যেমন ভাগবতে মা যশোদার সমস্ত প্রচেষ্টা বৃথা যায়, যতক্ষণ না তিনি ক্লান্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন, ঠিক তেমনি জ্ঞানপথে জীবও মুক্ত হয় তখনই, যখন সে তার সব অহংকার, সব চেষ্টা, সব জ্ঞান-অর্জনের আকাঙ্ক্ষা বিলিয়ে আত্মার আসল স্বরূপে বিশ্রাম নেয়। কৃষ্ণের বাঁধন তাই মায়ার প্রতীক, আর তাঁর মুক্তি জ্ঞানের প্রতীক। এই কারণেই শঙ্করাচার্য সাকার উপাসনাকে অনুমোদন করলেও বলেন—“উপাসনা কার্যত সত্য, কিন্তু পারমার্থিকভাবে নির্গুণ ব্রহ্মই একমাত্র বাস্তব।”
অদ্বৈত বেদান্তে দামোদর তত্ত্ব চেতনার অভ্যন্তরীণ নাট্যরূপ—যেখানে ব্রহ্ম নিজেই মায়ার দড়িতে বাঁধা হয়ে জীবের অভিজ্ঞতা লাভ করে, আর জ্ঞানের আগমনে সেই দড়ি গলে যায়। দামোদর কৃষ্ণ এখানে প্রেমময় ঈশ্বর নন, বরং জ্ঞানের সহায়ক রূপে সগুণ ব্রহ্ম, যাঁর উপাসনা জীবকে প্রস্তুত করে সেই অবস্থার জন্য, যেখানে সমস্ত রূপ, নাম, প্রেম ও লীলা বিলীন হয়ে যায় এক অবিভক্ত চৈতন্যে—যেখানে না দড়ি আছে, না বাঁধন, কেবল এক নির্গুণ, অচঞ্চল, সর্বব্যাপী ব্রহ্ম।
বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে দামোদর তত্ত্বের ব্যাখ্যা এক গভীর ভক্তিমূলক ও সম্পর্কনিষ্ঠ দার্শনিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। রামানুজাচার্যের এই দর্শনে কৃষ্ণ কেবল জ্ঞানের প্রতীক নন; তিনি পরব্রহ্ম বিষ্ণু-নারায়ণের সর্বোচ্চ অবতার, যিনি অসীম গুণ, অনন্ত করুণা এবং সীমাহীন প্রেমের মূর্তি। এখানে ব্রহ্ম কেবল নিরাকার চেতনা নয়, বরং সাকার, গুণপূর্ণ এবং ভক্তের প্রতি স্নেহশীল ঈশ্বর—যিনি জীব ও জগৎ উভয়েরই অন্তর্যামী এবং যাঁর মধ্যে সমস্ত অস্তিত্ব একত্রিত।
রামানুজাচার্যের দর্শনে শেষ-শেষি ভাব (śeṣa-śeṣi bhāva) এমন এক গভীর ও স্নিগ্ধ সম্পর্ক, যা ঈশ্বর ও জীবের মধ্যে চিরন্তন সংযোগকে প্রকাশ করে। “শেষ” শব্দের আক্ষরিক অর্থ “যা অবশিষ্ট থাকে” বা “যা অন্যের জন্য বিদ্যমান”; আর “শেষি” মানে “যার জন্য তা বিদ্যমান”—অর্থাৎ যিনি আশ্রয়, যিনি প্রভু, যিনি উদ্দেশ্য। রামানুজের ব্যাখ্যায় জীব হলো ঈশ্বরের শেষ, আর ঈশ্বর সেই জীবের শেষি। এই সম্পর্ক এমন এক আধ্যাত্মিক পারস্পরিকতা, যেখানে জীব কখনোই ঈশ্বর থেকে পৃথক নয়, আবার ঈশ্বরের সমানও নয়; বরং তিনি ঈশ্বরের অংশ, তাঁর উদ্দেশ্য এবং তাঁরই মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ করে। এই ভাব কেবল দার্শনিক নয়; এটি এক অতল ভক্তিসংবেদন—যেখানে আত্মা নিজের অস্তিত্বকেই ঈশ্বরের সেবার মধ্যে উপলব্ধি করে।
রামানুজ বলেন, বাস্তবতা এক, কিন্তু সেই একত্ব “বিশিষ্ট”—অর্থাৎ নানা গুণ ও বৈশিষ্ট্য দ্বারা পরিপূর্ণ। এই কারণেই তাঁর দর্শন পরিচিত বিশিষ্টাদ্বৈত নামে, যার অর্থ “গুণবিশিষ্ট একত্ববাদ”। এখানে এক চূড়ান্ত বাস্তবতা আছে, কিন্তু সেই বাস্তবতা নির্জীব বা শূন্য নয়; বরং জীব (চিৎ), জগৎ (অচিৎ) ও ঈশ্বর (ঈশ্বর) এই তিনের একত্র সমন্বয়। চিৎ মানে সচেতন সত্তা—যে জানে, অনুভব করে, সিদ্ধান্ত নেয়; অর্থাৎ জীব বা আত্মা। প্রতিটি জীবই এই চেতনার এক ক্ষুদ্র প্রতিফলন, যেমন অসংখ্য স্ফুলিঙ্গ আগুন থেকেই উদ্ভূত হয়। অচিৎ মানে জড় বা অচেতন জগৎ—যা নিজ থেকে সচল নয়, কিন্তু ঈশ্বরের দ্বারা ধারণকৃত ও নিয়ন্ত্রিত। আর ঈশ্বর (Īśvara) হলেন সেই পরম চেতনা, যিনি চিৎ ও অচিৎ—উভয়েরই আশ্রয়, নিয়ন্তা ও অন্তর্যামী।
রামানুজ তাঁর শ্রীভাষ্য (১.১.১)-এ বলেন—“চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের শরীর, আর ঈশ্বর তাঁদের আত্মা।” অর্থাৎ, যেমন আত্মা দেহকে ধারণ করে, সচল রাখে ও তার উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে, তেমনি ঈশ্বর সমগ্র জীবজগৎকে ধারণ করেন, পরিচালনা করেন এবং তাঁর মধ্যেই তাদের অস্তিত্ব নিহিত। জীব ও জগৎ ঈশ্বরের বাইরে নয়, আবার তাঁরা ঈশ্বরের সমানও নয়—তারা তাঁর গুণ, তাঁর প্রকাশ, তাঁর শরীর।
এভাবেই প্রকাশ পায় শেষ-শেষি ভাবের মূল সত্য: জীব ঈশ্বরের জন্য বিদ্যমান (শেষ), আর ঈশ্বর জীবের আশ্রয় ও উদ্দেশ্য (শেষি)। জীবের সমস্ত কর্ম, বোধ ও অস্তিত্বের চূড়ান্ত মানে ঈশ্বরকেন্দ্রিক। এই ভাবকে রামানুজ আখ্যা দেন শরীর-আত্মা তত্ত্ব—যেমন দেহ আত্মার দ্বারা বাঁচে, তেমনি জীব ও জগৎ ঈশ্বরের দ্বারা বাঁচে। কিন্তু ঈশ্বর আবার সেসব সত্তার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হন, যেমন আত্মা দেহের মাধ্যমেই ক্রিয়া করে। এখানে দ্বৈততা ও অদ্বৈততা উভয়ই একত্রে প্রতিষ্ঠিত—ঈশ্বর ও জীব পৃথকও, আবার অবিচ্ছিন্নও।
এই ভাবের আধ্যাত্মিক রূপ হলো শরণাগতি (śaraṇāgati)—অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ। জীবের প্রকৃত ধর্ম হলো সেবা, কারণ সে ঈশ্বরের অংশ। যেমন ভগবদ্গীতা (১৮.৬৬)-তে কৃষ্ণ বলেন—“সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ, অহং ত্বা সার্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।” শ্লোকটির অর্থ বাহ্যভক্তি বা আচারিক ধর্মের সীমা অতিক্রম করে এক গভীর অন্তর্মুখী উপলব্ধির দিকে নির্দেশ করে। এই শ্লোক কৃষ্ণের মুখে উচ্চারিত হলেও, অদ্বৈত ব্যাখ্যায় এখানে “কৃষ্ণ” মানে কোনো বাহ্যিক দেবতা নন; তিনি সর্বব্যাপী আত্মচেতনার প্রতীক—যিনি প্রতিটি জীবের অন্তরে স্বয়ং বিরাজমান “সৎ-চিত্-আনন্দ” স্বরূপ ব্রহ্ম।
এখানে “সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য” অর্থ—সব দ্বৈত-বোধ, কর্তৃত্ববোধ, ধর্ম-অধর্মের পার্থক্যবোধ এবং নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা ভাবার অহংকার ত্যাগ করা। “ধর্ম” শব্দটি কেবল নীতির নয়, বরং কর্তব্যবোধের সেই কাঠামো—যা “আমি কর্তা”, এই ভ্রমের উপর প্রতিষ্ঠিত। অদ্বৈত মতে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই কর্তা-ভাব বজায় থাকে, ততক্ষণ মোক্ষ সম্ভব নয়। তাই কৃষ্ণ বলছেন, “সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য”—অর্থাৎ সব ভূমিকা, সব পরিচয়, সব কর্তব্য ও উপাধি ত্যাগ করো, কারণ এগুলো তোমার সত্য পরিচয় নয়।
এরপর “মামেকং শরণং ব্রজ”—এর অর্থ দাঁড়ায়, “আমার একাত্ম স্বরূপে আশ্রয় নাও।” এখানে “আমি” (মম) কোনো ব্যক্তিগত ঈশ্বর নয়; বরং সেই চূড়ান্ত আত্মা বা ব্রহ্ম—যিনি প্রত্যেক সত্তার অন্তরে একমাত্র সত্যস্বরূপ। শঙ্করাচার্য তাঁর গীতা-ভাষ্যে ব্যাখ্যা করেছেন—“মাম্” শব্দটি এখানে ‘নিরুপাধিক ব্রহ্ম’-কে নির্দেশ করছে, যিনি কর্ম, ধর্ম ও ফলের সীমা অতিক্রম করেছেন। এই “শরণাগতি” কোনো ভক্তিমূলক শারীরিক আশ্রয় নয়; এটি জ্ঞানগত আশ্রয়—আত্মনিষ্ঠা—অর্থাৎ নিজের প্রকৃত স্বরূপে অবস্থিত হওয়া।
শেষ অংশে—“অহং ত্বা সার্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি”—অদ্বৈত দৃষ্টিতে “পাপ” মানে নৈতিক অপরাধ নয়, বরং অজ্ঞান (অবিদ্যা)—যা জীবকে নিজের সত্য স্বরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। কৃষ্ণ এখানে আত্মার পক্ষ থেকে ঘোষণা করছেন—যখন তুমি এই একাত্ম চেতনার আশ্রয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন আমি (অর্থাৎ সেই আত্মচেতনা) তোমাকে সমস্ত অজ্ঞান থেকে মুক্ত করব; তুমি আর ভয় বা দুঃখ অনুভব করবে না, কারণ তখন “তুমি” আর “আমি” আলাদা থাকবে না।
অদ্বৈতের ভাষায়, এই শ্লোকটি হলো সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনের ও আত্মপ্রতিষ্ঠার বাণী। এখানে “পরিত্যাগ” মানে জগৎ-ত্যাগ নয়, বরং অহংকার ও কর্তা-ভাবের পরিত্যাগ। আর “শরণাগতি” মানে ঈশ্বরের প্রতি নির্ভরতা নয়, বরং নিজের প্রকৃত স্বরূপে স্থিত হওয়া; যেখানে জানা যায়—"নাহং কর্তা, নাহং ভোক্তা, (গীতা ও উপনিষদের দার্শনিক সারসংক্ষেপ) অহং ব্রহ্মাস্মি (বৃহদারণ্যক উপনিষদের মহাবাক্য)”। এখানে তিনটি প্রধান দার্শনিক স্বীকারোক্তিকে একত্রিত করে আত্মা (Self) এবং ব্রহ্ম (Ultimate Reality)-এর স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে—
আমি কর্তা নই। আমি কাজের ফল বা দায়িত্ব গ্রহণ করি না। জীবাত্মা (অর্থাৎ শরীর-মনযুক্ত আমি) নিজেকে কর্তা বলে মনে করে, কিন্তু শুদ্ধ আত্মা (Spirit) কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত এবং নির্লিপ্ত। এটি কর্তৃত্বের অহংকার ত্যাগ নির্দেশ করে।
আমি ভোক্তা নই। আমি সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি বা কর্মফলের ভোগকারী নই। জাগতিক অভিজ্ঞতাগুলি শরীরের মাধ্যমে ঘটে; আত্মা কেবল সাক্ষী বা দ্রষ্টা। এটি ভোগের আসক্তি ত্যাগ নির্দেশ করে।
আমিই ব্রহ্ম। এটি হলো মহাবাক্য। জীবাত্মার আসল পরিচয় শরীর বা মন নয়, বরং সে পরমাত্মা বা ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন। সমস্ত সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মাকে ব্রহ্মরূপে উপলব্ধি করাই চূড়ান্ত জ্ঞান।
এভাবে এটি সম্পূর্ণভাবেই জ্ঞানযোগের পথকে নির্দেশ করে। যখন একজন সাধক গভীরভাবে উপলব্ধি করেন যে, তিনি তাঁর দেহ-মন-বুদ্ধির দ্বারা কৃত কোনো কর্মের কর্তা নন, এবং সেই কর্মের ফলের ভোগকারীও নন, তখন তিনি তাঁর আসল স্বরূপ উপলব্ধি করেন। সেই উপলব্ধিই হলো—তাঁর ব্যক্তিগত আত্মা (জীবাত্মা) এবং জগতের মূল শক্তি (ব্রহ্ম) এক ও অভিন্ন। এটিই অজ্ঞান থেকে মুক্তি এবং মোক্ষ বা নির্বাণ লাভের উপায়।
গীতা (১৮.৬৬) তাই বলে—“সব পরিচয়, সব কর্তব্য ও ধর্ম ত্যাগ করে নিজের মধ্যকার পরম ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত হও; সেই চেতনার সঙ্গে এক হয়ে যাও, তাহলেই সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তি।” এভাবেই, কৃষ্ণের এই আহ্বান—“মামেকং শরণং ব্রজ”—পরিণত হয় আত্মানুভূতির সর্বোচ্চ মন্ত্রে: “নিজের মধ্যকার চেতনা-সত্তাকেই আশ্রয় করো, কারণ সেই চেতনা-ই তুমি, সেই ব্রহ্ম।”
শ্রীকৃষ্ণ এই শ্লোকের মাধ্যমে অর্জুনকে এবং সমস্ত জীবকে যে মূল বার্তাটি দিয়েছেন, তা হলো: "তুমি নিজেকে কর্তা, ধার্মিক বা সাধক মনে করে যে-সকল দায়িত্ব, ফলকামনা বা পদ্ধতি অনুসরণ করছ—সেই সমস্ত কিছু (ধর্ম) ত্যাগ করো। শুধু মনে রেখো, তুমি আমার অংশ এবং আমার অধীন। তুমি কেবল আমার একক আশ্রয়ে এসো (মামেকং শরণং ব্রজ)।" এর অর্থ কর্মত্যাগ নয়, বরং কর্মের প্রতি কর্তৃত্বের অহংকার এবং ফলের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করা। এটিই হলো প্রপত্তি বা চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ, যা সকল প্রকার বন্ধন ও পাপ থেকে মুক্তি দেয়।
এই শরণাগতিকেই রামানুজ জীবের পরম কর্তব্য হিসেবে দেখেছেন। যখন জীব নিজের অহং ত্যাগ করে ঈশ্বরের সেবায় নিবেদিত হয়, তখনই সে তার সত্য পরিচয় উপলব্ধি করে—সে আর কোনো স্বতন্ত্র কর্তা নয়, সে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যের ধারক মাত্র।
এই সম্পর্কেরই নাম শেষ-শেষি ভাব—এক অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্র, যেখানে ঈশ্বর প্রভু, জীব তাঁর দাস; ঈশ্বর আশ্রয়, জীব আশ্রিত; ঈশ্বর উদ্দেশ্য, জীব সেই উদ্দেশ্যের উপায়। শ্রীভগবদ্রামানুজ স্তোত্র ও গদ্যত্রয় রামানুজাচার্যের ভক্তি ও দর্শনের এমন এক সংহত প্রকাশ, যেখানে দার্শনিক সত্য ও হৃদয়ের ভক্তি একাকার হয়ে যায়।
এই দুই গ্রন্থে এক চিরন্তন ভাব প্রতিধ্বনিত হয়েছে—“শেষী সর্বলোকনাথঃ, শেষঃ তস্য দাসঃ”, অর্থাৎ, ঈশ্বর সমস্ত জগতের প্রভু, আর জীব তাঁর চিরদাস। জীবের আসল পরিচয় তাই সেবকস্বরূপ; তার অস্তিত্ব কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়, বরং ঈশ্বরের গৌরব ও প্রেমের প্রকাশের জন্য। যেমন সূর্যের দীপ্তি নিজের আলোকের জন্য নয়, বরং সেই আলো সূর্যেরই মহিমা প্রকাশ করে—তেমনি আত্মাও ঈশ্বরের দীপ্তিরই প্রতিফলন, তাঁর সৃষ্টিতে অনন্ত সেবার এক প্রকাশ।
শ্রীভগবদ্রামানুজ নামটি এখানে দুই অর্থে ব্যবহার হয়েছে। প্রথমত, “শ্রীভগবদ্” নির্দেশ করে সেই পরমেশ্বর নারায়ণকে, যিনি চিৎ (সচেতন সত্তা) ও অচিৎ (অচেতন জগৎ)—উভয়েরই আশ্রয় ও নিয়ন্তা; দ্বিতীয়ত, এটি স্বয়ং আচার্য রামানুজ-এর জন্যও ব্যবহৃত, যাঁকে তাঁর শিষ্য ও পরবর্তী আচার্যরা শ্রদ্ধাভরে “শ্রীভগবদ্রামানুজ”—অর্থাৎ “ভগবানের অনুগ্রহরূপ আচার্য”—বলে সম্বোধন করতেন; কারণ তাঁর জীবন ও শিক্ষা উভয়ই ঈশ্বরপ্রেম, প্রপত্তি (পূর্ণ আত্মসমর্পণ) ও দাসত্বের (সেবা) জীবন্ত প্রতীক।
এই ভাবের সর্বোচ্চ প্রকাশ দেখা যায় গদ্যত্রয় (Gadyatraya)-এ, যা বৈষ্ণব-দর্শনের অন্তর্গত—১১ শতকে শ্রীরামানুজাচার্য রচিত তিনটি সংস্কৃত প্রার্থনা—শরণাগতি গদ্যম্ (বিষয়: ভগবানের চরণে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের (শরণাগতি) ভক্তি নিবেদন), শ্রীরঙ্গ গদ্যম্ (বিষয়: শ্রীরঙ্গম মন্দিরে (বিষ্ণুমন্দির) ভগবানের প্রতি ভক্তি এবং আশ্রয় প্রার্থনা) এবং শ্রীবৈকুণ্ঠ গদ্যম্ (বিষয়: বৈকুণ্ঠে (বিষ্ণুর ধাম) ভগবানের চরণে আশ্রয় লাভের প্রার্থনা)।
শরণাগতি গদ্যম্-এ রামানুজ স্বয়ং ভক্ত আত্মার রূপে লক্ষ্মী-নারায়ণের যুগলচরণে আশ্রয় প্রার্থনা করেন—এই গ্রন্থটি আত্মসমর্পণ বা প্রপত্তি-র পূর্ণ প্রতীক।