দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ৩১



মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, “অহং ব্রহ্মাস্মি” মানে একধরনের আত্ম-অতিক্রমী অভিজ্ঞতা (self-transcendent experience)—যেখানে ব্যক্তি নিজের ‘আমি’-চেতনা অতিক্রম করে এক মহাজাগতিক চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়। আব্রাহাম মসলোর ভাষায় এটি “peak experience”—এক পরম অভিজ্ঞতা, যেখানে ব্যক্তি অনুভব করে যে, তার অস্তিত্ব সীমিত নয়, বরং অসীম জীবনের ধারায় একীভূত। ধ্যানের গভীরে এই বোধ জাগে—আমি চিন্তা নই, অনুভূতি নই, শরীর নই; আমি সেই চেতনা, যিনি এই সব কিছুর সাক্ষী। এই অভিজ্ঞতাই “অহং ব্রহ্মাস্মি” বাণীর প্রকৃত অর্থ।

অদ্বৈত দর্শনের মতে, এই জ্ঞানই মুক্তি। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা নয়, কিন্তু আপেক্ষিক, আর জীব তো ব্রহ্মেরই প্রতিফলন। তাই শঙ্করাচার্য বলেছেন—“ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ”—ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ পরিবর্তনশীল, আর জীব আসলে ব্রহ্মই, অন্য কিছু নয়। এই উপলব্ধি ঘটে, যখন মানুষ নিজের গভীরতম সত্তার সঙ্গে একীভূত হয়—যেখানে জানা ও জানন, দর্শক ও দর্শন, ভক্ত ও ভগবান—সব এক হয়ে যায় সেই এক অনন্ত চেতনায়।

“অহং ব্রহ্মাস্মি” কেবল কোনো বুদ্ধিগত ঘোষণা নয়, এটি এক গভীর আত্মসাক্ষাৎকার—যেখানে মানুষ উপলব্ধি করে, যে-ঈশ্বরকে এতদিন বাইরে খুঁজছিল, তিনি আসলে তার নিজের চেতনার মধ্যেই সর্বদা বিরাজমান। এই বোধই মুক্তি, এই জ্ঞানই শান্তি, আর এই অভিজ্ঞতাই মানবজীবনের পরম পরিণতি।

ছান্দোগ্য উপনিষদে (৬.৮.৭) ঋষি উদ্দালক তাঁর পুত্র শ্বেতকেতুকে উপদেশ দিচ্ছেন—“তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো।” অর্থাৎ, “তুমিই সেই পরম সত্য।” এই উক্তিটি উপনিষদের অন্যতম মহাবাক্য, যা আত্মা ও ব্রহ্মের অভিন্নতাকে প্রকাশ করে। এর মধ্যে নিহিত আছে বেদান্ত দর্শনের মূল সার—যে-চেতনা আমাদের মধ্যে অনুভূত, সেটিই সমগ্র অস্তিত্বের চেতনা; জীব ও ব্রহ্ম এক।

এই উপদেশের প্রেক্ষাপট অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শ্বেতকেতু ছিলেন বেদবিদ্যায় পারদর্শী, কিন্তু সেই জ্ঞান ছিল গ্রন্থের, আত্মের নয়। তখন তাঁর পিতা উদ্দালক তাঁকে বলেন—“বাবা, তুমি যা শিখেছ, তা অনেক, কিন্তু সেই এক-কে কি জেনেছ, যাকে জানা মানে সব জানা?” এরপর তিনি উদাহরণ দেন—যেমন একটি মাটির পিণ্ড জানলে সমস্ত মাটির জিনিসের স্বরূপ জানা যায়, একটি সোনার পিণ্ড জানলে সমস্ত সোনার বস্তু বোঝা যায়, তেমনি যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তাঁর কাছে সমস্ত জগৎ জানা হয়ে যায়; কারণ জগৎ ব্রহ্মেরই প্রকাশ।

এই উপদেশের ধারাবাহিকতায় উদ্দালক বলেন—“সৎ এভ সোম্য ইদমগ্র আআসীত”—“হে সোম্য (শ্বেতকেতু), এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বে কেবল ‘সৎ’—অস্তিত্বই ছিল, একমাত্র পরম চেতনা।” সেই চেতনা থেকেই জগত উদ্ভূত হয়েছে। এই কথার পরে তিনি বলেন—“তৎ সৃষ্ট্বা তদেবানুপ্রাবিশৎ”—“তিনি (ব্রহ্ম) জগৎ সৃষ্টি করে তাতে নিজেই প্রবেশ করেছেন।” অর্থাৎ, সৃষ্ট জগৎ ও সৃষ্টিকর্তা আলাদা নয়; ঈশ্বর নিজেই বিশ্বরূপে প্রকাশিত।

এই ধারার চূড়ান্ত উপসংহার হলো—“তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো।” “তৎ” মানে সেই পরম সত্তা বা ব্রহ্ম, “ত্বম্” মানে তুমি, এবং “অসি” মানে আছ। এইভাবে “তত্ত্বমসি” মানে—“তুমি-ই সেই চেতনা, যে এই জগতের মূল, তুমি ও ব্রহ্ম আলাদা নও।” উদ্দালক এই বাক্য নয় বার উচ্চারণ করেন, প্রতি বার ভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে বোঝান যে, সমগ্র অস্তিত্বের ভেতরে একই সত্তা প্রবাহিত। যেমন নদীগুলি সমুদ্রে মিশে একাকার হয়, নাম ও রূপ হারিয়ে ফেলে, তেমনি জীবও ব্রহ্মের সঙ্গে একাকার—“নামরূপে বিবর্তিতানি”—জগতে নানা নাম ও রূপ আছে, কিন্তু আসলে তারা এক সত্তার প্রকাশ।

শঙ্করাচার্য এই বাক্যের ব্যাখ্যায় বলেছেন, “তত্ত্বমসি” হলো সেই জ্ঞানের বাণী, যা অজ্ঞানকে ছিন্ন করে। জীবের যে ‘আমি দেহ, আমি মন’ ভাব, তা ভ্রান্তি মাত্র। জ্ঞানলাভের মুহূর্তে সে বোঝে—আমি সেই চেতনা, যা সব কিছুর ভিতরে, সব কিছুর বাইরে; আমি ব্রহ্ম। এই উপলব্ধিই মুক্তি—“জীবব্রহ্মৈক্যবোধে মোক্ষঃ”—জীব ও ব্রহ্মের ঐক্য উপলব্ধিই মুক্তির স্বরূপ।

মনোবিজ্ঞানের আলোকে এই বাক্যটি আত্মসচেতনতার সীমা অতিক্রমের প্রতীক। সাধারণ মানুষ নিজেকে দেহ, চিন্তা বা সামাজিক পরিচয়ে চিহ্নিত করে; কিন্তু “তত্ত্বমসি” অভিজ্ঞতায় সেই সংকীর্ণ পরিচয় ভেঙে যায়। ব্যক্তি তখন উপলব্ধি করে—তার অস্তিত্ব কোনো পৃথক একক নয়, বরং এক সর্বজনীন চেতনার অংশ। একে আধুনিক ভাষায় বলা যায় self-transcendence বা cosmic consciousness—যেখানে ব্যক্তিগত ‘আমি’-চেতনা মিশে যায় অসীম চৈতন্যে।

“তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো” শুধু একটি বাক্য নয়; এটি মানবচেতনার চূড়ান্ত আহ্বান। এটি বলে—তুমি যে-সত্য খুঁজছ বাইরে, সে তোমার ভেতরেই আছে। তুমি কোনো ক্ষুদ্র, সীমিত সত্তা নও; তুমি সেই এক পরম চেতনারই প্রকাশ, যিনি জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের অন্তরালে আছেন। এই বোধ জেগে উঠলে, মানুষ আর আলাদা থাকে না—সে হয়ে ওঠে নিজেই সেই পরম সত্যের দীপ্ত প্রতিফলন।

এই শ্রুতিগুলিতে ঈশ্বর ও জীবের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই—দু-জনেই এক অপরিসীম চেতনার প্রকাশ। উপনিষদের এই অংশ থেকেই অদ্বৈত বেদান্ত বলে—জীব ও ব্রহ্ম এক, কেবল অজ্ঞানই তাদের ভেদরূপে প্রতীয়মান করে।

৩. ঘটক শ্রুতি—উপনিষদীয় দর্শনের একটি সূক্ষ্ম কিন্তু মৌলিক প্রশ্ন হলো—যদি শাস্ত্রে কখনো ভেদ (জীব ও ঈশ্বর পৃথক) এবং কখনো অভেদ (জীব ও ঈশ্বর অভিন্ন) দুই প্রকার উক্তি পাওয়া যায়, তবে এই দুই বিপরীত ভাবনাকে কীভাবে মিলিয়ে দেখা যায়? এই আপাত-বিরোধের সমাধান দিয়েছে ঘটক শ্রুতি—অর্থাৎ সেই শ্রুতিবাক্যসমূহ, যা ভেদ ও অভেদ উভয়ের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করে। “ঘটক” শব্দের অর্থই হলো সংযোগকারী—যা দুই বিপরীতকে একসূত্রে গাঁথে।

শ্রী রামানুজাচার্য তাঁর বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে এই ধারণাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, ভেদ ও অভেদ কোনো বিরোধ নয়, বরং দুই ভিন্ন স্তরের সত্য। বাস্তবতার দুটি মাত্রা আছে—একটি হলো পরমার্থিক (Absolute) স্তর, যেখানে ঈশ্বর সর্বাঙ্গীণ চেতনা; অন্যটি হলো আপেক্ষিক (Empirical) স্তর, যেখানে সেই চেতনার অঙ্গরূপে জীব ও জগৎ বিদ্যমান। জীব ও ঈশ্বর সম্পূর্ণ আলাদা নয়, আবার সম্পূর্ণ অভিন্নও নয়; জীব ঈশ্বরেরই অংশ বা শরীর, আর ঈশ্বর সেই অংশগুলির পরম আত্মা। এই সম্পর্ককে রামানুজ আখ্যা দিয়েছেন “শরীর-শরীরীভাব” (śarīra-śarīrī-bhāva)—যেমন শরীর আত্মা ছাড়া অর্থহীন, তেমনি আত্মাও শরীর ছাড়া প্রকাশিত হয় না। জীব হলো ঈশ্বরের শরীর, আর ঈশ্বর সেই শরীরের অন্তর্যামী আত্মা।

রামানুজ তাঁর শ্রীভাষ্য-এ (Brahma-sūtra-bhāṣya, ১.১.১ এবং ১.১.৪) এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে “যঃ প্রানেন প্রানিতি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩.৭.৩) মন্ত্রটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন—যিনি প্রাণকে পরিচালনা করেন, অথচ প্রাণ তাঁকে পরিচালনা করতে পারে না—তিনি-ই অন্তর্যামী ঈশ্বর। এর অর্থ, ঈশ্বর প্রত্যেক জীবের অন্তরে থেকে তাকে পরিচালনা করেন; জীব স্বাধীন বলে মনে করলেও তার অস্তিত্ব ও কর্ম আসলে সেই অন্তর্যামীরই অভিব্যক্তি।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রামানুজ “তত্ত্বমসি” বাক্যটির বিশেষ ব্যাখ্যা দেন। ছান্দোগ্য উপনিষদে (৬.৮.৭) উদ্দালক তাঁর পুত্র শ্বেতকেতুকে বলেন—“তত্ত্বমসি”—“তুমিই সেই ব্রহ্ম।” অদ্বৈত ব্যাখ্যায় এটি সম্পূর্ণ অভেদবোধক—অর্থাৎ, জীব ও ব্রহ্ম এক। কিন্তু রামানুজ বলেন, ঘটক শ্রুতির আলোকে এই উক্তির অর্থ ভিন্ন স্তরে ধরা উচিত। তাঁর মতে, “তুমিই সেই” মানে, তুমি সেই ব্রহ্মের দেহ, তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশস্বরূপ। তুমি ব্রহ্মের বাইরে নও, তাঁর মধ্যেই অন্তর্গত; কিন্তু তুমি তাঁর সমগ্র সত্তা নও। যেমন ঢেউ সমুদ্রের অংশ, কিন্তু সমুদ্রের সমান নয়—তেমনি জীব ঈশ্বরের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু ঈশ্বর অসীম ও সর্বাঙ্গীণ।

এই ব্যাখ্যায় রামানুজ ভেদ শ্রুতি (যেমন “দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া”—ঋগ্‌বেদ ১.১৬৪.২০, যেখানে দুটি পৃথক আত্মার কথা বলা হয়েছে) এবং অভেদ শ্রুতি (যেমন “অহং ব্রহ্মাস্মি”—বৃহদারণ্যক ১.৪.১০) উভয়কেই সত্য হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর মতে, জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে সম্পর্ক হলো অংশ-অংশী সম্পর্ক—যেখানে ভিন্নতাও আছে, আবার ঐক্যও আছে।

এইভাবে ঘটক শ্রুতি বেদান্তের দুই বিপরীত দিককে একত্রে ধারণ করে। অদ্বৈত বলে—সব অভিন্ন, দ্বৈত বলে—সব পৃথক; কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈত বলে—ঈশ্বর একমাত্র স্বাধীন বাস্তবতা, জীব ও জগৎ তাঁর গুণ বা বিশেষণরূপে বিদ্যমান। ভিন্নতা ঈশ্বরের প্রকাশের রূপ, ঐক্য তাঁর স্বরূপ।

ঘটক শ্রুতির তাৎপর্য এই যে, এটি উপনিষদের বহুমাত্রিক উক্তিগুলিকে সংঘর্ষে নয়, সমন্বয়ে পড়তে শেখায়। ভেদ ও অভেদ—দুই-ই সত্য, কারণ দুটোই ঈশ্বরের ভিন্ন স্তরের প্রকাশ: অভেদ নির্দেশ করে তাঁর সর্বব্যাপিতা, আর ভেদ প্রকাশ করে তাঁর অসীম বৈচিত্র্য। এই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গিই বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তের হৃদয়, যা বলে—“ঈশ্বরই এক, কিন্তু সেই একের মধ্যেই রয়েছে অগণিতের সুর।”

এই তিন প্রকার শ্রুতি মিলিয়ে বোঝা যায়—বেদান্ত কোনো একমাত্রিক দর্শন নয়; এটি বহুস্তরীয় সত্যের সমন্বয়। ভেদ শ্রুতি দেখায় পার্থক্যের বাস্তবতা, অভেদ শ্রুতি প্রকাশ করে চেতনার ঐক্য, আর ঘটক শ্রুতি দেখায় তাদের সংগতি।

অদ্বৈত দর্শনে এই তিন স্তর মিলে যায় পরম অভেদে—সবই ব্রহ্ম; দ্বৈত দর্শনে তারা পৃথক থাকে; কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতে এই দুইয়ের মধ্যবর্তী এক সমন্বয়—যেখানে ঈশ্বর সর্বব্যাপী পরমসত্তা, আর জীব সেই পরমসত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

ঘটক শ্রুতি আমাদের শেখায়—ভেদ ও অভেদ কোনো বিরোধ নয়; বরং একটিই সত্য, দুই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। যেমন সমুদ্র ও তরঙ্গ—তরঙ্গ সমুদ্র থেকে পৃথক মনে হয়, কিন্তু তার অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে সমুদ্রনির্ভর; তেমনি জীব ঈশ্বর থেকে আলাদা মনে হলেও, তার অস্তিত্ব ব্রহ্মের মধ্যেই নিহিত।

এইভাবে ঘটক শ্রুতি কাজ করে এক দার্শনিক সেতু হিসেবে। ভেদ শ্রুতি যেখান থেকে বলে জীব ও ঈশ্বর আলাদা, অভেদ শ্রুতি বলে তারা এক; আর ঘটক শ্রুতি বলে—এই দুই-ই সত্য, কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন স্তরে সত্য। জীব ঈশ্বর থেকে পৃথক নয়, আবার তাঁর সমানও নয়; জীব ঈশ্বরের দেহ, আর ঈশ্বর সেই দেহের আত্মা। যেমন শরীর আত্মাকে প্রকাশ করে, কিন্তু আত্মা ছাড়া শরীর অর্থহীন—তেমনি জীব ও ঈশ্বরও একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত।

এই ধারণার দার্শনিক তাৎপর্য বিশাল। এটি একদিকে দ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদের মধ্যে সমন্বয় ঘটায়, আর অন্যদিকে ভক্তি ও জ্ঞানের মধ্যে সেতুবন্ধন করে। ভক্তির দৃষ্টিতে ঈশ্বর ও জীবের মধ্যে প্রেম ও সম্পর্ক বজায় থাকে; জ্ঞানের দৃষ্টিতে তারা এক চেতনার প্রকাশমাত্র। ঘটক শ্রুতি এই দুই সত্যকে একই সূত্রে বেঁধে দেয়—ঈশ্বর ও জীব পৃথকও, আবার অবিচ্ছেদ্যও।

ঘটক শ্রুতি হলো সেই শ্রুতি, যা বেদান্তের ভেদ ও অভেদ দুই ভাবনাকে এক সুরে মিলিয়ে দেয়। এটি বলে—জীব ও ব্রহ্মের সম্পর্ক যেমন শরীর ও আত্মার সম্পর্ক: পৃথক বলে মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা এক অনন্ত জীবনের দুই দিক। বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে এই ঘটক শ্রুতিই সব বিরোধ দূর করে এক সংগতিপূর্ণ, প্রেমময় ও যুক্তিসম্মত ব্রহ্মদর্শনের ভিত্তি স্থাপন করে।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে দামোদর লীলা কোনো বাস্তব ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং চেতনার প্রতীকী নাট্যরূপ। কৃষ্ণের দড়িতে বাঁধা থাকা মানে চেতনার নিজস্ব মুক্ত প্রকৃতি অজ্ঞান ও কর্মের দ্বারা আবদ্ধ হওয়া। মা যশোদা এখানে মায়া বা প্রকৃতি—যিনি প্রেমের মাধ্যমে চেতনাকে বাঁধেন; কিন্তু তাঁর বাঁধনও আসলে মুক্তির প্রস্তুতি। ভক্তি তখন এক প্রাথমিক শুদ্ধি, যা জ্ঞানের আগমনের পূর্বসূচনা। তাই শঙ্করাচার্যের মতে ভক্তি কখনোই চূড়ান্ত নয়—এটি সোপান, যা জ্ঞানপথে উত্তরণ ঘটায়।