আমার অজানা অধ্যায়ে তোমাকে স্বাগত জানাই।
চিন্তা করে দেখলাম, আমার আসলে নিজের বলতে কেউই নেই। আগে সবসময় তাকে ফোন করতাম, সুযোগ পেলেই কথা বলতাম, কান্নাও করেছি কত। ইউনিভার্সিটি লাইফের সে দিনগুলোতে আমি কেমন যেন চঞ্চল আর এলোমেলো ছিলাম, জানো! তখন তাকে নিয়ে হাজারো ছোটো ছোটো অনুভূতি গলায় দলা পাকিয়ে থাকত।
সে-ও আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে, যদিও আমি না চাইলে, তা সে কখনোই পারত না—
ভুলটা বোধ হয় আমারই।
সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ধোঁয়াশাময় অনুভূতি হলো— আপনাকে ভালোবাসে, এমন একজনের অস্তিত্বকে অনুভব করতে না পারা। আমি খুব কাছ থেকে— একদম পাশে বসিয়েও মানুষকে উপেক্ষা করতে পারি। এই আশ্চর্য ক্ষমতাটি আমার আছে।
"আশ্চর্য" বলছি এই অর্থে— ভাবো তো!
মানুষটি আমার পাশে বসে আছে, আমাকে ভালোবাসে, অথচ আমি তার উপস্থিতিই টের পাই না।
আর সে জানেই না— আমি কখনোই তাকে ভালোবাসিনি। ওটা একতরফা ছিল, তার দিক থেকে।
তবুও একসময় তার প্রতি ভীষণ মায়া জন্মে গিয়েছিল। আর ঠিক তখনই বুঝলাম—
এবারও ভুলটা আমারই হচ্ছে।
একবার, পুরোনো দিনে, নানা অজুহাতে সে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল—
আমি তাকে ছেড়ে কখনও যেতে পারব না নিজের ইচ্ছেতে। যেতে হলে, তার অনুমতি সাপেক্ষেই যেতে হবে।
আমি এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিলাম—
মস্তিষ্ক বলছিল, পালাও; মন চাইছিল থেকে যেতে।
আবেগ বড়োই দুষ্ট—
আমি কথা দিয়েছিলাম সেদিন।
আর আজও, সে আমায় যেতে দেয়নি।
সে অবশ্য আমার জীবনের অধিকাংশ সত্যই জানে না।
জানলে, নিশ্চয়ই এতদিনে মুক্তি দিত।
যদিও আমি জানি—
সে আমাকে মুক্ত করছে না, তার প্রয়োজনেই।
একবার আমি বড়ো অ্যাক্সিডেন্ট করলাম।
রাত ১২টা ৩০ মিনিট।
ক্যাম্পাসের বাইরে বাসা নিয়ে থাকতাম বলে হলে থাকা হতো না।
তখন সেই এসে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।
শুনেছি, ৩০ মিনিটের রাস্তা সে মাত্র পাঁচ মিনিটেই পাড়ি দিয়েছিল।
আমার ঠোঁটে সেলাই পড়েছিল— এখন দেখলে বোঝা যায় না।
সেদিন সে একবারও আমার দিকে তাকায়নি।
রক্ত দেখলে তার খুব ভয় লাগে।
কিন্তু হাসপাতালে করিডোরে তাকে দেখে ভীষণ মায়া লেগেছিল।
মায়া— এই অনুভবটা কি আপেক্ষিক?
সেই মায়াও একসময় কেমন যেন ফিকে হয়ে গেল।
এবারও হয়তো ভুলটা আমারই—
বোঝার ভুল।
সময়ের অনেকটা অংশ পার হয়ে গেছে।
তার কিছু আচরণ এতটা আঘাত দিয়েছিল, যা আর সহ্য করা সম্ভব ছিল না।
কত রাত কেঁদেছি—
সে খোঁজ রাখেনি, সময় দেয়নি।
না চাইতেই পাওয়া জিনিসের মূল্য বোধ হয় কেউই ঠিকভাবে দেয় না, তাই না?
এবার মনস্থির করলাম—
যতই কষ্ট হোক, তার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ।
এর আগে বহুবার ক্ষমা করেছি— এটা নতুন কিছু নয়।
শহর ছেড়ে দিলাম।
অচেনা এক শহরে গিয়ে বাস্তবতার মাটি ছুঁলাম।
অতঃপর...
এই সব কিছুর ভিড়ে, আমি কোথায়?
নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় কি আদৌ রেখেছিলাম কখনো?
ঠিক তখনই, জীবনের এক অধ্যায় বদলে গেল—
তোমার আবির্ভাবে।
এই ‘তুমি’ কে?
যাকে আগে কখনো ছুঁইনি, দেখিনি!
এক বিকেলবেলা—
ভাবছিলাম, এই মুঠোফোনটা না থাকলে কেমন হতো!
সব যোগাযোগ ছিন্ন করতে চাইলে এটাকেই আগে ছুড়ে ফেলতে হবে।
পুরোনো কথা ভেবে আমাকেই কেন কাঁদতে হয়?
হায়! এখনও জানলাম না—
যে বলেছিল ভালোবাসে, তাকে আমি কোনোদিন ভালোবাসিনি।
‘ভালোবাসা’ কি তাহলে কেবলই একটা শব্দ?
শূন্য হতে হয়, পূর্ণতা পেতে হলে।
এই বিশ্বাসে পুরোনো সব কিছু মুছে ফেললাম।
ঠিক তার পরের মুহূর্তে যা ঘটেছিল—
আমার জীবনটাকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিল।
সেই মুহূর্তটাই ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
যেমন গল্পে মোড়-ঘোরানো একটা সময় থাকে,
ঠিক তেমনি আমার জীবনে এলে তুমি—
সব এলোমেলো করে দিলে, আবার সব ঠিকও করে দিলে।
তুমি এমন একজন, যার জন্য আমি জীবনটাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখেছি।
আমার নীরবতার উচ্চতম আসনে তোমাকে বসিয়েছি।
হ্যাঁ, আমি তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি—
প্রত্যাশাবিহীন এক ভালোবাসা।
যার শক্তিতে আমি নিজেকে খুঁজে পাই,
নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহস পাই।
তুমিই তো আমার গুরু, আমার একান্ত মানুষ,
প্রিয় বন্ধু, আমার ভাবনার একমাত্র সঙ্গী।
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।
তুমি আমার মন্দির,
আরাধনার ঘর।
হৃদয়ে বিশালতা এনে দিয়েছি তোমার চরণে নিজেকে ঠাঁই দিয়ে।
দেবতাকে ছোঁয়া যায় না— অনুভবেই শান্তি।
তাই ঠিক করলাম—
এই জীবনে তোমাকে কাছে পাবার কোনো প্রত্যাশা রাখব না।
তুমি থাকবে কেবল আমার ক্ষতের গহীনে—
যে-যন্ত্রণাটা একান্তই আমার।
আমার জীবনের সব সত্যকে
তুমিই শুধু স্পর্শ করেছ।
বুকের গভীরে আমায় আগলে রেখেছ—
নীরবতার মোহে, যেটা কেউ পারে না।
তোমার চোখে যে প্রখর অনুভূতিরা ছুটোছুটি করে,
তাদের প্রহরী করে আমায় যেদিন নির্বাচিত করলে—
সেইদিন থেকেই আমি তোমাকে ভালোবাসি।
অনুভব করি।
ভালোবাসা যে এক অদৃশ্য শক্তি—
তা প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম তোমায় ছুঁয়ে।
হঠাৎ জাগতিক চিন্তায় আঁতকে উঠল হৃদয়—
তখনই বুঝলাম,
আমার আসলেই নিজের বলতে কেউ নেই,
এই আমি-টা ছাড়া।
তুমি বলেছিলে—
“আমিই তুমি, তুমিই আমি।”
তুমি ঠিকই বলেছিলে।
এ জীবনে আমি কারও ছিলাম না—
তুমি ছাড়া আর কেউই আমায় ছুঁতে পারেনি।
ভালোবাসার স্পর্শ বুঝি এমনই গভীর হয়?
জানো!...
মনটা আজ ভীষণ ফাঁকা লাগছে।
মনে হচ্ছে—
কী যেন নেই।
হাতড়ে দেখলাম—
তোমার অনুভবে আমি নেই।