচ্ছতা ও নির্ভরতার মাধ্যমে। যখন ভক্ত নিজের ভালোবাসাকে সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জনের সঙ্গে নিবেদন করেন, তখন সেই প্রেমই ঈশ্বরের আনন্দে রূপান্তরিত হয়।

শব্‌রীর কাহিনি তাই কেবল এক ভক্তিপ্রাণা নারীর গল্প নয়, বরং এক অস্তিত্বতাত্ত্বিক প্রতীক—যেখানে ঈশ্বর সমাজের সব বাহ্য মাপকাঠি ভেঙে, প্রেমের সত্যকে স্বীকৃতি দেন। রাম ফল খাননি ক্ষুধার তাড়নায়; তিনি গ্রহণ করেছিলেন নিবেদনের অন্তঃসত্তা—যেখানে প্রত্যাশা নেই, আছে কেবল হৃদয়ের অর্পিত প্রেমের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ।

দার্শনিকভাবে এই ঘটনাটি বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এই দর্শনে ঈশ্বর ও জীবের সম্পর্ক শরীর ও আত্মার মতো—ঈশ্বর পরম আত্মা, আর সমস্ত জীব, জগৎ ও বস্তু তাঁর শরীররূপ প্রকাশ। ফলে যখন ভক্ত ভালোবাসা দিয়ে কিছু নিবেদন করেন, ঈশ্বর সেটিকে কোনো বাহ্য বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেন না; তিনি সেটিকে নিজেরই অংশ হিসেবে অনুভব করেন। তাঁর কাছে উপহার বা বস্তুর মূল্য নয়, চেতনার অভিপ্রায়—অন্তরের প্রেমই আসল নিবেদন।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে, শব্‌রীর অর্ধভক্ষিত ফল শ্রীরামের কাছে কেবল ফল নয়, এক জীবন্ত অনুভব—যেখানে দাতা ও গ্রহীতা এক অনুভূতির ঐক্যে মিলিত। এখানে ঈশ্বর ও জীবের সম্পর্ক কোনো জ্ঞানভিত্তিক দূরত্বে নয়, বরং প্রেমভিত্তিক সংহতিতে স্থিত। বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত যেমন বলে, ঈশ্বর জীবের অন্তর্যামী—অর্থাৎ প্রত্যেক প্রেমময় ক্রিয়া আসলে ঈশ্বরের মধ্যেই সংঘটিত। তাই রাম সেই ফল খাননি বাইরে থেকে; তিনি শব্‌রীর হৃদয়ের ভেতরে স্থিত থেকেই সেই প্রেমের স্বাদ গ্রহণ করেছেন—যেখানে ভক্তির নিবেদন আর ঈশ্বরের আনন্দ একাত্ম হয়ে গেছে।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, শব্‌রী ও শ্রীরামের এই মিলন কোনো বাহ্য ঘটনা নয়; এটি চেতনার নিজেরই আত্মসম্পর্কের উদ্ঘাটন। এখানে প্রেম জ্ঞানের পরিণতি, আর জ্ঞান প্রেমের অভ্যন্তরীণ দীপ্তি। শব্‌রী ও রাম—দু-জন আলাদা ব্যক্তি নন, বরং এক চেতনার দুই রূপ। শব্‌রী সেই চেতনার ভক্তি-রূপ, আর রাম তাঁর প্রকাশ-রূপ। যখন শব্‌রী ফল নিবেদন করেন, তখন তা আসলে চেতনার নিজের প্রতি প্রবাহ—চেতনা নিজেকে ভালোবাসছে, নিজেকে দান করছে, নিজেকেই গ্রহণ করছে।

এই ঘটনায় প্রেম ও জ্ঞানের বিভাজন মুছে যায়। প্রেম এখানে অন্ধ আবেগ নয়, বরং জ্ঞানেরই সচেতন উন্মোচন; আর জ্ঞান কেবল তত্ত্ব নয়, প্রেমের অভিজ্ঞতায় জীবন্ত। অদ্বৈত বেদান্ত বলে—“ব্রহ্মই সব”, তাই ঈশ্বর ও ভক্ত দুই-ই একই চেতনার প্রকাশ। প্রেমের মুহূর্তে এই অভিন্নতা অনুভবযোগ্য হয়ে ওঠে—ভক্ত তখন আর আলাদা সত্তা নয়, তিনি সেই ব্রহ্মচেতনারই প্রতিধ্বনি।

এই দৃষ্টিতে শব্‌রীর নিবেদন আসলে চেতনার নিজের প্রতিফলন—সীমিত আত্মা যখন নিজের অসীম রূপকে আহ্বান করে, তখন সেই অসীম চেতনা নিজেই সীমিতের রূপে সাড়া দেয়। শব্‌রী ও রামের মিলনে তাই দেখা যায়, ভালোবাসা আর জানা এক হয়ে যায়; চেতনার স্বরূপ তখন কেবল অনুভবযোগ্য নয়, অভিজ্ঞতায় প্রতিফলিত। এটাই অদ্বৈতের গভীরতম অন্তর্দৃষ্টি—যেখানে ঈশ্বর ও ভক্ত, প্রেম ও জ্ঞান, দান ও গ্রহণ—সবই চেতনার এক অখণ্ড লীলা।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্ব এই ঘটনাটিকে প্রেমের রসতত্ত্বে রূপান্তরিত করে। এই মতে, ঈশ্বরের লীলা কোনো নীতিকথা বা অলৌকিক প্রদর্শন নয়, বরং প্রেমের পরস্পর-আহ্বানের খেলা। শব্‌রীর ফল খাওয়া রামের কাছে কেবল ভক্তির প্রতিদান নয়, ছিল সেই প্রেমের স্বাদগ্রহণ—রসাস্বাদন। রাম সেখানে করুণাময় বিচারক নন, বরং প্রেমের রসরাজ, যিনি ভক্তির মাধুর্যে মুগ্ধ হন।

গৌড়ীয় ভাবধারায় ঈশ্বরের প্রধান শক্তি তিন ভাগে বিভক্ত—সন্দিনী (অস্তিত্ব), সম্বিত (চেতনা) ও হ্লাদিনী (আনন্দ)। এর মধ্যে হ্লাদিনী শক্তিই প্রেমের উৎস, যা ঈশ্বরকে ভক্তের হৃদয়ে অনুভূত করে তোলে। শব্‌রীর ফল সেই হ্লাদিনী শক্তিরই প্রকাশ—যেখানে ঈশ্বর ভক্তের দানে তৃপ্ত হন না—দানের বস্তুর কারণে, বরং সেই দানের অন্তরঙ্গ কম্পনে, ভক্তির স্পন্দনে (রস-স্পন্দ বা rasa-spanda)। এটি এক সূক্ষ্ম পারস্পরিকতা—ভক্ত দান করে প্রেম, ঈশ্বর গ্রহণ করেন আনন্দ; কিন্তু শেষপর্যন্ত দু-জনেই এক চেতনার দুই সুর।

“রস-স্পন্দ” (Rasa-Spanda) শব্দযুগলটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব ও কাশ্মীর শৈব দর্শনের মিলিত ভাবরস বহন করে—দুটি পৃথক ধারার হলেও উভয়ের অন্তর্নিহিত তত্ত্ব এক গভীর ঐক্যের দিকে নিয়ে যায়।

‘রস’ শব্দটি মূলত গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের প্রাণ। এটি কেবল কোনো আবেগ নয়, বরং চেতনার আনন্দ-তত্ত্ব—ঈশ্বর ও জীবের পারস্পরিক প্রেমের অভিজ্ঞতা। ষড়গোস্বামীগণের অন্যতম শ্রীজীব গোস্বামী (Śrī Jīva Gosvāmī) রচিত ষট্ সন্দর্ভ (Ṣaṭ Sandarbha) নামক বৈষ্ণব দার্শনিক গ্রন্থের ভক্তি সন্দর্ভ (যা ভক্তির প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করে)-এর একটি অংশ—”আস্বাদ্যো বেদ্যো ভগবান”। এই সূত্রটি ভগবানের স্বরূপ এবং ভক্তের সাথে তাঁর সম্পর্কের দুটি প্রধান দিককে তুলে ধরে।

এই বাক্যটি ঈশ্বরের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে:

আস্বাদ্য (Āsvādya): যিনি আস্বাদন বা উপভোগের যোগ্য।

তাৎপর্য: ভগবান কেবল যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে জানার বিষয় নন, বরং প্রেম ও অনুরাগের মাধ্যমে হৃদয়ে অনুভব বা মাধুর্য রস হিসেবে উপভোগ করার বিষয়।

বেদ্য (Vedya): যিনি জানার যোগ্য বা জ্ঞান দ্বারা লভ্য।

তাৎপর্য: ভগবান হলেন তত্ত্বগত সত্য (Ultimate Reality), যাকে উপনিষদ, বেদান্তের জ্ঞান (Jnana) ও অন্যান্য শাস্ত্র দ্বারা আলোচনা-বিচার করে জানতে হয়।

‘ভগবান’ শব্দটির গভীর দার্শনিক তাৎপর্য আছে, যা শুধু দেবতা বা ঈশ্বর নয়, বরং চেতনার পূর্ণতার প্রতীক। “ভগ” শব্দটি সংস্কৃতে ছয়টি ঐশ্বর্যের (Ṣaḍ-aiśvarya) নির্দেশক, এবং “বান” অর্থ যিনি তা ধারণ করেন বা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করেন। তাই ভগবান মানে সেই সত্তা, যিনি ছয়টি ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ—অর্থাৎ সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বপ্রিয় এবং স্বয়ংপূর্ণ চৈতন্যরূপ ঈশ্বর।

এই ছয়টি ঐশ্বর্য হলো—

১. ঐশ্বর্য (aiśvarya): সর্বশক্তি বা পরম নিয়ন্ত্রণ; যা-কিছু আছে, সবই তাঁর দ্বারা পরিচালিত।

২. বীর্য (vīrya): অবিনশ্বর শক্তি; সৃষ্টিতে, সংরক্ষণে ও সংহারে তাঁর অশেষ সক্ষমতা।

৩. যশ (yaśas): গৌরব ও মাহাত্ম্য; সব মহিমা ও খ্যাতি তাঁর থেকেই বিকীর্ণ।

৪. শ্রী (śrī): সৌন্দর্য, মাধুর্য ও করুণা; তাঁর লীলায় প্রকাশ পায় আনন্দ ও রস।

৫. জ্ঞান (jñāna): সর্বজ্ঞতা; সব জ্ঞানের উৎস ও সীমার অতীত জ্ঞান।

৬. বৈরাগ্য (vairāgya): অনাসক্তি; তিনি সব কিছুর কর্তা, তবুও কিছুতেই আসক্ত নন।

বিষ্ণুপুরাণে (৬.৫.৭৪) এই সংজ্ঞা স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে—“ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য, বীর্যস্য যশসঃ শ্রীঃ। জ্ঞান বৈরাগ্যযশ্চৈব, ষণ্ণাং ভগ ইতিঙ্গণঃ।।” অর্থাৎ, “যিনি ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্যে পরিপূর্ণ—তাঁকেই ভগবান বলা হয়।”

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, এই ছয় গুণই নিরাকার ব্রহ্মের প্রকাশ—ঐশ্বর্য ও বীর্য প্রকাশ করে সত্তার শক্তি, জ্ঞান ও বৈরাগ্য প্রকাশ করে চেতনার নিঃসঙ্গ স্বাধীনতা, আর যশ ও শ্রী প্রকাশ করে আনন্দ বা রসাত্মক ঐশ্বর্য। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে, এই গুণগুলির মধ্যে শ্রী বা হ্লাদিনী শক্তি (আনন্দ) সর্বোচ্চ—কারণ প্রেমই সব গুণের পূর্ণতা।

তাই ভগবান কেবল সর্বশক্তিমান নন; তিনি সর্বমধুরও। তাঁর ঐশ্বর্য তাঁকে মহান করে, কিন্তু তাঁর প্রেম তাঁকে নিকটবর্তী করে। ঐশ্বর্যে তিনি অসীম, আর প্রেমে তিনি দামোদর—অসীম থেকেও ভক্তির দড়িতে বাঁধা পড়েন। এই ভারসাম্যই ঈশ্বরতত্ত্বের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা—যেখানে শক্তি ও করুণা, জ্ঞান ও প্রেম, শাসন ও আত্মসমর্পণ—সব এক সত্তায় মিলেমিশে “ভগবান”-এর পূর্ণতা রচনা করে।

ভগবানকে সম্পূর্ণরূপে জানতে হলে কেবল বৌদ্ধিক জ্ঞান (বেদ্য) যথেষ্ট নয়, বরং হৃদয়ের প্রেম ও আনন্দ (আস্বাদ্য) দ্বারা তাঁর মাধুর্যকে আস্বাদন করাও প্রয়োজন। ভক্তের কাছে তিনি একই সাথে জ্ঞেয় (জানা যায়) এবং উপভোগ্য (আস্বাদন করা যায়)।