দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ৩৪


অদ্বৈত বেদান্তে মুক্তির উপায় বলা হয়েছে জ্ঞান—“ব্রহ্মবিদ্‌ ব্রহ্মৈব ভবতি” (মুণ্ডক উপনিষদ ৩.২.৯)—“যে ব্রহ্মকে জানে, সে ব্রহ্মই হয়ে যায়।” কিন্তু শঙ্করাচার্যের নিজস্ব ভাষ্যেই দেখা যায়, এই “জ্ঞান” কেবল বুদ্ধিগত অনুধাবন নয়; এটি এমন এক আত্মানুভূতি, যা হৃদয়কে স্পর্শ করে। তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে (১.১.৪) শঙ্কর বলেন—“জ্ঞানম্‌ ন তু তথ্যবোধমাত্রম্‌”—সত্যজ্ঞান মানে কেবল তথ্য জানা নয়, বরং সেই জ্ঞানে আত্মার সরাসরি উপস্থিতি অনুভব করা। এই অনুভব তখনই সম্ভব, যখন হৃদয় প্রেমে পরিপূর্ণ।

এই কারণেই কঠ উপনিষদ (১.২.২৩) বলে—“যমেবৈষ বৃত্তে তেন লভ্যঃ, তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনূং স্বাম্।” অর্থাৎ, “যাকে আত্মা নিজে গ্রহণ করে, কেবল তিনিই তাঁকে জানেন।” এখানে বোঝানো হয়েছে, আত্মজ্ঞান কোনো অধ্যয়ন নয়; এটি আকর্ষণ ও অনুগ্রহের ফল। আত্মা নিজে যাকে গ্রহণ করে, তার হৃদয়েই জ্ঞান জন্ম নেয়। এই গ্রহণের ভাষা জ্ঞানের নয়—এটি প্রেমের ভাষা।

তাই ভাগবত পুরাণে (১১.১৪.২১) শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেন—“ভক্তির্বিনান্যসাধনং নৈপুণ্যং মৎপ্রসাদজম্।” অর্থাৎ, ভক্তি ছাড়া অন্য কোনো সাধনায় আমার প্রাপ্তি সম্ভব নয়; কেবল ভক্তির মাধ্যমে, আমার কৃপায়, সেই উপলব্ধি ঘটে। এখানে “ভক্তি” মানে কোনো সীমিত আবেগ নয়—এটি সেই চেতনার স্পন্দন, যা জ্ঞানকে উষ্ণতা দেয়, হৃদয়কে নম্র করে, আর আত্মাকে ঈশ্বরের দিকে উন্মুক্ত করে।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্বে, বিশেষত শ্রীচৈতন্যদেব এই প্রেমভক্তিকেই সর্বোচ্চ বলেছেন—“প্রেমভক্তি হইতে ঈশ্বরলাভ, জ্ঞানে শুষ্কতা, প্রেমে সিক্ততা।” অর্থাৎ, জ্ঞানে ঈশ্বরকে বোঝা যায়, কিন্তু প্রেমে তাঁকে ছোঁয়া যায়। জ্ঞান দূর থেকে দেখে, প্রেম মিলিয়ে দেয়। এই প্রেমই কৃষ্ণের লীলার আত্মা—যেখানে অসীম ঈশ্বর মানুষ হয়ে গোকুলের পথ দিয়ে হেঁটে যান, মা যশোদার কোলে বাঁধা পড়েন। এই অসীমের সহজতা (সৌলভ্য) জ্ঞানের দ্বারা বোঝা যায় না; কেবল প্রেমই তা অনুভব করতে পারে।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায়ও প্রেমকে জ্ঞানের ঊর্ধ্বে ধরা হয়েছে। আব্রাহাম মসলো (Abraham Maslow) তাঁর Motivation and Personality (1954) গ্রন্থে বলেছেন, মানুষের বিকাশের শীর্ষে যে-“peak experience” ঘটে, সেখানে মন ও হৃদয়, চিন্তা ও অনুভূতি একাত্ম হয়ে যায়। এই অবস্থাতেই মানুষ নিজের অস্তিত্বের সীমানা অতিক্রম করে এক বৃহত্তর ঐক্যে বিলীন হয়—এটাই ধর্মীয় ভাষায় প্রেমানুভব।

প্রেম জ্ঞানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, কারণ জ্ঞান বলে—“আমি জানি”—আর প্রেম বলে—“আমি আছি, আমি তোমার।” জ্ঞান বিশ্লেষণ করে, প্রেম মিলিয়ে দেয়; জ্ঞান ঈশ্বরকে চিনে, প্রেম ঈশ্বরকে প্রকাশ করে।

অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, যখন জ্ঞান প্রেমে সিক্ত হয়, তখন জানা ও ভালোবাসা এক হয়ে যায়—সেই মুহূর্তে বলা যায়, “অহম্‌ ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৪.১০)—আমি-ই ব্রহ্ম, আর ভক্তির ভাষায় বলা যায়—“তুমি-ই আমি, আমি-ই তোমার।”

এই পরিণত অবস্থাই সর্বোচ্চ উপলব্ধি—যেখানে জ্ঞান মুক্তি দেয়, কিন্তু প্রেম মুক্তিকেও অতিক্রম করে। প্রেম ঈশ্বরকে মানবের হৃদয়ে আনয়ন করে, আর মানুষকে ঈশ্বরের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত করে। এই কারণেই প্রেমকে জ্ঞানের চেয়ে উচ্চতম পথ বলা হয়েছে—কারণ প্রেমই জ্ঞানকে পরিপূর্ণ করে, আর জ্ঞানকে চেতনার আলো থেকে ঈশ্বরীয় দীপ্তিতে রূপান্তরিত করে।

এখানে ব্রহ্ম-জীব-জগতের সম্পর্ক কোনো বিমূর্ত তত্ত্ব নয়, এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা। ঈশ্বর হলেন দেহধারী চেতনা—যিনি সকল জীবের অন্তর্যামী, কিন্তু আবার প্রত্যেক ভক্তের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষা করেন। তাঁর মধ্যে মহত্ত্ব ও মাধুর্য একত্রে। মহত্ত্ব তাঁর সর্বব্যাপী ঈশ্বরত্বে, আর মাধুর্য তাঁর আত্মীয়তায়। দামোদর লীলা এই দুই দিকের সমন্বয়—অসীম ঈশ্বর তাঁর অসীমত্বে থেকেও ভক্তের কাছে এতটাই আপন হয়ে ওঠেন যে, তিনি সহজেই বাঁধা পড়েন মায়ের ভালোবাসায়।

এইভাবে বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে দামোদর লীলা কেবল ঈশ্বরের এক ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং তত্ত্বের জীবন্ত প্রতীক—ঈশ্বর ও জীবের অবিচ্ছিন্ন, তবুও গুণগতভাবে পৃথক, প্রেমনির্ভর সম্পর্কের রূপক। কৃষ্ণের কোমরের দড়ি এখানে মায়া নয়, বরং প্রেমের শৃঙ্খল—যা ঈশ্বরের অসীম ঐশ্বর্যকে সীমায় এনে জীবের হৃদয়ে প্রকাশ করে। তাই বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে দামোদর কৃষ্ণ হলেন সর্বোচ্চ ঈশ্বর—যিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী, অথচ ভক্তির কাছে সম্পূর্ণভাবে নত, যিনি দুঃখ দূর করেন জ্ঞানে নয়, স্নেহে, আর যিনি মুক্তি দেন আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।

দ্বৈত বেদান্তে “দামোদর তত্ত্ব” এমন এক গভীর স্তরে বিশ্লেষিত হয়, যেখানে ঈশ্বর ও জীবের সম্পর্ক চিরন্তন পার্থক্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। শ্রীমাধ্বাচার্যের মতে, ঈশ্বর—যিনি বিষ্ণু বা কৃষ্ণরূপে একমাত্র স্বতন্ত্র (স্বাধীন) সত্তা—তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বাধার। অপরদিকে জীব এবং জগৎ—এই দুই সত্তাই তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল; তারা “পরতন্ত্র” বা নির্ভরশীল সত্তা। এই নির্ভরশীলতা কোনো মায়া নয়, কোনো সাময়িক প্রতিবিম্বও নয়—এটি চিরন্তন, বাস্তব এবং শাশ্বত। এখানেই দ্বৈত বেদান্ত অদ্বৈত দর্শন থেকে পৃথক হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এখানে “ঐক্য” নয়, বরং “ভেদ” (পার্থক্য) চিরন্তন সত্য।

মাধ্বাচার্য এই ভেদের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছেন “পঞ্চভেদ তত্ত্ব”-এর মাধ্যমে—পাঁচটি মৌলিক পার্থক্য, যা সমগ্র সৃষ্টির বাস্তব কাঠামোকে ব্যাখ্যা করে। এই পাঁচটি ভেদ হলো—(১) ঈশ্বর ও জীবের মধ্যে ভেদ (ঈশ্বর-জীব ভেদ), (২) ঈশ্বর ও জড়ের মধ্যে ভেদ (ঈশ্বর-জড় ভেদ), (৩) জীব ও জীবের মধ্যে ভেদ (জীব-জীব ভেদ), (৪) জীব ও জড়ের মধ্যে ভেদ (জীব-জড় ভেদ) এবং (৫) জড় ও জড়ের মধ্যে ভেদ (জড়-জড় ভেদ)। এই পাঁচ ভেদই বাস্তবতার ভিত্তি, যা ঈশ্বরের অসীমতা এবং জীবের সীমাবদ্ধতা উভয়কেই একসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করে।

এই তত্ত্বের আলোকে “দামোদর” রূপের তাৎপর্য এক ভিন্ন আলোয় ধরা দেয়। “দাম” অর্থাৎ দড়ি, আর “উদর” অর্থাৎ কোমর—দামোদর মানে তিনি, যাঁর কোমর দড়ি দিয়ে বাঁধা। ভাগবত পুরাণে (দশম স্কন্ধ, নবম অধ্যায়) মাতৃযশোদার সেই লীলা বর্ণিত, যেখানে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বেঁধে ফেলতে চেষ্টা করেন, কিন্তু দড়ি প্রতিবারই “দুই আঙুল কম” হয়ে যায়। দ্বৈত বেদান্ত এই ঘটনাকে প্রতীকীভাবে ব্যাখ্যা করে—ঈশ্বর অসীম, তিনি কখনোই সীমিত মানসে সম্পূর্ণভাবে ধরা দেন না। তবে জীব যখন ভক্তি ও আত্মসমর্পণে পরিপূর্ণ হয়, তখন সেই অসীম ঈশ্বর নিজেই প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দুই আঙুলের ব্যবধানই আসলে জীব ও ঈশ্বরের পার্থক্যের প্রতীক—একটি ঈশ্বরের কৃপা, অন্যটি জীবের পরিশুদ্ধ ভক্তি।

এখন যদি পঞ্চভেদ তত্ত্বের আলোকে এই ঘটনাকে দেখা যায়, তবে তা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথম ভেদ—ঈশ্বর ও জীবের মধ্যে পার্থক্য—যশোদা ও কৃষ্ণের সম্পর্কেই প্রতিফলিত। যশোদা সীমিত, কৃষ্ণ অসীম; কিন্তু সেই সীমিত মাতৃত্বই অসীম ঈশ্বরকে অনুভবযোগ্য করে তোলে। দ্বিতীয় ভেদ—ঈশ্বর ও জগতের মধ্যে পার্থক্য—দেখায়, জগৎ ঈশ্বরের সৃষ্টি হলেও ঈশ্বর জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন; যেমন কৃষ্ণের দেহে অসীম লীলা প্রকাশিত হলেও তিনি তাতে আবদ্ধ নন। তৃতীয় ভেদ—জীব ও জীবের মধ্যে পার্থক্য—প্রত্যেক ভক্তের প্রেম ও উপলব্ধি ভিন্ন, যেমন যশোদার মাতৃত্ব, আর গোপীদের প্রেম এক নয়, তবু উভয়ই ঈশ্বরোপাসনার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। চতুর্থ ভেদ—জীব ও জড়ের মধ্যে পার্থক্য—দেখায়, জীব চৈতন্যময়, কিন্তু জড় অচৈতন্য; সেই চেতনা দিয়েই জীব ঈশ্বরকে অনুভব করে। আর পঞ্চম ভেদ—জড় ও জড়ের মধ্যে পার্থক্য—জগতের বৈচিত্র্যের ভিত্তি, যা ঈশ্বরের অসীম সৃষ্টিশক্তির প্রকাশ।

“দামোদর তত্ত্ব” কেবল একটি পৌরাণিক কাহিনি নয়, এটি দ্বৈত বেদান্তের দর্শনীয় হৃদয়। এখানে প্রেম ও পার্থক্য পরস্পরের বিরোধী নয়; বরং ভেদের মধ্য দিয়েই প্রেমের গভীরতা প্রকাশিত হয়। যশোদার মাতৃত্ব ঈশ্বরকে বাঁধে, কিন্তু তাঁর অসীমতাকে সীমাবদ্ধ করে না—এটাই দ্বৈত ভাবের সার্থকতা। ঈশ্বর ও জীবের ভেদ চিরন্তন, তবু সেই ভেদই ভক্তির সেতু; কারণ যদি ঈশ্বর ও জীব সম্পূর্ণ অভিন্ন হতো, তবে প্রেম, ভক্তি, আর করুণার অর্থই হারিয়ে যেত। তাই দ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে “দামোদর” মানে সেই পরম সত্য—যিনি অসীম হয়েও সীমিত হৃদয়ে বাস করেন, যিনি অচিন্ত্য হয়েও প্রেমের দড়িতে আবদ্ধ হন। এটাই দ্বৈত দর্শনের জীবন্ত ব্যাখ্যা: ভেদই সত্য, কিন্তু সেই ভেদের অন্তরে লুকিয়ে থাকে প্রেমের ঐক্য।

এই দর্শনে কৃষ্ণ কেবল ব্রহ্ম বা পরম চেতনা নন—তিনি হলেন ব্যক্তিগত, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, যিনি জীবকে রক্ষা, পালন ও পরিচালনা করেন। জীব এখানে চিরসেবক, ঈশ্বর চিরস্বামী; জীবের অস্তিত্বের অর্থই হলো ঈশ্বরসেবা। ঈশ্বরের করুণা ও কৃপাই জীবের মুক্তির একমাত্র উপায়। এই কারণে ভক্তি এখানে শুধু আত্মসমর্পণ নয়, কর্তব্যও—ভক্তের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর প্রভুর সেবা ও উপাসনার অঙ্গ।

দামোদর লীলার ব্যাখ্যায় এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি এক চমৎকার পরস্পরবিরোধী সৌন্দর্য প্রকাশ করে। একদিকে কৃষ্ণ সর্বশক্তিমান, যিনি বিশ্বজগতের নিয়ন্তা, অপরদিকে তিনি মা যশোদার হাতে দড়িতে বাঁধা। এই লীলা দেখায়, ঈশ্বরের পরম স্বাতন্ত্র্য থাকা সত্ত্বেও, তিনি ভক্তের প্রেমের সামনে নম্র হয়ে পড়েন—কিন্তু তাঁর এই নমনীয়তাও তাঁর অসীম শক্তিরই প্রকাশ। মাধ্বাচার্য বলেন, ঈশ্বরের এই বশ্যতা বাস্তব নয়, বরং ভক্তির প্রভাবে প্রকাশিত লীলা; তাঁর সর্বশক্তি কখনও হ্রাস পায় না, বরং ভক্তির শক্তি প্রকাশ করেই তাঁর মহিমা আরও উজ্জ্বল হয়।

এই লীলায় ভক্তি ঈশ্বরকে পরিবর্তন করে না, বরং তাঁর করুণার পরিধিকে উন্মুক্ত করে। মা যশোদার স্নেহ ও রাগ—দুটিই ঈশ্বরের সঙ্গে জীবের সম্পর্কের প্রতীক। জীব এখানে ঈশ্বরের পরম অনুগত, কিন্তু ঈশ্বর সেই অনুগত প্রেমকে উপেক্ষা করেন না; তিনি নিজেই সেই প্রেমের বন্ধনে সাড়া দেন। এই সাড়া দেওয়াই দ্বৈত বেদান্তের “ভক্তবৎসলতা”—যেখানে ঈশ্বর সর্বদা ভক্তের কল্যাণে প্রবণ। দামোদর লীলায় ঈশ্বরের এই দিকটি স্পষ্টত প্রকাশিত—তিনি বাঁধা পড়েন না দুর্বলতার কারণে, বরং ভালোবাসার মহিমা প্রদর্শনের জন্য।

দ্বৈত মতে, ঈশ্বরের বশ্যতা কোনো দার্শনিক আপস নয়; এটি করুণার লীলা। তিনি চিরকাল স্বতন্ত্র, কিন্তু স্বেচ্ছায় ভক্তের স্নেহে নিজেকে নত করেন, যাতে জীব বুঝতে পারে—ঈশ্বর দূরের কোনো অপ্রাপ্য সত্তা নন, তিনি সজীব, প্রেমময় ও সাড়া দেওয়া বাস্তবতা। এইভাবেই দামোদর লীলা দ্বৈত দর্শনে ঈশ্বরের গৌরব ও ভক্তির শক্তি—দুইয়েরই মিলনবিন্দু হয়ে ওঠে।

মাধ্বাচার্যের ব্যাখ্যায় মুক্তি বা মোক্ষ কখনোই জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জিত হয় না; এটি ঈশ্বরের করুণা ও ভক্তির ফল। দামোদর কৃষ্ণের দড়িতে বাঁধা থাকা এই মুক্তির রূপক। মা যশোদা যেমন প্রেমের দ্বারা ঈশ্বরকে বেঁধে ফেলেন, তেমনি ভক্তও প্রেম ও সেবার মাধ্যমে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে। কিন্তু ঈশ্বরের সেই বাঁধন আপাত; তিনি সবসময়ই স্বাধীন, স্বতন্ত্র, আর জীব চিরকালই নির্ভরশীল। এই দ্বৈততার মধ্যেই প্রেমের সৌন্দর্য, কারণ এখানে প্রেম সমতার নয়, ভিন্নতার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণতা লাভ করে।

দামোদর লীলার এই ব্যাখ্যা ঈশ্বরের স্বরূপকে দ্বৈত দর্শনের মূল সূত্রে স্থাপন করে—ভক্ত ও ঈশ্বর দুই, কিন্তু অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক দ্বারা যুক্ত। কৃষ্ণের কোমরের দড়ি তাই জীবনের প্রতীক—ভক্তি সেই দড়ি, যা ঈশ্বরকে নিজের হৃদয়ে টেনে আনে, আর ঈশ্বরের করুণা সেই শক্তি, যা জীবকে মুক্তির দিকে টেনে নেয়। একদিকে ঈশ্বরের পরম স্বাধীনতা, অন্যদিকে ভক্তির পরম নির্ভরতা—এই দুই একসঙ্গে মিলেই দামোদর তত্ত্ব দ্বৈত বেদান্তে পরিণত হয় প্রেম ও শক্তির এক চিরন্তন সংলাপে, যেখানে ঈশ্বর সর্বোচ্চ এবং তবুও সবচেয়ে নিকট, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিপতি, আবার মা যশোদার কোলের শিশু।