জগদ্ধাত্রী: ১০



মাছভোগ কোনো নিষিদ্ধতার ভঙ্গ নয়, বরং আধ্যাত্মিক অন্তর্ভুক্তির প্রতীক—যেখানে জীবন, ভোগ, শরীর, রসনা, এমনকি ইচ্ছাও দেবীর লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেই লীলায় কোনো কিছুই অশুচি নয়, কারণ সবই চেতনার রূপান্তরে পবিত্র। এই শিক্ষাই বামাচারের মূল: “অন্ধকারকে বর্জন নয়, বরং নিজেকে আলোকিত করো।” আর এই আলোকই জগদ্ধাত্রীর শক্তি—যিনি কুণ্ডলিনীর মতো জাগিয়ে তোলেন সেই চেতনা, যেখানে ভোগ ও যোগ, শক্তি ও শান্তি, জীবন ও ব্রহ্ম—সব একাকার হয়ে যায়।

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজায় মাছের ভোগ দেবীর জন্য বাহ্যিক অর্ঘ্য নয়; এটি মানুষের আত্মনিবেদন—জীবনের আস্বাদনকে দেবীর চেতনার আলোয় উৎসর্গ করা। এই রীতি শেখায়, খাদ্যও তপস্যা হতে পারে, যদি তা ভোগ নয়, ব্রহ্মার্পণ হয়। গীতায় যেমন বলা হয়েছে—“যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সান্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ” (৩।১৩)—যাঁরা ঈশ্বর, দেবতা, অতিথি এবং অন্যান্য জীবের উদ্দেশ্যে নিবেদন করার পর অর্থাৎ যজ্ঞের অবশিষ্ট বা প্রসাদ গ্রহণ করেন, তাঁরা সকল প্রকার পাপ থেকে মুক্ত হন। পক্ষান্তরে, যারা কেবল নিজের উদরপূর্তির জন্য অন্ন রান্না করে, তারা আসলে পাপকেই ভোজন করে। এখানে 'যজ্ঞ' বলতে শুধু অগ্নিতে আহুতি দেওয়া নয়, বরং যে-কোনো নিঃস্বার্থ কর্ম বা সেবাকে বোঝানো হয়েছে। যারা যজ্ঞরূপে ভোগ করেন, তারা পাপ থেকে মুক্ত হন। অর্থাৎ, যদি খাদ্য চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে সেটি কেবল আহার নয়; তা হয়ে ওঠে সাধনা।

৪. সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতা ও উত্তরাধিকার: জগদ্ধাত্রী দেবীর পূজা ও তত্ত্ব রামকৃষ্ণ-সারদা পরম্পরার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত—কারণ এই উপাসনা কেবল একটি শাক্ত আচার নয়, বরং শক্তি, ধৃতি ও ভক্তির এক অদ্বৈত সংহতি। এই তত্ত্বের জীবন্ত প্রতিমূর্তি ছিলেন শ্রীমা সারদা দেবী, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের আধ্যাত্মিক সহধর্মিণী ও শক্তিস্বরূপা। তিনি স্বয়ং জয়রামবাটিতে জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন, যা আজও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন গভীর ভক্তি, শৃঙ্খলা ও তপস্যার সঙ্গে পালন করে আসছে। তাঁর কাছে জগদ্ধাত্রী কেবল এক দেবী নন—তিনি অন্তর্গত চেতনার সেই শক্তি, যিনি জীবনের প্রতিটি কর্মে স্থিতি, সাম্য ও আত্মনিবেদন প্রতিষ্ঠা করেন (শ্রীশ্রীমা সারদা দেবী ও তাহাঁর দেবতা শ্রী রামকৃষ্ণ, স্বামী গম্ভীরানন্দ, ১৯৬৪, অধ্যায় ১২)।

সারদা দেবী একবার বলেছিলেন—“যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে-ই প্রকৃত শক্তিমান—সে-ই জগদ্ধাত্রী।” (The Gospel of the Holy Mother, Advaita Ashrama, 1954, p. 223)। এই উক্তির মধ্যেই নিহিত আছে জগদ্ধাত্রীর তত্ত্বের সারাংশ। “নিয়ন্ত্রণ” এখানে দমন নয়, বরং আত্মসচেতন স্থিতি—যেখানে মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয় ও কর্ম একত্রে চেতনার নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই আত্মনিয়ন্ত্রণই তাঁর কাছে সত্য শক্তি। তাই সারদা দেবীর উপাসনায় বাহ্যিক আড়ম্বর নেই; সেখানে মাতৃত্ব, সহানুভূতি ও আত্মশাসনের এক শান্ত দীপ্তি বিরাজমান। তিনি দেখিয়েছিলেন, শক্তি মানে ধ্বংস নয়, বরং শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত কর্মশক্তি; নিয়ন্ত্রণ মানে দমন নয়, বরং চেতনার স্থিরতা। তাঁর জীবনে তন্ত্রের কঠোরতা ও ভক্তির কোমলতা একীভূত হয়েছিল—যেখানে ভোগ ও যোগ, কর্ম ও ধ্যান, গৃহ ও আশ্রম এক মহাসাধনায় রূপান্তরিত হয়েছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসও দেবী জগদ্ধাত্রীকে দেখেছিলেন সেই সর্বব্যাপী শক্তি হিসেবে, যিনি মায়া ও ব্রহ্ম—দুইয়েরই সমন্বয়। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত-এ তিনি বলেন—“যে-শক্তি জগৎ সৃষ্টি করে, সেই শক্তিই জগৎকে ধারণ করে—সে-ই জগদ্ধাত্রী।” (কথামৃত, খণ্ড ২, পৃ. ১১৪)। এই উক্তি কেবল ধর্মীয় নয়, দর্শনীয়ও—কারণ এটি অদ্বৈত বেদান্তের সেই মূল নীতিকেই প্রতিফলিত করে, যেখানে শক্তি ও ব্রহ্ম অবিচ্ছেদ্য। রামকৃষ্ণের মতে, জগদ্ধাত্রী হলেন মায়ার শুদ্ধতম রূপ, যিনি জগৎকে আবদ্ধও করেন, আবার মুক্তিও দেন; তাঁর করুণাই মায়াকে মোক্ষের সোপানে রূপান্তরিত করে। তাই তিনি বলেছিলেন—“মা শক্তি ছাড়া কিছুই হয় না; মা-ই ধরেন, মা-ই মুক্তি দেন।” (কথামৃত, খণ্ড ৩, পৃ. ১৭২)।

এই তত্ত্বের জীবন্ত প্রতিফলন দেখা যায় জয়রামবাটির রামকৃষ্ণ মঠে পালিত বার্ষিক জগদ্ধাত্রী পূজায়। ভোরে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ, তারপর পাঠ করা হয় দেবী-মাহাত্ম্যম্‌—যেখানে দেবীকে বলা হয়েছে “ধারণাশক্তি”, অর্থাৎ সেই শক্তি যিনি ব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করেন (মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ৮৯.১-৪)। বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় মা সারদার আরতি ও শক্তি-স্তব পাঠ, যেখানে দেবীকে স্তব করা হয় “আধারভূতা”—অর্থাৎ সমস্ত অস্তিত্বের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে। মঠের সন্ন্যাসীরা বলেন, এই পূজা তন্ত্রের আচার নয়, বরং তন্ত্রের মধ্য দিয়ে ভক্তির উদ্‌ভাস—যেখানে ধ্যান, কর্ম ও জ্ঞান একত্রে মিলিত হয়।

পূজার দিনে জয়রামবাটির পরিবেশ মাতৃত্বের আভায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। দেবীর ভোগে থাকে অন্ন, ফল, ক্ষীর ও প্রসাদ, যা পরে ভক্তদের মধ্যে যজ্ঞশিষ্ট হিসেবে বিতরণ করা হয়। (যজ্ঞশিষ্ট হলো সেই পবিত্র ভোজ্য, যা অন্যের বা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদন করার পর অবশিষ্ট থাকে এবং যা অহংকারহীনভাবে গ্রহণ করা হয়।) শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা (৩.১৩)-এ বলা হয়েছে—“যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সান্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ”—যারা ঈশ্বর, দেবতা ও সকল জীবের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে ভোগ করেন, তারা মুক্ত হন; কারণ চেতনার সঙ্গে যুক্ত আহার ভোগ নয়, তা সাধনা। গীতার প্রেক্ষাপটে, 'যজ্ঞশিষ্ট' ভোজন করার অর্থ হলো— নিজের জন্য ভোগ না করে, প্রথমে ঈশ্বর, সমাজ বা অপরের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে তারপর সেই অবশিষ্ট গ্রহণ করা। এটি ত্যাগ, সেবা ও নিষ্কাম কর্মের প্রতীক। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা বলেন—এই ভোগ কেবল খাদ্য নয়, এটি ব্রহ্মার্পণ; আর এই ব্রহ্মার্পণই জগদ্ধাত্রীর পূজার আত্মা।

এভাবে জগদ্ধাত্রী পূজার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ-সারদা পরম্পরা এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে—তন্ত্রের কঠোরতা ও ভক্তির কোমলতা, নিয়ন্ত্রণ ও করুণার ঐক্য। এখানে ব্রহ্মচেতনা কোনো গূঢ় তত্ত্ব নয়; এটি প্রতিদিনের সত্ত্বচর্চা, আত্মসংযম ও নীরব প্রেমের সাধনা। জগদ্ধাত্রী হয়ে ওঠেন আত্মসংযমের দেবী—সেই চেতনা-শক্তি, যিনি প্রতিটি কর্মকে ব্রহ্মার্পণে রূপান্তরিত করেন।

অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, জগদ্ধাত্রী সেই শক্তি, যেখানে জগৎ, শক্তি ও প্রেম একাকার। ব্রহ্ম যখন মায়ার দ্বারা সৃষ্টিকে ধারণ করেন, তখনই তিনি জগদ্ধাত্রী রূপে প্রকাশিত হন; আর যখন মানুষ আত্মসংযম ও জ্ঞানের দ্বারা নিজের অন্তরের মায়াকে অতিক্রম করে, তখনই সে জগদ্ধাত্রীর চেতনার অংশ হয়ে ওঠে। এই তত্ত্বেরই প্রতিফলন সারদা দেবীর জয়রামবাটির পূজায়—যেখানে তিনি দেবীকে আহ্বান করেন কেবল শক্তি হিসেবে নয়, বরং মায়াময় মাতা হিসেবে, যিনি বলেন—“মা-ই সংসার, মা-ই ব্রহ্ম।” (The Gospel of the Holy Mother, 1954, p. 226)।

জগদ্ধাত্রী পূজার মধ্যে রামকৃষ্ণ-সারদা পরম্পরা প্রকাশ করেছে সেই মহাসংহতি, যেখানে তন্ত্রের জ্ঞান, বেদান্তের একত্ব ও ভক্তির মাতৃত্ব—তিনিই এক জীবন্ত সাধনা। এই সাধনায় শক্তি মানে প্রেম, প্রেম মানে স্থিতি, আর স্থিতি মানে চেতনার গভীর শান্তি। সেই চেতনারই নাম জগদ্ধাত্রী—বিশ্বধারিণী, যিনি জীবন ও ব্রহ্মকে এক পরম সাম্যে মিলিয়ে দেন।

জগদ্ধাত্রী পূজা দুর্গাপূজারই ধারাবাহিকতা, কিন্তু তার দার্শনিক অভিমুখ সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুর্গা যেখানে কর্মের তেজে, কালী যেখানে বিলয়ের নিঃশেষতায়, জগদ্ধাত্রী সেখানে স্থিতির জ্যোতিতে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর পূজা এক শান্ত শৃঙ্খলা—যেখানে যুদ্ধের উত্তেজনা নেই, আছে আত্মসংযমের দীপ্তি; যেখানে বিজয় নয়, আছে অন্তর্গত সমতা; এবং যেখানে ভক্তি, জ্ঞান ও সমাজ একসূত্রে বাঁধা হয়ে প্রকাশ পায়—চেতনার, সংস্কৃতির, এবং মানবতার সুশৃঙ্খল রূপে।

গ. আঞ্চলিক পার্থক্য—কৃষ্ণনগর এবং চন্দননগর: জগদ্ধাত্রী পূজা বাংলার দুই ঐতিহাসিক শহর—কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরে—দুটি স্বতন্ত্র রূপে বিকশিত হয়েছে, যা একদিকে একই দেবীর উপাসনার ঐক্যকে প্রকাশ করে, আবার অন্যদিকে স্থানীয় ইতিহাস, নান্দনিকতা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বৈচিত্র্যও প্রতিফলিত করে। এই দুই কেন্দ্রেই পূজার মহিমা অপরিসীম, তবে এর প্রকাশভঙ্গি, শিল্পশৈলী এবং সামাজিক পরিসর একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির।

চন্দননগর: চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা মূলত এক শৈল্পিক ও নাগরিক উৎসব—এটি বাংলার আলোকসজ্জা, নকশা ও নান্দনিকতায় সর্বোচ্চ কৃতিত্বের প্রতীক। ফরাসি ঔপনিবেশিক অতীতের ছাপ আজও এখানকার নন্দনচেতনায় সুস্পষ্ট—শহরের মণ্ডপ নির্মাণ, সাজসজ্জা ও থিম-নির্মাণে ইউরোপীয় শিল্পবোধের এক সূক্ষ্ম পরিশীলন দেখা যায়। পাঁচ দিনব্যাপী এই উৎসবের সময় পুরো শহর যেন এক বিশাল প্রদর্শনশালায় পরিণত হয়—প্রতিটি প্যান্ডেল নিজস্ব দার্শনিক বা ঐতিহাসিক থিমে নির্মিত এবং প্রতিটি আলোসজ্জা যেন আলো ও ছায়ার তন্ত্রময় সুষমা। এই আলোকময় নগরী তাই শুধু ভক্তির স্থান নয়, শিল্প ও নন্দনের মিলনক্ষেত্র। চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী এখানে “দিব্য আলো”—অন্ধকারে জ্ঞানপ্রভা ও ঐক্যের প্রতীক।

কৃষ্ণনগর: অন্যদিকে কৃষ্ণনগরের পূজা রাজকীয় ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলার মিশ্রণ। নদীয়ার রাজবাড়ীতে অনুষ্ঠিত রাজপূজা এখনও জগদ্ধাত্রীর আচারিক ও তান্ত্রিক মূলরূপ সংরক্ষণ করে রেখেছে—এখানে পূজা গাম্ভীর্য, শাস্ত্রীয় নিয়ম এবং আচার-নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। একইসঙ্গে শহরের বারোয়ারি পূজাগুলি, যেমন “বুড়িমা” ও “ছোটো মা”, জনভক্তির কেন্দ্রবিন্দু। “বুড়িমা”-র প্রতিমা প্রতি বছর অলঙ্কৃত হয় ১৫০ কেজি সোনা ও ১৫০ কেজি রূপার গয়নায়—যা কেবল রাজকীয় ঐশ্বর্যের প্রকাশ নয়, বরং স্থানীয় মানুষের গভীর ভক্তি ও সামাজিক সংহতির প্রতীক।

কৃষ্ণনগরের আরেক অনন্য দিক হলো “সাং”—বিসর্জনের সময় অনুষ্ঠিত এক বিশেষ আচার, যা নৃত্য, সংগীত ও রীতিনিষ্ঠ আন্দোলনের সমন্বয়ে গঠিত। এটি একদিকে দেবীর বিদায়, অন্যদিকে তাঁর শক্তির প্রতিফলনের প্রতীক—যেখানে মানুষ নিজের অন্তরস্থ আবেগ, আনন্দ ও বেদনা নৃত্যের ছন্দে প্রকাশ করে। এই রীতি কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী উৎসবকে এক সম্পূর্ণ জীবন্ত, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতায় পরিণত করে।

এই দুই কেন্দ্রের পার্থক্য মূলত দর্শন ও প্রকাশের দুই মেরুতে অবস্থান করে—চন্দননগরের উৎসব বহির্মুখ শিল্পনন্দনের উজ্জ্বল উদযাপন, আর কৃষ্ণনগরের পূজা অন্তর্মুখ আচারিকতা ও ঐতিহ্যের গভীর সংরক্ষণ। একদিকে আলো, থিম ও আধুনিকতা; অন্যদিকে মন্ত্র, রীতি ও আত্মনিবেদন। তবুও, উভয়ের মর্মে এক অভিন্ন বোধ কাজ করে—ধারণা ও স্থিতির দেবী জগদ্ধাত্রী সেই সত্ত্বশক্তির প্রতীক, যিনি সৌন্দর্য, ভক্তি, জ্ঞান ও সংস্কৃতিকে এক সমবায় চেতনায় সংযুক্ত করেন।

চন্দননগর ও কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজা একই আধ্যাত্মিক তত্ত্বের দুটি ভিন্ন প্রতিফলন—একটি আলোয়, অন্যটি ধ্যানে; একটি কারুশিল্পে, অন্যটি আচারশুদ্ধিতে—কিন্তু উভয়েরই লক্ষ্য এক: জগতের স্থিতি, চেতনার ভারসাম্য এবং দেবীর মাধ্যমে জীবনের অনন্ত ঐক্যের উপলব্ধি।

সাংস্কৃতিক প্রতিফলন, সাহিত্য এবং সংশ্লেষণ: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ কেবল একটি উপন্যাস নয়—এটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বীজরোপণকারী এক সাংস্কৃতিক গ্রন্থ, যেখানে ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন ও রাজনীতি এক অবিচ্ছিন্ন রূপকে মিলিত হয়েছে। এই রচনায় জগদ্ধাত্রী মূর্তি কেবল এক দেবীর প্রতিমা নয়; তিনি ভারতের আত্মার প্রতীক, তাঁর সাংস্কৃতিক সত্তা ও হারিয়ে যাওয়া ঐশ্বর্যের স্মারক।

উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ১৭৭৩ সালের সন্ন্যাসী বিদ্রোহ—এমন এক সময়, যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দমননীতি ভারতের মাটিতে চরম দারিদ্র্য ও আত্মসমর্পণ বোধ সৃষ্টি করেছিল। এই প্রেক্ষাপটে বঙ্কিমচন্দ্রের জগদ্ধাত্রী হলেন “শৃঙ্খলার দেবী”—যিনি ভারতের স্থিতিশীল, সভ্য ও সমৃদ্ধ অতীতের প্রতীক। মহেন্দ্র যখন সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন তাঁর সামনে প্রকাশ পায় এক অপূর্ব জগদ্ধাত্রী মূর্তি—শান্ত, দীপ্ত, মাতৃসুলভ। সন্ন্যাসীরা বলেন, “এ মা যেমন ছিলেন”—অর্থাৎ, এই মূর্তি সেই ভারতের প্রতিরূপ, যিনি একদা জ্ঞান, ন্যায় ও ধর্মের আলোয় বিশ্বকে আলোকিত করেছিলেন।