দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ২২



এই কারণেই যশোদার দোলনা হয়ে ওঠে সৃষ্টি ও বিশ্রামের প্রতীক: চেতনা যখন বিশ্বকে ধারণ করে, আবার নিজেরই কোলে বিশ্রাম নেয়। এই লীলায় অদ্বৈতের জ্ঞান মিশে যায় মাতৃত্বের প্রেমে, আর প্রেমের কোমলতা ছুঁয়ে ফেলে পরম জ্ঞানের নিঃস্তব্ধ শিখর।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের দৃষ্টিতে, এই দৃশ্যটি চিত্‌-বিমর্শ তত্ত্বের এক জীবন্ত রূপ। দর্শন বলে—“চিত্‌ বিমর্শরূপা শক্তিঃ”, অর্থাৎ চেতনা নিজের প্রতিচ্ছবিতে, নিজের অনুভবেই আনন্দিত হয়। এখানে যশোদার স্নেহ সেই বিমর্শ—চেতনার আত্ম-পরিচয়, আর কৃষ্ণের নিদ্রা সেই প্রকাশ—চেতনার স্বয়ং-বিশ্রাম।

এই অবস্থায় ঈশ্বর কোনো বাহ্য বস্তু বা দৃষ্টান্ত নন; তিনি নিজের প্রেমের প্রতিফলনে নিজেকেই চিনছেন। যশোদা হলেন সেই মাতৃস্বরূপ প্রেম, যার মধ্যে চেতনা নিজেকে দেখে; আর কৃষ্ণ সেই পরম চেতনা, যিনি সেই প্রেমে লীন হয়ে নিজের মধ্যেই বিশ্রাম নিচ্ছেন।

কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে বলা হয়, চেতনার এই নিজেকে চিনে নেওয়াই বিমর্শ—এবং যখন সেই চেতনা নিজের প্রেমে বিশ্রাম নেয়, তখনই জন্ম নেয় প্রকাশ। এই দুটির সংযোগেই বিশ্ব-স্পন্দন বা স্পন্দ ঘটে—সৃষ্টি, স্থিতি, লয়—সবই এই চিরন্তন আত্মচেতনার তরঙ্গে স্পন্দিত হয়।

যশোদার স্নেহ ও কৃষ্ণের নিদ্রা কোনো লীলামাত্র নয়; এটি চেতনার নিজস্ব আত্ম-আনন্দের দৃশ্য। যখন ঈশ্বর নিজের ভালোবাসায় নিজেকে চিনে নেন, তখন বিশ্ব শান্ত হয়ে আসে; সময় থেমে যায়, থাকে শুধু প্রেমের অনন্ত স্পন্দন—চেতনার নিজের মধ্যে ফিরে আসার নিঃশব্দ মহাসংগীত।

বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, যশোদা-কৃষ্ণের এই লীলা ঈশ্বরের অন্তর্যামিত্ব বা immanent presence-এর প্রতীক। ভগবান সর্বব্যাপী হলেও, তিনি প্রতিটি হৃদয়ে গোপনে বিরাজমান; যশোদার হৃদয়েই তিনি স্নেহের কেন্দ্রে বিশ্রাম নিচ্ছেন। রামানুজাচার্য বলেন—ঈশ্বরের পরম করুণা ও প্রেমের প্রকাশই তাঁর লীলার উদ্দেশ্য। অসীম ঈশ্বর নিজেকে ছোটো করে দেন, যাতে ভক্ত তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারে; কারণ ভালোবাসা কেবল প্রভুত্ব নয়, পারস্পরিকতা চায়।

যশোদার লালন কোনো সাধারণ মাতৃত্ব নয়—এটি সেই ঈশ্বরীয় করুণার দৃশ্যমান রূপ, যেখানে অসীম স্বেচ্ছায় সীমায় আশ্রয় নিচ্ছে। বিশিষ্টাদ্বৈত মত বলে, ঈশ্বর সর্বব্যাপী, অন্তর্যামী—জীব, জগৎ ও প্রকৃতি, সবই তাঁর দেহরূপ। তবুও সেই সর্বব্যাপী ঈশ্বর, যশোদার কোলে সীমাবদ্ধ শিশুরূপে প্রকাশ পান। এই সীমাবদ্ধতা কোনো ক্ষয় নয়; বরং করুণার পূর্ণতা—কারণ ঈশ্বরের আনন্দ ভক্তের প্রেমেই নিহিত।

রামানুজ বলবেন, ঈশ্বরের প্রকৃত মহিমা তাঁর ক্ষুদ্রতায়; ভক্তের স্পর্শেই তিনি উপলব্ধ। তাই যশোদার কোলে কৃষ্ণ কেবল শিশুরূপ নন—তিনি ভক্তির পরম প্রতীক, যেখানে ভগবান নিজের সর্বশক্তিকে সঙ্কুচিত করে ভালোবাসার আকারে ধরেন। এই প্রেম-লীলা শেখায়, ঈশ্বর ভক্তির আহ্বানে কোনো “অভিমানী দেবতা” নন, বরং “প্রিয়জন”—যিনি ভক্তের স্নেহে আবদ্ধ হয়ে নিজেই আনন্দ পান।

যশোদার স্নেহ তাই সেই অন্তর্গত প্রেমের প্রতিচ্ছবি—যেখানে অসীম ঈশ্বর নিজেকে সীমার কোলে সমর্পণ করেন, যেন মানুষ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে। এখানে ঈশ্বরের সর্বব্যাপী শক্তি প্রেমে ব্যক্ত হয়; তাঁর অনন্তত্ব মানবীয় স্নেহে অনুগ্রহের রূপে প্রকাশ পায়। এই লীলাতেই বিশিষ্টাদ্বৈতের তত্ত্ব জীবন্ত হয়ে ওঠে—অন্তর্যামী ঈশ্বর ভক্তির হৃদয়ে শয়ন করছেন, আর ভক্তি নিজেই তাঁর বিশ্রামের শয্যা।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের দৃষ্টিতে, যশোদা-কৃষ্ণের এই লীলা হলো মাধুর্য-ভঙ্গির চূড়ান্ত প্রকাশ—যেখানে ঈশ্বরের মহিমা ও ঐশ্বর্য আড়াল হয়ে যায়, আর উন্মোচিত হয় তাঁর মানবীয় কোমলতা, প্রেম ও স্নেহের রস। মা যশোদা কৃষ্ণকে শুইয়ে দেন কর্তৃত্বে নয়, বরং মাতৃত্বের নিখাদ প্রেমে; আর কৃষ্ণও সেই ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়ে সুখ পান। এখানে ঈশ্বরের অবতার কেবল সৃষ্টির রক্ষার জন্য নয়—ভক্তির আস্বাদনের জন্য।

এই লীলা হলো হ্লাদিনী শক্তির কার্য—ঈশ্বর নিজের আনন্দকে প্রেমরূপে প্রকাশ করছেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্বে এটি মাধুর্য-রসের পরম মুহূর্ত, যেখানে ঈশ্বর আর দূরের সর্বশক্তিমান প্রভু নন; তিনি হয়ে ওঠেন প্রিয়, কোমল, স্নেহময় শিশু, যিনি মায়ের কোলে বিশ্রাম নেন, মায়ের স্নেহে দোল খেতে ভালোবাসেন।

এই লীলাই দামোদর তত্ত্বের প্রাণ—যেখানে ভক্তির দড়ি, যশোদার স্নেহ, ঈশ্বরকে বাঁধে। প্রেমে-বাঁধা-পড়ে-যাওয়া ঈশ্বরের মধ্যে ফুটে ওঠে এক আশ্চর্য অসীম-সীমার একতা: যিনি সমগ্র বিশ্বকে ধারণ করেন, তিনি এখন এক মায়ের কোলে শুয়ে আছেন; যিনি কালাতীত, তিনি এখন সময়ের স্নেহে আবদ্ধ।

প্রেম এই অসীমকে সীমায় নামায়, কিন্তু তাতে ঈশ্বরত্ব লুপ্ত হয় না; বরং আরও সহজে, আরও ঘনিষ্ঠভাবে প্রকাশিত হয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্ব এই প্রেমকে দেখে মাধুর্য-রসের দৃষ্টিতে—যেখানে ঐশ্বর্য গোপন থাকে, আর প্রকাশ পায় ঈশ্বরের হৃদয়।

যশোদার কোলে ঘুমন্ত কৃষ্ণ সেই রসেরই দৃশ্যমান প্রতীক—এ যেন হ্লাদিনী শক্তির খেলা, যেখানে ঈশ্বর নিজের প্রেমশক্তিতে মোহিত হয়ে শিশুরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। এখানে কৃষ্ণ প্রভু নন, বরং প্রেমের আশ্রয়; আর তাঁর নিদ্রা মানে ঈশ্বরের আত্মসমর্পণ—ভক্তির অন্তহীন স্নেহের কাছে এক পরম শান্ত আত্মনিবেদন।

মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিতে, যশোদা ও কৃষ্ণের এই সম্পর্ক এক archetypal mother-child bond—মাতৃত্ব ও ঈশ্বরত্বের সেই আদিম প্রতিরূপ, যেখানে যত্ন, সুরক্ষা ও মমতার মধ্যে এক গভীর আধ্যাত্মিক বিনিময় ঘটে। শিশুকৃষ্ণের নিদ্রা এখানে কেবল শারীরিক বিশ্রাম নয়; এটি আত্মার বিশ্রাম, সেই মুহূর্ত যখন চেতনা নিজের মধ্যেই শান্তিতে লীন হয়। আর যশোদার মাতৃস্নেহ সেই আশ্রয়—চেতনার কোমল কোলে আত্মার বিশ্রামের স্থান।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এটি এক archetype of divine intimacy—চেতনা যখন নিজেরই আত্মপ্রকাশে বিশ্রাম খোঁজে। মা ও শিশুর সম্পর্ক মানুষের মনের গভীরতম শান্তি-অভিজ্ঞতার প্রতীক; শিশুর নিদ্রা সেখানে আত্মার নিশ্চিন্ত শরণ, আর মায়ের লালন সেই চেতনার পরম নিরাপত্তা।

ফ্রয়েড এই দৃশ্যকে বলতেন “return to the primal comfort”—আত্মার সেই আদি আশ্রয়ে প্রত্যাবর্তন, যেখানে সকল বিভাজন ঘুচে যায়। আর ইয়ুং বলতেন—“the Self embracing its own image in maternal love”—অর্থাৎ, স্ব-সত্তা নিজের প্রতিচ্ছবিকে মাতৃপ্রেমে আলিঙ্গন করছে।

যশোদার কোলে ঘুমন্ত কৃষ্ণ কেবল ধর্মীয় চিত্র নয়; এটি মানুষের অন্তর্জগতে নিহিত এক divine archetype—যেখানে চেতনা ও আত্মা, ঈশ্বর ও ভক্ত, মা ও শিশু—সব মিলেমিশে এক হয়ে যায়, এক পরম শান্তির প্রতীক রূপে।

“ভগবান ঘুমিয়ে পড়েন” মানে ঈশ্বরের জগৎ থেকে সরে যাওয়া নয়; বরং এটি সেই মহামুহূর্ত, যখন বিশ্বচেতনা নিজের প্রেমে শান্ত হয়ে যায়। অসীম শক্তি সীমার কোলে বিশ্রাম নিচ্ছে—এই চিত্রই লীলার গোপন তত্ত্ব। চেতনার পরম পরিণতি হলো বিশ্রাম, আর সেই বিশ্রামই প্রেম।

এই এক দৃশ্যে ভারতীয় দর্শনের সমস্ত ধারার সমন্বয় দেখা যায়—অদ্বৈতের ঐক্য, যেখানে সব ভেদ মুছে যায়; বিশিষ্টাদ্বৈতের অন্তর্যামিত্ব, যেখানে ঈশ্বর জীবের ভেতরে বিরাজমান; কাশ্মীর শৈব দর্শনের চিত্‌-বিমর্শ, যেখানে চেতনা নিজের প্রতিফলনে আনন্দিত; আর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবের মাধুর্য, যেখানে ঈশ্বর নিজেকে প্রেমে বিলিয়ে দেন—সবই এই এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে।

যশোদার কোলে ঘুমন্ত কৃষ্ণ সেই এক ব্রহ্ম, যিনি প্রেমের আহ্বানে নিরাকার থেকে রূপবান হয়েছেন, আর রূপের মধ্যেই নিজের নিরাকারত্বের আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন। তাই এই পঙ্‌ক্তি কেবল একটি ভক্তিমূলক কবিতা নয়; এটি এক দার্শনিক উপনিষদ, যেখানে চেতনা প্রেমে বিশ্রাম নেয়, আর প্রেম হয়ে ওঠে চেতনার পরম প্রকাশ।

যশোদার দোলনা কেবল মাতৃত্বের দোলনা নয়—এটি ব্রহ্মের নিজস্ব হৃদয়, যেখানে ঈশ্বর নিজেকেই ঘুম পাড়ান; আর প্রেমের সেই নিঃশব্দ ছন্দে সমগ্র সৃষ্টি লীন হয়ে যায় এক গভীর, চিরন্তন শান্তিতে।

“কৌন কেহতা হ্যায় ভগবান নাচতে নহিঁ, গোপিয়োঁ কি তরহ তুম নাচতে নহিঁ”—এই পঙ্‌ক্তিটি ভারতীয় ভক্তি-চেতনার এক মহামন্ত্রের মতো, যেখানে এসে কবিতার সুর ও দর্শনের গভীরতা একাকার। প্রথম দর্শনে এটি বৃন্দাবনের সেই অনন্ত রসলীলার কথা মনে করায়—যেখানে কৃষ্ণ অসংখ্য গোপীর সঙ্গে নৃত্য করছেন, প্রেম ও আনন্দের অপরূপ ছন্দে। কিন্তু দর্শনের স্তরে এই “নাচ” বাহ্যিক গতি নয়; এটি চেতনার মহা-নৃত্য, সেই অন্তর্লীলার প্রতীক, যেখানে অসীম প্রেম নিজেকে অসংখ্য রূপে প্রকাশ করে।

এই “নৃত্য” মানে চেতনার আত্মপ্রকাশের ছন্দ—যেখানে স্থিরতা গলে গিয়ে সৃষ্টির গতি জন্ম নেয়। অসীম যখন সীমার মধ্যে খেলে, নিরাকার যখন রূপের আনন্দে নিজেকে প্রকাশ করে, তখনই লীলা শুরু হয়; আর সেই লীলাই জগতের নৃত্য, চেতনার নৃত্য। এ যেন পরম ব্রহ্ম নিজের আনন্দে নেচে উঠছেন, যেমন শৈবদর্শনে বলা হয়—“নৃত্যন্তং দেবম্‌”—নৃত্যরত দেবতা। এখানেই সৃষ্টি আর পরমার্থ একে অপরের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, এই নাচ হলো চিত্‌-আনন্দের স্পন্দন, সেই চিরন্তন প্রক্রিয়া যেখানে ব্রহ্ম নিজের মধ্যেই আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে প্রকাশিত হন। বিশিষ্টাদ্বৈত বলবে—এটি ঈশ্বর ও জীবের অন্তর্যামী সম্পর্কের প্রকাশ; ঈশ্বর প্রতিটি হৃদয়ে নৃত্য করছেন, প্রেমের মাধ্যমে। আর গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্ব এই দৃশ্যকে বলে রসানন্দের নৃত্য—যেখানে কৃষ্ণ নাচেন, কারণ প্রেম নিজেই আনন্দে কম্পিত।

“ভগবান নাচেন না” বলা মানে চেতনার ছন্দকে অস্বীকার করা। প্রকৃতপক্ষে, চেতনা নিজেই নৃত্য, আর নৃত্যই ঈশ্বরের প্রকাশ। বৃন্দাবনের রাসলীলা তাই কোনো পৌরাণিক দৃশ্য নয়; এটি চেতনার চিরন্তন লীলা—যেখানে অসীম প্রেম সীমার প্রতিটি হৃদয়ে নেচে ওঠে, আর প্রতিটি আত্মা কৃষ্ণের সেই ছন্দে অংশগ্রহণ করে, নিজেকে অনুভবের আনন্দে চিনে নেয়।

রসতত্ত্বের দৃষ্টিতে, এই নৃত্য আসলে রসানন্দ—অর্থাৎ চেতনার আত্মস্ফূর্ত আনন্দের প্রকাশ। রূপ গোস্বামী তাঁর ভক্তি-রসামৃত-সিন্ধু-তে যেভাবে বলেছেন, “আনন্দের মধ্যে প্রেমের কম্পনই রস”—এখানেই সেই তত্ত্ব জীবন্ত হয়ে ওঠে। কৃষ্ণ এই রসলীলায় রসরাজ, প্রেমের পরম আস্বাদক; তিনি প্রেমকে কেবল দেন না, নিজের মধ্যেই তার স্বাদ গ্রহণ করেন। গোপীগণ হলেন সেই আত্মারা, যারা প্রেমের তরঙ্গে নৃত্যরত—প্রত্যেকে ঈশ্বরচেতনার এক-একটি প্রতিচ্ছবি।

এই গোপীরা কোনো বহিরাগত চরিত্র নন; তাঁরা কৃষ্ণেরই অন্তঃশক্তি, তাঁর বিমর্শ-রূপা শক্তি—যার মাধ্যমে চেতনা নিজের প্রেমকে চিনে ফেলে। কৃষ্ণ তাঁদের সঙ্গে নাচছেন মানে, চেতনা নিজেরই প্রকাশিত রূপগুলোর সঙ্গে ছন্দে মিলছে; অসীম নিজেকে বহুরূপে অভিজ্ঞ করছে। তাই রসলীলা কোনো স্থানকালিক ঘটনা নয়, এটি এক অন্তর্জাগতিক প্রক্রিয়া—চেতনার আত্মোন্মোচন, আত্মার জাগরণ।

প্রতিটি গোপী এক-একটি হৃদয়, এক-একটি আত্মা, আর কৃষ্ণ সেই সর্বচেতন কেন্দ্র—যিনি সকলের হৃদয়ে নৃত্য করেন। তাই রসলীলা আসলে আত্মার অন্তর্গত নৃত্য, যেখানে প্রতিটি হৃদয় চেতনার স্পন্দনে দুলে ওঠে, আর প্রেম হয়ে ওঠে ব্রহ্মস্বরূপের সরলতম অভিব্যক্তি। এই নৃত্যে কোনো ভেদ নেই—ভক্ত ও ভগবান, এক ও বহু, প্রেম ও চেতনা—সব মিলেমিশে এক সুরে গলে যায়। এখানেই রসতত্ত্বের চরম ঘোষণা: প্রেমই চেতনার রূপ, আর চেতনারই পরম আনন্দ রসানন্দ।

অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায় এই নৃত্য আসলে চেতনার স্ব-লীলা, এক পরম আত্ম-অভিজ্ঞতার উৎসব। এখানে কোনো “দ্বিতীয়” সত্তা নেই—শুধু এক ব্রহ্ম, যিনি নিজের মধ্যেই বহুতার স্বাদ নিচ্ছেন। এই বহুত্ব কোনো বিভাজন নয়, বরং তাঁরই আনন্দের বিস্তার। যখন নিরাকার চেতনা রূপ ধারণ করে, তখনই সৃষ্টির ছন্দ জন্ম নেয়; স্থির চেতনা গলে যায় গতিতে, অনন্ত ধ্বনি রূপ নেয় নৃত্যের তালেই। এই নৃত্য তাই কোনো বাহ্য বা শারীরিক গতি নয়—এটি ব্রহ্মের আত্মস্পন্দন, সেই চিরন্তন আত্মবিস্তার, যেখানে একের ভেতর থেকে বহু, আর বহুতে ফিরে একের প্রকাশ ঘটে।

মহর্ষি উদ্দালক তাঁর পুত্র শ্বেতকেতুকে সৃষ্টিতত্ত্ব বোঝানোর সময় ব্রহ্মের সংকল্প বা ইচ্ছা হিসেবে উল্লেখ করেন, "একং বহু স্যাম্" (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৬/২/৩) অর্থাৎ, "আমি এক, বহু হব।" বা “আমি অদ্বিতীয় সত্তা (ব্রহ্ম), অনেক রূপে প্রকাশিত হব।”