দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ২১



ঈশ্বর এখানে দূরের কোনো সত্তা নন; তিনি ভক্তির মধ্যেই রসরূপে বিকশিত হন। যেমন রাধা ও কৃষ্ণের মিলন চেতনার প্রেমময় দীপ্তি, তেমনি রাম ও শব্‌রীর মুহূর্তটি রসেরই এক প্রকাশ—যেখানে দাতা ও গ্রহীতা, প্রেমিক ও প্রিয়, ভক্ত ও ঈশ্বর একই আনন্দ-প্রবাহে যুক্ত।

অন্যদিকে, ‘স্পন্দ’ শব্দটি কাশ্মীর শৈব দর্শনের কেন্দ্রীয় ধারণা—এর অর্থ চেতনার কম্পন—সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, যার মাধ্যমে স্থির চৈতন্য নিজেকে প্রকাশ করে। অভিনবগুপ্তের ভাষায়, “স্পন্দো হি জীবনম্”—চেতনার স্পন্দনই জীবন। এই স্পন্দই শিবচেতনার সৃষ্টিশক্তি, যা নিস্তব্ধতার মধ্যেও চিরক্রিয়াশীল।

যখন গৌড়ীয় প্রেমতত্ত্ব ও শৈব স্পন্দতত্ত্ব মিলিয়ে দেখা হয়, তখন “রস-স্পন্দ” হয়ে ওঠে এক অনন্য ধারণা—প্রেমের আন্দোলনে চেতনার নিজস্ব স্পন্দন। এটি কোনো মনস্তাত্ত্বিক আবেগ নয়; এটি চেতনার নিজস্ব আত্ম-আনন্দ, যেখানে ঈশ্বর নিজের শক্তির সঙ্গে নৃত্য করেন। শব্‌রীর হাতে অর্পিত ফল বা যশোদার হাতে ধরা দড়ি তখন কেবল ভক্তির প্রতীক নয়—এগুলি রস-স্পন্দের প্রতিচ্ছবি: চেতনার আনন্দ যখন প্রেমে কম্পিত হয়, তখন অসীম নিজেই নিজের সীমার স্পর্শে মোহিত হয়ে পড়ে।

এই “রস-স্পন্দ” তাই প্রেমের দর্শন নয়, চেতনার মহাজাগতিক ছন্দের উপলব্ধি। এটি সেই মুহূর্ত, যখন ব্রহ্ম আনন্দে স্পন্দিত হয়, আর জীব সেই স্পন্দনের সুরে নিজের ঈশ্বরীয় স্বরূপ চিনে ফেলে।

যেমন দামোদর লীলায় যশোদার দড়ি কৃষ্ণকে বাঁধে, অথচ সেই বাঁধনই কৃষ্ণের আনন্দের কারণ, তেমনি শব্‌রীর বড়ই ফল রামের হৃদয়কে জয় করে। উভয় ক্ষেত্রেই প্রেমই ঈশ্বরের আসল শক্তি—যা অসীমকে সীমার মধ্যে নিয়ে আসে, ব্রহ্মকে লীলায় প্রকাশ করে। গৌড়ীয় তত্ত্ব এই ভাবকে আরও গভীর করে বলে—ঈশ্বর কেবল সর্বজ্ঞ নন, তিনি রসরাজ—প্রেমের আস্বাদক। ভক্তের হৃদয়ে যে-প্রেম জাগে, সেটিই ঈশ্বরের নিজের হ্লাদিনী শক্তির প্রতিফলন। তাই শব্‌রীর নিবেদন রামের কাছে কেবল করুণা জাগায়নি, তা হয়ে উঠেছিল তাঁর নিজের আনন্দের উপলব্ধি—প্রেমের সেই চিরন্তন প্রতিধ্বনি, যেখানে ঈশ্বর ভক্তিতে, আর ভক্ত ঈশ্বরে পূর্ণতা পায়।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এই ঘটনাটি এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি-সম্পর্ক বা intersubjective communion-এর প্রতীক। এখানে ঈশ্বরের প্রতিক্রিয়া কোনো বাহ্যিক অলৌকিক ক্রিয়া নয়, বরং সেই মুহূর্ত, যখন দুটি চেতনা—ভক্ত ও ঈশ্বর—একই অনুভূতির সুরে কম্পিত হয়। শব্‌রীর প্রত্যাশাহীন, নিখাদ প্রেম রামের চেতনার সঙ্গে এমনভাবে সুর মিলিয়েছিল যে, ফল খাওয়া এক আধ্যাত্মিক প্রতিসাড়া হয়ে উঠেছিল। সেই মুহূর্তে দেওয়া ও গ্রহণ, ভক্তি ও অনুগ্রহ, মানব ও ঈশ্বর—সব ভেদ মুছে গিয়ে একীভূত হয়েছিল এক চৈতন্য-স্পন্দনে।

মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে, ঈশ্বরের “খাওয়া” মানে প্রতিক্রিয়া দেওয়া, অর্থাৎ চেতনা ও অনুভূতির পারস্পরিক সংযোগ। শব্‌রীর ভক্তি যত গভীর, আন্তরিক ও একাগ্র হয়েছে, ততই রামের প্রতিক্রিয়াও ব্যক্তিগত ও প্রত্যক্ষ হয়েছে। এটি একধরনের reciprocal resonance—যেখানে এক হৃদয়ের কম্পন অন্য হৃদয়ে প্রতিধ্বনি তোলে। যেমন দুটি বীণার তার একই স্বরে বাঁধলে একটির স্পর্শে অন্যটি নিজে থেকেই বেজে ওঠে, তেমনি ভক্ত ও ঈশ্বরের হৃদয়ও সেই অন্তরঙ্গ সুরে একে অপরকে জাগিয়ে তোলে। এই প্রতিধ্বনিই ভক্তির প্রকৃত অলৌকিকতা—যেখানে ঈশ্বর দূরে নন, বরং প্রেমের সুরে নিজেরই প্রতিধ্বনি শুনে সাড়া দেন।

তাই এই পঙ্‌ক্তি কেবল ভক্তির কোনো সরল কাহিনি নয়; এটি এক গভীর দার্শনিক প্রতীক, যেখানে ঈশ্বরের স্বরূপকে প্রকাশ করা হয়েছে প্রেমের বন্ধনে। ঈশ্বর এখানে কোনো দূরের, অচেনা বিচারক নন; তিনি সেই চেতনা, যিনি হৃদয়ের প্রেমে আবদ্ধ। তাঁর কাছে বাহ্যিক দানের মূল্য নেই—না পাকা ফলের, না কাঁচা ফলের—মূল্য আছে নিবেদনের স্বচ্ছতার, প্রেমের আন্তরিকতার। শব্‌রীর অর্ধভক্ষিত ফল তাই ভগবানের কাছে অশুদ্ধ নয়; বরং সেই নির্মল হৃদয়ের প্রতীক, যা প্রত্যাশাহীন ভালোবাসায় পূর্ণ।

এই ঘটনায় প্রকাশ পায় এক অনন্ত সত্য—ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না আচার বা প্রদানে, তাঁকে স্পর্শ করা যায় কেবল প্রেমে। কারণ প্রেমই তাঁর পরম স্বরূপ, আর ভক্তি সেই স্বরূপের জাগরণ। শব্‌রীর ফল তাই রামের আহার নয়, বরং মানবপ্রেমের ঈশ্বরীয় রূপান্তর—যেখানে সীমিত হৃদয় নিজের সীমা ভেঙে অসীমের সঙ্গে মিলিত হয়। সেই মিলনেই দাতা ও গ্রহীতা, ভক্ত ও ভগবান, মানব ও ঈশ্বর—দুই নয়, এক প্রেমতরঙ্গে একাকার হয়ে যায়। এই একতাই ভক্তির চূড়ান্ত অর্থ—যেখানে ভালোবাসাই ধর্ম, আর নিবেদনই মুক্তি।

“কৌন কেহতা হ্যায় ভগবান সোতে নহিঁ, মা যশোদা কে যায়সে সুলাতে নহিঁ”—এই এক পঙ্‌ক্তিতে যেভাবে সরল স্নেহ আর গভীর দর্শন মিলেমিশে গেছে, তা ভারতীয় ভাবচিন্তার এক অসাধারণ রূপ। আপাতদৃষ্টিতে এটি এক মায়াময় পারিবারিক দৃশ্য—মা যশোদা কোলে শিশুকৃষ্ণকে দোলাচ্ছেন, মৃদু সুরে ঘুমপাড়ানি গান গাইছেন, শিশুর চোখ ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসছে। কিন্তু এই কোমল মানবীয় চিত্রের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক মহাতাত্ত্বিক সত্য—অসীম চেতনা প্রেমের আহ্বানে যখন সীমাকে আলিঙ্গন করে, তখনই সৃষ্টি ও লীলা জন্ম নেয়।

যশোদার কোলে যে-কৃষ্ণ ঘুমিয়ে পড়ছেন, তিনি কোনো সাধারণ শিশু নন; তিনি সেই পরম চেতনা, যিনি সত্তা (Sat), চিত্‌ (Cit) ও আনন্দ (Ānanda)-এর অবিচ্ছিন্ন ঐক্য। অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, এই ব্রহ্ম নিরাকার, অনন্ত ও অপরিবর্তনীয়; তিনি চিরজাগ্রত, কখনও ঘুমিয়ে পড়েন না, কখনও ক্লান্ত হন না। অথচ এখানেই এক চমৎকার বিপরীত ঐক্য দেখা যায়—এই চিরজাগ্রত ব্রহ্মই প্রেমের টানে যশোদার কোলে শিশুরূপে শয়ন করছেন। এটি কোনো মায়ার বিভ্রম নয়; বরং অসীমের স্বেচ্ছা-সীমা—চেতনার নিজেরই আত্মপ্রকাশ।

এই নিদ্রা আসলে অজ্ঞানতার প্রতীক নয়; এটি পূর্ণ চেতনার বিশ্রাম, সেই অবস্থার প্রতীক, যেখানে জানা, চিন্তা, কর্ম—সব মিলেমিশে যায় আনন্দের নিঃশব্দ সুরে। উপনিষদে বলা হয়েছে—যত্র সুপ্তো ন কঞ্চন কামং কাময়তে, ন কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি, তৎ সুষুপ্তম্।সুষুপ্তস্থান একীভূতঃ প্রজ্ঞানঘন এব আনন্দময়ো হি আনন্দভুক্ চেতোমুখঃ প্রাজ্ঞস্তৃতীয়ঃ পাদঃ।। (মাণ্ডুক্য উপনিষদ, শ্লোক ৫) “যত্র তু সুপ্তো ন কঞ্চন কামং কাময়তে তদ্‌ ব্রহ্ম।” অর্থাৎ, “যে-অবস্থায় শয়নকারী (সুপ্তঃ) কোনো কামনা-বাসনা করেন না (ন কঞ্চন কামং কাময়তে), এবং কোনো স্বপ্নও দেখেন না (ন কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি), সেই অবস্থাটি হলো সুষুপ্তি (গভীর ঘুম)। সুষুপ্তি-অবস্থায় বিরাজমান (সুষুপ্তস্থান) আত্মা একীভূতঃ (একত্রিত বা অভিন্ন), প্রজ্ঞানঘন (জ্ঞান বা চেতনার ঘনীভূত রূপ), আনন্দময় (আনন্দস্বরূপ), আনন্দভুক্ (আনন্দ উপভোগকারী), এবং চেতোমুখঃ (চেতনার মুখ বা দ্বার)। এই (আত্মা) হলেন তৃতীয় পাদ (তৃতীয় অবস্থা) — প্রাজ্ঞ।”

এই শ্লোকটি ভারতীয় দর্শনের আত্মতত্ত্ব বোঝার জন্য অপরিহার্য। এটি তুচ্ছ জাগতিক অভিজ্ঞতার অনুপস্থিতির মাধ্যমে ব্রহ্মের স্বরূপ নির্দেশ করে:

স্বরূপের বিশুদ্ধতা: সুষুপ্তিতে মন ও ইন্দ্রিয়গুলির সমস্ত ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায়, আত্মা আর ব্যক্তিগত কামনা (Kāma) বা স্বপ্নরূপ বিকৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয় না। এটিই আত্মার বিশুদ্ধ, অবিকৃত স্বরূপের নিকটতম অবস্থা।

একীভূতঃ (One without a second): গভীর ঘুমে মন সমস্ত ভেদাভেদ (বিষয়, দ্রষ্টা, দৃশ্য) ভুলে গিয়ে একীভূত হয়ে যায়। এই ঐক্যই অদ্বৈত-এর একটি ব্যাবহারিক প্রমাণ।

প্রজ্ঞানঘন (Mass of Consciousness): সুষুপ্তিতে জ্ঞান বিক্ষিপ্তভাবে না থেকে ঘনীভূত (Dense) বা একক চেতনারূপে বিদ্যমান থাকে। এই ধারণাই 'চেতনার ঘনতা'-র দার্শনিক ভিত্তি দেয়।

আনন্দময় ও আনন্দভুক্ (Blissful and Enjoyer of Bliss): গভীর ঘুমের পর আমরা বলি, "খুব শান্তিতে ঘুমিয়েছি।" এটি প্রমাণ করে যে, সেই অবস্থায় আত্মা আনন্দস্বরূপে (Ānandamaya) বিরাজ করে এবং সেই আনন্দই উপভোগ করে (Ānandabhuk)। এই আনন্দ বাহ্যিক বস্তুর ওপর নির্ভরশীল নয়।

প্রাজ্ঞ (Prājña): সুষুপ্তি অবস্থায় বিদ্যমান এই আত্মাকে প্রাজ্ঞ বলা হয়। এর অর্থ হলো বিশেষ জ্ঞানী (Especially Knowing)। এই জ্ঞানটি জাগতিক জ্ঞান নয়, বরং অন্তর্নিহিত বা অন্তর্জ্ঞানের (Intuitive) জ্ঞান, কারণ এই অবস্থায়ও আত্মা তার নিজের সত্তা সম্পর্কে অবগত থাকে।

এই শ্লোকটি শেখায় যে, ব্রহ্মকে বা চূড়ান্ত সত্যকে জানতে হলে বাইরে খোঁজা নিষ্প্রয়োজন, কারণ কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত এবং আনন্দস্বরূপ আত্মা—যা সুষুপ্তিতে বিদ্যমান—সেটিই ব্রহ্মের স্বরূপ। যেখানে চেতনা নিজের মধ্যে নিঃশব্দ, কোনো কামনা নেই—সেই অবস্থাই ব্রহ্ম। কৃষ্ণের ঘুম তাই জড়তা নয়, বরং আনন্দের অন্তঃপ্রকাশ—যেখানে পরম চেতনা প্রেমের শান্তিতে স্থিত।

এই দৃশ্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় দামোদর তত্ত্বের সার। দামোদর লীলায় যেমন দেখা যায়—অসীম ঈশ্বর যশোদার স্নেহের দড়িতে বাঁধা পড়ে যান—তেমনি এখানে তিনি প্রেমের কোলে বিশ্রাম নিচ্ছেন। দুটোই এক দর্শনের রূপান্তর: ঈশ্বর সীমাকে তুচ্ছ করেন না, বরং সীমার ভেতরেই নিজের অসীমতাকে লীলারূপে প্রকাশ করেন।

যশোদার কোলে কৃষ্ণের এই নিদ্রা তাই ভারতীয় ভাবজগতের এক অনুপম প্রতীক। এখানে অদ্বৈতের ব্রহ্ম, বিশিষ্টাদ্বৈতের অন্তর্যামী ঈশ্বর এবং গৌড়ীয় ভাবধারার প্রেমময় কৃষ্ণ—সব এক বিন্দুতে এসে মিলিত। ব্রহ্ম আর দূরের, নিরাকার পরমাত্মা নন; তিনি আমাদের জীবনের সহজতম স্নেহে, মাতৃপ্রেমের স্পর্শে, দোলনার মৃদু ছন্দে প্রকাশিত। এই প্রেমেই দর্শন রক্তমাংসের জীবন্ত সত্তা হয়ে ওঠে—শুধু চিন্তার সূক্ষ্ম আভাস নয়, অনুভবের উষ্ণ বাস্তবতা। আর দর্শনেই প্রেম খুঁজে পায় তার চিরন্তন আশ্রয়—যেখানে আবেগ আর জ্ঞান, ভক্তি আর তত্ত্ব, মানব আর ঈশ্বর—সব এক আলোকস্রোতে মিলেমিশে যায়।

“ভগবান ঘুমিয়ে পড়েন না, যদি না যশোদা তাঁকে ঘুম পাড়ান”—এই বাক্য কেবল কাব্য নয়; এটি চেতনার সর্বোচ্চ উপলব্ধির ইঙ্গিত। যখন প্রেমই চেতনার প্রতিফলন হয়ে ওঠে, তখন ঈশ্বর দূরে নন—তিনি আমাদের হৃদয়ের কোলে বিশ্রাম নিচ্ছেন, আর সেই নিদ্রাই হলো পরম শান্তি, পরম লীলা।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, যশোদার দোলনা কেবল মাতৃত্বের প্রতীক নয়—এটি ব্রহ্মের নিজস্ব মায়াশক্তির এক গভীর দার্শনিক রূপক। এখানে অসীম চেতনা নিজেই সীমারূপে প্রকাশিত হচ্ছে, এবং সেই সীমার মধ্যেই ফিরে পাচ্ছে নিজের বিশ্রাম। “ঈশ্বর ঘুমিয়ে পড়েন”—এই বাক্যের আড়ালে কোনো জড় অবচেতনতা নেই; এটি বোঝায়, চেতনা নিজের মধ্যেই স্বয়ংলীন—বৈচিত্র্যের প্রকাশ থেকে ঐক্যের নিদ্রায় ফিরে যাওয়া। এই অবস্থায় কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকে না, যেখানে চেতনা সম্পূর্ণভাবে নিজের মধ্যেই স্থিত, সেটিই ব্রহ্মস্বরূপ। সেই আলোকে, যশোদার কোলে কৃষ্ণের নিদ্রা কোনো অবিদ্যা-বদ্ধ অচেতনতা নয়; বরং এক চেতনার নিঃশেষ শান্তি, যেখানে সৃষ্টি ও লয়, কর্ম ও বিশ্রাম—সব একসুরে মিলেমিশে যায়।

এই মুহূর্তে যশোদা ও কৃষ্ণ আর কেবল মা ও সন্তান নন; তাঁরা চেতনা ও প্রেমের দুই দিক। কৃষ্ণ সেই ব্রহ্ম—নিরাকার, অপরিবর্তনীয়, চিরজাগ্রত, “অচ্যুত” ও অবিনশ্বর। তবুও, এই চিরজাগ্রত ব্রহ্ম প্রেমের আকর্ষণে যশোদার কোলে “ঘুমিয়ে পড়ছেন”—এ যেন পরম চেতনার নিজস্ব আত্মবিসর্জন, যেখানে অসীম নিজেকে সীমায় পরিণত করে নিজেরই স্নেহে স্থিত।

এই নিদ্রা জ্ঞানের অন্তিম রূপ—যেখানে জানা ও চেনা একাকার হয়ে যায়। তখন জ্ঞান আর বুদ্ধিবৃত্তি নয়, হয়ে ওঠে অনুভব—এক নিস্তব্ধ পূর্ণতা। অদ্বৈত বেদান্ত শেখায়, ব্রহ্ম নিরাকার, অনন্ত, নির্গুণ; তবু তাঁর মায়াশক্তি যখন প্রকাশিত হয়, তখনই রূপ, নাম ও সম্পর্কের মাধ্যমে তিনি অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন; অর্থাৎ, ব্রহ্ম (চূড়ান্ত, অখণ্ড সত্য), যিনি প্রকৃতিগতভাবে জ্ঞানস্বরূপ (Pure Consciousness) এবং সমস্ত অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে (Transcendent), তিনিই যেন স্বয়ং অভিজ্ঞতা লাভ করেন বা জানা বিষয় (Known Object)-এ পরিণত হন।

যশোদার কোলে শায়িত কৃষ্ণ কোনো মায়াময় প্রতিচ্ছবি নন—তিনি সেই ব্রহ্ম, যিনি নিজের অসীমতাকে সীমারূপে উপলব্ধ করছেন, যেমন অসীম আকাশ জলের পাত্রে প্রতিফলিত হয়। এই প্রতিফলন বিভ্রম নয়, বরং প্রেমের খেলা—অসীমের নিজেরই আত্ম-অনুভবের লীলা।