দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ৩৩



শ্রীরঙ্গ গদ্যম্‌-এ তিনি ভগবান শ্রীরঙ্গনাথের অনন্ত কল্যাণগুণের বন্দনা করেছেন; এখানে ঈশ্বরের সৌম্যতা, করুণা ও সৌশীল্যের (বিনয়, শালীনতা, সরলতা, উত্তম চরিত্র, মধুর স্বভাব, উত্তম ব্যবহার) বর্ণনা হৃদয়গ্রাহী।

শ্রীবৈকুণ্ঠ গদ্যম্‌-এ মুক্তির চিত্রায়ণ রয়েছে—বৈকুণ্ঠে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে চিরন্তন সেবা ও আনন্দলাভ।

এই তিনটি গ্রন্থ বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শনের আধ্যাত্মিক ভিত্তিকে রস ও প্রেমে পূর্ণ করে তোলে। উপনিষদ ও ব্রহ্মসূত্র যেখানে জ্ঞানপথ নির্দেশ করে, সেখানে গদ্যত্রয় মুক্তির সহজ ও প্রেমপূর্ণ পথ দেখায়—প্রপত্তি বা সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের পথ।

শ্রীভগবদ্‌রামানুজ স্তোত্র ও গদ্যত্রয় কেবল রামানুজীয় ভক্তি-সাহিত্য নয়; এ এক পূর্ণ জীবনদর্শন—যেখানে ঈশ্বরই সর্বলোকনাথ, আর জীব তাঁর অন্তর্গত আত্মা, তাঁর প্রেমের প্রকাশ। এখানে দার্শনিক যুক্তি ও ভক্তির আর্তি মিলে সৃষ্টি করেছে এক অখণ্ড সুর—যেখানে আত্মা ঈশ্বরের মধ্যে নিবিষ্ট হয়ে বলে ওঠে, “শেষী সর্বলোকনাথঃ, শেষঃ তস্য দাসঃ।”

শেষ-শেষি ভাব—দর্শন ও ভক্তি, এই দুই ধারার মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে। দর্শনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ঈশ্বর-জীব সম্পর্কের অস্তিত্বগত (ontological) ভিত্তি—জীব ঈশ্বরনির্ভর, তাঁর অস্তিত্ব ঈশ্বরের অস্তিত্বের মধ্যেই নিহিত। আবার ভক্তিমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক প্রেমময় সম্পর্ক—যেখানে আত্মা নিজের স্বাধীনতা ত্যাগ করে ঈশ্বরের সেবায় পরিপূর্ণ হয়। এই সেবাই তার মুক্তি, এই প্রেমই তার ধর্ম।

রামানুজাচার্যের শেষ-শেষি ভাব কেবল এক তাত্ত্বিক ধারণা নয়, এটি এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা—ভক্তি ও জ্ঞানের একত্র দীপ্তি। এখানে আত্মা ও ঈশ্বরের সম্পর্ক কোনো কর্তৃত্ব বা অধীনতার নয়, বরং ভালোবাসা, নির্ভরতা ও ঐক্যের এক সূক্ষ্ম মেলবন্ধন। জীব ঈশ্বরের মধ্যে বাস করে, তাঁর দ্বারা টিকে থাকে এবং তাঁরই জন্য উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে—যেমন দীপের শিখা সূর্যের আলোকের প্রতি উৎসর্গিত হয়ে দীপ্ত হয়, কিন্তু নিজের দীপ্তির মাধ্যমেই সূর্যের জ্যোতিকে প্রতিফলিত করে। এই পরস্পর নির্ভরতা ও একাত্মতাই শেষ-শেষি ভাবের চিরন্তন তাৎপর্য, যা রামানুজ দর্শনের হৃদয়বিন্দু।

এই তত্ত্বের আলোকে দামোদর কৃষ্ণের লীলা এক অপূর্ব ব্যাখ্যা পায়। মা যশোদার হাতে কৃষ্ণের বাঁধা পড়া এখানে ঈশ্বরের সৌলভ্য—অর্থাৎ সহজলভ্যতা ও স্নেহশীলতার চিহ্ন। তিনি যিনি অসীম, সেই ঈশ্বর নিজেকে ভক্তের প্রেমে এমনভাবে নমিত করেছেন যে, তাঁর পরম ঐশ্বর্য লুকিয়ে যায় স্নেহের আলিঙ্গনে। বিশিষ্টাদ্বৈত মতে, ঈশ্বর কেবল সর্বশক্তিমান নন, তিনি ভক্তের নিকট স্নেহময়; তিনি কেবল কর্তা নন, প্রিয়জনও। এই লীলায় ঈশ্বরের “সৌলভ্য” ও “সৌম্যতা” একত্রে প্রকাশ পেয়েছে—তিনি সহজলভ্য, কারণ তাঁর স্বভাবই করুণা এবং তিনি সৌম্য, কারণ তাঁর ঐশ্বর্য প্রেমের আবরণে আবৃত।

ঈশ্বরের সৌলভ্য (Soulabhya) এক গভীর ভক্তিতাত্ত্বিক ধারণা, যার অর্থ—“সহজে লাভযোগ্যতা” বা “সহজে প্রাপ্ত হওয়ার স্বভাব।” শব্দটি এসেছে লভ্‌ ধাতু থেকে, যার অর্থ “লাভ করা”, আর “সৌলভ্য” মানে “সহজে লাভ করা যায় এমন অবস্থা।” সুতরাং, সৌলভ্য মানে সেই ঈশ্বরীয় গুণ, যেখানে পরমাত্মা—অসীম, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপী হয়েও—নিজেকে ক্ষুদ্র জীবের কাছে সহজ, স্নেহময়, ঘনিষ্ঠ ও প্রাপ্য করে তোলেন।

বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শনে শ্রীরামানুজাচার্য ঈশ্বরের কয়েকটি মৌলিক গুণ বর্ণনা করেছেন—পরত্ব (Paratva) অর্থাৎ সর্বোচ্চতা, সৌলভ্য (Soulabhya) অর্থাৎ সহজপ্রাপ্যতা, মাধুর্য (Mādhurya) অর্থাৎ প্রেমরূপ সৌন্দর্য এবং করুণা (Karunā) অর্থাৎ দয়া। এই সৌলভ্যই ঈশ্বরের করুণার প্রতিফলন—তিনি কেবল সৃষ্টিকর্তা নন, তিনি নিজেকে ভক্তের বন্ধু, সন্তান, প্রেমিক, এমনকি দাসরূপে প্রকাশ করেন।

ভগবদ্গীতার নবম অধ্যায়ের এই শ্লোকে কৃষ্ণ ঈশ্বরের সৌলভ্য বা “সহজপ্রাপ্যতা”-র সত্যটিই প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন—“সমোঽহং সর্বভূতেষু ন মে দ্বেষ্যোঽস্তি ন প্রিয়ঃ। যে ভজন্তি তু মাং ভকত্যা ময়ি তে তেষু চাপ্যহম্।।” অর্থাৎ, “আমি সকল জীবের প্রতি সমান; আমার কারও প্রতি রাগ নেই, কারও প্রতি বিশেষ প্রীতি নেই। কিন্তু যে ভক্তি সহকারে আমাকে ভালোবাসে, আমি তার হৃদয়ে বাস করি।”

এখানে প্রথমেই কৃষ্ণ ঘোষণা করছেন—“আমি সকল জীবের প্রতি সমান।” এর অর্থ, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে কোনো জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, অবস্থান বা যোগ্যতার পার্থক্য নেই। তাঁর অনুগ্রহ সূর্যের আলোর মতোই সবার জন্য সমানভাবে বিকশিত। কেউ যদি সূর্যালোকে মুখ ঘোরায়, তবে আলো তার গায়ে পড়ে না—এ দায় তো সূর্যের নয়। তেমনি ঈশ্বর সর্বত্র সমানভাবে বিরাজমান, কিন্তু মানুষ নিজের হৃদয় যত বিশুদ্ধ ও উন্মুক্ত করে, ততই তাঁর কৃপা অনুভব করতে পারে।

এরপর কৃষ্ণ বলেন—“ন মে দ্বেষ্যোস্তি ন প্রিয়ঃ”—“আমার কারও প্রতি দ্বেষ নেই, কারও প্রতি প্রিয়তাও নেই।” এর দ্বারা বোঝানো হয়, ঈশ্বর পক্ষপাতহীন। তিনি কারও প্রতি রাগ করেন না, আবার কোনো ভক্তকে অন্যের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন না। কিন্তু যাঁরা আন্তরিক ভক্তি দিয়ে তাঁকে ডাকে, তাঁদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আপনাআপনিই গভীর হয়ে ওঠে—যেমন চুম্বক কাছে আনা লোহার টুকরোকে টানে।

এই ভাবটি স্পষ্ট হয় পরবর্তী পঙ্‌ক্তিতে—“যে ভজন্তি তু মাং ভকত্যা ময়ি তে তেষু চাপ্যহম্।” অর্থাৎ, “যারা ভক্তি সহকারে আমাকে ভালোবাসে, আমি তাদের হৃদয়ে বাস করি।” এখানেই ঈশ্বরের সৌলভ্যর মর্ম। অসীম, সর্বশক্তিমান, অদ্বিতীয় সেই চেতনা কোনো দূরবর্তী সত্তা নন; তিনি মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করেন, মানুষের ভালোবাসায় সাড়া দেন, এবং নিজেকে ভক্তের অন্তরেই প্রকাশ করেন। ঈশ্বর নিজেকে এমনভাবে “সহজ” করে তোলেন যে, ভক্তের প্রেমই তাঁর আবাস হয়ে ওঠে।

এই সৌলভ্যই ঈশ্বরের মহিমার সর্বোচ্চ রূপ—যিনি মহাবিশ্বের শাসক, তিনিই আবার ভক্তের অন্তরঙ্গ বন্ধু, পুত্র, প্রেমিক বা সঙ্গী হয়ে ওঠেন। গোকুলের কৃষ্ণ, যিনি ব্রহ্মারও উপাস্য, তিনিই যশোদার কোলে বাঁধা পড়ছেন, গোপবালকদের সঙ্গে খেলছেন—এই দৃশ্যই সৌলভ্যের জীবন্ত প্রতীক।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটি মানুষের inner spirituality বা “অন্তর্মুখী ঈশ্বরানুভূতি”-র ব্যাখ্যা। ঈশ্বর তখন আর কোনো বাহ্য শক্তি নন; তিনি মানুষের মন ও হৃদয়ের এক অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা—যেখানে প্রেম, সচেতনতা ও শান্তি মিলেমিশে যায়।

এই শ্লোকের মর্মার্থ হলো—ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান ও সকলের কাছে সমানভাবে উপস্থিত, কিন্তু যাঁরা প্রেম ও ভক্তি দিয়ে তাঁর দিকে মুখ ফেরান, তাঁদের হৃদয়ে তিনি স্বয়ং অবতীর্ণ হন। অসীম যখন নিজেকে সীমার ভিতর উপলব্ধি করান, তখনই সেই রূপের নাম সৌলভ্য।

ভাগবত পুরাণে সৌলভ্যের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ দেখা যায় দামোদর লীলায়—যেখানে মা যশোদা তাঁর সন্তানরূপ কৃষ্ণকে দড়ি দিয়ে বাঁধছেন। যিনি পরম ব্রহ্ম, তিনিই সেই মায়ের কোলের শিশু। এই লীলায় ঈশ্বরের “সর্বশক্তিমান” রূপ নয়, বরং “সহজপ্রেমময়” রূপ ফুটে ওঠে। যিনি বিশ্বধারক, তিনিই গোপালেরূপে গরু চরাচ্ছেন, বন্ধুর সঙ্গে খেলছেন—এটাই সৌলভ্য, ঈশ্বরের সেই রূপ যেখানে তিনি “অসীম” থেকেও “অন্তরঙ্গ” হন।

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, ঈশ্বরের সৌলভ্য ধারণাটি একেবারে অভিজ্ঞতামূলক। এখানে যা কাজ করে, তা হচ্ছে “accessible divinity”, অর্থাৎ এমন এক ঈশ্বরস্বরূপ চেতনা, যা কোনো ধর্মীয় কল্পনা বা দূরবর্তী পরাশক্তি নয়—বরং মানুষের অন্তর্গত অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেই অনুভবযোগ্য। এই ব্যাখ্যা ঈশ্বরকে “বাইরের দেবতা” থেকে “ভেতরের চেতনা”-য় পরিণত করে। তিনি উপস্থিত প্রতিটি অনুভূতিতে, প্রতিটি প্রেমে, প্রতিটি করুণ মুহূর্তে।

যখন ভক্ত নিজের হৃদয়ে ঈশ্বরকে অনুভব করে, তখন সেই অনুভূতি এক অনন্য ঐক্যে পরিণত হয়—যেখানে অতীততা (transcendence), অর্থাৎ সীমার ঊর্ধ্বে থাকা অসীম ঈশ্বর; এবং অন্তর্গততা (immanence), অর্থাৎ হৃদয়ের গভীরে অবস্থান করা সেই একই ঈশ্বর—দু-জন যেন এক হয়ে যান। তখন ভক্ত বোঝে, ঈশ্বর দূরে নন; তিনি সর্বত্র, এবং সর্বাধিক ঘনিষ্ঠভাবে নিজের মধ্যেই বিরাজমান। এই মিলনের মুহূর্তেই প্রেম, চেতনা ও অস্তিত্ব একাকার হয়ে যায়—এটাই সৌলভ্যের পরম অভিজ্ঞতা।

আধুনিক মানবতাবাদী মনোবিজ্ঞানী কার্ল রজার্স (Carl Rogers) “unconditional positive regard” বা নিঃশর্ত গ্রহণযোগ্যতার কথা বলেছেন—যেখানে ভালোবাসা কোনো শর্ত বা বিচারের উপর নির্ভর করে না। ঈশ্বরের সৌলভ্যও ঠিক তেমনই এক মনস্তাত্ত্বিক সত্য: তিনি আমাদের ভেতরের সেই চেতনা, যে সব অবস্থায়—ভালো বা মন্দ—আমাদের গ্রহণ করে, আমাদের মধ্যে অবস্থান করে। এই অনুভূতিই মানুষকে ভয়, অপরাধবোধ বা বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত করে।

এখানে ঈশ্বর transcendence অর্থাৎ অতীততার প্রতীক—যিনি সমস্ত সীমা, কাল ও সত্তার ঊর্ধ্বে। আবার তিনিই immanence—অর্থাৎ অন্তর্গত, যিনি মানুষের হৃদয়ে, চিন্তায়, অনুভূতিতে, এমনকি যন্ত্রণার মাঝেও উপস্থিত। এই দুই অবস্থার মিলনেই সৃষ্টি হয় সৌলভ্যের অভিজ্ঞতা—যেখানে অসীম ঈশ্বর আমাদের “ভেতরের আমি”-এর মধ্যে এসে মিশে যান।

যখন ভক্ত হৃদয়ে ঈশ্বরকে অনুভব করে, তখন সেই অনুভূতি কোনো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি এক মনস্তাত্ত্বিক পূর্ণতা বা peak experience, যাকে আব্রাহাম মসলো (Abraham Maslow) বলেছিলেন আত্মোত্তীর্ণ অভিজ্ঞতা (self-transcendent experience)। এই অবস্থায় মানুষ “নিজে” ও “ঈশ্বর”-এর মধ্যে কোনো দূরত্ব অনুভব করে না; চেতনা নিজের গভীরে এমন এক উপস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়, যাকে কেবল বলা যায়—“আমি তাঁর মধ্যে, তিনিও আমার মধ্যে।”

মনোবিজ্ঞানের ভাষায় সৌলভ্য হলো সেই অবস্থা, যেখানে মানুষ উপলব্ধি করে যে, ঈশ্বর কোনো দূরে থাকা মহাশক্তি নন; বরং তিনি প্রতিটি মুহূর্তের অভিজ্ঞতায়, প্রতিটি প্রেম, করুণা, ও সচেতনতার স্পর্শে সহজভাবে উপলব্ধ। অসীম তখন সীমার মধ্যেই প্রকাশ পায়—এই সহজতাই সৌলভ্য, ঈশ্বরের চেতনার মানবিক মুখ।

সৌলভ্য মানে ঈশ্বরের সেই আশ্চর্য নম্রতা, যেখানে পরম ব্রহ্ম যেন নিজেকে নত করেন, যেন মানুষ প্রেম দিয়ে তাঁকে স্পর্শ করতে পারে। যেমন ভক্ত কুলশেখর প্রার্থনা করেছিলেন—“হে কৃষ্ণ! আমার মনের রাজহংস যেন চিরকাল তোমার পদপদ্মে আশ্রয় নেয়।” এই সহজ আশ্রয়, এই অন্তরঙ্গতা—এটাই সৌলভ্য। অসীম ঈশ্বর যখন নিজেকে সহজ করে তোলেন, তখন ভক্তের হৃদয়ই হয়ে ওঠে তাঁর বৈকুণ্ঠ, তাঁর নিবাস।

রামানুজের দর্শনে মুক্তি ব্যাপারটা জ্ঞান নয়, বরং ভক্তি ও প্রপত্তি—আত্মসমর্পণ। এখানে ভক্তি কেবল মানসিক ভক্তি নয়, বরং ঈশ্বরের প্রতি এক আত্মীয়তাপূর্ণ প্রেম, যা জ্ঞানের চেয়ে গভীর। জীব মুক্ত হয় তখনই, যখন সে নিজের অহং ত্যাগ করে ঈশ্বরের ইচ্ছায় নিজেকে সমর্পণ করে। দামোদর লীলায় যশোদার সেই সমর্পণই মুক্তির প্রতীক—তিনি কৃষ্ণকে শাসন করতে গিয়ে আসলে তাঁরই প্রেমে আত্মসমর্পণ করেন। ঈশ্বরও সেই সমর্পণেই বাঁধা পড়েন। ভক্ত ও ঈশ্বর এখানে দু-জন নন, বরং দুই দিক—প্রেমদাতা ও প্রেমগ্রাহী, কর্তা ও অনুগত—যাঁরা পরস্পরের পরিপূরক।

এই ব্যাখ্যায় দামোদর লীলা প্রমাণ করে যে, ঈশ্বর কোনো দূরের, অপ্রাপ্য, জড়বুদ্ধির নীতিস্বরূপ নন; তিনি প্রেমের দ্বারা উপলব্ধ এবং ভক্তের জীবনে তিনি অনায়াসে অবতীর্ণ হন। তাঁর অসীম করুণা এমন যে, তিনি নিজেই বাঁধা পড়তে আনন্দ পান, কারণ সেই বাঁধন প্রেমের, যা জ্ঞানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এভাবে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে দামোদর কৃষ্ণ হয়ে ওঠেন পরম ভক্তবৎসল ঈশ্বর, যিনি সর্বত্র বিদ্যমান, কিন্তু কেবল হৃদয়ে প্রেম থাকলেই অনুভূত হন।

প্রেমকে জ্ঞানের চেয়ে উচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে—এই ভাবনা ভারতীয় দর্শনের কেন্দ্রে এক অনন্ত সত্যের মতো প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কারণ প্রেম কেবল আবেগ নয়, এটি চেতনার এমন এক গতি, যা জ্ঞানকে জীবন্ত করে তোলে। জ্ঞান আলো দেয়, কিন্তু প্রেম সেই আলোর উষ্ণতা—যেখানে দেখা ও অনুভব, জানা ও থাকা—একীভূত হয়ে যায়।