দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ২৯



এই ভজনের প্রতিটি স্তবক তাই ভক্তির এক-একটি ধাপ—মীরার আহ্বান থেকে শব্‌রীর নিবেদন, যশোদার স্নেহ থেকে গোপীদের নৃত্য—সব মিলিয়ে চেতনার এক সম্পূর্ণ যাত্রা। ঈশ্বর এখানে কোনো দূরের পরমাত্মা নন; তিনি অন্তর্জগতের নৃত্যময় উপস্থিতি, যিনি প্রেমে বাঁধা পড়েন, আহ্বানে সাড়া দেন, হাসেন, ঘুমোন, নাচেন—আর ভক্তের প্রতিটি অনুভূতির মধ্যে নিজেকে চিনিয়ে দেন।

“অচ্যুতম্ কেশবম্ কৃষ্ণ দামোদরম্” তাই কেবলই একটি ভজনগান নয়—এটি জীবনের উপাসনা, যেখানে কর্ম ধ্যান হয়ে যায়, প্রেম জ্ঞান হয়ে ওঠে, আর ঈশ্বর ও মানুষ এক অদ্বৈত আনন্দে মিশে যায়।

শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যানুযায়ী, অদ্বৈত বেদান্তে কৃষ্ণ হলেন ব্রহ্মের সগুণ প্রকাশ—অর্থাৎ সেই নিরাকার, নির্গুণ, অবিকৃত চৈতন্য, যা মায়ার আচ্ছাদনে ঈশ্বররূপে আত্মপ্রকাশ করে। এখানে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, অবশিষ্ট সমস্ত কিছু—জগৎ, জীব, রূপ, নাম—মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন আপাত-সত্য। শঙ্করাচার্য তাঁর গীতা-ভাষ্যে কৃষ্ণকে “জ্ঞাননিষ্ঠ উপদেষ্টারূপ ঈশ্বর” বলে স্বীকার করেছেন, যিনি জ্ঞানের মাধ্যমে জীবকে নিজের অন্তর্নিহিত ঐক্য-স্বরূপ উপলব্ধি করাতে চান। এই ঈশ্বর বা দামোদর কৃষ্ণ, তাই পরম ব্রহ্মের মায়িক প্রকাশ, যিনি জীবের অজ্ঞান দূর করার জন্য সগুণ রূপে অবতীর্ণ হন।

অদ্বৈত মতে, জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন; ভেদ কেবল অবিদ্যার কারণে। মায়া বা অবিদ্যা সেই দড়ি, যা পরম চেতনার কোমরে জড়ানো, যেমন দামোদর লীলায় কৃষ্ণ দড়িতে বাঁধা। এই দড়ি অজ্ঞানের বন্ধনের প্রতীক, যা ভক্তি ও জ্ঞানের দ্বারা ক্রমে ছিন্ন হয়। কিন্তু এই ভক্তি এখানে উদ্দেশ্য নয়, উপায়। শঙ্করাচার্য বলেন, “ভক্তি চিত্তশুদ্ধ্যৈ”—অর্থাৎ ভক্তি মনকে নির্মল করে, জ্ঞানলাভের উপযোগী করে তোলে। দামোদর লীলা সেই চিত্তশুদ্ধিরই কাব্যিক রূপ, যেখানে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম মনকে নিবেদনের মাধ্যমে অহংকারশূন্য করে তোলে, আর সেই শূন্য মনেই উদ্‌ভাসিত হয় ব্রহ্মজ্ঞানের আলো।

অদ্বৈত দৃষ্টিতে দামোদর কৃষ্ণ হলেন মায়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত সেই চেতনা, যিনি ভক্তের অনুরাগের প্রতিফলন হিসেবে প্রকাশ পেয়েছেন। ভক্ত যখন সগুণ ব্রহ্মকে—দামোদর কৃষ্ণকে—ভালোবাসেন, তখন তাঁর মন সংহত, স্থিতিশীল ও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। সেই মনই পরে নির্গুণ ব্রহ্মের উপলব্ধির জন্য প্রস্তুত হয়। ভক্তি এখানে জ্ঞানের সহচরী, “ঘটক শ্রুতি”—অর্থাৎ সংযোগকারী সূত্র, যা জীবের দ্বৈত অবস্থান থেকে অভেদ জ্ঞানের দিকে পরিচালিত করে। কৃষ্ণের দড়িতে বাঁধা থাকা এখানে রূপক—অসীম ব্রহ্ম নিজেকে মায়ার দ্বারা সীমাবদ্ধ করেছে যেন জীবের অভিজ্ঞতার স্তরে অবতীর্ণ হতে পারে; কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতাই আসলে আত্মপ্রকাশের লীলা, কারণ জ্ঞান লাভের সঙ্গে সঙ্গে সেই দড়িই বিলীন হয়ে যায়।

ঘটক শ্রুতি (Ghaṭaka Śruti) শব্দটি বৈদান্তিক দর্শনের এক গভীর ধারণা, বিশেষত বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। “ঘটক” মানে মিলনকারী বা সংযোগ স্থাপনকারী, আর “শ্রুতি” মানে বেদবাক্য বা বৈদিক উক্তি। সুতরাং ঘটক শ্রুতি হলো সেই শ্রুতিবাক্য, যা দুই বিপরীত ধরনের বেদবাক্যের মধ্যে সমন্বয় ঘটায়, অর্থাৎ ভেদ (পার্থক্য) ও অভেদ (অভিন্নতা)-এর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে।

বেদান্ত দর্শনের অন্যতম মৌল প্রশ্ন হলো—জীব (ব্যক্তিগত আত্মা) ও পরমাত্মা (ব্রহ্ম বা ঈশ্বর)-এর মধ্যে সম্পর্ক কী? তারা কি সম্পূর্ণ এক? না কি একেবারে পৃথক? না কি তারা একে অপরের মধ্যে কোনো বিশেষ ঐক্য বা নির্ভরতার সম্পর্কে আছে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে উপনিষদে পাওয়া শ্রুতিবাক্যগুলি নানা রকম ব্যাখ্যার জন্ম দিয়েছে। সেই ব্যাখ্যার ভিন্নতার মধ্য দিয়েই উদ্ভূত হয়েছে তিন শ্রেণির শ্রুতি—ভেদ শ্রুতি, অভেদ শ্রুতি, এবং ঘটক শ্রুতি।

১. ভেদ শ্রুতি—জীব ও ঈশ্বরের ভিন্নতা: “ভেদ শ্রুতি” বলতে সেই সমস্ত শ্রুতিবাক্য বোঝায়, যা জীব ও ঈশ্বরকে পৃথক সত্তা হিসেবে নির্দেশ করে। এগুলি বলে—ঈশ্বর সর্বব্যাপী, স্বয়ংপ্রভ, পরম কর্তা; আর জীব সীমাবদ্ধ, নির্ভরশীল ও জ্ঞানসীমাবদ্ধ।

উদাহরণ হিসেবে প্রায়ই উল্লেখ করা হয় ঋগ্‌বেদের উক্তি—“দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।” (১.১৬৪.২০)

এর অর্থ—“একই গাছে দুটি পাখি বসে আছে, এক পাখি ফল খাচ্ছে (ভোগ করছে), আর অন্যটি নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে (দর্শন করছে)।” এখানে ‘ফল-ভোগকারী পাখি’ হলো জীব—যে কর্মফলের ভোগী, আর ‘দর্শক পাখি’ হলো ঈশ্বর—যিনি নিত্য, অক্রিয় ও সর্বজ্ঞ। এই উপমায় ভেদ বা পার্থক্য স্পষ্ট।

এই ভেদ শ্রুতিগুলির উদ্দেশ্য হলো ঈশ্বর ও জীবের মধ্যে অধীনতা ও সম্পর্কের দিকটি বোঝানো—যেমন “নিত্যঃ নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম্”—শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৬.১৩)-এর এই উক্তিটি হিন্দু দর্শনের এক মৌল তত্ত্ব প্রকাশ করে। এর অর্থ—“তিনি (পরমাত্মা) সকল নিত্যদের মধ্যে নিত্যতম, এবং সকল চেতন সত্তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ চেতা।” এই একটি বাক্যে ঈশ্বর ও জীবের সম্পর্কের যে গভীর সত্য নিহিত আছে, তা ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, এখানে একদিকে ভেদ আছে, আবার অন্যদিকে ঐক্যও আছে।

“নিত্যঃ নিত্যানাং”—এই অংশে বোঝানো হয়েছে যে, জীবাত্মারাও নিত্য, কারণ আত্মা দেহের মতো নাশমান নয়। তবে ঈশ্বর সেই এক নিত্য সত্তা, যাঁর অস্তিত্বে সমস্ত জীবের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। জীবদের নিত্যতা ধার করা, কিন্তু ঈশ্বরের নিত্যতা স্বয়ংপ্রকাশিত। যেমন অসংখ্য দীপ নিজের আলো ছড়ায়, কিন্তু সব প্রদীপই জ্বলে এক প্রধান আগুন থেকে; আগুন নিভে গেলে দীপও নিভে যায়। তেমনি ঈশ্বর সেই মূল চিরন্তন সত্তা, যাঁর থেকে সকল আত্মার অস্তিত্ব বিকশিত।

“চেতনশ্চেতনানাম্”—এই অংশে বলা হয়েছে, ঈশ্বর সকল চেতনার উৎস। জীবেরা সচেতন, তারা চিন্তা করে, জ্ঞান লাভ করে, অনুভব করে—কিন্তু সেই চেতনা তাদের নিজস্ব নয়; ঈশ্বরের আলোয় তাদের চেতনা দীপ্ত। ভগবদ্‌গীতার (১৫.১৫) এই উক্তি— “সর্বস্য চাহং হৃদিসন্নিবিষ্টো মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানম্পোহনম্ চ”—অর্থাৎ, “আমি সকলের হৃদয়ে বিরাজমান; আমার থেকেই স্মৃতি, জ্ঞান ও বোধ উৎপন্ন হয়,”—শ্রীকৃষ্ণের এক গভীর তত্ত্ববাণী।

এখানে শ্রীকৃষ্ণ ঘোষণা করছেন যে, ঈশ্বর কেবল জগতের সৃষ্টিকর্তা নন, তিনি প্রত্যেক জীবের অন্তরাত্মা হিসেবেও বিরাজমান। তিনি কেবল বহির্বিশ্বের নিয়ামক নন, মানুষের চেতনারও উৎস। প্রতিটি জীবের অন্তরে যে স্মরণশক্তি, বোধশক্তি ও চিন্তাশক্তি কাজ করে, তার মূল শক্তি আসে সেই পরম চেতনা থেকে।

“সর্বস্য চাহং হৃদিসন্নিবিষ্টঃ”—এর অর্থ, “আমি প্রত্যেকের হৃদয়ে অবস্থান করছি।” এখানে “হৃদয়” মানে কেবল দেহের কোনো অঙ্গ নয়; এটি মানুষের অন্তঃচেতনা, যেখানে ইচ্ছা, বুদ্ধি ও অনুভূতির সংযোগ ঘটে। ঈশ্বর সেই চেতনার কেন্দ্রে উপস্থিত।

“মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানম্পোহনম্ চ”—অর্থাৎ, “আমার থেকেই স্মৃতি, জ্ঞান ও ভ্রম (ভুলে যাওয়া) সৃষ্টি হয়।” এই বাক্য মানবজীবনের প্রতিটি মানসিক প্রক্রিয়াকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে। আমরা যখন কিছু মনে রাখি, কিছু জানি বা কিছু ভুলে যাই—সবই সেই অন্তর্নিহিত চেতনার প্রবাহে ঘটে। ঈশ্বর এখানে কোনো বাহ্য নিয়ন্ত্রক নন; তিনি আমাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস।

দার্শনিকভাবে এটি বোঝায় যে ঈশ্বর অন্তর্নিহিত কারণ (antaryāmin)—তিনি প্রতিটি জীবের অন্তরে অবস্থান করে সেই জীবের চিন্তা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও ক্রিয়াকে পরিচালিত করেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদের (৩.৭.৩) এই মন্ত্রটি—“যঃ প্রানেন প্রানিতি, যম্প্রাণো ন বৈ প্রণিতি, এস ত আত্মান্যন্তর্যামী, অমৃতঃ।” অর্থাৎ, “যিনি প্রাণকে পরিচালনা করেন, অথচ প্রাণ তাঁকে পরিচালনা করতে পারে না—তিনি-ই অন্তর্যামী আত্মা, অমৃতস্বরূপ।”

এই বাক্যটি অন্তর্যামী ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত অংশের অন্তর্গত, যেখানে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য ব্যাখ্যা করছেন—ঈশ্বর কেবল বহির্জগতের নিয়ামক নন, তিনি প্রতিটি জীবের অন্তরে বাস করে প্রতিটি ক্রিয়া, গতি, জীবনশক্তি ও চেতনার পিছনে নিয়ন্ত্রণমূলক উপস্থিতি হিসেবে বিরাজ করেন।

এখানে “প্রাণ” শব্দটি শুধু নিঃশ্বাস নয়; এটি জীবনের সামগ্রিক প্রেরণাশক্তি—জীবনের গতি, অনুভূতি, চেতনা ও সঞ্চালনের প্রতীক। আমরা বাঁচি, চলি, ভাবি, অনুভব করি—সবই সেই প্রাণশক্তির দ্বারা; কিন্তু এই প্রাণশক্তি নিজে স্বাধীন নয়, এরও এক অভ্যন্তরীণ উৎস আছে, যিনি তাকে চালনা করেন। সেই অন্তর নিহিত চেতনা-শক্তিকেই বলা হয়েছে “অন্তর্যামী ঈশ্বর”—যিনি অন্তরে থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, অথচ স্বয়ং অনিয়ন্ত্রিত, স্বতন্ত্র ও অমৃত।

এই ধারণা “ইমানেন্ট ডিভাইন প্রেজেন্স” বা অন্তর্নিহিত ঈশ্বরচেতনার দর্শনকে প্রকাশ করে। ঈশ্বর এখানে কোনো দূরের দেবতা নন, বরং জীবনের মধ্যস্থ সেই অদৃশ্য কেন্দ্র, যা প্রাণ, মন, ইন্দ্রিয় ও চিন্তার গতিকে সমন্বয় করে রাখে।

যেমন দেহে রক্ত চলাচল বা নিঃশ্বাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে, অথচ আমরা সচেতনভাবে তাকে পরিচালনা করি না—তেমনি ঈশ্বরও নিঃশব্দে, অদৃশ্যভাবে প্রতিটি জীবনের ভিতরে ক্রিয়াশীল। এই কারণেই শাস্ত্র তাঁকে বলে “অন্তর্যামী”—অর্থাৎ, যিনি অন্তরে থেকে সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, কিন্তু নিজে কখনও বদ্ধ বা প্রভাবিত হন না।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এই ভাবটি সাক্ষীচেতনা (witness consciousness)-এর ধারণার সঙ্গে তুলনীয়—আমাদের সমস্ত চিন্তা, অনুভূতি ও ক্রিয়া চললেও, অন্তরের এক স্তরে থাকে এক নিঃশব্দ সচেতনতা, যা কেবল দেখে, কিন্তু জড়ায় না। উপনিষদের অন্তর্যামী সেই সাক্ষীচেতনারই মহাজাগতিক রূপ—যিনি সকলের ভিতরে, সকলের মাধ্যমে, তবু সকলের অতীত।

এই মন্ত্রটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—আমরা যাকে জীবন বলি, তার পিছনে কাজ করছে এক নীরব, সর্বব্যাপী উপস্থিতি; আমরা শ্বাস নিচ্ছি, চলছি, ভাবছি, কিন্তু সেই সব কিছুর মধ্যে ঈশ্বরেরই নিঃশব্দ স্পন্দন প্রবাহিত। তিনিই প্রাণকে চালান, কিন্তু কোনো প্রাণ বা শক্তিই তাঁকে চালাতে পারে না—কারণ তিনিই সর্বশক্তির উৎস, সর্বজীবনের অন্তর্গত আত্মা।

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই শ্লোকের ভাবটি মানুষের চেতনা ও অচেতনার ঐক্য নির্দেশ করে। আমাদের মনের ভেতর যত ভাবনা, স্মৃতি, অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়া জাগে—তার পেছনে আছে এক গভীর, নীরব উপস্থিতি। সেই নীরব উপস্থিতিকেই বলা হয় সাক্ষীচেতনা—এক এমন সচেতন অবস্থা, যা নিজে কিছু করে না, কিন্তু সব কিছুর সাক্ষী থাকে। আনন্দ, দুঃখ, চিন্তা বা বিভ্রান্তি—সবই আসে ও যায়, কিন্তু এই সাক্ষীচেতনা থেকে যায় অপরিবর্তিত।

আধুনিক মনোবিজ্ঞানে একে বলা হয় pure awareness বা চেতনার ক্ষেত্র (field of consciousness)। এটি এমন এক অভ্যন্তরীণ স্তর, যেখানে সমস্ত চিন্তা, অনুভূতি ও মানসিক ক্রিয়ার জন্ম হয় এবং লয়ও ঘটে। যেমন আকাশে মেঘ আসে ও যায়, কিন্তু আকাশ থাকে অপরিবর্তিত; তেমনি চিন্তা, স্মৃতি, অনুভব—সবই আসে ও চলে যায়, কিন্তু চেতনার এই নীরব ক্ষেত্র অটুট থাকে।

শ্রীকৃষ্ণ এই চেতনার ক্ষেত্রের প্রতীক। যখন তিনি বলেন—“সর্বস্য চাহং হৃদিসন্নিবিষ্টো, মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানম্পোহনম্ চ”—তখন তাঁর অর্থ দাঁড়ায়: “আমি সেই অন্তর্নিহিত চেতনা, যেখান থেকে স্মৃতি জন্ম নেয়, জ্ঞান বিকশিত হয়, আর প্রয়োজনে ভ্রমও ঘটে।” অর্থাৎ, ঈশ্বর কোনো বহিরাগত শক্তি নন; তিনি আমাদের মনের গভীরে, সেই নিস্তব্ধ কেন্দ্রে অবস্থান করছেন, যেখান থেকে সব অভিজ্ঞতা উত্থিত হয়।

এইভাবে, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায়—ঈশ্বর বা শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন আমাদের অন্তর্গত সচেতনতারই নাম; তিনি সেই নীরব সাক্ষী, যিনি সব চিন্তার পেছনে আছেন, কিন্তু কখনও চিন্তায় আবদ্ধ হন না। তাঁকেই উপলব্ধি করা মানে নিজের গভীরতম চেতনার সঙ্গে একাত্ম হওয়া—যেখানে জ্ঞান, স্মৃতি, ভুলে যাওয়া, সবই এক ঐক্যবোধে মিলেমিশে যায়।

এই শ্লোকটি শেখায় যে, ঈশ্বর কেবল দূর আকাশের পরমেশ্বর নন; তিনি আমাদের হৃদয়ের মধ্যেই নীরবে অবস্থান করছেন—প্রতিটি চিন্তা, স্মৃতি ও বোধে তাঁরই ছায়া। যখন মানুষ এই অন্তর্যামী উপস্থিতিকে অনুভব করে, তখন জ্ঞান কেবল তথ্য থাকে না; তা হয়ে ওঠে প্রজ্ঞা—যেখানে জানা, জানন, ও জাননেয়, তিনই এক পরম চেতনায় মিলেমিশে যায়। অর্থাৎ, মানুষের চেতনাশক্তি, চিন্তা ও স্মৃতি সবই ঈশ্বরচেতনার প্রতিফলন।