এখানে “তমস” মানে অজ্ঞানতা বা অবিদ্যা, যা আত্মার প্রকৃত দীপ্তিকে আচ্ছন্ন করে রাখে; আর “জ্যোতি” মানে জ্ঞান, আত্মবোধ, সেই অন্তর্গত স্বয়ম্প্রকাশ, যা নিজের দ্বারা নিজেকেই আলোকিত করে। উপনিষদীয় ভাষায় আত্মা “স্বয়ংজ্যোতি” (স্বয়ং আলোকিত), অর্থাৎ সে নিজেই জ্ঞানের উৎস। কিন্তু যখন মায়া বা অবিদ্যা মনকে আবৃত করে, তখন সেই আলোক নিস্তরঙ্গ হয়ে পড়ে; মানুষ নিজেকে শরীর, ইন্দ্রিয়, মানসিক গতি ও ভোগের সঙ্গে অভিন্ন মনে করে।
কার্ত্তিক মাসে প্রদীপ জ্বালানো তাই কেবল এক ধর্মীয় আচার নয়, বরং এই অন্তর-অন্ধকার মোচনের প্রতীকী সাধনা। প্রতিটি প্রদীপ যেন এক ধ্যান—স্মরণ করিয়ে দেয়, জ্ঞানের আলো বাইরে নয়, নিজের মধ্যেই নিহিত। এই দীপ যখন মাটির প্রদীপে জ্বলে, তখন তা আমাদের দেহস্বরূপ পাত্রে চেতনার শিখার প্রতিরূপ হয়ে ওঠে; ঘৃত বা তেল মানে সাধনার তপস্যা, আর বত্তি মানে অন্তরস্থিত সংকল্প। এই ত্রয়ী মিলেই জ্ঞানের দীপ জ্বলে ওঠে—যেমন আত্মার মধ্যে যখন তপস্যা, সংকল্প ও অন্তরস্থিত বিশুদ্ধ চেতনা মিলিত হয়, তখন মায়ার অন্ধকার সরে যায়।
জ্ঞানযোগের দৃষ্টিতে দামোদর মাস কেবল ভক্তির উৎসব নয়—এটি এক গভীর আত্মস্মৃতির সাধনা, যেখানে আলোর প্রতীক হয়ে ওঠে জ্ঞান, আর বাঁধনের প্রতীক হয়ে ওঠে অজ্ঞান। কৃষ্ণের কোমরে দড়ি বাঁধা থাকার চিত্র—যা দামোদর লীলা নামে পরিচিত—এই যোগিক দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মার অবস্থার প্রতীক। আত্মা আসলে স্বয়ং দীপ্ত, নিত্য মুক্ত; কিন্তু যখন সে মায়া বা অজ্ঞানতার দড়িতে আবদ্ধ হয়, তখন নিজের দীপ্তি ভুলে যায়। কৃষ্ণের দড়ি তাই সেই অবিদ্যা-র প্রতীক—যা আত্মাকে নিজের সত্য স্বরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে।
এই অবস্থায় “প্রদীপ” বা আলো হলো জ্ঞান, যা অন্ধকার ছিন্ন করে আত্মস্মৃতি ফিরিয়ে আনে। উপনিষদের মহামন্ত্র “তমসো মা জ্যোতির্গময়” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৩.২৮)—অর্থাৎ, “অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাও”—এই দীপোৎসবের প্রতীকী ভিত্তি। এই শ্লোকের বাণী কেবল বাহ্য জগতের আলো নয়, বরং অন্তরচৈতন্যের দীপ্তি প্রকাশ করে। যখন ভক্ত তুলসীর তলায়, নদীতীরে বা নিজের গৃহে প্রদীপ জ্বালায়, তখন সে আসলে নিজের অন্তর্দীপ জ্বালায়—যা চিদানন্দ আত্মা-র জাগরণ। এই কারণেই পদ্মপুরাণ ও হারিভক্তিবিলাস উভয়েই বলেছেন—“দীপ দানং তু জ্ঞানপ্রদানস্য প্রতিরূপম্।” অর্থাৎ, প্রদীপদান জ্ঞানের আলোকদানরূপ। এই “জ্ঞান” কোনো তাত্ত্বিক বোধ নয়, বরং আত্মবোধ—যা মায়ার অন্ধকার সরিয়ে নিজের অন্তর্নিহিত ব্রহ্মচৈতন্যকে জাগিয়ে তোলে।
প্রদীপের শিখা যেমন কখনো নিভে না, কেবল দুলে—তেমনি আত্মাও কখনো নষ্ট হয় না; তার বিস্মৃতিই অন্ধকার। বৃহদারণ্যক এবং ছান্দোগ্য উপনিষদ-এর বাণীতে বলা হয়েছে—“অহং ব্রহ্মাস্মি” ও “তৎ ত্বমসি”—অর্থাৎ “আমি ব্রহ্ম” এবং “তুই সেই।” এই শ্লোকদ্বয় জ্ঞানের পরম উপলব্ধি, যা দামোদর দীপের অন্তর্গত প্রতীক। মায়া মানে ভুলে যাওয়া, আর জ্ঞান মানে স্মরণ। দামোদর মাসের দীপসাধনা সেই স্মরণপ্রক্রিয়া—নিজের অন্তরের দীপ্তি পুনরুদ্ধারের এক উপনিষদীয় অনুশীলন।
ভগবদ্গীতায় কৃষ্ণ এই আত্মস্মৃতি-সাধনাকে কর্মযোগের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন—“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোস্ত্বকর্মণি।।” (গীতা ২.৪৭) অর্থাৎ, কর্তব্যকর্ম করো, কিন্তু ফলের প্রতি আসক্ত হয়ো না। দামোদর মাসের প্রতিটি আচার—প্রদীপ জ্বালানো, ভোগ নিবেদন, জপ বা সেবা—এই ঈশ্বরার্পণবোধের বাস্তব রূপ। এটি কেবল বাহ্য আচরণ নয়; এটি মন, বাক্, ও দেহকে বিশুদ্ধ করার মাধ্যমে অন্তর্লীন ঈশ্বরস্মৃতিতে ফিরে যাওয়ার এক অভ্যন্তরীণ সাধনা।
এই সাধনার আরেক শাস্ত্রীয় প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় যোগবাশিষ্ঠে—“যথা প্রদীপো নিবস্তুঃ স্নিগ্ধপাভাস তমঃক্ষয়ঃ। তদ্বদ্ভূতিনো জ্ঞানেন প্রজ্ঞা তদ্ভূতিনো মতা।।” (গীতা ৬.১৯ তুলনীয়) অর্থাৎ, “ঠিক যেমন বাতাসহীন স্থানে রাখা একটি প্রদীপ স্থির, শান্ত ও উজ্জ্বল শিখা দিয়ে অন্ধকারকে দূর করে; ঠিক তেমনই যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করে নিজের স্বরূপের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, তাঁর প্রজ্ঞা বা বোধি সেই স্থির প্রদীপের মতোই অবিচল, শান্ত এবং মনের সকল অন্ধকার (অজ্ঞানতা বা ভ্রম) দূরকারী হয়।” এই শ্লোকই দামোদর মাসের দীপ-উৎসবের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা—যেখানে বাহ্য প্রদীপ আসলে আত্মদীপের প্রতিরূপ।
এই দীপসাধনা শেষে সাধক উপলব্ধি করে—আত্মা কখনও আবদ্ধ নয়, আবদ্ধতা কেবল ভুল পরিচয়ের ফল। কৃষ্ণের কোমরের দড়ি যেমন মায়ার প্রতীক, তেমনি তাঁর দীপ্তিময় রূপ প্রকাশ করে আত্মার চিদানন্দস্বরূপ প্রকৃতি। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (ষষ্ঠ অধ্যায়, একাদশ মন্ত্র)—এক গভীর আধ্যাত্মিক উন্মোচন, যা পরমাত্মার সর্বব্যাপী ও অন্তর্মুখী স্বরূপকে একযোগে বর্ণনা করে। এখানে “ঈশ্বর” কোনো দূরবর্তী সত্তা নন; তিনি সেই একক চেতনা, যিনি একই সঙ্গে বিশ্বরূপে প্রকাশিত এবং প্রতিটি জীবের অন্তরে গুপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান। শ্লোকটি এভাবেই শুরু হয়—“একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ, সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা। কর্মাধ্যক্ষঃ সর্বভূতাধিবাসঃ, সাক্ষী চেতা কেবলো নির্গুণশ্চ।।”
এই এক শ্লোকে ঈশ্বরের দশটি গুণ বা স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে, যা জ্ঞানযোগের দৃষ্টিতে “আত্মার প্রতিচ্ছবি” বলেই বিবেচিত। প্রথমে বলা হয়েছে—“একো দেবঃ”, অর্থাৎ ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। এখানে “এক” মানে সংখ্যা নয়, বরং চেতনার একত্ব—যেখানে সমস্ত বহুত্ব মিশে যায় এক অভিন্ন অস্তিত্বে। তাই বলা হয়—“একং সৎ বিপ্রা বহুধা বদন্তি” (ঋগ্বেদ, ১.১৬৪.৪৬)—সত্য এক, জ্ঞানীরা তাকে নানাভাবে নাম দেয়।
এরপর শ্লোকে বলা হয়—“সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ”—ঈশ্বর প্রত্যেক জীবের মধ্যে গোপনে বিরাজমান। তিনি দৃশ্যমান নন, কিন্তু প্রতিটি সত্তার প্রাণে, চিন্তায়, অনুভবে অনুপম উপস্থিত। এটি বোঝায় যে, আত্মা কখনও ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; বরং ঈশ্বরই আত্মা রূপে প্রতিটি জীবের অন্তরে অধিষ্ঠিত।
“সর্বব্যাপী” শব্দটি তাঁর সর্বত্র বিরাজমান শক্তিকে নির্দেশ করে। তিনি কোনো স্থানবিশেষে সীমাবদ্ধ নন, বরং সময় ও স্থানের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে আছেন—এটাই তাঁর বিশ্বরূপ। এই ধারণাই গীতার (৯.৪) বাণীর সঙ্গে যুক্ত—“ময়া তত্মিদম্ সর্বং জগত্ অব্যক্তমূর্তিনা”—আমি অব্যক্ত রূপে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত।
এরপর বলা হয়েছে—“সর্বভূতান্তরাত্মা”—তিনি সকল প্রাণীর অন্তরাত্মা, অর্থাৎ প্রত্যেক জীবের মধ্যেই আত্মা রূপে অবস্থান করছেন। এখানেই আত্মানুসন্ধানের যোগিক তাৎপর্য; যখন মানুষ নিজ আত্মাকে চিনে, তখন আসলে সে ঈশ্বরকেই উপলব্ধি করে। উপনিষদীয় সূত্রে বলা হয়—“তমেবং বিদ্বানমৃত ইহ ভবতি। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪.৪.৬) ”—"যে এই আত্মাকে এইরূপে জানে, সে ইহলোকেই অমরত্ব লাভ করে।" অর্থাৎ, যে নিজের অন্তরাত্মাকে চিনে, সে অমর হয়।
এরপর শ্লোকে আসে—“কর্মাধ্যক্ষঃ”—তিনি সমস্ত কর্মের অধ্যক্ষ বা নিয়ন্তা। এর মানে এই নয় যে ঈশ্বর বিচারকের মতো ফল বিতরণ করেন; বরং তিনি সেই সত্তা, যাঁর চেতনা সমস্ত কর্মকে চালিত করে। তাঁর উপস্থিতিতেই কর্ম সংঘটিত হয়, তাঁর অনুপস্থিতিতে কিছুই সম্ভব নয়।
“সর্বভূতাধিবাসঃ”—তিনি সকল প্রাণীর আশ্রয় ও আবাস। এই অর্থে ঈশ্বর কেবল সৃষ্টিকর্তা নন, বরং প্রতিটি জীবের হৃদয়ে অবস্থিত আশ্রয়চেতনা। যেমন গীতায় (১৫.১৫) কৃষ্ণ বলেন—“সর্বস্য চাহং হৃদিসন্নিবিষ্টো”—আমি সকলের হৃদয়ে অবস্থিত।
“সাক্ষী” মানে তিনি সকল ঘটনার নিঃস্পৃহ দ্রষ্টা—তিনি কখনও জড়িত নন, কিন্তু সব কিছুর সাক্ষী। তিনি প্রত্যক্ষ করেন, বিচার করেন না; তাঁর দেখা নিঃশর্ত ও অমল।
“চেতাঃ” মানে চৈতন্য বা জ্ঞানের উৎস। ঈশ্বর কোনো জড় শক্তি নন, তিনি নিজেই চেতনা—যিনি সবকিছুকে সচেতন করে তোলেন। এই চেতনা-স্বরূপই আমাদের মধ্যে আত্মার রূপে প্রতিফলিত।
“কেবলঃ” অর্থাৎ তিনি একাকী, স্বতন্ত্র—তিনি কারও ওপর নির্ভরশীল নন। তাঁর অস্তিত্ব স্বয়ম্ভূ, তিনি নিজেই নিজের ভিত্তি। আর শেষ পদ—“নির্গুণশ্চ”—এখানে বলা হয়েছে, তিনি প্রকৃতির তিন গুণ—সত্ত্ব, রজ, তম—এই ত্রিগুণের ঊর্ধ্বে। তিনি গুণের বাইরে থেকেও গুণের ধারক ও উৎস।
এইভাবে শ্লোকটি এক বিস্ময়কর দ্বৈত চিত্র আঁকে—ঈশ্বর একই সঙ্গে অন্তরস্থিত ও সর্বব্যাপী, নির্গুণ অথচ সর্বগুণাধার। জ্ঞানযোগের দৃষ্টিতে এটি আত্মার প্রতিফলন: আত্মাও এক ও অদ্বিতীয়, সর্বভূতে গুপ্ত, চেতনা-স্বরূপ, এবং কখনও প্রকৃতির দ্বারা আবদ্ধ নয়।
এই শ্লোকটি দামোদর তত্ত্বেরই অন্তর্মুখী প্রতিধ্বনি—যেখানে কৃষ্ণের কোমরের দড়ি আসলে সেই গূঢ় ঐক্যের প্রতীক। তিনি বাঁধা পড়েন, কিন্তু তবুও মুক্ত; তিনি অন্তরে গোপন, তবু সর্বব্যাপী। এই “একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ”—এই বোধই বলে দেয়, ঈশ্বর কোনো দূরের দেবতা নন, বরং তিনি আমাদের প্রতিটি নিশ্বাসে, প্রতিটি চিন্তায়, প্রতিটি প্রদীপের শিখায় দীপ্ত—আমাদের নিজের অন্তরের মধ্যেই। এ-ই অন্তঃকৃষ্ণ, সেই অন্তর্লীন চেতনা, যা বাইরে নয়—নিজের ভেতরে জ্বলছে দীপ্ত শিখার মতো।
দামোদর মাসের সাধনা আসলে এক ত্রিমাত্রিক যোগযাত্রা—যেখানে জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ও ভক্তিযোগ এক হয়ে আত্মস্মৃতির পূর্ণতায় রূপ নেয়। কর্ম এখানে কেবল বাহ্যিক আচার নয়, এক অন্তর্মুখী সাধনার বাহন; আর জ্ঞান সেই কর্মের অন্তর্গত দীপ, যা চেতনার অন্ধকার সরিয়ে দেয়। যখন ভক্ত দড়িবাঁধা কৃষ্ণের সামনে প্রদীপ জ্বালায়, তখন সেই প্রদীপ কেবল আলোকসজ্জা নয়, বরং আত্মবোধের প্রতীক—এক নীরব ঘোষণা: “আমি আলোকিত, কারণ ঈশ্বর আমার অন্তরে।” এই উপলব্ধিই জ্ঞানযোগের চূড়ান্ত পরিণতি—যা উপনিষদের বাণীতে ধ্বনিত, “অহং ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৪.১০)—“আমি ব্রহ্ম, আমি সেই আলো, আমি সেই চেতনা।”
এই উপলব্ধিই দামোদর মাসের অন্তর্নিহিত উপনিষদীয় বার্তা—“প্রদীপ জ্বালাও, কিন্তু বাইরে নয়, নিজের অন্তরে।” কারণ মুক্তির আলো কোনো বাহ্যিক উৎস নয়; এটি আত্মার গভীরে স্থিত সেই অনন্ত চৈতন্য, যা সর্বদা দীপ্ত। কৃষ্ণের কোমরের দড়ি যেমন শেষে প্রেমের বন্ধনে পরিণত হয়, তেমনি অবিদ্যা বা অন্ধকারও জ্ঞানের দীপ্তিতে বিলীন হয়ে যায়। এই কারণেই গৌড়ীয় ব্যাখ্যায় বলা হয়—দামোদর মাস তিন যোগের সমন্বিত প্রতিমা: কর্ম ঈশ্বরার্পণ, জ্ঞান আত্মস্মরণ, আর ভক্তি সেই অন্তরআলোর আনন্দে একাত্ম হওয়া।
এই দর্শনের ভিত্তি ভগবদ্গীতার একাধিক শ্লোকে স্পষ্ট। কৃষ্ণ বলেন—“যোগঃ কর্মসু কৌশলম্” (গীতা ২.৫০)—অর্থাৎ, “যে-কর্ম অনাসক্তির সঙ্গে ঈশ্বরার্পণবোধে সম্পন্ন হয়, সেটিই যোগ।” দামোদর মাসের প্রতিদিনের অনুশীলন—তুলসীসেবন, দীপদান, হরিনাম সংকীর্তন, ব্রত বা উপবাস—এই নিঃস্বার্থ কর্মযোগেরই জীবন্ত প্রকাশ। এগুলি এমন কর্ম, যা “নিষ্কাম”—অর্থাৎ ব্যক্তিগত ফললাভের আকাঙ্ক্ষাহীন। যখন দীপ জ্বালানো আর কেবল এক রীতি নয়, বরং অন্তর্দীপ জ্বালানোর স্মরণ হয়ে ওঠে, তখন কর্ম অহং থেকে মুক্ত হয়ে ঈশ্বরচেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়। যেমন গীতাতে বলা হয়েছে—“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন” (২.৪৭)—অর্থাৎ, “তোমার অধিকার কেবল কর্মে, ফলের প্রতি নয়।” দামোদর মাস সেই আচারমূলক কর্মকে ঈশ্বরস্মৃতির সাধনায় রূপান্তরিত করে।
দীপদান এখানে জ্ঞানযোগের প্রতীক, কারণ এটি সেই তমসো মা জ্যোতির্গময়—“অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাও” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৩.২৮)—বাণীর প্রতিরূপ। তুলসীসেবন ও নামসংকীর্তন ভক্তিযোগের প্রকাশ, যা চৈতন্যচরিতামৃতের বাণীকে জীবন্ত করে—“কৃষ্ণ নাম করে আপনা জগৎ শুদ্ধ করে।” আর ব্রত, উপবাস, প্রার্থনা—এগুলি কর্মযোগের শৃঙ্খল, যা মনকে নিয়ন্ত্রিত ও একাগ্র করে তোলে।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানের গবেষণাও এই যোগসাধনার অন্তর্নিহিত কার্যকারিতা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছে। নিয়মিত আচার বা অনুশীলন মনকে একধরনের পূর্বনির্ধারিত স্থিতি (predictive stability) প্রদান করে—অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনের অনিশ্চয়তা ও চাপের মধ্যে এটি মনকে এক নিরাপদ ও পরিচিত ছন্দের আশ্রয় দেয়। এর ফলে মানুষের তাৎক্ষণিক উদ্বেগ (state anxiety) ধীরে ধীরে হ্রাস পায়, কারণ মন সেই পুনরাবৃত্ত নিয়মিত আচারের মধ্যে নিজেকে স্থিত ও সুরক্ষিত বোধ করে।
নিউরোসায়েন্সের দৃষ্টিতে এই ছন্দময় অনুশীলন মনকে অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা তথ্যের ভার থেকে মুক্ত করে। যখন মন এই ভারমুক্ত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই মনোযোগ (attentional focus) বৃদ্ধি পায়, এবং ব্যক্তি একপ্রকার স্বচ্ছ, সজাগ ও একাগ্র অবস্থায় প্রবেশ করে।