২৩ মার্চ ২০০৯
প্রীতিলতা হল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমি এখন দুজনের মাঝে। আমি দুজনেরই, অথচ দুজনের কেউই আমার নয়। আমি জানি, আমি আসলে একা হয়ে আছি, এরকম হয়েই থাকতে হবে। আমি ঠিক পারবো, আমার একা থাকতে কোনো সমস্যাই হবে না। তবু, এতকিছুর পরও আমি ওকে মেসেজ পাঠাই, পাঠিয়েই যাই; কল করলে ও ধরে না, তাই মেসেজ পাঠাই। কেন পাঠাই, জানি না। যে মেসেজগুলির কোনো উত্তর আসে না, একটু পরপরই সেগুলির দিকে বারবার তাকানো, কোনো যুক্তি ছাড়াই উত্তরের প্রত্যাশায় বসে থাকা—খুব কষ্টের। আমার লজ্জা লাগে না, ক্লান্তি আসে না। ভালোবাসা মানুষকে লজ্জাহীন, ক্লান্তিহীন করে দেয়। যে আমাকে ভালোবেসেছে বলে ধরে নিয়েছিলাম, তার প্রতি আগ্রহ যতো বাড়িয়েছি, যাকে আমি সবচাইতে বেশি ভালোবেসেছিলাম, ততোই তার প্রতি সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।
আমি কবিতা ভালোবাসি। অনেক চেষ্টা করেও আবৃত্তি করতে পারি না। আসলে সবাই দিয়ে সবকিছু হয় না। আমি মেনে নিয়েছি। কবিতার প্রতি এই ভালোবাসার কারণে যারা কবিতা ভালোবাসে, কবিতা আবৃত্তি করতে পারে, তাদের দেখলেই ভীষণ প্রাণের মানুষ মনে হয়, কাছে পেতে বড় ইচ্ছে করে। সেইদিনের তারিখটা সবসময়ই মাথায় থাকে। পহেলা ফাল্গুন। বসন্তবরণ হচ্ছে। আমাদের ভার্সিটিরই এক প্রাক্তন ছাত্র দারুণ আবৃত্তি করেন। সেদিন আমাদের আমন্ত্রণে উনি এলেন, আবৃত্তি করলেন; আমি শুনলাম, উনাকে দেখলাম, এলোমেলো হয়ে গেলাম। এক আপুর কাছ থেকে উনার ফোন নাম্বার যোগাড় করে উনার কণ্ঠস্বর শোনার লোভে ফোনও করে ফেললাম। ফোনে আমি চুপ করে ছিলাম, কিছুই বলিনি। অসীম একরাশ মুগ্ধতা আমাকে ঘিরে ফেলল।
সেসময় আমি সাড়ে ৩ বছরের একটা সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলাম। আমি এমন একটা মেয়ে যে তার প্রেমিক বাদে অন্য ছেলেদের সাথে কখনোই মিশেনি। হিজাব পরি, নিজেকে সবার কাছ থেকে যতটুকু সম্ভব আড়াল করে রাখি। বান্ধবীর মাধ্যমে সেই আবৃত্তিকারের সাথে দেখা করলাম। উনি ভীষণ সুন্দর করে কথা বলতেন। প্রথম পরিচয়েই আমাকে বিয়ে করতে চাইলেন। উনার কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে যাই, কিন্তু কেন জানি না, উনার সাথে কথা বলা চালিয়ে যেতে থাকি। একসময় নিজেকে উনার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ফেলি।
আমি আমার আগের প্রেমিককে জানালাম, আমি অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছি। আমি জানি, আমি ভুল করছি, কিন্তু আমি কিছুতেই নিজেকে উনার কাছ থেকে দূরে রাখতে পারছি না। আমি ইচ্ছের বিরুদ্ধে উনার সাথে কথা বলি, দেখা করি। তাকে দেখলে, তার কথা শুনলে, এমনকি তার কথা ভাবলেও আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। আমার কথা শুনে ও খুব রাগারাগি করে, আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমি কী করবো। অথচ, আমি চাইছিলাম, ওর কাছে থেকে যেতে। আবার নতুন সম্পর্কটা আমাকে ওর কাছে যেতে দিচ্ছিল না। আমি জানতাম, আমি যা করছি, তা ঠিক না। আবার ভুল করার মোহ আমাকে বারবার টানছিল।
এভাবে ৪ মাস কেটে গেলো। দ্বিতীয়জনকেও আগের সম্পর্কের কথা বললাম। উনি আমাকে বললেন, তুমি যা ভাল মনে কর, তা-ই কর। কিন্তু, আমার পক্ষে আর আগের সম্পর্কে ফিরে যাওয়া হল না। আবার এদিকে উনি আমাকে জানালেন, উনার বাসায় কী একটা যেন সমস্যার কারণে আমার সাথে সম্পর্কে জড়ানো সম্ভব নয়। একথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তবে এতদিন যা চলে আসছে, তা কী? উনাকে বলতে শুনলাম, “আমি কি কখনো তোমাকে বলেছি, ভালোবাসি? তবে কেন কোন যুক্তিতে তুমি ধরেই নিয়েছ, আমি তোমার প্রেমিক?” আমি বললাম, “কিন্তু, আপনি আমার সাথে আন্তরিকভাবে কথা বলে গেছেন দিনের পর দিন। আমার সাথে কখনোই কথা বন্ধ করেননি। এমনও হয়েছে, আপনি ব্যস্ত, ফোন ধরতে পারছেন না, অথচ সে অবস্থায়ও কোনো না কোনোভাবে সময় বের করে আমাকে ফোন করেছেন। আপনি আমার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন, এতে আমি কল্পের প্রতি সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। আপনি আমার সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছেন, আর ও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আমি আপনাকেই বিয়ে করতে চাই। আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারেন না। এটা অন্যায়।” আমার কথা শুনে উনি শব্দ করে হাসতে লাগলেন। “আরে বোকা নাকি? আন্তরিকভাবে কথা বলেছি মানে? আমি কেন তোমার সাথে অভদ্র আচরণ করবো? আমি তোমার সাথে কথা বলেছি, তোমাকে সময় দিয়েছি। তুমিও দিয়েছ। জোর করে কেউ তোমার কাছ থেকে সময় নিয়েছে? কিংবা আমি কি কখনো তোমার উপর কোনো ধরনের অধিকার খাটিয়েছি? আমাদের কথা হয়, কখনো-কখনো দেখাও হয়; আমাদের মধ্যে ভাল একটা সম্পর্ক আছে। এর চাইতে বেশি তো আর কিছুই নয়। এইটুকুতেই প্রেম হয়ে যায়? এতো সস্তা? বি প্র্যাক্টিক্যাল! তোমাকে বিয়ে করার তো প্রশ্নই আসে না! মাথা ঠিক আছে তোমার?” “কেন আমাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়? আমি কি আপনার অযোগ্য? আমাকে আপনার যোগ্য হতে হলে কী করতে হবে? একটু বলুন! আমি সবকিছু করতে রাজি আছি! তবু আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। আমার পক্ষে আর ওর কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাকে আপনি ফিরিয়ে দেবেন না প্লিজ!” উনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করার পেছনে কোনো কারণই বলতে পারলেন না। শুধু সরাসরি বলে দিলেন, “সম্ভব নয়! এভাবে থাকতে পারলে থাক, নাহলে সরি!” আমি ভাবি, কত সহজ ‘সম্ভব নয়’ বলে দেয়া! আমি মনকে বোঝাতে পারি না। আমি কলের পর কল দিই, মেসেজের পর মেসেজ পাঠাই, কোনো লাভই হয় না। যখন উনার সাথে কথা হতো, তখন মনে হতো, উনি আমাকে ভালোবাসেন। কিন্তু যখনই কমিটমেন্টের প্রসঙ্গ আসত, তখনই আমাকে অ্যাভয়েড করে চলতেন। বলতেন, আমি তো বলিনি, ভালোবাসি! উনার সাথে কথা বলার লোভে আমি আর কিছুই বলতাম না। উনার সব শর্ত মেনে নিতাম। আমাদের অসংজ্ঞায়িত সম্পর্কটা এভাবেই চলতে থাকে। একদিন উনাকে বললাম, “আমার বাসায় বিয়ের কথা চলছে। আমি এখন কী করব? কিছু একটা করেন প্লিজ!” “কিছু করব মানে? বিয়ে কর, সুখী হও। সিম্পল! আমি তো তোমাকে আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলিনি। নাকি এরকম কিছু বলেছি?” আমি এর কোনো প্রত্যুত্তর দিতে পারলাম না। বাসায় বলে দিলাম, “আমি কোনোভাবেই এখন বিয়ে করতে পারব না। আমাকে বিয়ের জন্য চাপাচাপি করলে আমি আত্মহত্যা করব।”
বিয়ের প্রস্তাব আসতেই থাকে। মেয়ে হয়ে জন্মানোর সবচাইতে বড় শাস্তি, একটা মেয়ে অবিবাহিত থাকার মানেই হল, মেয়েটার কোনো আইডেন্টিটি নেই—এটা সবাই ধরে নেয়। ছেলেদের আইডেন্টিটি নিজের পায়ে দাঁড়ানোয়, আর মেয়েদের আইডেন্টিটি অন্য কারো গলায় ঝুলে পড়ায়। ছেলেদের সাফল্য সুন্দরী বউ ঘরে রাখায়, মেয়েদের সাফল্য প্রতিষ্ঠিত জামাইয়ের ঘরে যাওয়ায়। বাসার সবাই মিলে আমাকে সফল করে দিতে উঠেপড়ে লাগল। এর মাঝে একবার কল্প আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। আমার বাসায় গিয়ে আমার মায়ের সাথে কথা বলেছে, আমার বড় আপুর পা জড়িয়ে ধরে পাগলামি করেছে। আমার মন সায় দেয়নি। ‘না’ করে দিয়েছি। এর আগে আমি যখনই ওকে বিয়ের কথা বলতাম, ও বরাবরই এড়িয়ে গেছে। আমি ওর সাথে ছিলাম নিজের ধৈর্যের গুণে, ওর ভালোবাসার গুণে নয়। আমাকে ও কখনোই ভাল রাখেনি। বিয়ের পর যে ভাল রাখবে, তার নিশ্চয়তা কী? আমি ওকে বিয়ে করব না। আবার এমন নয় যে, আমি অন্য কাউকে বিয়ে করার জন্য বসে আছি। আসলে, আমাকে জোর করে ধরে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। বিয়ের সিদ্ধান্তটা আমার উপর ছেড়ে দিলে আমি সারাজীবনই একা থাকব। আমার আর কোনো সম্পর্কেই জড়াতে ইচ্ছে করে না, ভয় লাগে। ভাবি, একা আছি, বেশ তো আছি! একটা অনিশ্চিত অস্বস্তিকর সম্পর্কে থাকার চাইতে একা থাকা অনেক ভাল।
আমার প্রথম প্রেমিকের সাথে আমার একেবারেই যায় না। সে সিগারেট খেত, বন্ধুদের সাথে মিলে ড্রিংক করত, ওর বন্ধুরাও কেমন জানি বখাটে টাইপের ছিল। আমার সাথে যতোটা কথা বলত, তার চাইতে বেশি অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলত। আমি সবই বুঝতাম, কিন্তু ওর কাছ থেকে সরে আসতে পারতাম না। কল্প জুম্মার নামাজটাও কখনো পড়ত না, একটাও রোজা রাখত না, সবসময়ই বিভিন্ন বিশ্রী গালি দিয়ে কথা বলত। খুব আমুদে ছিল সে, ভবিষ্যৎ নিয়ে একবিন্দুও টেনশন ছিল না কোনোদিনও। আমি যে তার জীবনে আছি, এটা নিয়েও কখনো ভাবত না। আমাদের সামনের দিনগুলি কীভাবে কাটবে, একটা ভাল ক্যারিয়ার গড়তে হলে কী করা দরকার, এসব ব্যাপার নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। ও শুধু এইটুকুই বুঝত, আমি ওর আছি, সারাজীবনই ওর হয়ে থাকব। আমাকে কীকরে সুখে রাখবে, আমাদের একটা ফ্যামিলি হবে, সে ফ্যামিলির দায়িত্ব তাকে নিতে হবে, এসব চিন্তা তার মাথায়ই কখনো আসত না। আমার দ্বিতীয় রিলেশনের কথা জানার পর থেকে ও ড্রাগস নেয়া শুরু করেছিল। নিজের প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই, ভালোবাসা নেই। যে নিজেকে ভালোবাসে না, তার পক্ষে অন্য কাউকে ভালোবাসা কখনোই সম্ভব নয়। ওর নিজের তেমন কোনো টাকাপয়সা ছিল না, কিন্তু কেউ বিপদে পড়লে অন্যের কাছ থেকে ধার করে হলেও সাহায্য করত। একবার ক্যান্সারে আক্রান্ত এক মেয়ের জন্য টাকা দিতে ওর মায়ের স্বর্ণের চুড়ি বিক্রি করে দিয়েছিল। অন্যের ধন চুরি করে কিংবা অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে কাউকে সাহায্য করার কী মানে, আমি বুঝি না। এটা কী মহানুভবতা? নাকি নির্লজ্জতা? নিজের পরিবারের প্রতিও ওর কোনো দায়িত্ববোধ ছিল না। আমাকে ভালোবাসত, কিন্তু কোনো যত্ন নিত না, ফোন করে তেমন একটা খবরটবর নিত না। ওর কোনো কাজ নেই, অথচ আমার সাথে কথা বলার সময়টুকু পর্যন্ত ও পেত না। আমি ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময়, কিংবা বাসায় ফেরার পথে আমাকে সময় দিতে চাইত না। এতোটাই ব্যস্ত ছিল সে! বেকার মানুষ, বিজি বেশি!
ওর আর্থিক দিকটা আমিই দেখতাম। উনি তো নবাবজাদা, মানুষের বাসায় গিয়ে টিউশনি করলে নাকি উনার মানসম্মান থাকবে না। আমি টিউশনি করে যা পেতাম, তার পুরোটাই ওর হাতে তুলে দিতাম। সে-ই আমাকে ওখান থেকে কিছু ‘হাতখরচ’ দিত। যেদিন বেতন পেতাম, সেদিন ও ফ্রেন্ডদের ট্রিট দিত। আমার কষ্টের টাকা মদ খেয়ে উড়াত। কিছুই বলতে পারতাম না। ভালোবাসতাম যে! নামাজ পড়ে আল্লাহ্র কাছে কেঁদে-কেঁদে চাইতাম, যাতে ওকে আল্লাহ্ ভাল করে দেন। আমার সে প্রার্থনা কবুল হয়নি। যদি কখনো আমাদের মধ্যে কোনোকিছু নিয়ে ঝগড়া হতো, আমরা কথাবলা বন্ধ করে দিতাম, তবে আমাকেই কল করে রাগ ভাঙাতে হতো। কথা না বললে ওর অতোটা কষ্ট হতো না, কিন্তু আমি কথা না বলে থাকতে পারতাম না, বেহায়ার মতো ফোন করে কান্না করে দিতাম। আমার চাইতে আমার বান্ধবীর সাথে কথা বলতে সে বেশি পছন্দ করত, আমার বান্ধবীর বিভিন্ন কাজ করে দিত, ওকে নিয়ে ঘুরতে যেত, ওর মন খারাপ থাকলে ওকে সময় দিত, আমার টিউশনির টাকা দিয়ে আমার বান্ধবীকে গিফট কিনে দিত। আমার টাকা দিয়ে আমাকে কখনো কিছুই কিনে দিত না, বরং আমি আমার কোনো প্রয়োজনে ওর কাছ থেকে টাকা চাইলে অনেক কৈফিয়ত দিয়ে টাকাটা নিতে হত। আমার অন্যান্য বান্ধবীদের সাথেও ওর ভাল যোগাযোগ ছিল, শুধু আমাকেই ও তেমন একটা পাত্তা দিত না। ওর একটা বাজে প্রবৃত্তি ছিল। আমার কয়েকজন বান্ধবীর সাথে ও খুব মেশা শুরু করেছিল। নিয়মিত ওদেরকে সময় দিত, ওদের খুব কেয়ার নিত। একসময় ওদের কয়েকজন ওকে ভালোবেসে ফেলে এবং ওদের প্রেমিকের সাথে ওদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়। এদের মধ্যে দুইজনের ব্রেকাপের পিছনে ও পুরোপুরি দায়ী ছিল। আর ব্রেকাপের পরই ও সরে পড়ত। এটা ছিল ওর এক ধরনের খেলা। ওর তো তেমন কোনো কাজটাজ ছিল না, তাই এসবই করে বেড়াত। ওকে ওর নিজের জীবন নিয়ে একটু সিরিয়াস করতে কত যে চেষ্টা করতাম! এর অর্ধেক সময়ও আমি আমার নিজের জন্য দিলে জীবনে অনেককিছু করে ফেলতে পারতাম।
অপরদিকে, শিশির নিয়মিত নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন, সিগারেট খেতেন না, অন্য কোনো বাজে অভ্যাসও ছিল না। অনেক কবিতার বই কিনতেন, আর আমাকে পড়ে শোনাতেন। উনি অদ্ভুত রকমের সুন্দর করে আবৃত্তি করতে পারতেন। পড়াশোনায় ভাল ছিলেন, উনার ফ্যামিলি স্ট্যাটাসও ভাল, দারুণ মার্জিত, মানুষ হিসেবেও উনি বেশ চমৎকার। উনার সাথে কথা বললে যে কেউই উনার প্রেমে পড়ে যাবে, কিন্তু উনি নিজে প্রেমে পড়তেন না। অন্যকে প্রেমে ফেলে দিয়ে নিজে নিরাবেগ থাকার বিরল যোগ্যতাসম্পন্ন আবেগশূন্য কঠিন মনের একজন মানুষ উনি। সবার সাথেই খুব ভদ্রভাবে মেশেন। যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করা, পরিস্থিতি সামাল দেয়া, এরকম আরো অনেক গুণ উনার মধ্যে আছে। ধীরেসুস্থে সুন্দর করে কথা বলেন, দুচোখের দৃষ্টি ধীর শান্ত; শুধুই তাকিয়ে-তাকিয়ে শুনতে ইচ্ছে করে। মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা উনার মধ্যে আছে। নিজের ক্যারিয়ার, ফ্যামিলি, বন্ধুবান্ধব সবকিছুর প্রতিই সিরিয়াস, কমিটেড। তবে আমি উনার যে ব্যাপারটায় সবচাইতে বেশি মুগ্ধ ছিলাম, তা হলো, উনি নিজে আর উনার ফ্যামিলি বেশ রক্ষণশীল। উনার আগে একটা রিলেশন ছিল, বিয়ের কথাবার্তাও চলছিল, তবে ওই মেয়ে একটু উদারমনা ছিল, উনি অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটাকে রক্ষণশীল করতে পারেননি, তাই ওই মেয়েকে উনি আর শেষ পর্যন্ত বিয়ে করলেন না। উনি আমাকে প্রায়ই বলতেন, “দেখ, আমি কিন্তু শুকনো কাঠের মতো। আমার মধ্যে অনুভূতি-টনুভূতি একটু কম।” তারপরও আমি ভাবতাম, আমি যাকে এত ভালোবাসি, সে নিশ্চয়ই একদিন না একদিন আমার জন্য নিজেকে বদলাবে, আমাকে ভালোবাসবে। মানুষ আসলে বদলায় না, কিছু সময়ের জন্য মেনে নেয় কিংবা মেনে নেয়ার অভিনয় করে যায়—একথা আমি আগে বুঝিনি। যে মানুষ আমাকে প্রথম দেখাতেই বিয়ে করবেন বললেন, সে মানুষ কত কঠিন হয়ে গেলেন। তবে উনি কখনোই আমার সাথে কথা বন্ধ করেননি, কোনোদিনই গলার স্বর উঁচু করে আমাকে একটা কথাও বলেননি। আমাকে নিয়ে উনার কখনো কোনো অভিযোগ ছিল না, আমার সবকিছুই উনার ভাল লাগত। উনি ছিলেন পুরোদস্তুর ভদ্র একজন মানুষ। আমার জন্য ভার্সিটির গেইটে অপেক্ষা করতেন, প্রায়ই যখনই চাইতাম, তখনই উনাকে কাছে পেতাম, আমাকে নিয়ে খেতে যেতেন, আমার সুবিধা-অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখতেন। অথচ, উনি আমাকে ভালোবাসতেন না বলে দাবি করেন। এটার কী ব্যাখ্যা? আমাকে ভালো না বাসার কোনো লক্ষণই কখনো উনার মধ্যে দেখিনি। সবসময়ই আমার পাশে থাকতেন, আমার সব রকমের খেয়াল রাখতেন, আমার একেবারে ছোটোখাটো ব্যাপারগুলিও মাথায় রাখতেন; তবে কমিটমেন্টের কথা এলেই বলতেন, “আমি কি বলেছি, ভালোবাসি?” কিছু মানুষ আছে যারা কমিটমেন্ট পছন্দ করে না, কিন্তু ঠিকই রিলেশনশিপে থাকতে চায়। তবে উনিও কি ওরকম? নাকি, আমাদের মধ্যে যা ছিল, তা আসলে রিলেশনশিপই নয়?
একসময় কল্পকে প্রায়ই বলতাম, “চলো, আমরা পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি।” ও কখনোই রাজি হতো না। অথচ, যে ধরনের ছেলেরা পালিয়ে বিয়ে করে, ওকে দেখলে তাদের মতোই লাগত। বরং আমিই এমন যে, কেউই আমাকে দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না, আমি ওকে এমন একটা প্রস্তাব দিয়েছি। আমি আসলে পুরুষমানুষের মনোজগতটা বুঝতে পারি না। নারীর মন বোঝা যদি কঠিন হয়, তবে আমি বলবো, পুরুষের মন বোঝা রীতিমতো অসম্ভব! ওই রহস্যেঘেরা পৃথিবীতে যে মেয়ে একবার ঢুকে পড়েছে, একমাত্র মৃত্যুতেই তার মুক্তি! পুরুষমানুষের মন হিব্রু ভাষায় লেখা বইয়ের মতো—সারাদিন চোখের সামনে খুলে রাখতে পার, তবে কিছুতেই এক বর্ণও বুঝতে পারবে না, এটা গ্যারান্টেড! শিশির আমাকে বিয়ে করতে রাজি হন না, আমাদের সম্পর্ককে কোনো নামে ডাকতে রাজি হন না, কিন্তু মানুষ হিসেবে কোনো ত্রুটি আমি কখনোই উনার মধ্যে খুঁজে পাইনি। আমার প্রায়ই মনে হয়, আমি আসলে দুজনকেই ভালোবাসি, তবে দ্বিতীয়জনের সাথে বেশি মানসিক শান্তি পেয়েছি। প্রথমজনকে বিয়ে করে ফেললে সারাজীবনই কষ্ট পেতাম, তাই হয়তো আল্লাহ্ চাননি যে আমাদের বিয়েটা হোক। আমার খুব অভিমান হয়, দ্বিতীয়জন আর যা-ই করুক, আমার সাথে কথাবলাটা বন্ধ না করলেও পারতেন। ওটাই যে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল! আমি জানি, কল্পের কথা ভাবাটা আমার জন্য গাধামি ছাড়া আর কিছুই নয়, কারণ ও আমাকে কখনোই আর বিশ্বাস করতে পারবে না। যেখানে বিশ্বাসই নেই, সেখানে ভালোবাসার কী অর্থ? ওর জন্য আমার ভালোবাসাটা অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। ওকে যদি পেয়েও যাই, সবকিছু তো আর কখনোই আগের মতো হবে না; বরং যা পাব তা শুধুই অশান্তি, অবিশ্বাস আর অস্বস্তি। কী লাভ ওর কথা ভেবে?
আমি এমন কীভাবে হয়ে গেলাম? আমি সত্যিই এটা ভেবে অবাক হই। প্রথমত, আমার চিন্তার বাইরে গিয়ে প্রথম প্রেম, দ্বিতীয় প্রেমটিও তা-ই। প্রথম সম্পর্কে অবিশ্বস্ত হয়ে আবার আরেক নতুন সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা। শিশির আমাকে অপেক্ষা করতে বলেন না, আবার আমাকে এড়িয়েও চলেন না। আমি কতবার বলেছি, আমি আমার বাসায় কথা বলি, আমার বাসা থেকে নাহয় প্রস্তাবটা দিক। আমাকে সেটাও করতে দেন না। আমি বলি, “এমন করছেন কেন? প্রেম কি খারাপ কিছু? অনেকেরই তো এরকম সম্পর্ক বাসা থেকে মেনে নেয়। আমাদেরটা নেবে না কেন? সমস্যাটা কোথায়? আমাকে বলুন। আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন না? নাকি, অন্যকাউকে ভালোবাসেন? নাকি, অন্য কোনো ব্যাপার আছে এখানে? আমাকে খুলে বলুন প্লিজ!” উনি কিছুই বলেন না। শুধু বলেন, সম্ভব নয়। দেড় মাস আমার কল রিসিভ করেননি। কেন? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “বাসায় বিয়ের কথা বললে আপনার কথা বলি?” জোরাজুরি করাতে আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিলেন। চলে গেলেন, বলে গেলেন না। দেড় মাস পর হঠাৎ একদিন কল রিসিভ করলেন। আমি ভীষণ কান্নাকাটি করাতে বললেন, “আমি জানি, আমার বাসায় তোমাকে মেনে নেবে না। তবু তুমি চাইলে বাসায় কথা বলব। অপেক্ষা কর, সময় হোক।” আমি অভিমান করে বললাম, “থাক্, লাগবে না।” “আচ্ছা, ঠিক আছে।” বলেই ফোনটা রেখে দিলেন। কমপ্লিটলি ইমোশনলেস একটা মানুষ! আর আমি এমন একটা রোবটের প্রেমে দিশেহারা! যাকে আমি রাখতে পারবো না, তাকে আমি ছাড়তে পারি না; যে আমায় রাখবে না, সে আমায় ছাড়ে না। এ কেমন জীবন?
প্রতিদিনই ভাবি, আর উনাকে কিছু লিখব না, আর কখনো কল দিব না। কখনো-কখনো উনাকে কল দিই না; যদি দিইও, এমন সময় দিই, যখন আমার ফোনে ব্যালেন্স থাকে না; কিন্তু মেসেজ দেয়া কিছুতেই থামাতে পারি না। আমি বুঝি, আমি উনার কাছে অনেক ছোট হচ্ছি; সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। তারপরও আমি এই নেশা থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না। আগের প্রেমে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, তাই সেখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব না। আর এই প্রেমে একটা ছেলের কারণে পৃথিবীর সব ছেলের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি প্রতি মুহূর্তেই। আমার একটাই কথা, ভালো যদি উনি না-ই বাসেন, তবে সব বুঝেও কেন আমার সাথে কথা বলতেই থাকলেন? প্রথম প্রেমের সমাপ্তি ঘটিয়ে তার প্রতি নির্ভরতা বাড়িয়ে ফেলছি দেখেও কেন এতো দেরি করে চলে গেলেন যখন আমার ফেরার আর কোনো উপায়ই নেই? চলে যেতে হলে প্রথমেই যেতেন, দুঃখ দিতে হলে প্রথমেই দিতেন। যখন শুনলেন আমার রিলেশন আছে, তখনো কেন একনিষ্ঠ প্রেমিকের মতো আচরণ করে গেলেন দিনের পর দিন? আমি জানি, এই দুইজনের কেউই আমাকে কখনো বিয়ে করবে না, তবুও আমি মনে-মনে ঠিক করে রেখেছি, যদি ওদের কেউ এখন আমাকে বিয়ে করতে চায়ও, আমিই রাজি হব না বিয়ে করতে। আসলে এই ভাবনাটা আমাকে এক ধরনের প্রশান্তি দেয়। আমি কি আসলেই ওদের রিফিউজ্ করতে পারব? পারব না, হয়তো তাই ওরা কেউ আমাকে বিয়ে করতে সামনে আসবেও না। প্রথমজন নাম্বার পরিবর্তন করেছে। ও এখন যে নাম্বারটা ব্যবহার করে, তা আমি আমার কন্টাক্টস্ থেকে ডিলিট করে দিয়েছি, যেন কখনো ভুল করে ওকে কল করতে ইচ্ছে করলেও কল করার কোনো পথ খোলা না থাকে। কিন্তু দ্বিতীয়জনের নাম্বার, ফেসবুক সবই আমার মুখস্থ। নিজের অজান্তেই উনাকে কল দিই, মেসেজ পাঠাই। খারাপ লাগলেই উনার নাম্বারে আঙুল চলে যায়। শত চেষ্টা করেও নিজেকে কোনোভাবেই থামাতে পারছি না। কতজন কত সুন্দর-সুন্দর পরামর্শ দেয়! পরামর্শ দেয়াটা তো সহজ, কিন্তু মেনে চলা তো ভীষণ কঠিন। কোনো অবস্থার মধ্য দিয়ে নিজে না গেলে সে অবস্থা নিয়ে সারাদিন লেকচার ঝাড়া যায়। এসব লেকচার আমি এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিই। তার উপর বাসায় আছি, কোনো কাজ নেই, পুরোপুরি বেকার। চাকরির জন্য পড়াশোনা করা উচিত, কিন্তু তাও করতে পারি না, কোনো কাজেই উৎসাহ পাই না, এক ফোঁটাও উদ্যম আসে না। বাসায় শুধু বলে, বিয়ে কর বিয়ে কর! কিন্তু বিয়েও কোনো সমাধান নয়। আমি এখনো পর্যন্ত নিজেকেই চিনতে পারলাম না, বিয়ে করলে আরেকজন নতুন মানুষকে চিনব কীভাবে? নিজেকে সময় দিতে হবে। আমি তো কখনোই এমন এলোমেলো ছিলাম না! আমি কবে এমন হলাম? কেন হলাম? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
একদিন কোনো কিছু না বলে, ফেসবুকেও উনি আমাকে ব্লক করে দিলেন। ২৭ দিন পর আবার আনব্লক করে একটা টেক্সটে লিখলেন, “এখন একটু বিজি, বিভিন্ন জায়গায় চাকরির পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। পরীক্ষা শেষ হলে আবার কথা বলব।” টেক্সটটা পাঠিয়েই আবার উধাও! উনার টেক্সটটা কয়েকশো বার পড়ে ফেলেছি। এরপর লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে উনাকে ফোন করে বসলাম। রিসিভ করলেন। “আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি চাইলে আমরা আবার আগের মতো কথা বলব, দেখা করব, ঘুরব। তবে তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব না।” উনাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারছিলাম না। অগত্যা, আমি উনার সব কথাই মেনে নিলাম। উনি আবার আগের মতো আমাকে কবিতা শোনাতে লাগলেন। আহা! যে আবেগ ঢেলে উনি কবিতা আবৃত্তি করেন, যদি সে আবেগের সিকিভাগও উনার মধ্যে সত্যিই থাকত! আমাদের কথা চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমাকে বলার মতো কোনো গল্পই উনার নেই, কিন্তু উনাকে বলার মতো হাজার-হাজার গল্প আমার আছে। আমার কথা কখনোই ফুরোয় না। আমি আসলে নিজ থেকেই উনাকে ফোন করি, দেখা করতে চাই। উনি ভীষণ সাবধানী মানুষ, যদি মনে করতেন, নিজের ইমেজ নষ্ট হবে, কিংবা পড়াশোনার ক্ষতি হবে, তবে দেখা করতে কিছুতেই রাজি হতেন না। সাবধানী আর হিসেবি মানুষের পক্ষে প্রেমে পড়া সম্ভব নয়—এটা উনাকে দেখে শিখেছি। আমি উনার আবৃত্তি খুব বেশি পছন্দ করি। উনার কারণে আমার অন্য কাউকেই আর ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না। তবে আমি জানি, ভালোবাসা তেমন কঠিন কিছু না। এর চাইতে বরং ঘৃণা করা অনেক কঠিন। প্রথম প্রেমের পর তো কখনো মাথায়ই আসেনি যে আবার প্রেমে পড়ব। আর প্রথম প্রেমের আগে তো ভাবিইনি যে আমার দ্বারা কোনোদিন প্রেমটেম হবে। হয়ে তো গেলো! আমি ভাবি, বিয়ে করে প্রেম করাটা অনেক ভাল, তাহলে অন্তত একা-একা কষ্টে থাকতে হয় না। নিজের কষ্টে আরেকজনকে পাশে পাওয়া যায়। তবে শুনতে পাই, লোকে নাকি বিয়ের পরও দুজন মিলে একা-একা থাকে, একা-একাই কষ্ট পায়, আবার একা-একাই সুখে থাকে। নিজের সাথে নিজে একা থাকার চাইতে তো কারো সাথে একা থাকাটা অনেকবেশি কষ্টের। তার মানে কি বিয়ের পরও মানুষ একাকিত্বের কষ্ট আর কষ্টের একাকিত্ব থেকে মুক্তি পায় না?
আমার জীবনে কল্পই প্রথম ছেলে যার সাথে আমার অপ্রয়োজনে কথা হতো। আমরা দুজন সারারাত জেগে কথা বলতাম। ভার্সিটিতে গেলে সারাদিন সারারাতের গল্পগুলো মনে পড়ত। সম্পর্কের শুরুতে ও অনেক কেয়ারিং ছিল, আমার কথা সত্যিই ভাবত। ওর কাছ থেকে প্রচুর কথা বলা শিখেছি, অনেক হাসা শিখেছি। ও শিখিয়েছে কীভাবে কেয়ার নিতে হয়। যখন যেখানে যা পেত, ওর দেখে ভাল লাগলে, আমার জন্য সেটা নিয়ে আসত। এমনকি, যখন ওর কাছে টাকা থাকত না, তখনো প্রয়োজনে আমার কাছ থেকে নিয়ে হলেও ওই জিনিসটা আমার জন্য কিনে আনত। প্রথম ৩ বছর দেখা করা ব্যাপারটাই বুঝতাম না। আমরা শুধু কথা বলতাম। ওর সাথে কথা না বললে ভাল লাগত না। ও-ই প্রথম একদিন বলল, আজ আমার সাথে নাস্তা না করলে, আমি কিছুই খাব না। সেদিন থেকে শুরু। এরপর প্রতিদিনই একসাথে নাস্তা করে ভার্সিটিতে যেতাম। তখন আমার নিজের ফোন ছিল না, আম্মার ফোনে, আব্বার ফোনে কথা হত। ওর কন্ঠস্বর আমার খুব প্রিয়, শুনলেই পাগল-পাগল লাগত; এখন হয়তো সেই ভালোলাগাটা একটু কমেছে। কল্পের কথার কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না। হয়তো দেখা করার জন্য ডেকেছে, কিন্তু দেখা গেল, আমাকে আসতে বলে সে খেলতে চলে গেছে। ওর মনেই নেই যে, সেদিন আমাদের দেখা করার কথা। আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, আর ও মাঠে খেলছে। এরকম হত। আমি অসুস্থ হলে খুব বকত, খারাপ রেজাল্ট করলেও বকত। আমার ফার্স্ট সেমিস্টারের রেজাল্ট খুব খারাপ হল। পরীক্ষার সময় সে আমার সাথে কথা বলে না, পরে পরীক্ষার হলে গিয়ে শুনি আমার বান্ধবীর সাথে ও সারারাত গল্প করেছে। এরকমও হত। তারপরও আমি ওর সাথে কথা না বলে, ওকে ভালো না বেসে থাকতে পারতাম না। পরীক্ষা শেষ করে আমি ওকে কিছুই বললাম না, বরং ওই বান্ধবীকে অনেক বোঝালাম, আমাদের সম্পর্কের কথা বলে অনেক কাঁদলাম, কল্পের সাথে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করলাম, পরে ওর সাথে খারাপ ব্যবহারও করেছি। আমি ছিলাম কল্পের জীবনে পার্মানেন্ট, আর প্রায় প্রতিদিনই ও নতুন-নতুন মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলত। ও এক মেয়েকে পড়াত। সে মেয়ের সাথে মাঝেমাঝে সারারাত ফোনে গল্প করত। আমি জিজ্ঞেস করলে বলত, ওর সাথে নাকি পড়া নিয়ে কথা বলে! জানত, আমি এটা পছন্দ করি না, তারপরও বলত। আমি তো পুরনো হয়ে গেছি, আমার সাথে গল্প করে আর কী হবে? অথচ, আমার কখনোই ওর সাথে কথা বলার আগ্রহ এতটুকুও কমেনি। প্রতিদিনই ওকে নতুন-নতুন করে আবিষ্কার করতাম।
আমি ভাবতে লাগলাম, এরকম কেন হচ্ছে? আমার কী কোনো ভুল? কিংবা, কেউ কি ওকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? হঠাৎ মনে পড়ল, যেদিন ও আমাকে প্রপোজ করেছিল, আমি সেদিন কিছুই বলিনি। ১১ দিন পর ওর প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলাম। দুই মাস সবকিছু ঠিকঠাক চলল। এরপরই সব কেমন জানি হয়ে যেতে লাগল। আমার প্রতি ওর ভালোবাসা কমতে থাকে, তবে ও কখনো আমার উপর আধিপত্যটা কমায় না। ভালোবাসা নেই, অথচ শাসন আছে পুরোমাত্রায়। আমি কোথায় যাই, কী করি, ওকে সবকিছু বলতে হবে, ওর অনুমতি ছাড়া কিছুই করা যাবে না। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার সব দায়িত্বই আমার একার। ওকে ধরে রাখাটা আমার একার দায়। একদিন এক বান্ধবীর সাথে আমার কষ্টের কথা শেয়ার করলাম। ও শুনে বলল, “কী বলিস? তোদের নাকি ব্রেকাপ হয়ে যাবে যাবে, এরকম অবস্থা? ও তো এখন নীলার সাথে সারাদিন গল্প করে, ওর সব কথাই শোনে। দুইদিন পরপরই ওরা দেখা করে।” তখন থেকে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। কয়েকদিন সহ্য করে একদিন ওকে বলেই ফেললাম, “তুমি নীলার সাথে কথা বলতে পারবে না।” জেদ করে ও আমার সাথে কথাবার্তা বন্ধ করে দিল, কিন্তু নীলার সাথে সম্পর্কটা ঠিক রাখল। আমি নীলাকে ফোন করলাম, ওর সাথে দেখাও করলাম, হাতজোড় করে কাঁদলাম অনেকক্ষণ। কিন্তু কোনো লাভই হলো না। উল্টো, ওরা আরো বেপরোয়া হয়ে গেল। আর লুকিয়ে মিশত না, আমার সামনেই ঘোরাঘুরি করত। আমার দ্বিতীয় সম্পর্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত এরকমই চলছিল। সিক্সথ্ সেমিস্টারে একটাও পরীক্ষা দিলাম না। নিজের জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে লাগলাম। ঠিক মতো খেতাম না, ক্লাসে যেতাম না, রুম থেকে বের হতাম না, কারো সাথেই কথা বলতাম না। ও আমার বাবাকে ফোন করে বলল, “দেখেন আঙ্কেল, আপনার মেয়ের কী অবস্থা! পড়াশোনা করে না, বাজে ছেলেমেয়েদের সাথে মেশে। ওর জীবন শেষ!” পরিবারের কাছ থেকে অনেক বকা শুনতে হয়েছে। আমাকে বাসার সবাই ভুল বুঝেছে। তারপরও ওকে ভালোবাসি, ওর সাথে জোর করে হলেও কথা বলি। স্বপ্ন দেখি, একদিন ও নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমার কাছে ফিরে আসবে। সারারাত ঘুমাতে পারতাম না, ক্লাসে ঘুমাতাম। স্মৃতিশক্তি কমতে-কমতে এতোটাই কমে গিয়েছিল যে আগের দিনের কথাটাও মনে আসত না। এইভাবেই দিন যেত। শুধু মিথ্যে ওয়াদার উপর ভর করে আমাদের সম্পর্ক টিকে ছিল। স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আসলে আমার আর ওর পছন্দ একদমই মিলে না, স্বভাবও ভিন্ন, জীবনের কাছ থেকে চাওয়াটাও দুইরকমের। সবই জানতাম, সব জেনেবুঝেও ভালোবাসতাম।
আমার জীবনে শিশিরের আবির্ভাব নিতান্তই আকস্মিক। সেই পহেলা ফাল্গুনের দুইদিন পরের সন্ধেবেলা। অনেকদিন হয়ে গেল কল্প আমার সাথে কথা বলে না। সেই সন্ধ্যায় আমরা রুমের সবাই মিলে মজা করছিলাম। বসন্তবরণের অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ এলো। শিশিরের আবৃত্তির কথাও বাদ গেল না। এক আপুকে কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম, “শিশির ভাইয়ার নাম্বারটা যোগাড় করে দিতে পারবেন?” উনার মোবাইলেই নাম্বারটা ছিল। নিলাম। সেই থেকে শুরু। শিশিরের সাথে আমার বিশেষ কোনো সুখের স্মৃতি নেই। আমার প্রতিদিন দেখা করতে ইচ্ছে করত, উনাকে রান্না করে খাওয়াতে ইচ্ছে করত। ইচ্ছে করত, হাতে তুলে খাইয়ে দিই, উনি খাওয়াতে দিতেন না। প্রথম-প্রথম উনি বেশি দেখা করতেন, পরে-পরে আর অতো বেশি দেখা করতেন না। আমরা ক্যাম্পাসেই দেখা করতাম; ক্লাসের ফাঁকে, ক্লাস শেষ হলে। উনি আমার জন্যই কষ্ট করে ক্যাম্পাসে আসতেন। শিশিরকে দেখলে আমার শুধুই ভালোবাসতে ইচ্ছে করত, উনাকে নাম ধরে ডাকতাম, কিন্তু ‘তুমি’ করে বলতে পারতাম না। ততদিনে বুঝে গেছি, আমি কল্পকে ভুলে যাচ্ছি আর শিশিরের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। কাউকে ভুলে গিয়ে দ্রুত অন্যকারো প্রেমে পড়া সম্ভব নয়। ওরকম কিছু হওয়ার মানেই হল, প্রথম প্রেমটা প্রেম ছিল না, স্রেফ অভ্যস্ততা ছিল। আসলে, আমার প্রথম প্রেমটা অভ্যস্ততাই ছিল; আমার দিক থেকে না হলেও কল্পের দিক থেকে। যা-ই হোক, সেসময় আমার মধ্যে যা কাজ করত, তা হল, কল্পের প্রতি মায়া, শিশিরের প্রতি ভালোবাসা। এই দোলাচলে পড়ে আমার মধ্যে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল। একসময় কল্পের জন্য মায়া চাপা পড়ল, শিশিরের প্রতি ভালোবাসার স্রোতে আমি হারিয়ে গেলাম। অথচ, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, আমি ওদের কাউকেই পেলাম না। নিজেকে খুব খারাপ মনে হয়। যখন শিশির আমাকে এড়িয়ে চলে, তখন মনে হয়, সম্পর্কের প্রতি অবিশ্বস্ততার কারণেই আমি এরকম কষ্ট পাচ্ছি। আমি কল্পকে কষ্ট দিয়েছি বলেই আমি নিজে কষ্ট পাচ্ছি। কখনো রাস্তাঘাটে কল্পের সাথে দেখা হলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারি না। বাসায় বিয়ের জন্য সারাক্ষণই চাপাচাপি করতে থাকে। এটাই স্বাভাবিক। মাঝেমাঝে বিয়ে করতে ইচ্ছেও করে। কখনো, আরো পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, একটা চাকরি পেলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম, তখন আর কেউ বিয়ের করার জন্য জোর করত না। আবার মনে আসে, দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। কাউকেই সহ্য হয় না। সবার সাথেই দুর্ব্যবহার করতে ইচ্ছে করে। যখন বিয়ে করার জন্য রাজি হই, তখন আম্মা এমন ভাব করেন, যেন আমি উনার দাসী, যখন যাকে বিয়ে করতে বলবেন, তাকে তখনই বিয়ে করে ফেলতে হবে। আমার পছন্দ-অপছন্দের কোনো দাম দিতে চান না। আমাকে কোনো গুরুত্বই দেয়া হচ্ছে না, এটা মাথায় এলেই বিদ্রোহী হয়ে সবকিছু ভাঙচুর করতে ইচ্ছে করে। আমার সব বান্ধবী নিজেদের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করছে। ওদের বাবা-মা’ও মেনে নিচ্ছেন। এসব দেখলে খুব হতাশ লাগে। আমার প্রেমটা ঠিকমতো চললেও বাসায় প্রেম করে বিয়ে করার ব্যাপারটা কখনোই মেনে নিত না। আমার জীবনটা এমন ধ্বংস হয়ে গেছে কেন? নিজেকে অসহ্য লাগে। আমি খুব ধর্ম পালন করতে ভালোবাসি, নিয়মিত নামাজ পড়ি, পর্দা করি। এতকিছুর পরও সবাই সবকিছু পাবে, আর আমি কিছুই পাবো না? আমার সাথেই কেন এমন বিশ্রী ঘটনাটা ঘটল? আমার প্রতি স্রষ্টার এ কেমন সুবিচার? রাগ হয় স্রস্টার উপর।
আমার দ্বিতীয় প্রেমের কারণে অনেকেই আড়ালে আমাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করত, আমাকে খারাপ মনে করত। বলত, পৃথা একটা বাজারে মেয়ে, একজনকে ছেড়ে আরেকজনকে ধরেছে। আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলত। আমি যে কেমন, তা যারা জানত, তারা এসব কথার প্রতিবাদ করত। আমি খুব ভয়ে থাকতাম, যদি আমার কাছের মানুষরা আমার দ্বিতীয় প্রেমের কথা জানতে পারে, তবে অন্য সবার মতো ওরাও আমাকে খারাপ মনে করবে। আমি তো ইচ্ছে করে প্রেমে পড়িনি। আমার কী দোষ? তবে হ্যাঁ, আমার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনা উচিত। শিশির আমাকে যে সময়ে নক করতেন, সেসময় কল্পের সাথে আমার ঝামেলা চলছিল, ও আমাকে সময় দিত না। শিশিরের সাথে গল্প করতে আমার ভাল লাগত। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি যা করছি, তা করাটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। কিছু-কিছু ছেলে মেয়েদের দুর্বল করে দেয়ার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। শিশিরের সাথে কথা বলার তিনদিনের মাথায় আমি বুঝতে পারলাম, আমি উনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি। কল্পকে এই ব্যাপারটা জানানোর জন্য কল করলাম, ও ধরল না। মেসেজে জানালাম, নো রেসপন্স। আমি কী করব? আমার পৃথিবীটা খুব ছোট। ক্লাসে যাই, রুমে ফিরে আসি—এ-ই আমার পৃথিবী। একা থাকতে আমার খুব খারাপ লাগে। কল্প কখনোই শিশিরের সাথে কথা বলার ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিত না। ভাবত, আমি আছি, থাকব। আর এভাবে করেই একদিন আমি হারিয়ে যাই। যখন বুঝতে পেরেছি, আমি শিশিরের প্রেমে পড়ে গেছি, ওদিকে কল্পও আমার সাথে কথা বলে না, তখন শিশিরকে বললাম, আমার একটা রিলেশন আছে। ও উত্তর দিল, “তো? আমি কী করবো? আমি জানতে চাইনি তো! একজন মানুষ অনেকের প্রেমেই পড়তে পারে। প্রেমে পড়ার ঘটনা একজন মানুষের জীবনে অনেকবারই হতে পারে। প্রেম-ভালোবাসাকে এতো গণ্ডিবদ্ধ করে দেয়ার কী আছে?” শিশির জানালো, করলে ও আমাকে একেবারে বিয়েই করবে। ওসব প্রেমটেমের মধ্যে ও নেই। এটা শুনে আমি খুশি হয়ে উঠলাম, আরো বেশি করে ওর প্রেমে পড়ে গেলাম। যখন একটা মেয়ে কারো প্রেমে পড়ে, মেয়েটা তখন সবসময়ই তার প্রিয় মানুষটির প্রতিশ্রুতিকেও প্রতিজ্ঞা ধরে নিয়ে বসে থাকে। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। এর মধ্যে শিশিরের ছোটবোন প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলল। ওকে নিয়ে ওদের পরিবারে অনেক ঝামেলা হল। তারপর থেকেই উনার একটাই কথা: উনি আমাকে ভালোবাসেন না, উনি আমাকে বিয়ে করতে পারবেন না। মাঝে-মাঝে স্বাভাবিক কথা বলতেন, আবার আমি বেশি পাগলামি করলে কঠিন বাস্তবতার কথা শোনাতেন। এসব শুনে আমার ভাল লাগত না। প্রেমালাপ হিসেবে সত্যকথন বরাবরই বেমানান। আমি শুনে কাঁদি, কষ্ট পাই। কিন্তু তারপরও আমি উনাকে কল দিই, কথা বলার চেষ্টা করি। এমনি করে দেড় বছর চলল। কল্প আমার একটা টেক্সটেরও কোনো রিপ্লাই দেয়নি। ওদিকে আমি শিশিরের সাথে কথা বলে যাচ্ছি, দেখা করছি, উনি প্রায়ই অবহেলা করতেন, কষ্ট হতো অতোটা তাচ্ছিল্য মেনে নিতে, সেসময় মনে হতো, কল্পের সাথে অন্যায় করছি বলেই এমন শাস্তি পাচ্ছি, আর অপরাধবোধটা আরো তীব্রভাবে কাজ করত। উনি বলতেন, “আমি জানি, আমার জন্যই তুমি কষ্ট পাচ্ছ। মেনে নাও না! একেক সম্পর্ক একেক রকমের। আমি এমনই! আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইলে আমাকে আমার মতো করেই মেনে নিতে হবে। কী আর করা যাবে, বলো?” আমার জীবনটা একরকম রৌদ্রছায়ার খেলা হয়ে গেল। শিশির খুব বাস্তববাদী একজন মানুষ ছিলেন। উনি বুঝতে পারতেন, উনি যে আমাকে ভালোবাসেন না, এটা যখনই আমার মনে আসে, তখন আমার খুব কষ্ট হয়। আমাকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করতেন, আমাকে বিভিন্ন কাজে উৎসাহ দিতেন। আমার প্রতি উনার আন্তরিকতা আর যত্নের কোনো কমতি ছিল না। তাই উনার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো কমেনি, বরং দিনদিন আরো বেড়ে গেছে। মনের মধ্যে আশা জাগত, হয়তো উনি এমনই, আসলে আমাকে ভালোবাসেন, কিন্তু মুখে বলতে পারেন না। বিয়ের জন্য আমি খুব পাগলামি শুরু করলে, উনি আমাকে বলতেন, “আচ্ছা দেখি, যদি কখনো তেমন সুযোগ আসে, যদি তোমাকে পাওয়াটা আমার ভাগ্যে থাকে, তখন দেখা যাবে। তবে আমি তোমাকে কথা দিতে পারছি না।” আমার জন্য উনার ওইটুকু কথাও ছিল অর্ধেক বিয়ে হয়ে যাওয়ার সমান।
এভাবেই চলছিল। সবকিছুই ঠিকঠাক, আবার কিছুই ঠিক নেই—এমনভাবে আমি বেঁচে ছিলাম। এক বছর পর কল্প ফোন করল, বলল, আমাকে ও বিয়ে করতে চায়, ও আমার সাথে দেখা করবে। আমার মন সায় দিল না। আমি নিজেই আগে ওকে বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করতাম, বলতাম, প্রয়োজনে কাজী অফিসে গিয়ে আমরা বিয়ে করি, ও আমাকে প্রবোধ দেয়ার জন্য বিয়ের মিথ্যে আয়োজন করত—বাসায় কথা বলছে, চেষ্টা করছে, কাজী অফিসে আমাদের বিয়ের সাক্ষী হিসেবে থাকার জন্য ওর বন্ধুকে বলে রেখেছে, এসব কথা বলত; সেসময় ওর ওরকম মিথ্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আস্তে-আস্তে আমি নিজেই আমার অবস্থান থেকে সরে এসেছি। শিশিরকে বললাম, “কল্প আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি কী করবো?” উনি বললেন, যাও করে ফেল। আমি কিন্তু তোমাকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিইনি। পরে এটা নিয়ে আমাকে কথা শোনাতে এসো না যেন!” দুইদিন ভাবলাম। না, মন সায় দিল না। আবারো শিশিরের সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা চলতে লাগল। শিশিরও আমাকে সময় দেন, ব্যস্ত থাকলে আমাকে বুঝিয়ে বলেন, ব্যস্ততার বাইরে অন্য সময়টা আমার জন্য রাখেন। শিশিরের নাম্বার কখনো অফ থাকলে, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট থাকলে আমার পাগল-পাগল লাগে, হতাশ হয়ে পড়ি। কখনো হঠাৎ মনে হয়, কল্পকে ফোন করি, কিন্তু ওর কোনো নাম্বার আমি মোবাইলে সেভ করে রাখিনি। মনে আসে, আমিই সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে পারি না, সব দোষ আমার। আমি কল্পের বিশ্বাস নষ্ট করে দিয়েছি। কাউকে ভালো না বাসার চাইতেও বড় অপরাধ তার বিশ্বাসকে নষ্ট করে দেয়া। কল্প নিজে যা ইচ্ছে হাজার কিছু করুক, কিন্তু ও তো আমাকে বিশ্বাস করত। ভাবত, আমি কখনোই এমন কিছু করতে পারব না, সবাইকে গর্ব করে বলত, “পৃথা অসাধারণ একজন মানুষ। পৃথিবী উল্টো দিকে ঘোরা শুরু করবে, কিন্তু ও কখনোই আমাকে ছেড়ে যাবে না।” যা ও কখনোই ভাবতে পারেনি, আমি তা-ই করেছি। আমি কল্পকে যতোটা ঠকিয়েছি, তার চাইতে অনেকবেশি ঠকিয়েছি নিজেকে। আমি নিজের চোখে নিজের যে রূপটা দেখলাম, সেটা তো আমি আগে চিনতাম না। নিজের প্রতি বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা, দুইই কমে গেছে। এতকিছুর পরও কিন্তু আমি একা। কী লাভ হলো? আমি অনেক খারাপ। নতুন কোনো সম্পর্কে জড়াতে পারি না। ভয় হয়, যদি আবারো কোনো ঝড়ে নিজেকে এলোমেলো করে ফেলি! তখন কী হবে? আমি তো কখনোই এমন ছিলাম না, বিনা প্রয়োজনে ছেলেদের সাথে কথা পর্যন্ত বলতাম না। তবে কেন এমন হলো? আমি পোশাকি পর্দাটা পুরোপুরি মেনে চলি, ধর্মীয় বিধিনিষেধ পালন করার ব্যাপারেও অনেক কঠোর থাকি, এক ওয়াক্ত নামাজও কখনো বাদ যায় না। প্রেমে পড়ার প্রথম দিকে ভাল কাজ করতেও ভয় লাগত, মনে হতো, প্রেমও করব, আবার পর্দাও করব, নামাজ পড়ব, কেমন না ব্যাপারটা? পরে বুঝলাম, আমি তো খারাপ কিছু করছি না, প্রেম করা তো কোনো অন্যায় না, তবে কেন আমি ভাল কাজ করতে পারব না? আমার মন যদি পবিত্র থাকে, যদি আমি আল্লাহ্র প্রতি ঐকান্তিক বিশ্বাস রাখি, যদি আমার নিয়ত শুদ্ধ হয়, তবে কেন আমি নামাজ পড়তে পারব না? ছোটবেলা থেকে যা করে আসছি, তা করতে না পারলে আমি বাঁচব কীকরে? তবে কিছু পরিবর্তন এসেছে আমার মধ্যে। আগে লাজুক ছিলাম, কারো সাথে কথা বলতে পারতাম না, এখন পারি। আগের চাইতে রাগ কমেছে, ধৈর্য বেড়েছে। আগে ভালোবাসায় বিশ্বাস করতাম না, এখন করি। এই ভালোবাসায় বিশ্বাসটাই আমাকে শেষ করে দিল। ভূতে বিশ্বাস আর ভালোবাসায় বিশ্বাস মূলত একই জাতীয় বিশ্বাস; দুটোর একটারও সুনির্দিষ্ট কোনো ভিত্তি নেই, অথচ দুটোর ভয়েই মানুষ অস্থির হয়ে থাকে।
২ নভেম্বর ২০১১
ইয়োকোহামা, জাপান
জীবন বয়ে চলে। যা কিছুই ঘটুক, যা কিছুই হোক, জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। বেঁচে থাকলে যে করেই হোক, জীবন এগোয়—-এটাই নিয়ম। কল্প ওর মতো করে ভাল আছে। বিয়ে করেছে, ওর সন্তানের বয়স দেড় বছর। অনেক বদলে গেছে সে; একটা প্রাইভেট ফার্মে আছে, মন দিয়ে গুছিয়ে সংসার করে, বউকে ভালোবাসে, এমনটাই শুনেছি। শিশির এখনো চাকরি খুঁজছেন। তেমন ‘পারফেক্ট’ কাউকে পাননি বলে বিয়েটা এখনো করা হয়ে ওঠেনি। আমি স্কলারশিপ নিয়ে জাপানে মাস্টার্স করতে এসেছি ৭ মাস হতে চলল। গত ১৯ দিন ধরে হসপিটালে; রোড অ্যাক্সিডেন্টে আমার বাম পায়ের দুটো আঙুল ভেঙে দুই ভাগ হয়ে গেছে, গোড়ালির দিকের অনেকটা মাংস ছিঁড়ে গেছে, প্রথম দিকে পায়ে পচন ধরে যাচ্ছিল, এখন অনেকটা ভাল আছি। হসপিটালে থাকতে আমার ভালোই লাগছে। খুব সুন্দর গোছানো পরিচ্ছন্ন পরিপাটি পরিবেশ। আমার বেডের জানালা দিয়ে একটা পার্ক দেখা যায়। সে পার্কের পাশ দিয়ে একটা হ্রদ বয়ে গেছে। সে হ্রদে রাজহাঁস ডানা ঝাপটায়, সাঁতরে চলে। ছোট-ছোট শিশুরা হ্রদের ধারে ছোটাছুটি করে, হ্রদের জলে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দেয়। জাপানি শিশুরা অরিগ্যামিতে ওস্তাদ! কত রঙবেরঙের বড়বড় ঘুড়ি বানিয়ে পার্কের মাঠটাতে ওড়ায়। হ্রদের ওদিকটায় কয়েকটা পাহাড় আছে, সেগুলি সবুজ ঘাসের গালিচায় ঢাকা। সেখানে মেঘের মতো ধবল গাভীর পাল চরে বেড়ায়। বিকেলের রোদটা এসে আমার গালে আর বিছানায় গড়াগড়ি খায়। আমি প্রায়ই ভাবি, এতো সুন্দর পৃথিবীটা আমি আরো আগে কেন দেখেনি? সুন্দর প্রেম কি তবে অন্য সকল সৌন্দর্য থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়? সুন্দর সকল কিছুই কি তবে একে অন্যের প্রতি ঈর্ষান্বিত? এই যে এখন প্রেম নেই, বেশ ভাল আছি। আচ্ছা, প্রেম কি সত্যিই নেই? এই সুন্দরের সাথে লুকোচুরি খেলার নেশাটা কী তবে? প্রেম নয়?
ডক্টর সানকিজির দেয়া একমুঠো বুনোফুলে রোজ আমার ঘুম ভাঙে। ফুলগুলো ভারি মিষ্টি, স্নিগ্ধ। হালকা নীল সাদা বেগুনি আর অদ্ভুত সুন্দর অচেনা কিছু রং। রোজই নির্দিষ্ট রংয়ের কিছু ফুল নির্দিষ্ট সংখ্যায়ই থাকে। আমি একটু অবাক হই। সানকিজি সকালে না আসতে পারলেও ফুলগুলো ঠিকই আমার কাছে পৌঁছে যায়। ডক্টর সানকিজি মানুষটা ভাল। খুবই ভদ্র, অমায়িক, বিনয়ী। ও আমাকে ডাকে পৃ বলে। ওই নামে ডাকার সময় ওর চোখমুখ শরীর সব একসাথে হাসতে থাকে। আর আমি ওকে ডাকি কিজি।
গুড মর্নিং বিউটিফুল পৃ!
আমার ধারণা, আমি দেখতে অসুন্দর বলেই হয়তো সে আমাকে মজা করে বিউটিফুল বলে। তাও শুনতে ভাল লাগে।
বললাম, তুমি কি জানো কিজি, তোমার দেয়া ফুলগুলো আমাকে খারাপ থাকতেই দেয় না? তোমার ফুলগুলো তোমার ট্রিটমেন্টের চাইতেও ভাল! হাহাহাহা…….আমি সত্যিই খুব ভাল আছি। তুমি আমাকে এতো দ্রুত সুস্থ করে দিচ্ছ কেন? তুমি কি চাও না আমি এখানে থাকি?
আমার কথা শুনে ডক্টর সানকিজি হাহা করে হেসে উঠল। বড় সরল আন্তরিক অকপট সে হাসি। হাসলে তাকে খুব বিশ্রী দেখায়, তবুও সে সবসময়ই প্রাণ খুলে হাসে। আর এই ব্যাপারটার জন্যই তাকে সুন্দর দেখায়। প্রাণখোলা হাসির মানুষ সবসময়ই সুন্দর।
পৃ, আমি আজ তোমার উপর খুব রেগে আছি।……কিজির স্বর গম্ভীর।
কিজি দ্রুত ইংরেজিতে কিছু বললে আমি বুঝতেই পারি না। তখন আমি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি, এটা বুঝতে পেরে কিজি কথাটা রিপিট করে এবং যথাসম্ভব ধীরে-ধীরে বলার চেষ্টা করে। আমি কখনো-কখনো ইচ্ছে করেই কিজিকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য একটা কথা বুঝতে পারার পরও ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। কিজি বারবারই কোনো ক্লান্তি বা বিরক্তি ছাড়া আমাকে কথাটা বুঝিয়ে বলে, এতোটাই আন্তরিকভাবে ও আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে উল্টো আমিই অস্বস্তিতে পড়ে যাই। কিজির সারল্য আমাকে লজ্জায় ফেলে দেয়।
আমি কি জানতে পারি, ডক্টর কিজি কেন আমার উপর রেগে আছে?
কিজি আমার কথার উত্তর না দিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে টেস্টের রিপোর্টগুলো দেখতে লাগল। দেখতে-দেখতে ওর ভ্রু কুঁচকে গেল।
আমি জানালা দিয়ে ভোরের আলোয় দূরের পাহাড়গুলো দেখছি। রোজ দেখতে-দেখতে অজানা অচেনা দেশের এই পাহাড়গুলো আমার বড় আপন হয়ে গেছে। ওরাও আমায় আপন করে নিয়েছে। জীবনে যাদের অনেক ভালোবেসেছি, তারাও কখনো আমায় এতোটা আপন করে নেয়নি। আসলে ওদের কোনো দোষ নেই। মানুষের ভালোবাসার ক্ষমতা অসীম। জীবন যা দেয়, তাতেই মানুষের দিব্যি চলে যায়। কিন্তু মানুষ অতোটুকুতে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না, সে আরো চায়, আরো চায়। এই বাড়তি চাহিদাই মানুষের ভালোবাসার ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। যার চাহিদা যতো কম, তার ভালোবাসার ক্ষমতা ততো বেশি। অভাবের চাইতে অভাবের অনুভূতি মানুষের ভালোবাসার ক্ষমতাকে বেশি কমিয়ে দেয়।
কিজি, তুমি পাহাড় ভালোবাস? ওদের সাথে তোমার কথা হয় কখনো? আমার তো মাঝেমধ্যে ওদের সাথে ঝগড়াও হয়ে যায়। হাহাহাহা……..
আচ্ছা কিজি, তুমি কি জানো, আজকে হলুদ টাইয়ে তোমাকে কতটা অসুন্দর দেখাচ্ছে? আমার ইচ্ছে করছে, এখুনি তোমার টাই ধরে টান মেরে তোমাকে ফ্লোরে ফেলে দিই! ওমা! ওভাবে করে কটমট চোখে তাকাচ্ছ কেন? হাসো কিজি! তোমাকে হাসিতেই মানায়।
একটা কথা জানার ছিল। তোমার দেয়া ফুলগুলোর মধ্যে নীলচে ছোট্ট ফুলটার চাষ কি বাংলাদেশে সম্ভব? আমাকে একটু জেনে জানাতে পারবে? আমার দেশের আবহাওয়া সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে তো? গুগল করবে? নাকি, আমি বলে দেবো?
তুমি কি বুঝতে পারছো কিজি, তুমি আমার সাথে অন্যায় করছ? তুমি আমাকে নিয়মে বেঁধে রাখতেই পারো, আমার মনটাকে কীকরে বাঁধবে, কিজি? অনেক কষ্ট করে আমি সুস্থ হয়েছি। ভালোবাসা ভীষণ বাজে একটা মানসিক রোগ। আমি আবারো অসুস্থ হতে চাই না।
জানো কিজি, আমার খুব ইচ্ছে হয়, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো আবার কোনো এক বাঁশিওয়ালা আসুক, আর আমাকে তার বাঁশির যাদুতে ভাসিয়ে নিয়ে যাক। আমি হারিয়ে যাবো তার যাদুমায়ার সুরে…….ওওইইইই দূর পাহাড়ে। হায় দেখ, যে হারাতে চায় না, সে হারিয়ে যায়; যে হারাতে চায়, সে কখনো হারাতে পারে না! বলতে পারো কিজি, কেন এমন হয়?
কিজিকে কাছে পেলে আমার কথা ফুরোয়ই না।
একদিন জানালা থেকে মুখ সরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখি কিজি নেই; আমার বিছানায় পরে আছে একটা ভেজা টিস্যু, নরোম। চোখের জল বড় নরোম হয়। ওই টিস্যুটা আমি টিস্যুতে মুড়িয়ে তুলে রাখলাম। নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কোনোকিছুই আমার কাছে সামান্য নয়। কিজি কখনো আমাকে পাগল ভাবত কিনা কে জানে? ভাবত না বোধহয়। অতোটা সারল্য নিয়ে কাউকে পাগল ভাবা যায় না।
ডক্টর সানকিজি হাসিমুখে রুমে ঢুকল।
আজ কেমন আছো বিউটিফুল পৃ?
আমি ভাল নেই কিজি।
ওহহহহ্! কেন? কী হয়েছে? বলো, কী করতে হবে? পায়ের ব্যথাটা আবার উঠেছিল?
তুমি গতকাল আটটা টিস্যু থেকে একটা টিস্যু আমার রুমে ফেলে রুমটাকে কেন নোংরা করে গিয়েছিলি, কিজি?
কিজির মধ্যে যেন ভূমিকম্প হয়ে গেল। সে এসি’র মধ্যেও ঘামতে শুরু করল।
তুমি কীভাবে জানলে যে আমি আটটা টিস্যুই নিয়েছিলাম!?
কিজি হঠাৎ খুবই সিরিয়াস হয়ে উঠল।
ওহ্ কিজি! কাম অন! জাস্ট কিডিং! তুমি কি সত্যিই আটটা টিস্যুই ইউজ করেছিলে? তুমি সুস্থ আছো তো কিজি? তোমার ঠান্ডা লাগেনি তো? তোমার কী হয়েছে?
এবার যেন কিজি একটু শান্ত হল।
হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ! তুমি ঠিকই বলেছ পৃ, আমার একটু ঠান্ডা লেগেছিল। (কিজির উত্তরটা তৈরি করে দিয়ে আমিই ওকে বাঁচিয়ে দিলাম যেন!)
দয়া করে আমায় একটু নিঃশ্বাস নিতে দাও, কিজি। আমার দম্ বন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে একটা কাগজ আর একটা কলম দেবে? শিশিরকে আমার অনেক অনেককিছু লিখতে হবে। প্লিজ কিজি, প্লিজ……
তুমি দিনদিন বড্ডো অস্থির হয়ে যাচ্ছ, পৃ। এসব তোমার শরীরের জন্য মোটেও ভাল নয়। কালকে তোমার ইউরিনে ইনফেকশন ধরা পড়েছে; ভেরি মাইল্ড ইনফেকশন যদিও। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা কর, পৃ। এতটা অস্থির হয়ো না।
আর দিনদিন তুমি খারাপ থেকে আরো খারাপতর হচ্ছ, কিজি। আই হেইট ইউ, কিজি! আই রিয়েলি হেইট ইউ!
হাহাহা……. দ্যাটস্ গ্রেট! গো অন বিউটিফুল পৃ! আই ডু লাইক ইট! লাভ অর হেইট্রেড! অ্যানিথিং ফ্রম ইউ উইল বি মাই গিফট্!
এইটুকু বলে ডক্টর সানকিজি চলে গেল। এই প্রথম কিজি আমার রুম থেকে হেসে বের হল।
আটটা টিস্যুর কথাটা হয়তো তাকে বলা ঠিক হয়নি। আমি সবসময় খেয়াল করেছি, চেকআপের সময় আমি বাইরে তাকিয়ে থাকার ফাঁকে কিংবা আনমনে শুয়ে থাকার ফাঁকে কিজি সবসময় রুম থেকে ভেজাচোখে বের হন। আমি রোজ টিস্যুবক্সের টিস্যুগুলি বের করে সেখানে গুনেগুনে দশটা টিস্যু সাজিয়ে রেখে দিই এবং বুঝতে পারি, কিজি কতটা টিস্যু নিয়েছে। সেদিন কিজি সাতটা টিস্যু পকেটে নিয়ে ভুলে একটা আমার বিছানায় ফেলে রেখে গিয়েছিল।
আমার কষ্ট—কিজিকে কাঁদায়।
কিজির কান্না—আমাকে আহত করে।
আচ্ছা, ভালোবাসা সহ্য করা এতো কঠিন কেন?
চারদেয়ালের মধ্যে অসংখ্য যন্ত্রপাতির সাথে বসবাস; মনখারাপের অনেক উপাদানের ভিড়ে কিজির কান্নাও জায়গা করে নেয়। কাঁচের জানালায় ঠিকরেপড়া ক্লান্ত রৌদ্রের মিষ্টি আলতো আদর গায়ে মাখতে-মাখতে কী এক গভীর আচ্ছন্নতায় আমি একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।