দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ২৭



অভ্যাস (Abhyāsa) ও বৈরাগ্য (Vairāgya)—এই দুটি ধারণা শুধু শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা (৬.৩৫)-তেই বিধৃত নয়, এ দুই-ই সমগ্র যোগদর্শনের ভিত্তি। পতঞ্জলির যোগসূত্র-এ (১.১২) বলা হয়েছে—“অভ্যাসবৈরাগ্যাব্যাং তন্নিরোধঃ।” (যোগসূত্র ১.১২) অর্থাৎ, “অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তির নিবৃত্তি বা মনঃসংযম সম্ভব।” এখানেই এই দুই বৈশিষ্ট্যের দার্শনিক পটভূমি।

অভ্যাস (Abhyāsa) মানে কেবল যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তি নয়; এটি মনকে ধীরে ধীরে এক স্থির কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া। যেমন ধ্যানের সময় মন যদি চিন্তা, স্মৃতি বা কল্পনায় চলে যায়, তখন সেটিকে ধীরে ধীরে আবার শ্বাসে, মন্ত্রে বা ঈশ্বরচিন্তায় ফিরিয়ে আনা—এটাই অভ্যাস। প্রতি বার মন সরে গেলে তাকে ফেরানো মানেই নতুন স্নায়ুপথ তৈরি করা। আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের ভাষায় এটিই neuroplasticity—যেখানে মস্তিষ্ক পুনঃসংযোগ তৈরি করে, মনকে স্থিতি শেখায়।

অভ্যাস মানে “পুনরাগমন”—মন যত বার বিচলিত হয়, তত বার তাকে কেন্দ্রে আনা। এই পুনরাগমনের ধারাবাহিকতাই মনের ওপর সংযম সৃষ্টি করে। গীতার পরিভাষায়, এটাই “সততা”—অর্থাৎ ধৈর্য ও অধ্যবসায়।

অন্যদিকে, বৈরাগ্য (Vairāgya) মানে জগৎকে অস্বীকার করা নয়, বরং জগৎকে আসক্তি ছাড়া দেখা। পতঞ্জলি (যোগসূত্র ১.১৫) বৈরাগ্যের ব্যাখ্যা করেছেন—“দৃষ্টানুশ্রবিকবিষয়বিতৃষ্ণস্য বশীকৃতচিত্তস্য বৈরাগ্যম্।” (যোগসূত্র ১.১৫) অর্থাৎ, যে-ব্যক্তি দেখা ও শোনা সব ইন্দ্রিয়বিষয়ের প্রতিও অনাসক্ত, তার মনই প্রকৃত বৈরাগ্যে প্রতিষ্ঠিত। এই বৈরাগ্য মানে জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়, বরং সব অভিজ্ঞতাকে সমভাবে দেখা—যেখানে আনন্দ বা দুঃখ, লাভ বা ক্ষতি—কোনোটিই অন্তর্গত শান্তিকে নাড়াতে পারে না।

শ্রীকৃষ্ণ গীতায় (২.৫৮-৬১) বলেছেন, যে-যোগী ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মনকে স্থির করে, সে-ই প্রকৃত যোগী। সেখানে তিনি বলেছেন—“যদা সংহারতে চায়ং কূর্মোঽঙ্গানীব সর্বশঃ।” (গীতা ২.৫৮) অর্থাৎ, যেমন কচ্ছপ নিজের অঙ্গগুলো টেনে নেয় নিজের খোলসের ভেতর, তেমনি জ্ঞানী ব্যক্তি ইন্দ্রিয়গুলোকে নিজ চেতনায় ফিরিয়ে নেয়—এটাই বৈরাগ্যের লক্ষণ।

অভ্যাস ও বৈরাগ্য একে অপরের পরিপূরক—অভ্যাস মনকে কেন্দ্রে আনে, বৈরাগ্য মনকে ভারমুক্ত রাখে। একে তুলনা করা যায় শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো: অভ্যাস হলো “শ্বাস নেওয়া”—কেন্দ্রে ফেরা; বৈরাগ্য হলো “শ্বাস ছাড়া”—অনাসক্তি ও মুক্তি।

এই দুই একত্রে কাজ করলে মন ধীরে ধীরে শান্ত ও স্বচ্ছ হয়—চঞ্চলতা তার জায়গা ছেড়ে দেয় স্থিতিতে, আর স্থিতি থেকে জন্ম নেয় জ্ঞান। শ্রীকৃষ্ণ তাই বলেন, মনকে জয় করা মানে যুদ্ধ নয়, বরং এক দীর্ঘ ও স্নিগ্ধ প্রশিক্ষণ—যেখানে অভ্যাস মনকে ফেরায়, বৈরাগ্য মনকে মুক্ত করে।

এভাবে অভ্যাস ও বৈরাগ্য একে অপরের পরিপূরক। অভ্যাস মনকে একাগ্র করে, বৈরাগ্য মনকে বিশ্রাম দেয়। অভ্যাস ছাড়া বৈরাগ্য শুষ্ক হয়; বৈরাগ্য ছাড়া অভ্যাসে ক্লান্তি আসে। তাই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশটি ভারসাম্যের শিক্ষা—নিয়মিত চর্চা ও অনাসক্তি একত্রে রাখলেই মন ধীরে ধীরে নিজের পরমপ্রভু হয়ে ওঠে।

আধুনিক মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এই প্রক্রিয়াই ‘মাইন্ডফুলনেস’ বা ‘চিন্তা-প্রশিক্ষণ’ (cognitive training)-এর মূল ভিত্তি। মাইন্ডফুলনেস মানে হলো—মনকে বর্তমান মুহূর্তে ফিরিয়ে আনা, এখানেই থাকা, এই মুহূর্তের অভিজ্ঞতায় সম্পূর্ণ সচেতন থাকা।

যখন মন অতীতের কোনো স্মৃতিতে বা ভবিষ্যতের কোনো আশঙ্কায় ছুটে যায়, তখন সেটিকে নরমভাবে, বিনা রাগে ও বিনা বিচারমূল্যে আবার বর্তমান মুহূর্তে ফিরিয়ে আনা—এটাই অভ্যাস (abhyāsa)। এই অভ্যাসের ফলে মন ধীরে ধীরে শেখে স্থির থাকতে, নিজের অস্থিরতা চিনতে, এবং সেই অস্থিরতার মধ্যেও শান্তি খুঁজে নিতে।

অন্যদিকে, বৈরাগ্য (vairāgya) মানে হলো চিন্তা, অনুভূতি বা ঘটনার সঙ্গে অতিরিক্ত একাত্ম না হওয়া—অর্থাৎ, নিজের আবেগ বা চিন্তাকে দেখা, কিন্তু তাতে ডুবে না যাওয়া। যেমন আকাশে মেঘ আসে ও যায়, তেমনি মনের ভেতরে নানা ভাবনা ও অনুভূতি আসে ও চলে যায়—আর তুমি সেই আকাশের মতো স্থির থেকে কেবল সেগুলো দেখছো।

এই দুই নীতি—অভ্যাস ও বৈরাগ্য—একত্রে কাজ করলে মন ধীরে ধীরে স্থির হয়, শান্ত হয়। মানুষ তখন নিজের চিন্তা ও আবেগকে দমন না করে তাদের সঙ্গে সচেতনভাবে সহাবস্থান করতে শেখে। ফলস্বরূপ জন্ম নেয় মানসিক স্থিতি, অন্তরের শান্তি, আর ধীরে ধীরে উদ্‌ভাসিত হয় আত্মজ্ঞান—যা প্রাচীন যোগশাস্ত্রের উদ্দেশ্য, আবার আধুনিক মনোবিজ্ঞানেরও চূড়ান্ত লক্ষ্য।

এই এক শ্লোকেই শ্রীকৃষ্ণ পুরো যোগ-শিক্ষার সারসংক্ষেপ দিয়েছেন—মনকে জয় করা মানে জোর নয়, বরং ধৈর্য ও অনাসক্তির এক দীর্ঘ প্রশিক্ষণ; যেখানে মন নিজেই নিজের বন্ধু হয়ে যায়, শত্রু নয়।

গীতার এই শ্লোকের এই দুটি কনসেপ্ট—অভ্যাস ও বৈরাগ্য—এখানেই তার প্রয়োগ: নাম হলো অভ্যাস, ফল-ত্যাগ বৈরাগ্য। কাজের ভেতর ফলের নেশা যখন মাথা তোলে, নাম তখন মৃদু স্মরণ করায়—“ফল প্রসাদ”; সাফল্য এলেই নাম বলে—“এটাও দান”; বিপর্যয় এলে নাম জাগিয়ে দেয়—“এইটাও পথের অংশ।” ফলে উদ্‌বেগের গ্রাফ নিচু হয়—প্রসাদবুদ্ধির রৈখিকতা ভেতরের অস্থিরতাকে বাঁধতে শেখায়।

দর্শনের পরিভাষায়, এটি “অচিন্ত্য ভেদাভেদ”-এর নীরব রূপায়ণ। নাম জপে ঈশ্বর ও জগৎ পৃথক, কারণ আমি চাকরি করছি, ব্যাবসা সামলাচ্ছি, সন্তান মানুষ করছি; তবু অভিন্ন, কারণ এই সকল কাজের অন্তঃপ্রবাহ এক স্মৃতিতে বাঁধা—নামেই। কাশ্মীর শৈবের ভাষায়, প্রকাশ ও বিমর্শ—কর্ম ও স্মরণ—এখানে আলিঙ্গনে; প্রকাশ কর্মের বাহির, বিমর্শ নামের অন্তর, দুইয়ে মিলে বিশ্ব-স্পন্দন সম্পূর্ণ। অদ্বৈতের সন্নিধিতে, নাম স্মৃতি মনকে সাক্ষী-চেতনার দিকে ফেরায়; “আমি করছি” থেকে “হওয়া হচ্ছে”—এই ব্যাকরণ-পরিবর্তনে কৃতিত্বের বর্ম খুলে যায়, দায়িত্ব থেকে যায়, অহং সরে দাঁড়ায়। বৌদ্ধ অনিত্যতার বোধে, কাজ ও ফল—উভয়ই ক্ষণিক; নাম সেই ক্ষণিকতাকে আতঙ্ক নয়, স্বাধীনতা করে তোলে—যা আসছে তা আসুক, যা যাচ্ছে তা যাক; আমার কাজ স্মরণ রেখে সামঞ্জস্যে থাকা।

তাই “নাম জপতে চলো, কাজ করতে চলো”—এক কাঁধে দুই সেতার: একদিকে অন্তরের জপ, অন্যদিকে বহিরের কর্ম; মাঝে সুর বাঁধছে ঈশ্বরস্মৃতি। পথ চলতে চলতেই ধ্যান ঘটে—শ্বাসে নাম, পদক্ষেপে নাম, বিরতিতে নাম। ক্রমে দেখা যায়, কাজটাই প্রার্থনা, দায়িত্বটাই সেবা, আর জীবনটাই বড়ো এক জপমালা—যার প্রতিটি দানা হলো মুহূর্ত, প্রতিটি স্পর্শে উচ্চারিত নাম।

এখানেই লুকিয়ে আছে এক গভীর ঐক্যবোধ—যেখানে ভক্তি, জ্ঞান ও কর্ম আলাদা কোনো পথ নয়, বরং এক চেতনার তিনটি স্বরলিপি। ভক্তি সেখানে হৃদয়ের নিবেদন, জ্ঞান তার অন্তর্গত স্বরূপবোধ, আর যোগ সেই দুয়ের সুরমিলন—যেখানে জানা, ভালোবাসা ও করা একাকার হয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন—তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু মাম্‌ অনুস্মর যুদ্ধ্য চ। (গীতা ৮.৭)—অর্থাৎ, হে অর্জুন, সর্বক্ষণ আমাকে স্মরণ করো এবং তোমার কর্তব্যও সম্পাদন করো। এই একটি নির্দেশেই গীতার সমস্ত যোগতত্ত্ব একত্র হয়ে গেছে। “অনুস্মর”—এখানে ঈশ্বরস্মৃতি, যা ভক্তির সার; আর “যুদ্ধ্য চ”—এখানে কর্তব্য, যা কর্মযোগের মূল। স্মরণ যদি থাকে, কিন্তু কর্ম না থাকে, তবে জীবন স্থবির হয়ে পড়ে; কর্ম যদি থাকে কিন্তু স্মরণ না থাকে, তবে তা বন্ধন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যখন স্মরণ ও কর্ম একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়, তখনই কর্ম হয়ে ওঠে সাধনা, কর্তব্য হয়ে ওঠে উপাসনা।

এই অবস্থায় ভক্তি জ্ঞানে দীপ্ত হয়, কারণ ভালোবাসা তখন অন্ধ আবেগ নয়, তা হয়ে ওঠে জ্ঞানের আলোকিত উপলব্ধি—যে যাকে ভালোবাসে, সে তাকেই জানে। আবার জ্ঞান ভক্তিতে কোমল হয়, কারণ জ্ঞান তখন গর্ব নয়, প্রেমে স্নিগ্ধ বিনয়—যে যাকে জানে, সে তার প্রতিই নম্র হয়। এই দুইয়ের সংযোগেই জন্ম নেয় যোগ—যেখানে মন থাকে স্থির, হাত ব্যস্ত, হৃদয় নম্র, আর চেতনা একইসাথে শান্ত ও জাগ্রত।

এই যোগের মর্ম বোঝাতে শ্রীকৃষ্ণ আরও বলেছেন—“যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি” (গীতা ২.৪৮)—যোগে স্থিত হয়ে কর্তব্য সম্পাদন কর। অর্থাৎ, তোমার বাহ্যিক কর্ম যেন অন্তরের সমাধিকে ভঙ্গ না করে। আবার বলেছেন—“মদ্ভক্তো মাঁমভিযাতি” (গীতা ১৮.৫৫)—ভক্তির মাধ্যমে আমাতে প্রবেশ ঘটে; কারণ যে ভক্তির মধ্য দিয়ে কাজ করে, সে কর্মফল থেকে মুক্ত হয়।

এইভাবেই গীতার দর্শন আমাদের শেখায়, স্মরণ ও কর্ম—এই দ্বন্দ্ব নয়, বরং চেতনার দুই দিক। যখন মানুষ সেই ছন্দে পৌঁছে যায়, তখন নাম আর শব্দ থাকে না—হয়ে ওঠে উপস্থিতি; কর্ম আর বোঝা থাকে না—হয়ে ওঠে প্রসাদ; আর জীবন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনাপুঞ্জ থাকে না—হয়ে ওঠে এক চলমান ধ্যান, নীরব, দীপ্ত ও পরিণত। তখন শ্রীকৃষ্ণের আহ্বান আর কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের নির্দেশ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের ডাক—যেখানে স্মৃতি ও কর্ম, প্রেম ও জ্ঞান, ধ্যান ও দায়িত্ব—সব মিলেমিশে একীভূত হয়ে যায়, এবং জীবন নিজেই হয়ে ওঠে যোগের জ্যোতিষ্মান রূপ।

ভজনের এই শেষ পঙ্‌ক্তি—“যাদ আয়েগি উনকো কভি না কভি, কৃষ্ণ দর্শন তো দেনগে কভি না কভি”—অর্থাৎ, “যেদিনই হোক, কোনো একদিন তো তিনি আসবেনই; কৃষ্ণ একদিন-না-একদিন অবশ্যই দর্শন দেবেন।” এই একটি বাক্যের মধ্যে ভক্তির অন্তরতম আত্মবিশ্বাস ও প্রেমের পরিপূর্ণ দর্শন লুকিয়ে আছে। এখানে “আসা” বা “দর্শন” কোনো বাহ্যিক ঘটনা নয়; এটি এক অভ্যন্তরীণ প্রভাত, যেখানে হৃদয় সম্পূর্ণরূপে প্রেমে পরিপূর্ণ হলে চেতনা নিজেকে ঈশ্বররূপে চিনে ফেলে। ভক্তির ভাষায় ঈশ্বরদর্শন মানে ঈশ্বরকে দেখা নয়, বরং ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হওয়া; জ্ঞানের ভাষায় এটি আত্মপ্রকাশ, আর মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটি আত্মরূপান্তরের শীর্ষ অভিজ্ঞতা।

যখন বলা হয়, “যাদ আয়েগি উনকো কভি না কভি”—“কোনো একদিন তো তিনি আসবেনই”—তখন এখানে প্রকাশ পায় ভক্তের ধৈর্য ও বিশ্বাস। ঈশ্বরের আগমন সময়ের কোনো ঘটমান মুহূর্ত নয়; এটি ঘটে তখনই, যখন হৃদয় প্রস্তুত হয়।

“যমেবৈষ বৃত্তে তেন লভ্যঃ, তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনূং স্বাম্” (কঠ উপনিষদ ১.২.২৩)—মন্ত্রটি উপনিষদের এক গভীরতম সত্য প্রকাশ করে। এর সহজ অর্থ, “যাকে আত্মা নিজে গ্রহণ করে, কেবল তিনিই তাঁকে লাভ করতে পারেন; অন্য কেউ নয়।” এই বাক্যটিতে দুটি দিক আছে—আধ্যাত্মিক এবং মনস্তাত্ত্বিক—উভয়ই একে অপরকে গভীরভাবে পরিপূর্ণ করে।

প্রথমত, এখানে “আত্মা” শব্দটি কোনো সীমাবদ্ধ ব্যক্তিগত আত্মা নয়; এটি পরমাত্মা বা পরচেতনা—যাকে উপনিষদে বলা হয়েছে “অদ্বিতীয় ব্রহ্ম”। এই আত্মাকে জানা যায় না বাহ্যিক ইন্দ্রিয় বা বুদ্ধির দ্বারা; তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন তখনই, যখন মন প্রস্তুত, নির্মল ও নিরাসক্ত। অর্থাৎ, মানুষ যতই চেষ্টা করুক না কেন, ব্রহ্মকে দেখা বা বোঝা কোনো ইন্দ্রিয়গত প্রক্রিয়া নয়; এটি ঘটে কেবল তখন, যখন আত্মা নিজেই নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। তাই উপনিষদ বলে, ঈশ্বরপ্রাপ্তি চেষ্টার ফল নয়, কৃপা ও প্রস্তুতির মিলন।

দ্বিতীয়ত, “যমেবৈষ বৃত্তে”—মানে, যাঁর প্রতি আত্মা ‘বৃত্ত’ হয় বা মনোনিবেশ করে। এখানে “বৃত্ত” মানে মন বা হৃদয়ের প্রবণতা। যে-ব্যক্তি মনকে পরমাত্মার দিকে বারবার ফেরায়—অর্থাৎ, ধ্যান, প্রার্থনা, ভক্তি, বা প্রেমে নিজেকে কেন্দ্রীভূত করে—তার চেতনা ধীরে ধীরে পরম চেতনার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ফেলে। এই প্রস্তুত অবস্থাতেই “আত্মা তনূং স্বাম্ বিবৃণুতে”—আত্মা নিজেকে প্রকাশ করে। যেমন সূর্য সবসময়ই আলো দেয়, কিন্তু মেঘের ঘন পর্দা সরে গেলে তবেই আলো দেখা যায়, তেমনি আত্মা সবসময়ই আছে, কেবল মন পরিষ্কার হলেই তাঁর জ্যোতি অনুভূত হয়।