দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ২৩



এই উক্তিটি ব্যাখ্যা করে যে, সৃষ্টির শুরুতে অদ্বিতীয় ব্রহ্ম (পরম সত্তা) বিদ্যমান ছিলেন। তিনি একাকী থাকতে চাননি, তাই তিনি নিজের ইচ্ছায় (সঙ্কল্পের মাধ্যমে) নিজেকে বহু জীব ও জগৎরূপে প্রকাশিত করার সংকল্প করলেন। এ তত্ত্ব বেদান্তের এই মূল কথাকে প্রতিষ্ঠা করে যে, জগতের সমস্ত বৈচিত্র্য (বহু) সত্ত্বেও, তার মূলে রয়েছে এক অদ্বিতীয় সত্তা (একম্)। অর্থাৎ, সমস্ত বৈচিত্র্যের উৎস এবং ভিত্তি হলেন সেই এক ব্রহ্ম।

আর এই ঘোষণাই হলো সৃষ্টির প্রথম নৃত্য, ব্রহ্মের প্রথম স্পন্দন। অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, বিশ্ব কোনো বহিরাগত বস্তু নয়; এটি চেতনার নিজের খেলা, নিজের ছন্দে নিজেরই অভিজ্ঞতা। যেমন সাগরের ঢেউ আলাদা নয় সাগর থেকে, তেমনি এই বিশ্বও ব্রহ্মেরই আত্মপ্রকাশ—চেতনার মহা-নৃত্যের এক অশেষ তরঙ্গ।

কৃষ্ণের নৃত্য কোনো ঐতিহাসিক লীলা নয়; এটি ব্রহ্মের আনন্দরূপ প্রকাশ—অসীম চেতনা যখন নিজের মধ্যেই সাড়া দেয়, তখনই সৃষ্টি হয় ছন্দ, সৌন্দর্য ও প্রেমের গতি। এই নৃত্যেই জগৎ জেগে ওঠে, এই নৃত্যেই আত্মা নিজের চিরন্তন রূপে নৃত্যরত থাকে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের আলোকে এই নৃত্য চিত্‌-বিমর্শ তত্ত্বের এক জীবন্ত ব্যাখ্যা। এখানে “চিত্‌” মানে পরম চেতনা, সেই শিবস্বরূপ, যিনি স্বয়ম্ভূ, নিরাকার, অচল; আর “বিমর্শ” মানে সেই চেতনার নিজেরই প্রতিফলনে সাড়া দেওয়া, নিজেকে নিজের মধ্যেই অনুভব করা। যখন চেতনা নিজেরই আনন্দে জেগে ওঠে, নিজেরই প্রেমে প্রতিধ্বনিত হয়, তখনই সৃষ্টি হয় প্রকাশ। এই প্রকাশ-প্রতিক্রিয়াই চিত্‌-বিমর্শ—যেখানে চেতনা নিজেকে চিনে, আর সেই চিনতেই বিশ্ব জন্ম নেয়।

এই তত্ত্বের দৃষ্টিতে, কৃষ্ণ হলেন প্রকাশ—সেই স্বয়ংপ্রভ চেতনা, যার দীপ্তি সমস্ত সত্তায় আলো জ্বালে; আর গোপীগণ হলেন বিমর্শ—সেই অনুভূতি, যা নিজেরই দীপ্তিকে স্পর্শ করে আনন্দিত হয়। কৃষ্ণ ও গোপীদের এই সম্পর্ক কোনো বহির্জাগতিক প্রেমকাহিনি নয়; এটি পরম ঈশ্বর ও তাঁর শক্তির পারস্পরিক আলিঙ্গনের প্রতীক, যেখানে “আমি” ও “তুমি”র ভেদ ঘুচে যায়, আর চেতনা নিজের প্রেমে প্রতিফলিত হয়।

এই নৃত্যে প্রতিটি পদক্ষেপ মানে এক-একটি সৃষ্টির জন্ম—চেতনার এক-একটি নতুন তরঙ্গ, অস্তিত্বের এক-একটি নতুন ছায়া। প্রতিটি দোলন যেন সেই মুহূর্ত, যখন প্রকাশ ও বিমর্শ একে অপরের মধ্যে গলে গিয়ে বিশ্বকে প্রাণ দেয়। তাই এই নৃত্য কেবল শরীরের গতি নয়; এটি চেতনার স্ব-আনন্দের ছন্দ, যেখানে অসীম নিজের সীমাকে ছুঁয়ে দেখে, আর সীমা অসীমে মিশে যায়।

কাশ্মীর শৈব মতের ভাষায়, এ নৃত্যই মহাশক্তির স্বচ্ছন্দ লীলা—চিত্‌-বিমর্শরূপা শক্তিঃ—চেতনা নিজের প্রতিচ্ছবিতে আনন্দিত হচ্ছে, নিজের ভেতরেই প্রেমের আলোয় জেগে উঠছে। এই প্রেমই বিশ্বরূপ নৃত্যের প্রাণ; প্রতিটি সৃষ্টির স্পন্দন, প্রতিটি জীবের বোধ আসলে সেই এক চেতনার কম্পন, যা কৃষ্ণ ও গোপীর নৃত্যে প্রতীকীভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে এই নৃত্য কেবল এক পৌরাণিক লীলা নয়, বরং ঈশ্বর ও জীবের অন্তর্যামী ঐক্যের দৃশ্যমান প্রতীক। রামানুজের তত্ত্ব অনুসারে, ঈশ্বরই পরম আত্মা (পরমাত্মা), আর সমগ্র সৃষ্টি—জীব ও জগৎ—তাঁর শরীররূপ। তাই ঈশ্বর কেবল কোনো দূরের, অলৌকিক প্রভু নন; তিনি প্রতিটি হৃদয়ের মধ্যে অন্তর্যামী, প্রতিটি প্রাণস্পন্দনে নৃত্যরত।

এই নৃত্যের মূলে আছে সেই চেতনা, যা প্রত্যেক জীবের ভেতর নিজেরই আনন্দে দোলে। জীব এখানে ঈশ্বরের দেহ, যার মাধ্যমে পরমাত্মা নিজেকে প্রকাশ করেন; আর ঈশ্বর সেই আত্মা, যিনি প্রতিটি জীবকে প্রাণ, চেতনা ও অর্থ দেন। কৃষ্ণের নৃত্য তাই ভক্ত ও ঈশ্বরের পারস্পরিক পরিচয়ের প্রতীক—যেখানে ঈশ্বর জীবের মধ্যেই নৃত্য করছেন, আর জীব ঈশ্বরের সেই নৃত্যে অংশ নিচ্ছে। এটি এক অন্তর্মিলনের ছন্দ, যেখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়, প্রেমিক ও প্রিয়, দাতা ও গ্রহীতা—সব ভেদ মুছে যায়, কেবল সম্পর্কের সুর বাকি থাকে।

বিশিষ্টাদ্বৈত তত্ত্বে এই নৃত্য হলো “অন্তর্যামী ব্রহ্মের জীবন্ত স্পন্দন”—ঈশ্বর প্রতিটি হৃদয়ে তাঁর শক্তির সঞ্চালনে আনন্দিত। কৃষ্ণের নাচ তাই কোনো সীমিত রাসলীলা নয়; এটি সেই চিরন্তন ঐক্যের গতি, যেখানে ঈশ্বর ও জীব একে অপরকে চিনে, অনুভব করে, প্রেমে মিলিত হন। যখন ভক্ত হৃদয় ঈশ্বরের প্রেমে দোলে, তখনই কৃষ্ণ সেই অন্তরে নৃত্য করেন—এবং এই নৃত্যই সৃষ্টির প্রাণ, জীবনের ছন্দ ও মুক্তির পথ।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবধারায় রাসলীলা হলো প্রেমের চূড়ান্ত মাধুর্যের প্রকাশ—যেখানে ঈশ্বর ও ভক্তের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই, কেবল প্রেমের স্পন্দন। কৃষ্ণ এখানে আর দূরের কোনো পরমেশ্বর নন; তিনি প্রেমের আস্বাদক, রসরাজ, যিনি নিজের হ্লাদিনী শক্তি—রাধা ও গোপীগণের মাধ্যমে—নিজের আনন্দকেই অনুভব করছেন। এই নৃত্যে ঈশ্বর ও ভক্ত পরস্পরকে চেনেন না, কারণ “চেনা” মানেই তো দূরত্ব; তাঁরা একে অপরের মধ্যে মিশে যান, যেমন সুর ও তাল এক ছন্দে মিলেমিশে যায়।

গৌড়ীয় তত্ত্ব বলে, প্রেমই ঈশ্বরের স্বরূপ, আর ভক্তি সেই প্রেমের প্রতিফলন। তাই কৃষ্ণ যখন গোপীদের সঙ্গে নাচছেন, তখন আসলে প্রেম নিজেই নিজের আনন্দে নৃত্য করছে। এখানে কোনো “আমি” বা “তুমি” নেই—কেবল এক ঐক্যবোধ, এক পরমানন্দময় কম্পন, যেখানে চেতনা নিজের প্রেমে নিমগ্ন। গোপীরা আলাদা সত্তা নন; তাঁরা কৃষ্ণেরই প্রতিচ্ছবি, তাঁরই প্রেমশক্তির তরঙ্গ। কৃষ্ণ তাঁদের মধ্যে নিজের আনন্দকে চিনে নিচ্ছেন—যেমন আলো নিজের প্রতিফলনে নিজেরই দীপ্তি দেখে।

এই নৃত্য তাই কোনো বাহ্য লীলা নয়, বরং চেতনার পরমানন্দের প্রতীক—যেখানে ভক্তি জ্ঞানে পরিণত হয়, আর জ্ঞান প্রেমে গলে যায়। এখানে কৃষ্ণের প্রতিটি পদক্ষেপ প্রেমের হৃদস্পন্দন, প্রতিটি গোপী সেই প্রেমের প্রতিধ্বনি। যখন প্রেম নিজেরই আনন্দে কম্পিত হয়, তখনই রাসলীলা ঘটে—এক এমন নৃত্য, যেখানে ঈশ্বর ও ভক্ত, চেতনা ও আনন্দ, রূপ ও নিরাকার—সব ভেদ বিলীন হয়ে যায়, কেবল প্রেমই থেকে যায় চিরন্তন বাস্তবতা হিসেবে।

এই নৃত্য কেবল ভক্তির আবেগ নয়—এটি এক সর্বব্যাপী দার্শনিক সত্যের প্রকাশ। যখন চেতনা নিজের প্রতিচ্ছবিতে আনন্দিত হয়, যখন সে নিজের ভেতরে প্রতিধ্বনি শোনে—তখনই সৃষ্টি জন্ম নেয়। সেই আনন্দ, সেই আত্ম-উল্লাসই কৃষ্ণের নৃত্য। এই নৃত্য আসলে ব্রহ্মের আত্মবিস্তার, যেখানে পরম চেতনা নিজেরই প্রেমে বিকশিত হয়ে অসংখ্য রূপে নিজেকে প্রকাশ করে।

“ভগবান নাচেন না” বলা মানে চেতনার ছন্দকে না বোঝা—যার মানে অজ্ঞতারই উচ্চারণ। কারণ চেতনা নিজেই ছন্দ, সৃষ্টি নিজেই নৃত্য। ব্রহ্ম স্থির নন; তাঁর স্থিরতাই স্পন্দিত, তাঁর নীরবতাই সুরের উৎস। কৃষ্ণের রাসলীলা সেই নিত্য নৃত্য, যেখানে ব্রহ্ম ও মায়া, চেতনা ও প্রেম, জ্ঞান ও রস—সব এক হয়ে যায়। এই নাচ তাই কোনো পৌরাণিক দৃশ্য নয়; এটি এক চিরন্তন তত্ত্বের রূপক—যেখানে ঈশ্বর ও আত্মা একে অপরের মধ্যে পরিপূর্ণ হয়, পৃথক থেকেও অভিন্ন, অভিন্ন থেকেও পৃথক। এই অচিন্ত্য ভেদাভেদই রাসলীলার প্রাণ—চেতনার সেই গোপন সংগীত, যেখানে প্রেমই দর্শন হয়, আর দর্শনই প্রেমের নৃত্যে বিলীন হয়ে যায়।

এরপর আসে উপদেশমূলক অংশ—“নাম জপতে চলো, কাম করতে চলো, হর সময় কৃষ্ণ কা ধ্যান করতে চলো”। এই আহ্বানটি আসলে এক সংহত সাধনার পথ, যেখানে ভক্তি ও কর্ম, ধ্যান ও দৈনন্দিন জীবন, আত্মসমর্পণ ও দায়িত্ব একসূত্রে গাঁথা। এটি সেই সমন্বয়, যেখানে আধ্যাত্মিকতা কোনো নিভৃত অভ্যাস নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনযাত্রার মধ্যেই প্রকাশ পায়।

এই অংশের মর্ম আসলে ভক্তিযোগ ও কর্মযোগের সংহতি, যা শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতার কেন্দ্রীয় তত্ত্ব। “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্‌” (২/৫০)—অর্থাৎ “কর্মফলের প্রতি আসক্তি বর্জনপূর্বক দক্ষতার সাথে কর্তব্যকর্ম করাই প্রকৃত যোগ”। এই এক বাক্যে কৃষ্ণ এক গভীর দার্শনিক সত্য প্রকাশ করেছেন। এখানে “যোগ” মানে কেবল ধ্যান বা নির্জন সাধনা নয়; বরং সেই অভ্যন্তরীণ ঐক্য, যেখানে বাহ্য ক্রিয়া ও অন্তরের স্মৃতি একে অপরের পরিপূরক। আর “কৌশল” মানে কোনো প্রয়োগধর্মী বুদ্ধি নয়, বরং এক চেতনাগত ভারসাম্য—যেখানে কর্মের মধ্যেও মন স্থিত, শান্ত ও ঈশ্বরস্মৃতিময়।

গীতার দৃষ্টিতে, কর্ম ত্যাগ করার বিষয় নয়, কারণ কর্মই জীবনের প্রকাশ; কিন্তু কর্মের আসক্তি, অর্থাৎ ফলপ্রত্যাশার জড়তা মনকে বন্ধনে ফেলে। যখন কর্ম ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা হয়, তখন সেই কর্ম মুক্তির মাধ্যম হয়ে ওঠে। এ-ই কর্মযোগের মর্ম—“কর্মফলত্যাগ” মানে কাজকে ফেলে দেওয়া নয়, বরং কাজের ফলের প্রতি নিজের মানসিক নির্ভরতা ত্যাগ করা। তখন কর্তা ‘আমি’ নয়, কর্তা ‘তিনি’—ঈশ্বর।

এই অবস্থায় মন থাকে “সাক্ষী”-র আসনে—কাজ হচ্ছে, কিন্তু আমি তার কেন্দ্রে নই; আমি শুধু মাধ্যম। গীতা বলে, “মামনুস্মর যুদ্ধ্য চ” (৮/৭)—অর্থাৎ “তুমি আমাকে স্মরণ করো এবং যুদ্ধ করো (অর্থাৎ কর্তব্যও সম্পাদন করো)।" এটি কোনো বিরোধ নয়, বরং ঐক্য—যেখানে স্মরণই কর্মের প্রাণ, আর কর্মই স্মরণের চলমান রূপ।

কৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ (যা তার চরম কর্তব্য বা কর্ম) ত্যাগ করতে বলেননি। বরং বলেছেন, মনকে আমাতে (ঈশ্বরে) রেখে তুমি তোমার কঠিনতম কর্মটি করো। এটি বোঝায় যে, পার্থিব কর্তব্য ত্যাগ না করেও আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। যখন কেউ ঈশ্বরকে স্মরণ করে কর্তব্য করে, তখন সে কর্মফলের প্রতি আসক্ত হয় না। কারণ, কর্মের ফল ঈশ্বরের পায়ে অর্পিত থাকে—যার মন ও বুদ্ধি আমাতে অর্পিত, সে নিঃসন্দেহে আমাকেই লাভ করবে। অর্থাৎ, এই উক্তিটি জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে শেখায় যে, সর্বদা ঈশ্বরকে স্মরণ করে (ভক্তি), পূর্ণ উদ্যম ও নিষ্ঠার সাথে নিজের কর্তব্য (কর্ম) পালন করে যেতে হবে।

নামজপ এই যোগের জীবন্ত অনুশীলন। নাম মানে কেবল উচ্চারিত শব্দ নয়; এটি চেতনার এক ধারা, যা মনের দিশা স্থির করে। যখন নাম স্মরণে থাকে, মন বিচ্ছিন্ন হয় না; যত কাজই করি—লেখা, পড়া, হাঁটাচলা, সেবা—ভেতরে এক অনাহত ছন্দ বা অনাদি নাদ (এক অভ্যন্তরীণ আধ্যাতনা (Internal Sound), যা চেতনার গভীর স্তরে বিদ্যমান) বাজতে থাকে। সেই ছন্দই যোগ, কারণ তা মনের ছন্দকে ঈশ্বরের স্মৃতির সাথে এক করে দেয়।

এখানেই মণিকাঞ্চনের উপমার তাৎপর্য—সোনা থেকে যত গহনাই রূপ নিক, তাদের আসল সত্তা সোনা-ই। রূপ বদলালেও সত্তা বদলায় না। তেমনি জীবনের অসংখ্য কর্ম—পরিবার, সমাজ, কর্তব্য, পেশা—সবই যেন গহনার মতো ভিন্ন ভিন্ন রূপ, কিন্তু তাদের অন্তরে থাকে একটিই অনন্ত সত্তা—ঈশ্বরস্মৃতি, নাম—যা চেতনার সোনালি ভিত্তি।

যখন সাধক এই অবস্থায় পৌঁছায়, তখন আর ধ্যান ও কর্ম আলাদা থাকে না। থালা ধোয়া, সন্তানকে কোলে নেওয়া, ক্লান্ত বিকেলে বিশ্রাম নেওয়া—সবই হয়ে ওঠে “নামময় ধ্যান”। কাজ তখন কেবল কাজ নয়, এক সজীব উপাসনা; ফল তখন কেবল প্রাপ্তি নয়, এক প্রসাদ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তখন জপমালার দানার মতো—প্রতিটি কাজ, প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি ভাব ঈশ্বরের নামেই বাঁধা পড়ে।

এই অবস্থাই “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্‌”-এর জীবন্ত প্রকাশ: চেতনা স্থির, মন স্মরণে নিমগ্ন, কর্ম প্রবহমাণ, আর জীবন হয়ে ওঠে এক চলমান ধ্যান—নীরব, দীপ্ত, ও ঈশ্বরময়।

নামের কার্যকারণ বোঝাতে বেদান্ত, ভক্তি, এমনকি কাশ্মীর শৈব দর্শন একই বিন্দুতে এসে ইশারা দেয়। অদ্বৈত বলে: ব্রহ্ম এক, নাম-রূপ তারই “উপাধি”—স্মরণ যখন ঘনীভূত হয়, মন উপাধির গোলকধাঁধা থেকে সরে সেই এক চেতনার দিকে ফিরে যায়। “নাম চিন্তামণিঃ কৃষ্ণশ্ চৈতন্যরসবিগ্রহঃ। পূর্ণঃ শুদ্ধো নিত্যমুক্তোঽভিন্নত্বান্নামনামিনোঃ।।”—অর্থাৎ, “ভগবানের নাম চিন্তামণির মতো অলৌকিক; নামই কৃষ্ণ, নামই চৈতন্যময় রসরূপ; নাম পূর্ণ, শুদ্ধ, চিরমুক্ত, কারণ নাম ও নামধারী কৃষ্ণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।”