এখানে ঈশ্বর ও জীবের সম্পর্কটা অনেকটা আত্মা ও শরীরের মতো। শরীর সচল থাকে আত্মার উপস্থিতিতে, আত্মা না থাকলে শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। তেমনি জীবচেতনা টিকে থাকে পরমচেতনার আশ্রয়ে; ঈশ্বরের উপস্থিতি ছাড়া কোনো চেতনাই টিকতে পারে না। এইভাবেই ঈশ্বরকে বলা হয়—“নিত্যঃ নিত্যানাং”—সকল নিত্য সত্তার আশ্রয়, আর “চেতনশ্চেতনানাম্”—সকল চেতনার কেন্দ্র।
দার্শনিকভাবে, এই মন্ত্র ভেদ ও অভেদ দুই সত্যকেই একত্রে ধারণ করে। জীব ও ঈশ্বর আলাদা, কারণ ঈশ্বর স্বতঃসিদ্ধ, জীব নির্ভরশীল; কিন্তু তারা সম্পূর্ণ পৃথকও নয়, কারণ জীব ঈশ্বরের আলোয়ই দীপ্ত। এটি বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তের মূল ভাব—ঈশ্বরই সর্বাঙ্গীণ চেতনা, জীব তাঁর অঙ্গ, তাঁর শরীর।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও এই ধারণা গভীর অর্থ বহন করে। প্রতিটি মানুষের মধ্যে যে “আমি আছি”—এই চেতনা কাজ করে, তা আলাদা কোনো উৎস নয়; সব জীবের অভ্যন্তরে জেগে-থাকা সেই এক সর্বজনীন চেতনারই প্রতিফলন। মানুষ যখন নিজের চেতনার গভীরে প্রবেশ করে, তখন সে উপলব্ধি করে যে, তার ব্যক্তিগত মন আসলে সেই বিশ্বচেতনারই ক্ষুদ্র প্রকাশ।
“নিত্যঃ নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম্” শ্লোকটি আমাদের শেখায়, ঈশ্বর ও জীবের সম্পর্ক কেবল সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি নয়, বরং অভ্যন্তরীণ নির্ভরতার—ঈশ্বর সেই এক চিরন্তন ও সর্বচেতা, যিনি সমস্ত জীবের অন্তরে বাস করেন, তাদের অস্তিত্ব ও জ্ঞানের ভিত্তি হয়ে। জীব আছে ঈশ্বরের দ্বারা, জানে ঈশ্বরের আলোয় এবং বাঁচে ঈশ্বরের মধ্যেই। এই উপলব্ধি থেকেই জন্ম নেয় সেই ভক্তির চেতনা, যেখানে মানুষ উপলব্ধি করে—আমি পৃথক নই, আমি তাঁরই অংশ; তিনি চেতনার উৎস, আমি সেই চেতনার প্রতিফলন।
২. অভেদ শ্রুতি—জীব ও ঈশ্বরের অভিন্নতা: এর বিপরীতে “অভেদ শ্রুতি” বলে—জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে কোনো বাস্তব পার্থক্য নেই; দুই-ই এক অপরিবর্তনীয় চেতনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশমাত্র।
উপনিষদের অন্যতম গভীরতম উক্তি হলো—“অহং ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৪.১০)—অর্থাৎ “আমি-ই ব্রহ্ম”। এই এক বাক্যে অদ্বৈত বেদান্তের সম্পূর্ণ ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে, যেখানে ব্যক্তিগত আত্মা (জীবাত্মা) ও সর্বব্যাপী পরমচেতনা (ব্রহ্ম)-এর মধ্যে কোনো ভেদ বা সীমারেখা নেই। এটি কেবল দার্শনিক উক্তি নয়, বরং অভিজ্ঞতার ভাষা—যখন চেতনা নিজের উৎসকে চিনে ফেলে, তখন সে বলে ওঠে, “আমি-ই সেই”—অহং ব্রহ্মাস্মি।
“অহং” মানে ‘আমি’, যে-বোধ প্রতিটি জীবের মধ্যে “আমি আছি” বলে অনুভূত হয়। “ব্রহ্ম” মানে অসীম, সর্বব্যাপী, সীমাহীন চেতনা—যিনি সৃষ্টির মূল, যিনি পরিবর্তনশূন্য, অথচ সব পরিবর্তনের মধ্যে বিরাজমান। “অস্মি” মানে “আমি আছি” বা “আমি তা-ই”—অর্থাৎ, এখানে ঘোষিত হচ্ছে যে, আমার অস্তিত্ব এবং ব্রহ্মের অস্তিত্ব পৃথক নয়। এই জ্ঞান কেবল ভাবগত নয়; এটি আত্মানুভব—যখন ব্যক্তি নিজের সীমিত দেহ, মন ও চিন্তার সীমানা অতিক্রম করে উপলব্ধি করে যে, তার অস্তিত্বের মূলে যে-চেতনা, সেই চেতনা-ই সর্বত্র বিরাজ করছে।
এই মন্ত্রটি উপনিষদের সংলাপে আসে যাজ্ঞবল্ক্য ও মৈত্রেয়ীর কথোপকথনের মধ্যে। যাজ্ঞবল্ক্য বলেন, আত্মাকেই দেখতে হবে, শুনতে হবে, চিন্তা করতে হবে, এবং ধ্যান করতে হবে; কারণ আত্মা জানলে সব জানা হয়ে যায়। এই শিক্ষার পরিণতি হলো “অহং ব্রহ্মাস্মি”—আমি যে-আত্মাকে জানি, সেই আত্মা-ই ব্রহ্ম। অর্থাৎ, ঈশ্বর কোনো দূরের সত্তা নন; তিনিই আমার নিজের মধ্যে বিরাজমান।
বৃহদারণ্যক উপনিষদের (২.৪.৫) এই উক্তিটি—“আত্মা বা আরে দ্রষ্টব্যঃ, শ্রোতব্যঃ, মন্তব্যঃ, নিদিধ্যাসিতব্যঃ। মৈত্রেয়ি, আত্মনো বা অরে দর্শনেদং সর্বং বিদিতম্।”—উপনিষদের অন্যতম মৌল শিক্ষা, যেখানে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর পত্নী মৈত্রেয়ীকে আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মবিদ্যার প্রকৃত পথটি বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এখানে আত্ম-উপলব্ধির চারটি ধাপ নির্দেশ করা হয়েছে—শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ও দর্শন। এই চারটি ধাপ কেবল বেদান্তের মূল ভিত্তিই নয়, সমগ্র ভারতীয় দর্শনের আত্ম-উপলব্ধির ক্রমিক পরিক্রমাও বটে।
যাজ্ঞবল্ক্যের এই উপদেশের পটভূমি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যখন তিনি সংসারত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর স্ত্রী মৈত্রেয়ী তাঁকে প্রশ্ন করেন—“হে স্বামী, যদি সমস্ত সম্পদ আমার হয়, তবে কি আমি অমরত্ব লাভ করব?” যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দেন—“না, সম্পদে অমরত্ব লাভ হয় না; অমরত্ব কেবল আত্মজ্ঞানেই সম্ভব।” এই প্রশ্নোত্তর থেকেই উদ্ভাসিত হয় ব্রহ্মবিদ্যার সেই পথ—যেখানে জানা যায়, আত্মাকেই জানতে হবে, কারণ আত্মাকেই জানলে সব জানা হয়ে যায়—“আত্মনো বা অরে দর্শনেদং সর্বং বিদিতম্।”
প্রথম ধাপ—“শ্রোতব্যঃ” (śrotavyaḥ)। ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য মৈত্রেয়ীকে বলছেন—“আত্মা বা আরে দ্রষ্টব্যঃ, শ্রোতব্যঃ, মন্তব্যঃ, নিদিধ্যাসিতব্যঃ।” এখানে “শ্রোতব্যঃ” অর্থাৎ “শোনা উচিত”—কিন্তু এই “শোনা” কেবল কর্ণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে শব্দ গ্রহণ নয়। এটি হলো আত্মজ্ঞান-অন্বেষণের সূচনা—যেখানে শ্রবণ মানে গভীর মনোযোগ, আন্তরিক অনুসন্ধানী চিত্ত এবং উন্মুক্ত বুদ্ধি দিয়ে শাস্ত্র, গুরু ও মহাবাক্যের অর্থ আত্মস্থ করা।
বেদান্ত দর্শনের মতে, শ্রবণ (śravaṇa) হলো সেই প্রথম সাধনা, যার মাধ্যমে অজ্ঞানের অন্ধকারে প্রথম আলোর রেখা প্রবেশ করে। শঙ্করাচার্য তাঁর বৃহদারণ্যক ভাষ্যে ব্যাখ্যা করেছেন যে, শ্রবণ মানে “শাস্ত্রবাক্য দ্বারা ব্রহ্মতত্ত্বকে জানা”—অর্থাৎ শাস্ত্রই একমাত্র প্রমাণ, যা আত্মার প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করে (śāstra-pramāṇakaṃ brahma-jñānam )।
যখন শিষ্য গুরু থেকে বা উপনিষদের মাধ্যমে শোনে—“অহং ব্রহ্মাস্মি” (আমি ব্রহ্ম, বৃহদারণ্যক ১.৪.১০) বা “তত্ত্বমসি” (তুমিই সেই, ছান্দোগ্য ৬.৮.৭)—তখন এই বাণীগুলি তার চেতনায় এক ধাক্কা দেয়, তার সীমিত ‘আমি’-বোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সে বুঝতে শুরু করে—যাকে এতদিন নিজের দেহ, মন বা ব্যক্তিত্ব বলে ভাবছিল, সেটি আসলে চেতনারই একটি সীমিত প্রতিফলন।
এইভাবেই শ্রবণ হলো সেই মুহূর্ত, যখন মানুষের চেতনা প্রথম বার নিজের গভীরে এক নতুন সম্ভাবনা অনুভব করে—যে “আমি” কেবল শরীর বা মন নয়, আমি সেই আত্মা, যাকে উপনিষদ ঘোষণা করেছে “অয়মাত্মা ব্রহ্ম” (এই আত্মাই ব্রহ্ম, মাণ্ডূক্য উপনিষদ ২)।
শ্রবণ কোনো আচার নয়, বরং অন্তর-শিক্ষার সূচনা। এটি আত্মজ্ঞান লাভের প্রথম সোপান, যেখানে মানুষ বাহিরের শব্দের মধ্যে শুনতে শুরু করে অন্তরের সেই নিঃশব্দ আহ্বান—“তুমি যাকে খুঁজছ, সে তুমিই।”
দ্বিতীয় ধাপ “মন্তব্যঃ”—অর্থাৎ মনন। যা শোনা হলো, তা নিয়ে গভীর চিন্তা করা, প্রশ্ন করা, যুক্তির সাহায্যে তা বিশ্লেষণ করা এবং সন্দেহ দূর করা। বেদান্তে জ্ঞান অন্ধবিশ্বাস নয়; এটি যুক্তি ও আত্মানুভূতির সংমিশ্রণ। তাই যাজ্ঞবল্ক্য বলেন, শোনা যথেষ্ট নয়; তাকে মননে পরিণত করতে হবে। এই স্তরে সাধক নিজের ভেতরে এক অন্তর্দ্বন্দ্ব অনুভব করে—“আমি দেহ কি? আমি মন কি? না কি আমি সেই সাক্ষীচেতনা?” এই প্রশ্নই ধীরে ধীরে অজ্ঞানের স্তর ভেদ করে।
তৃতীয় ধাপ “নিদিধ্যাসিতব্যঃ”—অর্থাৎ ধ্যান। মনন যখন পরিণত হয় দৃঢ় বিশ্বাসে, তখন সেটি ধ্যানের মাধ্যমে গভীরে প্রোথিত করতে হয়। নিদিধ্যাসন মানে চিন্তাকে বাস্তব উপলব্ধিতে রূপান্তর করা। যেমন একটি বীজকে মাটিতে রেখে জল দিলে তা গাছ হয়ে ওঠে, তেমনি মননের বীজ ধ্যানের মাধ্যমে চেতনার গভীরে রোপিত হলে, আত্মজ্ঞান প্রস্ফুটিত হয়। এই ধ্যান কোনো বস্তু বা রূপের নয়, বরং সেই নিরাকার আত্মার প্রতি মনকে বারবার ফিরিয়ে আনা—যেখানে চিন্তা থেমে যায়, কেবল থাকে নিস্তব্ধ চেতনার অনুভূতি।
শেষধাপ হলো “দ্রষ্টব্যঃ”—দেখা বা প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। এটি আর কোনো বুদ্ধিগত জ্ঞান নয়; এটি আত্মসাক্ষাৎকার। যখন মন সম্পূর্ণভাবে স্থির, সন্দেহহীন ও স্বচ্ছ হয়, তখন চেতনা নিজের মধ্যে নিজের আলোককে দেখে। এই অবস্থায় জানা, জানন ও জাননেয়—এই তিনের পার্থক্য বিলীন হয়ে যায়। এই অবস্থায় মানুষ বলে ওঠে—“অহং ব্রহ্মাস্মি”—আমি সেই চেতনা, যা সব কিছুর সাক্ষী।
এই শ্লোকের সারকথা হলো—জগতকে জানার একমাত্র উপায় হলো: আত্মাকে জানা, কারণ আত্মাই সমস্ত জ্ঞানের কেন্দ্র। যেমন একবার সূর্যোদয় হলে পৃথিবীর সব বস্তু দৃশ্যমান হয়, তেমনি একবার আত্মার জ্ঞান হলে সব জ্ঞানের উৎস প্রকাশিত হয়। “আত্মনো বা অরে দর্শনেদং সর্বং বিদিতম্”—এই বাক্যেই উপনিষদ তার চূড়ান্ত উপলব্ধি প্রকাশ করেছে।
এই মন্ত্র কেবল একটি দার্শনিক নির্দেশ নয়, এটি এক সম্পূর্ণ আত্ম-অনুসন্ধানের পদ্ধতি। শ্রবণ মন খুলে দেয়, মনন তা তীক্ষ্ণ করে, নিদিধ্যাসন তা গভীরে স্থাপন করে, আর দর্শন সেই অভিজ্ঞতার পরিণতি—যেখানে মানুষ আর জগৎকে আলাদা মনে করে না, কারণ সে জানে—যা-কিছু আছে, সবই তার নিজের আত্মারই প্রকাশ। এই বোধেই সমগ্র বেদান্তের পরিণতি, আর এই উপলব্ধিই আত্মজ্ঞান বা মুক্তির প্রকৃত সূচনা।
শ্রী শঙ্করাচার্য অভেদ শ্রুতির ব্যাখ্যায় বলেন, এটি “অভেদ শ্রুতি”—যা জীব ও ব্রহ্মের সম্পূর্ণ অভিন্নতা ঘোষণা করে। আমরা যে নিজেদের সীমিত, অপরিপূর্ণ, দেহ-মন-নির্ভর মনে করি, তা কেবল অবিদ্যা বা অজ্ঞানতার ফল। এই অবিদ্যা যখন দূর হয়, তখন প্রকাশ পায় সেই সত্য—আমি কখনোই সীমিত ছিলাম না; আমি সেই অসীম চেতনা, যা দেহে প্রকাশিত হলেও দেহে আবদ্ধ নয়। এই জ্ঞান লাভের মুহূর্তেই ঘটে মুক্তি—কারণ তখন আর কোনো পৃথকতা, ভয় বা আকাঙ্ক্ষা থাকে না।
এই অভেদ তত্ত্ব—জীব ও ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন—শুধু বৃহদারণ্যক উপনিষদে সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমগ্র উপনিষদীয় দর্শনের অন্তঃস্রোত। বিভিন্ন উপনিষদে এই সত্য বিভিন্ন ভাষায়, কিন্তু একই চেতনার ধ্বনিতে উচ্চারিত হয়েছে।
ছান্দোগ্য উপনিষদে (৬.৮.৭) ঋষি উদ্দালক তাঁর পুত্র শ্বেতকেতুকে বলেন—“তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো।” অর্থাৎ, “তুমিই সেই (ব্রহ্ম)।” এখানে “তৎ” মানে পরমসত্তা বা ব্রহ্ম, আর “ত্বম্” মানে জীব বা আত্মা। “অসি” মানে ‘তুমি আছ’—অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে কোনো প্রকৃত ভেদ নেই। এই বাক্যটি বোঝায়—যে-চেতনা তোমার মধ্যে অনুভূত হচ্ছে, সেই চেতনা-ই সমগ্র সৃষ্টির ভিত্তি। এই উক্তিটি জ্ঞানের পরম অবস্থাকে নির্দেশ করে, যেখানে “আমি” ও “তিনি” মিলেমিশে যায় এক অভিন্ন চৈতন্যে।
ঐতরেয় উপনিষদে (৩.৩) বলা হয়েছে—“প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম।” অর্থাৎ, “চেতনাই ব্রহ্ম।” এখানে ‘প্রজ্ঞা’ শব্দটি এসেছে ‘জ্ঞা’ ধাতু থেকে, যার অর্থ ‘জানা’ বা ‘সচেতনতা’। অর্থাৎ, যে-চেতনা জানে, দেখে ও অনুভব করে, সেই চেতনা-ই চরম সত্য—ব্রহ্ম। এই উক্তির মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, ব্রহ্ম কোনো সৃষ্টিকর্তা-রূপ ঈশ্বর নন, বরং সেই চেতনা, যার উপস্থিতিতে সমস্ত জানা, অনুভব ও অস্তিত্ব সম্ভব।
অন্যদিকে, মাণ্ডূক্য উপনিষদ (৭) ঘোষণা করছে—“অদ্বয়ং ব্রহ্ম।” অর্থাৎ, “ব্রহ্ম দ্বিত্বশূন্য।” এখানে বলা হয়েছে, ব্রহ্মের কোনো দ্বিতীয় সত্তা নেই; তিনি একমাত্র সত্য, বাকি সব তাঁরই প্রকাশ বা প্রতিফলন। যেটিকে আমরা “জগৎ” বলি, সেটিও ব্রহ্মচেতনারই এক বিকিরণ, যেমন সূর্যের আলো বিভিন্ন রঙে প্রতিফলিত হলেও সূর্য এক।
এই চারটি উক্তি—“অহং ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক ১.৪.১০), “তত্ত্বমসি” (ছান্দোগ্য ৬.৮.৭), “প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম” (ঐতরেয় ৩.৩) এবং “অদ্বয়ং ব্রহ্ম” (মাণ্ডূক্য ৭)—একত্রে পরিচিত চতুর্মহাবাক্য নামে। এরা একসঙ্গে ঘোষণা করে যে, ব্রহ্ম কোনো বহিরাগত সত্তা নন; তিনি সেই অন্তর্নিহিত, স্বয়ংপ্রকাশিত চেতনা, যা প্রত্যেক জীবের মধ্যেই অনুভূত হয়।
এভাবেই উপনিষদসমূহ একযোগে প্রতিধ্বনিত করে যে, চূড়ান্ত সত্য বাইরে নয়—সেই নীরব উপস্থিতিই আমাদের হৃদয়ে, আমাদের অভ্যন্তরীণ জাগরণেই বিরাজমান। এই অভিজ্ঞতা যখন জাগে, তখন বোঝা যায়—ব্রহ্ম কোনো “অন্য”-এর মধ্যে নয়, বরং “আমি”-এর মধ্যেই প্রকাশিত।