হে প্রিয় ভালোবাসা, আজ পর্যন্ত তোমাকে আমার ছুঁয়ে দেখা হলো না। আমরা একে অপরের শরীর ছুঁয়েছি মাত্র, তোমাকে ছুঁতে পারিনি কখনও, পারোনি ছুঁতে তুমিও আমাকে।
খুব ইচ্ছে, একদিন তোমায় সত্যিই ছোঁব! শরীর দিয়ে নয়, এই পুরোটা আত্মা দিয়ে! আমরা হয়তো শারীরিকভাবে একসাথে নেই, জানি না আর কখনও দেখা হবে কি না, অবশ্য, তার আশা আমি করিও না। আমি তো রোজই তোমাকে ছুঁই, তুমি টের পাও না। আমার আত্মা দিয়ে আমি প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে স্পর্শ করি।
তুমি নেই! তুমি কাছে নেই, তুমি পাশে নেই। তুমি আসলে কোথাও নেই। তবু আমার সবটা জুড়ে এক তুমিই আছ! না থেকেও এক তুমিই থেকে যেতে পারো।
তোমাকে ছুঁতে হলে আমাকে তোমার কাছে ছুটে যেতে হয় না, তোমার গায়ের ঘ্রাণ আমি আমার মাঝেই পাই, তোমার আসা-যাওয়া এই আমার ভেতরে সবসময় চলতে থাকে, তুমি থেকে যাও আমার মনের ঘরের প্রতিটি আনাচে-কানাচে। হৃদয়ের যেই কোণটায় খুব অন্ধকার, সেখানেও তুমি ঠায় বসে থাকো!
জানো, আমি তোমাকে চিনতে পারিনি, প্রিয় ভালোবাসা! আমি তোমার শরীরকে তুমি ভেবেছিলাম, আমি আমার এই শরীরকে আমি ভেবেছিলাম, আর সেখানেই ছিল যত গণ্ডগোল!
ভাবতে ভাবতে একদিন নিজেকে নিজেরই শরীর থেকে একটুখানি সরিয়ে নিয়ে দূর থেকে নিজেকেই দেখলাম। দেখি, আমি একটা খোলসমাত্র, আসল আমিটা তো এই তুচ্ছ শরীর থেকে অনেক দূরে! তখন ইচ্ছে হলো, এবার নিজেকে একটু ঘেঁটেই দেখি নাহয়--- নিজের বোধ, নিজের সম্পদ।
বুঝলাম, নিজের আমিত্ব বলে আজ অবধি জেনেছি যা-কিছু, তা-কিছু আসলে আমিই নই! তাহলে কোথায় আমি? আমি কী তবে? আর এই রোজই যে ভালোবাসা ভালোবাসা করে নিজেকে অস্থির করে তুলছি, আমি এমন কেন করছি? এই আমিটা ঠিক কোন আমিটা? এই তোমাকে না পাওয়ার হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম প্রতিদিন একটু একটু করে, আরেকটু হলেই ম্লান সূর্যের মতন রক্তাক্ত হয়ে ডুবে যেতাম, জানো?
রোজ ঘুম থেকে উঠে ভাবি, এই তো আমি এখানেই আছি! অথচ আমার এই ভেতরের আমিটা সহস্র বছর হয়তো ঘুমিয়েই ছিল, কোথায় যে ছিল, ছিল কোন খোলসে, আমি জানি না এসবের কিছুই। একটি দীর্ঘসময় আমি কেবল স্বপ্নই দেখেছি, ছিলাম ঘুমে বিভোর, তাই বহুকাল নিজেকেই হয়নি দেখা, তোমাকেও দেখিনি এতকাল, প্রিয় ভালোবাসা!
তুমি জেনেছ, আমি স্বার্থপর, তুমি জেনেছ, আমি আত্মকেন্দ্রিক, তুমি জেনেছ, আমি রুচিহীন। আমি নিতান্তই শ্রীহীন একটি ঘর, বহু বছর প্রদীপ জ্বলেনি যে ঘরে, তুমি এমনই এক ঘর দেখেছ এই এতটা কাল।
আজ হঠাৎ আমার মনে যেন সেই সহস্র বছরের ঘুম কেটেছে! আমি তৃষ্ণার্ত, আমি ক্ষুধার্ত, অমি অসহায়, আমায় একটু দয়া করো… আজ আমি নিজেকে সত্যি সত্যি জানতে চাই, আজ আমি আমার ভালোবাসাকে জানতে চাই।
নিছকই শারীরিকভাবে নয়, শরীর ভীষণ তুচ্ছ এক সত্তা, আজ আমি আমার ভালোবাসার আত্মাকে জানতে চাই, রোজ আমার ভালোবাসার আত্মাকে আমার আত্মা দিয়ে একটু একটু করে ভালোবাসতে চাই।
আমার বহু বছরের শখ আমার ভালোবাসাকে ছুঁয়ে দেখবার, মনে হতে থাকে, যেন আমাদের সহস্রকালের প্রেম, তবুও একে অপরকে ছুঁয়ে দেখা হয়নি কখনও, আমরা দুজন দুজনের বাহ্যিক খোলসটাকে ছুঁয়েছি মাত্র! আর এ কারণেই আমি তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত, পীড়িত।
মিনতি করে বলছি, আমাকে দয়া করো, এই শারীরিক বন্ধন থেকে এবার আমাকে মুক্ত করো। আমি ডানা ছড়িয়ে উড়তে চাই, অনেক অনেক পথ আমার এই নরম ডানাদুটো মেলে, তোমার ওই খোলা আকাশে উড়তে চাই।
এই দেহের বন্দি খাঁচায় আজ আমি বড্ড ক্লান্ত, আমার আকাশ যেন অদ্ভুত অকারণ এক অচেনা কালো অন্ধকারে ছেয়ে আছে এই হৃদয়ের কোনও এক কোণে। ঠিক যে কোনায় গেলে আমি নিজেকে দেখতে পাই, সেখানটাতেও গভীর এক গাঢ় আঁধার ছেয়ে আছে। আমি কিছুতেই নিজেকে সেই আঁধার ভেদ করে দেখতে পারি না, কালো মেঘমেদুর আকাশটাতে উড়তে আমার ভীষণ ভয় করে।
আমাকে রোদ দাও, আমাকে আলো দাও, আমি মেঘের সেই বিকট গর্জনটিই শুনতে চাই, বিকট সেই গর্জনে আমার কান চৌচির হয়ে ফেটে পড়ুক, প্রখর আলোয় আমার চোখদুটো ঝলসে যায় তো যাক, তোমার আত্মার প্রচণ্ড স্পর্শে আমি যদি মূঢ় হই তো হই!
যত জ্বালা, যত যন্ত্রণা, যত আঘাত আসে…আসুক সেসব! আমি আজ ওদের সব কিছুর মুখোমুখি হতে চাই, আমি আমৃত্যু লড়াই করতে চাই, আমি নগ্ন করে দেখতে চাই কতটা কুৎসিত সেই কষ্ট, আমি দেখতে চাই ভালোবাসার আসল রঙ কেমন হয়।
না, ভয় নেই, আমি ভয় পাবো না, আমি মূর্ছা যাব না, আমি ক্লান্ত পথিকের বেশে হাঁটু মুড়ে বিবর্ণ চিত্তে বসেও পড়ব না।
এবার আমি মুখোমুখি হব সত্যের, আমি একটি বন্ধ দুয়ার ভেঙে ফেলতে চাই, আমি আমার মনের যে কোণটাকে গাঢ় আঁধার ছেয়ে রেখেছে, সেখানে আলো পোঁছাতে চাই, আমি যুগের পর যুগ যে আধো-বিশ্বাসকে সর্বস্ব মেনে পথ চলেছি, সেটিকে উপড়ে ফেলে দিতে চাই, আমি পুরোপুরিই বাঁচতে চাই, একটু আধটু নয়, একেবারে আস্ত একটা জীবনের যাপন করতে চাই, আমি আমার সমস্ত বাঁচা বাঁচতে চাই।
প্রিয় ভালোবাসা, আজ যত খুশি তুমি তোমার আঘাত, বেদনা, জীর্ণতাকে সঙ্গে নিয়ে এসো, আজকে আমি তোমাকে পুরোপুরি গ্রহণ করেছি, তাই আজ আমি সমস্ত শঙ্কা ও সংশয় থেকে মুক্ত!