তোমাকে মনে পড়ে

তোমাকে…আজ কেন মনে পড়ছে? কেন মনে পড়ছে?
তোমাকে আজ কেন মনে পড়ছে, বলো তো?
সবই তো তুমি শেষ করে দিয়েছ।
তবু কেন?
অনেক কষ্ট করেছিলাম তোমাকে ভুলতে। ভুলেও ছিলাম তো! তবে তোমাকে—
কেন মনে পড়ছে আজ, বলো তো?




মনকে প্রশ্ন করলাম অনেক করে, জবাব পেলাম না। না, জবাব পেলাম না কিছুই। তুমি বলতে পারবে?




তোমাকে কেন মনে পড়ছে? তুমি বলতে পারবে? না, পারবে না। তুমি পারবে না বলতে। তুমি পারবে না। তোমার যে সে মন নেই, যে মন দিয়ে মানুষ মর্মকথা বলে, বোঝে।




তোমার সে মন মুর্দা। মুর্দার মতোই চেতনাহীন। শত কান্নাভেজা কণ্ঠস্বরেও সাড়া মেলে না সেই মনের। হ্যাঁ, তোমার মন মুর্দার মতো, মরা মন—যার কামনা নেই, বাসনা নেই, কথা নেই, ব্যথা নেই, স্বপ্ন নেই, সাধ নেই, আশা নেই, ভাষা নেই, আর নেই ভালোবাসা। নিশ্চল শিলার মতোই শীতল তোমার মন, স্থির অচঞ্চল। তা না হলে আজ আমাকে এমন করে অভিনয় করতে হতো না—মুখে হাসি চোখে অশ্রু নিয়ে বুকে ব্যথার বোঝা বয়ে। অভিনয়? হ্যাঁ, অভিনয়। নিপুণ-নিখুঁত অভিনয় করি। দিন থেকে রাত অবধি। আমার অভিনয় দেখে কেউ বলতে পারবে না, এই আমি এক সুন্দর কাপুরুষকে কামনা করেছি। আর আর অন্তরের সবটকু লালিমা নিংড়ে তাকে ভালোবেসেছি।




হ্যাঁ, এক কাপুরুষকে আমি গভীরভাবে ভালোবেসেছি। কেউই জানে না সে কথা।




ভালোবাসা অপরাধ? না, অপরাধ না। ভালোবাসা অপরাধ না। অপরাধ না!




তবে তোমার মতো কাপুরুষকে ভালোবাসা অপরাধ। দেরিতে বুঝলাম, অনেক দেরিতে বুঝলাম তোমাকে। তোমার রূপ সুন্দর, কিন্তু অন্তর সুন্দর নয়। অন্তর তোমার লোহা দিয়ে ঢালাই-করা, সেখানে কিছু প্রবেশ করতে পারে না। যদি জোর করে কিছু প্রবেশ করেও, তা আঘাত পেয়ে ফিরে আসে।




তা যাক। তোমাকে কেন মনে পড়ছে, বলো তো? কেন? তোমাকে মনে করব না, এটাই তো ছিল আমার পণ। তবে কেন মনে পড়ছে?




পরাজয় হলো আমার? তা তোমার মতো কাপুরুষকে ভালোবাসলে জয়ী তো হয় না কেউ। পরাজয় যে তার অনিবার্য!




এককথা বলতে আরেককথার ফেনিল ঢেউ ভেঙে পড়ল মনসমুদ্রর বেলাতটে। কী বলছিলাম? অভিনয়?




হ্যাঁ, অভিনয়। আমার অভিনয়। সকাল থেকে শুরু হয় আমার অভিনয়। আমার অভিনয়ে ফাঁক থাকে না একটুও। ফাঁকি থাকে না একটুও। সকলের তাগিদ সকলের প্রয়োজন পুরিয়ে ফেলি, কারুর অভিযোগ থাকে না, আমার অভিনয়-নৈপুণ্যে। কিন্তু আজ তোমাকে কেন মনে পড়ছে?




কেন মনে পড়ছে, বলো তো?




তোমাকে মনে করব না, এই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমার সেই দিনের কথা শুনে, যে-দিন তুমি নিজ থেকে বলেছিলে আমাদের পরিচয় ভুলে যেতে, আমাদের পরিচয় মুছে দিতে।
আরও বলেছিলে সেদিন তুমি…




থাক সে কথা—পরে হবে সে কথা। কী বলছিলাম? অভিনয়?




হ্যাঁ, অভিনয় করি, সুন্দর অভিনয়। কঠিন বিচারকের চোখও আমার অভিনয়ে কোনো ত্রুটি পাবে না। কিন্তু অভিনয়ের শেষে যখন বিশ্রাম আসে, তখন নেমে আসে অবসাদ—গভীর ক্লান্ত অবসাদ, ব্যথার ভারে মোড়ানো অবসাদ। আমার সে অবসাদের রূপটি বড়ো ক্লিষ্ট-করুণ।




গতির পর যতি আমার জন্য বেদনা আনে, সে বেদনা তুমি জানো না। কেমন করে জানবে? তুমি যে কাপুরুষ, নির্মম কাপুরুষ! মনহীন এক কাপুরুষ তুমি…সত্যিই তোমার মন নেই; শুধু আছে প্রাণ, যে-প্রাণ বেঁচে থাকতে চায় প্রেম, প্রীতি, মায়ামমতা, স্নেহ, সোহাগ, বন্ধু, বন্ধন সব এড়িয়ে।




পাষাণ পুরুষ তোমরা, প্রেমের মূল্য তোমাদের কাছে নেই। দু-দিনের জন্য কেবল মেয়েদের তনুমন নিয়ে খেলা কর তোমরা।




তোমরা নিজের প্রয়োজনে, যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু খরচ করো মনের সম্পদ। কিন্তু আমরা বোকা, তাই তোমাদের ভালোবাসি, নিজের সব উজাড় করে। এবং তাই আমরা চিরদিন ঠকি, কাঁদি আর কখনো কখনো নিজেকে খুন করে মরে যাই।




সে যাক। কিন্তু তোমাকে আজ কেন মনে পড়ছে বলো তো? কেন মনে পড়ছে? তোমাকে মনে করব না কোনোদিনই—এই সাধনা নিয়ে মনকে শাসন-শোধন করেছি কঠিন প্রহরে। দিনের পর দিন। তবে তোমাকে কেন মনে পড়ল বলো তো? তুমি কী ভাবছ জানি না, হয়তো কিছুই ভাবছ না। যে-মন দিয়ে মানুষ ভাবে, সে মন তো তোমার নেই। তুমি মনহীন মানুষ, তুমি আবার ভাববে কী?




তবে আমি ভাবছি, তোমার মতো কাপুরুষ আর ক-জন আছে! তবে তোমার মন না থাক, রূপ আছে—অপূর্ব রূপ, যা আমাকে মুগ্ধ করেছে।




আর করেছে রিক্ত-উদাসীন। সত্যিই বাইরের তুমি যত সুন্দর, আর ভেতরের তুমি তত অসুন্দর। আমি তো জানতাম না; যদি জানতাম, তবে কি এমন করে নিজেকে হেমন্তের রিক্ত মাঠের মতো শূন্য করতাম?




সত্যি সেদিন কী যে ব্যথা পেয়েছিলাম, যেদিন তুমি বলেছিলে, আমাদের পরিচয়ের গভীরতা তোমার কাম্য নয়! এবং আরও কাম্য নয়—পরিচয়ের পর প্রণয়, প্রণয়ের পর পরিণয়। পর পর পরিণতি।




আরও বলেছিলে কত-কী!...সত্যি তুমি এমন কথা কেমন করে বলতে পারলে বলো তো? অমন কঠিন কথা, অত স্বচ্ছ করে বলতে…তোমার মনের মরা নদীতে, একটু দ্বিধার দোলা দুলে উঠল না?




তুমি সেদিন আরও বলেছিলে, যেখানে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়, যেখানে মনের কারবার করা বিলাসিতা। তারপর বলেছিলে, দারিদ্র্য যেখানে প্রকট, প্রেম সেখানে কপট। প্রেম মানুষের মনের অন্ধ মোহ। প্রেমের কোনো রূপ নেই, গন্ধ নেই, ছন্দ নেই, স্বাদ নেই। প্রেম অর্থহীন।




সত্যিই কী কাপুরুষ তুমি! প্রেমের কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে! সত্যিই কি তা-ই?




তবে কেন রাজার কুমার প্রেমের জন্য, মাথার মুকুট শাহীতক্তে রেখে হাসিমুখে পথে নেমে গেল? আর লাইলি-মজনুর কাহিনি কেবল কাহিনিই? তারপর শিরিন-ফরহাদ মিথ্যে? রোমিও-জুলিয়েট কিছুই নয়? শাজাহানের তাজমহল তাঁর অমর প্রেমের চিহ্ন বহন করে না?




পৃথিবীর সব প্রেম কেবলই মোহময় আর মূল্যহীন? তবে তোমার কাছে তা-ই। তোমার কাছে প্রেমের মূল্য নেই।




তুমি তো রক্ত-মাংসের মানুষ ন‌ও। তুমি পাষাণাবৃত পাষাণ পুরুষ। তাই তোমার কাছে মূল্যবান প্রেমকে মূল্যহীন মনে হয়।




আমার কী মনে হয়, জানো? আমার মনে হয়, অহল্যার মতোই তোমার ভেতরের ‘তুমি’টা কঠিন পাষাণে পরিণত হয়েছে কারুর কোনো অভিশাপে। তা যাক!




তোমাকে কেন মনে পড়ছে বলো তো? শীতের ম্লান সন্ধ্যায় মনে পড়ে অনেক অনেক স্মৃতির কথা, অনেক অনেক প্রীতির গাথা, কিন্তু তোমাকেই কেন মনে পড়ছে বলো তো? কেন এতটা মনে পড়ছে?




তোমাকে আর মনে করব না—এই কথাটা সেদিন বলেছিলাম, তোমার সামনে মনে মনে। কিন্তু আমার হার হলো যে!




সত্যি সেদিন গভীর ব্যথায় বিদ্ধ পাখির মতো, যন্ত্রণায় স্থির বসে রইলাম আমি, তোমার সামনের চেয়ারে। একটাও কথা বলতে পারিনি, তুমি কিন্তু একটানা অনেক কথা বলছিলে। আমি তোমার আর কোনো কথাই শুনতে পাইনি, আমার কান তখন বধির হয়ে গিয়েছিল ব্যথার বারুদে।




একসময় আমি উঠে এসেছিলাম চোখের পানিতে অন্ধ হয়ে। অভিমান? না, না, তোমার ওপর সেদিন আমি অভিমান করিনি। সেদিন কেন, আজও তোমার ওপর আমার অভিমান নেই। যে অভিমান বোঝে না, তার ওপর অভিমান করতেও যে-অভিমান হয়! তা যাক!




আজ তোমাকে কেন মনে পড়ছে বলো তো? তোমাকে মনে করব না বলে পণ করেছিলাম যে! চাঁপাফুলের মতোই মেয়েদের মন—কোমল সুন্দর…তাই রেখা বসে বেশি।




অভিনয়? হ্যাঁ, আমি অভিনয় করি—দিনের উজ্জ্বল আলোকিত রঙ্গমঞ্চে।




খাবার, বাজার, চাল, ডাল, নুন, তেল, হলুদ, লঙ্কা, রসুন, পেঁয়াজ, মশলা, আদা, জর্দা, সুপুরি, খয়ের, পান, চুন।
মাংস, মাছ আলু, বেগুন, লাউ, কপি, কুমড়ো, শিম, শাক।
চুলো, কাঠ, কয়লা, কল, ঝি, চাকর, হাঁড়ি, কলসি, প্লেট, পেয়ালা, গ্লাস, চামচ।
সেলাই, মেশিন, দর্জি, মুদি, মেথর, ধোপা, নাপিত, গামলা, দুধ, দই, ঘি, মাখন।
বাড়ি, শাড়ি, গাড়ি, গহনা, আত্মীয়স্বজন, পরিজন, প্রয়োজন, ফকির, মিসকিন।
শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর, ভাসুর, জা, স্বামী, সন্তান, সংসার, অভাব, অভিযোগ, মান, অভিমান, রাগ, অনুরাগ, আদর, সোহাগ, হাসি, কান্না।
—এইসবের মধ্যে ডুবে অমি অভিনয় করি, নিখুঁত অভিনয় করি, কেউ ধরতে পারে না তার মধ্যের গভীর ফাটলটা। অভিনয়ের শেষে যখন অবসর মেলে, তখন ঘড়ির ঘণ্টায় বাজে বারোটা।




আর তখন আমার অবসাদে ক্লিষ্ট-ক্ষত-হওয়া মন, দেহ ফেনিল সাদা বিছানায় আশ্রয় নিয়ে স্মৃতির ছোবল তুলে, সারারাত্রি রক্তক্ষরণ করে চোখের অশ্রুতে। চোখের লোনা ঝরনাতে ভিজে যায় বালিশ, ভিজে যায় বসন। আর ভিজে যায় মুখ, চোখ, বুক।




তুমি তো জানো না সে কথা, কেউ জানে না সে কথা। কত কথা মনে পড়ে, কতদিনের কত কথা। দু-জনের কত আলাপ, আলোচনা, তর্ক, বিতর্ক, কত-কী নিয়ে—জীবন, যৌবন, দর্শন, বিজ্ঞান, মানুষ, প্রাণী, জন্ম, মৃত্যু।




কত কথার আদান-প্রদানে তুফান তুলতাম দু-জনা। মনে পড়ে আমার সে দিনের কথা, যে-দিন তোমার আমার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল, দরজার কড়া নড়ে উঠবার কিছুক্ষণ পরেই তুমি উঠে এসে কপাট খুলে দিলে। তোমার মুখে বিরক্তি, আর চোখে বিস্ময় ছিল। আর আমার মুখে-চোখে ছিল শুধুই বিস্ময়, তোমার অপরূপ সৌন্দর্য দেখে।




তারপর পরিচয় হলো, আলাপ হলো, দেখা হলো আর অনেক অনেক কথা হলো। অনেক অনেক বার। অনেক বার!




সেসব কথা তোমার কি মনে আছে? কিন্তু আমার মনে আছে, সব কথা মনে আছে।




জীবনে শুভলগ্ন একবার আসে, আমার জীবনেও একবার এসেছিল। কিন্তু সে লগ্ন আমার শুভ হয়ে আসেনি, অশুভ হয়ে এসেছিল। তাই আজ আমার নিজের নিভৃতে চোখের মুক্তো-ফোঁটাই সম্বল হলো। আমি রানি হয়েও ভিখারিনি। মনের সম্পদ আমার শেষ হয়ে গেছে এক কাপুরুষকে ভালোবেসে।




অপরাধ তোমার, না আমার? কেন কাপুরুষকে ভালোবেসে ছিলাম? ভালোবাসার স্থান, কাল, পাত্র, বিচার ভেদাভেদ নেই যে, তাই প্রেমের পরিণতি বরাবরই করুণ।




গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্র পৃথিবীর বুকে অগ্নিখরা ঢালবে, জ্বলে যাবে বন, মন। পানির প্রত্যাশায়, চাতক চেয়ে দেখবে নির্মল নীল আকাশ, তখন আমার ব্যথাকাতর চোখে পানির বন্যা ছুটবে। বর্ষার বৃষ্টি পৃথিবীর বুকে ঝরবে। বীণার কান্নায় মেঘের গুরুগুরু ডাক উঠবে কালো আকাশের অন্তরালে। কেকা ডাকবে ব্যাকুল কণ্ঠে সাথীকে তার। বিরহ-যক্ষের দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ঘুরবে ঝড়ের রূপে, তখন আমার ভেজা-পিছল চোখে পানির প্লাবন জাগবে।




শরতের সোনালী সূর্য পৃথিবীর বুকে ঝরনার নৃত্যে নেমে আসবে অজস্র ধারাতে, সবুজ ধানের শিষ দুলবে নতুন খুশিতে। সরষে-কন্যা চোখ মেলবে বিস্ময়ে, আনন্দে। সৌরভ ছড়াবে শিউলি-কেতকী-মালতীর মহল। অলির দল আসবে কত! দুপুরের আকাশের নীল অথই সমুদ্রে সাঁতার কাটবে কপোত, কপোতীর সঙ্গে।




তখন আমার বেদনাবিদ্ধ চোখেতে পানির পান্না পড়বে। হেমন্তের ধূসর কুয়াসা পৃথিবীর বুকে নেকাব ঢাকবে ধারে, সূর্যের শেষ রশ্মি রেখা টানবে, লাল লম্বা আঁধারের তোরণদ্বারে বিষণ্ন বিকেলে ম্লান সন্ধে নামবে। পাখির কাফেলা উড়ে যাবে শূন্য সীমান্তে, তখন আমার কান্নাভরা উদাসি চোখে পানির কণিকা ঝরবে।




শীতের কঠিন শীতলতা পৃথিবীর বুকে হিমের গুণ্ঠন টানবে। শিশির ঝরবে মুক্তার মতো। ঘুমিয়ে পড়বে প্রকৃতি, তুষার-কবরে। কাশের গুচ্ছ নুয়ে পড়বে, তৃণের তনুতে। শেফালির কোমল দল খসে যাবে হলুদ বোঁটার বন্ধন থেকে। গরবি করবী কেঁদে লুটোবে মাটির মলিন শয্যাতে। শিথিল বসন খুলে যাবে চাঁপার। নীলিম আকাশে জ্বলবে তারার মানিক। হিমভেজা জোছনা নেবে আসবে পৃথিবীর পথে। দূরে ডাকবে সাথীহারা বিরহিণী বিহঙ্গিনি। তখন আমার ব্যথিত দু-চোখে পানির ঝাড় বাড়বে।




তারপর আসবে বসন্ত। সুন্দর বসন্ত। গন্ধে, ছন্দে, বর্ণে, পর্ণে, পুষ্পরঙ্গে জড়ানো বসন্ত আসবে। বসন্তের রক্তিম লাল পৃথিবীর বুকে আবির ছড়াবে, আবেগ জড়াবে। লতা, পাতা, ফুল ফুটবে নতুন জীবনে। সৌরভ ছুটবে। প্রজাপতি পাখনা মেলবে, ফুলে ফুলে উড়বে মাতাল আনন্দে। পলাশ-শিমুল আগুন জ্বালবে ডালে ডালে।




গুলমোহরের সোনার পেলব পাপড়ি ঝরে পড়বে ধুলোর পথে। দখিনা বাতাস জাল বুনবে, মনের বনে কোকিল পাখি গাইবে বসন্তের জয়গান। তখন আমার দুঃখের আগুনজ্বলা চোখে পানির ফোয়ারা উঠবে।




আমার মনপিঞ্জরের পাখি গাইবে রোদনভরা বসন্ত—সখি, কখনও আসেনি আগে। এমনি করে কাটবে আমার জীবনের বাকি দিনগুলি। তুমি জানবে না, কেউ জানবে না। তা যাক।




কেমন করে কার দিন কাটছে, সে খবরে তোমার কী আসবে যাবে? তুমি তো শিলাখণ্ডের একটা টুকরো—যার জীবনের কোনো চিহ্ন নেই।




কিন্তু তোমাকে কেন মনে পড়ছে বলো তো? আমি তো কিছু চাইনি জীবনে। ধন, মান, যশ, সুনাম, শাড়ি, চুড়ি, বাড়ি, গাড়ি, গহনা, দাস, দাসী, সম্মান, প্রতাপ কিছু চাইনি, এসব আমি কিছুই চাইনি। শুধু চেয়েছিলাম সবুজ স্বপ্ন-জড়ানো ছোট্ট একটি বাসা। যার মধ্যে থাকবে শুধু ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা। কিন্তু তা পেলাম না।




তাই আমার মন গভীর শূন্যতায় ভরে আছে, তাই তোমাকে ভালো লেগেছিল, তাই তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার মনের শূন্য ফাঁক তুমি ভরে দেবে। কিন্তু না, কিছু হলো না, মনের ফাটল, আরও গভীর হলো।




তোমাকে ভুল বুঝলাম, মরীচিকার মোহে মিছে মজলাম। তোমাকে ভালোবাসবার আগে, আমার সুখ না থাক, শান্তি ছিল।




তা-ও গেল, আমার সব গেল। সব গেল, কেবল অর্থ আর অভিনয় আমার সম্বল হলো। সমুদ্রের বুকে মিশে একবিন্দু বারির জন্য হাহাকার, ঘরহীনার মতো আমার অবস্থা আজ। কিন্তু তোমার কাছেও তো আমি কিছু চাইনি, নিষ্ঠুর! আমি শুধু চেয়েছিলাম, তোমার কথার মোতি কুড়িয়ে মালা গাঁথতে। তা-ও পেলাম না। তোমাদের কারুর কাছেই আমি কিছু পেলাম না।




এই বেদনা বুকে নিয়ে আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেব, জীবনের শেষ দিনে। আত্মহত্যা? না, আত্মহত্যা আমি করব না। সুখে-দুখে জড়ানো, এ জীবন জীবনে দু-বার ফিরে পাবো না। স্মৃতির সুরভি নিয়ে জ্বলে জ্বলে ধূপের মত আপনি থেকেই মিলিয়ে যাব একদিন।




এবার চললাম। এখন মাঘের মধ্যরাত। বাইরে শীতের শিশির ঝরছে, কাচকুচির মত। শীতালি বাতাস বইছে, সুচের তীক্ষ্ণতা নিয়ে। হিমরাতের গভীর ঘুমে পৃথিবী আচ্ছন্ন।




নিদ্রাহীন নয়নে আমি শুধু শুয়ে আছি, লেপের ওম জড়িয়ে। আমার বাতায়ন থেকে দেখা যাচ্ছে, নারকোল গাছের সবুজ বিনুনি। আজ আমার জীবনের সব সবুজ ধূসর হয়েছে। দূর আকাশে শুকতারা জ্বলছে—আমার চোখের অশ্রুফোঁটার মতো। কিন্তু তোমাকে কেন মনে পড়ছে?