এই ধারণাই তন্ত্রশাস্ত্রে এসে “জগদ্ধাত্রী” নামের দেবীতত্ত্বে পরিণত হয়। কাত্যায়নী তন্ত্র, শ্রীতত্ত্বচিন্তামণি ও নিত্যশোড়শারণব তন্ত্র প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁকে বলা হয়েছে “ধারকশক্তি”, “স্থিতিদায়িনী” ও “সত্ত্বগুণ-প্রধানা”—অর্থাৎ এমন এক শক্তি, যিনি জগৎকে অন্তর্নিহিত স্থিতির দ্বারা ধারণ করে রাখেন। তিনি চলমান জগতের অন্তর্গত শান্তি, সেই অবিচল কেন্দ্র, যা সব পরিবর্তনের মাঝেও অবিচল থাকে। এই দর্শনের দার্শনিক ভিত্তি অদ্বৈত বেদান্তের “চিত্” ও “স্থিতি”-র মিলনে গঠিত—যেখানে বলা হয়েছে, “স্থিতি বিনা যোগঃ নাস্তি,” অর্থাৎ স্থিতি ছাড়া যোগ নেই; তেমনি তন্ত্রে বলা হয়, “স্থিতি বিনা শক্তিঃ নাস্তি”—স্থিতি ছাড়া শক্তি প্রকাশিত হয় না। চেতনার এই দুই দিক—অচল জ্ঞান ও কার্যশক্তি—একত্রে মিলেই গঠিত জগদ্ধাত্রী, যিনি একযোগে “চেতনা ও কর্ম”, “জ্ঞান ও ধৃতি”, “মন ও প্রাণ”-এর ঐক্যের প্রতীক।
জগদ্ধাত্রীর প্রতিমা বা উপাসনাকাঠামো কোনো একদিনে সৃষ্টি হয়নি; এটি বৌদ্ধ ও শাক্ত প্রতীকের এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক রূপান্তরের ফল। প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের “ধারিণী” যেমন বিশ্বচেতনার মাতৃরূপ—যিনি জ্ঞান ও করুণার সংরক্ষিকা, তেমনি শাক্ত তন্ত্রে জগদ্ধাত্রী সেই মাতৃশক্তি যিনি সত্ত্বগুণের মধ্য দিয়ে চেতনার স্থিতি ও সমতা রক্ষা করেন। বৌদ্ধ ধারিণীর প্রশান্ত শুভ্র মুখের প্রতিফলনই আমরা দেখি জগদ্ধাত্রীর শুভ্রবর্ণে; তাঁর এই শুভ্রতা প্রতীক সত্ত্বগুণের—যা রজঃ ও তমঃ গুণের ঊর্ধ্বে, নির্মল ও আলোকিত চেতনার প্রতিচ্ছবি। তাই জগদ্ধাত্রী “স্থিতির দেবী”—যিনি চঞ্চলতার মধ্যেও অচল, বহুত্বের মধ্যে থেকেও একত্বে স্থিত।
এই ধারকশক্তির আরেক প্রতীক রূপ “বজ্রধারিণী” বা “বজ্রযোগিনী”—যাঁর হাতে ধরা বজ্র অবিনাশী প্রজ্ঞার প্রতীক, যেমন জগদ্ধাত্রীর বাহন সিংহ প্রখর চেতনার প্রতীক। “বজ্র” যেমন অচল জ্ঞান, তেমনি “সিংহ” হলো জ্ঞানের সাহস ও দীপ্তি—অভয়তার মূর্ত রূপ। দুই-ই নারীশক্তির আত্মপ্রকাশ: একদিকে বৌদ্ধ বজ্রধারিণী, অন্যদিকে শাক্ত জগদ্ধাত্রী—উভয়েই স্থিতি ও চেতনার অবিচল দীপ্তিকে ধারণ করে বিশ্বকে রক্ষা করেন। এভাবেই বৌদ্ধ-জৈন “ধারকশক্তি” শাক্ত তন্ত্রে এসে পরিণত হয়েছে “জগদ্ধাত্রী”-তে—যিনি একাধারে শান্ত, স্থিত, করুণাময় ও বিশ্বধারিণী।
গুপ্তোত্তর যুগে ভারতীয় চিন্তাধারায় এক আশ্চর্য রূপান্তর ঘটে—যা শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক স্তরেও গভীর। এই সময় থেকেই বৌদ্ধ ও শাক্ত তন্ত্রের পারস্পরিক প্রভাব এক নতুন যুগের সূচনা করে, যাকে ইতিহাসবিদেরা নাম দিয়েছেন “তান্ত্রিক সমন্বয় যুগ”—যা প্রায় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে বিস্তৃত। গুপ্তযুগের পর রাজনৈতিকভাবে ভারত যখন বহু রাজ্যে বিভক্ত, তখন আধ্যাত্মিক ঐক্যের এক নতুন প্রচেষ্টা দেখা যায় ধর্ম ও তন্ত্রচর্চার জগতে। সেই প্রচেষ্টার মূলমন্ত্র ছিল সংহতি—জ্ঞান ও শক্তি, প্রজ্ঞা ও করুণার, বোধি ও লীলার ঐক্যসাধন।
এই ঐতিহাসিক পর্বে যখন বৌদ্ধ বজ্রযান ও হিন্দু শ্রীবিদ্যা তন্ত্র পরস্পরের ভাবধারায় মিশে যেতে শুরু করে, তখন কেবল দেবীচিত্র বা প্রতিমা নয়, বরং তাদের অন্তর্নিহিত দর্শনও এক গভীর সেতুবন্ধ তৈরি করে। এখানে “বজ্রযান” মানে সেই বৌদ্ধ পথ, যেখানে জ্ঞান ও শক্তি একত্রে সাধনার উপায়। “বজ্র” শব্দটি বোঝায় অবিনাশী চেতনা—যেমন বজ্র কখনও ভাঙে না, তেমনি এই চেতনা অপরাজেয় ও অচল; আর “যান” মানে পথ বা বাহন, অর্থাৎ এমন এক যোগপথ, যা এই অবিনাশী বোধে পৌঁছে দেয়।
এই বজ্রযান দর্শনের দুই মৌল স্তম্ভ হলো “প্রজ্ঞা” (prajñā) ও “করুণা” (karuṇā)। প্রজ্ঞা মানে কেবল তথ্যগত জ্ঞান নয়, বরং এমন এক অন্তর্দৃষ্টি—যা বিষয়ের কেন্দ্রে পৌঁছে তার শূন্যতা ও ঐক্য উপলব্ধি করে। করুণা তার পরিপূরক দিক—এই অন্তর্দৃষ্টির জীবন্ত রূপ, যা সকল জীবের কল্যাণে প্রকাশিত হয়। তাই প্রজ্ঞা হলো জ্ঞানের গভীরতা, আর করুণা সেই জ্ঞানের প্রেমময় প্রকাশ। এই দুইয়ের মিলনেই সৃষ্টি হয় পূর্ণ চেতনা, যাকে বজ্রযানে বলা হয় “অভেদ চেতনা”—যেখানে বোধ ও অনুকম্পা এক হয়ে যায়।
অন্যদিকে, হিন্দু তান্ত্রিক ঐতিহ্যের “শ্রীবিদ্যা” ও “ত্রিপুরা-তত্ত্ব” এই দ্বৈত নীতিরই রূপান্তর। “শ্রীবিদ্যা” মানে দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর উপাসনা—যিনি তিনলোকের (ত্রিপুর) মধ্যস্থিত চৈতন্যস্বরূপা। এখানে ত্রিপুর মানে তিন স্তর—বাহ্য জগৎ (জাগ্রৎ), স্বপ্ন জগৎ (স্বপ্ন), ও গভীর নিদ্রা বা কারণ অবস্থা (সুষুপ্তি); আর ত্রিপুরাসুন্দরী সেই চেতনা, যিনি এই তিন অবস্থার মধ্য দিয়েও অবিচল, যিনি চিরন্তন সাক্ষী। শ্রীবিদ্যা তন্ত্রে বলা হয়, এই দেবীই “চেতনার কেন্দ্রবিন্দু”, অর্থাৎ যিনি প্রজ্ঞার আলোয় বিশ্বকে ধারণ করেন এবং করুণার মাধ্যমে তাকে রক্ষা করেন।
এই সময়ে দেবীচক্র—যেমন অষ্টগৌরী (আটটি দেবীশক্তি), ষোড়শ নিত্যা (ষোলো দেবীচেতনা) ও ত্রিপুরা-তত্ত্ব—এইসব তান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে বৌদ্ধ দেবীমণ্ডলীর প্রতীক ও দার্শনিক ভাবনা। “তারা” হয়ে ওঠেন মুক্তিদায়িনী করুণাশক্তি; “প্রজ্ঞাপারমিতা” (জ্ঞানের পরম পরিপূর্ণতা) বোঝান সেই সীমাহীন অন্তর্দৃষ্টি, যা বুদ্ধত্বের মূলে; “বজ্রযোগিনী” (অভেদ যোগচেতনার রূপ) প্রকাশ করেন অনিত্যতার মধ্যেও স্থিত সচেতনতার দীপ্তি; আর “উষ্ণীষবিজয়া”—বুদ্ধের মাথার উষ্ণীষ থেকে উদ্ভূত দেবী—প্রতীক জ্ঞানের সর্বোচ্চ আশ্রয় বা বোধিসত্ত্বিক পরিপূর্ণতার।
এখানে দেখা যায়, এই সংমিশ্রণ কেবল প্রতিমার নয়, বরং এক অন্তর্দার্শনিক যাত্রা—যেখানে “স্থিতি” (অচলতা) ও “চলন” (গতি), “শান্তি” ও “শক্তি”, “নির্বাণ” ও “সংসার”—এই আপাতবিরোধী ধারণাগুলি এক অভিন্ন বোধে মিলিত হয়। সেই একত্বচেতনা বলে—জ্ঞান ও করুণা, স্থিরতা ও ক্রিয়া, মুক্তি ও জগৎ, সবই এক চেতনার ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ। এই অভেদ তত্ত্বই পরে জগদ্ধাত্রী-চিন্তায় পরিণত হয়, যেখানে দেবী নিজে সেই ধারকশক্তি—যিনি জ্ঞান ও প্রেম, স্থিতি ও প্রকাশ, উভয়কেই এক সত্তায় ধারণ করেন।
এই সংমিশ্রণেরই এক উজ্জ্বল পরিণতি হলো “জগদ্ধাত্রী”—যিনি বৌদ্ধ ধারিণী ও বজ্রযোগিনীর উত্তরাধিকার বহন করে শাক্ত চেতনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর মূর্তি এক বহুমাত্রিক প্রতীকবোধের ধারক। তাঁর মুখমণ্ডল শান্ত ও প্রশান্ত—যা প্রজ্ঞাপারমিতার সেই নির্বিকার প্রজ্ঞার স্মারক; তাঁর শুভ্রবর্ণ সত্ত্বগুণের চিহ্ন—নির্মল, বিশুদ্ধ, জ্ঞানময়; তাঁর সিংহবাহন বজ্রচেতনার প্রতীক—অভয়, স্থিত, ও অপরাজেয়; আর তাঁর স্থির দৃষ্টি প্রতিফলিত করে সেই অচল ব্রহ্মচেতনা, যেখানে তন্ত্র ও বেদান্ত মিলিত হয়ে চেতনার পূর্ণ সমতা প্রকাশ করে।
ডি. ডি. কোসাম্বি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও নন্দলাল দে প্রমুখ ইতিহাসবিদেরা এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন “শাক্ত-বজ্রযান চেতনার সমন্বিত বিকাশ” বা syncretic evolution of Śākta-Vajrāyana consciousness। তাঁদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গুপ্তোত্তর ভারতের এই তান্ত্রিক যুগে “মাতৃতত্ত্ব” কেবল ধর্মীয় প্রতীক রূপে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এটি এক মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক সত্যে পরিণত হয়েছিল। দেবীমূর্তি তখন হয়ে ওঠেন মানবচেতনার অন্তর্দার্শনিক কেন্দ্র—এক এমন প্রতীক, যিনি একদিকে আত্মসংযম ও অন্তরস্থিত শান্তির প্রতিমা, অন্যদিকে সামাজিক সংহতি ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক।
জগদ্ধাত্রী তাই কেবল এক শাক্ত দেবী নন; তিনি সেই সমন্বিত ভারতীয় চেতনার প্রতীক, যেখানে বৌদ্ধ প্রজ্ঞা, জৈন সংযম ও শাক্ত শক্তি একই সূত্রে গাঁথা। তাঁর মধ্যে ইতিহাস, দর্শন ও সমাজচেতনার যে-স্রোত মিলিত হয়েছে, তা আজও প্রকাশ করে সেই শাশ্বত সত্য—স্থিতি ও শক্তি, ধৃতি ও করুণা, জ্ঞান ও প্রেম—সবই এক অবিচ্ছিন্ন ধারার প্রকাশ, এক বিশ্বধারিণী চেতনার অনন্ত সুর।
জগদ্ধাত্রী পূজা তার বহিরঙ্গ আচার বা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে ভারতের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে এক মহৎ দার্শনিক সূত্রকে বহন করে—এটি ধৃতি-তত্ত্বের এক ধারাবাহিক ও ক্রমবিকাশমান রূপ। এই ধৃতি-তত্ত্ব মূলত সেই নীতি, যা মানবচেতনার স্থিতি, সংযম এবং ভারসাম্যকে “শক্তি”-রূপে প্রকাশ করে। বৌদ্ধ, জৈন ও শাক্ত—এই তিন দর্শনধারায় এই নীতি তিনটি ভিন্ন রূপে বিকশিত হয়েছে, অথচ তাদের অভ্যন্তরীণ আত্মা এক।
অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র—এই নামেই লুকিয়ে আছে এর দার্শনিক মহিমা। “অষ্টসাহস্রিকা” অর্থ আট হাজার, আর “প্রজ্ঞাপারমিতা” মানে প্রজ্ঞার পরিপূর্ণতা। অর্থাৎ, এটি সেই সূত্র, যেখানে আট হাজার স্তব বা শ্লোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে—কীভাবে জ্ঞান, করুণা ও শূন্যতার উপলব্ধির মধ্য দিয়ে এক বোধিসত্ত্ব চূড়ান্ত প্রজ্ঞায়, অর্থাৎ বুদ্ধত্বে পৌঁছায়। এই সূত্র মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রাচীনতম এবং মৌলিক প্রজ্ঞাপারমিতা সাহিত্যগুলির অন্যতম, যার প্রভাব পরবর্তীকালে “বজ্রযান”, “যোগাচার”, এমনকি “মধ্যমক” দর্শনেও গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
এই সূত্রের কেন্দ্রবিন্দু হলো “শূন্যতা” (śūnyatā)—একটি এমন দৃষ্টিভঙ্গি, যা বলে যে, সমস্ত বস্তু, অনুভূতি, চিন্তা ও ধর্ম (ধর্ম এখানে মানে সব অস্তিত্বমান বাস্তব উপাদান) আসলে নিজস্ব স্বভাব (স্বভাব-স্বতন্ত্র সত্তা) নিয়ে থাকে না। তারা সবই পরস্পরনির্ভর, সম্পর্কিত এবং আপাতভেদ সত্ত্বেও এক অন্তর্নিহিত ঐক্যের মধ্যে স্থিত। বোধিসত্ত্ব যখন এই শূন্যতার সত্য উপলব্ধি করেন, তখন তিনি সমস্ত দ্বৈততার সীমা অতিক্রম করেন—সুখ-দুঃখ, অর্জন-ক্ষতি, জন্ম-মৃত্যু—সব কিছুই তখন এক অপরূপ সমতার আলোকপ্রভায় বিলীন হয়ে যায়।
এই সূত্রে প্রজ্ঞা বা prajñā কেবল চিন্তাশক্তি নয়, এটি এক অন্তর্দৃষ্টি—যা জ্ঞানের সমস্ত ধারণাকে অতিক্রম করে। বুদ্ধ এখানে বলেন, “যিনি সমস্ত ধর্মকে যেমন তা, তেমনভাবে জানেন, তিনিই প্রজ্ঞাপারমিতায় প্রতিষ্ঠিত।” এই জ্ঞান কোনো বাহ্যিক তত্ত্ব নয়, বরং নিজ অভিজ্ঞতার গভীরে উন্মোচিত সেই বোধ, যা বলে—যা-কিছু প্রতীয়মান, তা অনিত্য; আর অনিত্যতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে নিত্যতত্ত্বের আভাস। এই উপলব্ধির সঙ্গে যুক্ত করুণা বা karuṇā—যা এই জ্ঞানের জীবন্ত প্রকাশ, সকল জীবের কল্যাণে হৃদয়ের প্রসারণ।
অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রে বোধিসত্ত্বকে বলা হয়েছে সেই সাধক, যিনি “সব ধর্মে প্রশিক্ষিত, অথচ কোনো ধর্মে আবদ্ধ নন।” এই বাক্যই সূত্রটির মূল দর্শন প্রকাশ করে—প্রশিক্ষণ বা সাধনা প্রয়োজন, কিন্তু সেই সাধনায় আসক্তি নয়। একবার সত্য উপলব্ধি হয়ে গেলে, তখন কর্মের মধ্যেও থাকে নিস্ক্রিয়তা, আর নিস্ক্রিয়তার মধ্যেও কর্মের অন্তর্নিহিত ছন্দ। এটিই “অচল প্রজ্ঞা”—যা কর্মের মাঝেও স্থির, এবং স্থিতির মধ্যেও জীবন্ত।
এই সূত্রে বার বার উল্লেখ আসে “তথতা” বা tathatā—যার অর্থ “যেমন আছে, তেমনভাবে থাকা।” বোধিসত্ত্ব সত্যকে যেমন আছে তেমনই দেখেন, কোনো প্রক্ষেপণ বা ব্যাখ্যার আড়াল ছাড়া। এখানেই তিনি “অভেদ চেতনা” উপলব্ধি করেন, যেখানে সব বিপরীত সত্তা—সংসার ও নির্বাণ, গতি ও স্থিতি, জ্ঞান ও মায়া—সবই এক পরম সত্যের বিভিন্ন ছায়া।
অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের এই বাণী পরবর্তীকালে বজ্রযান ও শাক্ত তন্ত্রের মিলনেও প্রতিধ্বনিত হয়—যেমন বজ্রের অচলতা, তেমনি প্রজ্ঞার অচলতা; আর সেই অচল জ্ঞানের মধ্যে লুকিয়ে থাকে করুণার প্রবাহ। এখানেই সূত্রের গভীরতম দার্শনিক মর্ম: স্থিতিই শক্তি, শূন্যতাই পূর্ণতা, আর নীরবতাই সর্বোচ্চ জ্ঞানের ভাষা।
এই সূত্র কেবল এক ধর্মগ্রন্থ নয়, এটি মানবচেতনার স্থিতি ও মুক্তির মহাগান—যেখানে “ধারণ”, “স্থিতি”, ও “প্রজ্ঞা”—এই তিন একত্রে মিলিত হয়ে রচনা করে সেই চিরন্তন বাণী: “যিনি জানেন কিছুই আলাদা নয়, তিনিই সব কিছু জানেন।”
বৌদ্ধ ধারায় “ধারিণী” বা “ধারণশক্তি” (অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র, অধ্যায় ২৭) সেই চেতনা, যিনি সমস্ত ধর্ম, করুণা ও প্রজ্ঞাকে ধারণ করেন। তিনি কেবল মন্ত্রনাদ নন, বরং সেই অন্তর্নিহিত শক্তি, যা জ্ঞানকে স্থিত রাখে, পরিবর্তনের মাঝেও তার দীপ্তি অক্ষুণ্ণ রাখে। জ্ঞানের এই ধারণ-ক্ষমতাই বৌদ্ধ চেতনার কেন্দ্রীয় ভিত্তি—এটি ধ্বংস নয়, রক্ষা; গতি নয়, স্থিতির মধ্যে লুকানো এক শান্ত শক্তি।
জৈন দর্শনে এই নীতিই “ধৃতি” নামে পরিচিত (তত্ত্বার্থসূত্র ৯.৬), যা মানসিক সংযম ও নৈতিক দৃঢ়তার প্রতীক। এখানে শক্তি মানে আক্রমণ নয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ; বীরত্ব মানে নিজের অন্তর্দ্বন্দ্ব জয়।