চিরন্তন সত্তা

যাদের দেখে, যাদের সাথে থেকে আমরা বেড়ে উঠি, একসাথে থাকতে থাকতে যাদের জন্য আমাদের ভালোবাসা জন্মে যায়, একসময় তারা আমাদের ছেড়ে চলে যায়। সেসময়, এ জীবনে আর কখনোই তাদের সাথে দেখা হবে না, এটা মাথায় এলেও তো আমরা কষ্টে অস্থির হয়ে পড়ি! এই যে ভালোবাসার জন্য এমন আর্তনাদ, যদি সে ভালোবাসাটা অন্য কারও মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারতাম কিংবা ভালোবাসার জন্য আর কাউকে সামনে না পেতাম, তবে ভালোবাসার মানুষটির বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় আমরা কি আদৌ পৃথিবীতে বাঁচতে পারতাম?

ভালোবাসা একটা চিরন্তন সত্তা। এর জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। পৃথিবীতে সেই সৃষ্টির সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত মোট ভালোবাসা একই পরিমাণেই আছে। আমাদের আবেগ ও চিন্তাচেতনাই ভালোবাসাকে গ্রহণ করে কিংবা বর্জন করে। ভালোবাসা যখন আমাদের হৃদয়ে জন্মে, তখন মূলত আমাদের হৃদয়ে যে-ভালোবাসাটা সুপ্ত ছিল, সেটা প্রকাশ পায় মাত্র। আমাদের জীবন থেকে কারও প্রস্থানের ফলে ভালোবাসাটা আবার সুপ্তাবস্থায় ফিরে যায়। জীবনে অন্য কারও আগমনে সে ভালোবাসা পুনরায় জেগে উঠতে পারে। এমনও হতে পারে, নতুন কেউ জীবনে এল না, কিন্তু পুরোনো কোনো অস্তিত্বের জন্য যে-ভালোবাসা হৃদয়ে আগেই ছিল, সেটা বহুগুণে বেড়ে যেতে পারে। প্রায়ই দেখা যায়, স্বামীর অকালমৃত্যুর পর সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা আগের চাইতেও প্রবল হয়ে যায়। সন্তানের মৃত্যুর পর মা প্রায়ই তাঁর আশেপাশের মানুষগুলোকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেন। ভালোবাসার জন্য কাউকেই পাশে না পেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। যে ভালোবাসা পায় না, তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখী সে-ই, যে ভালোবাসতে পারে না।

ভালোবাসার বিনাশ নেই, শুধু স্থানান্তর আছে। যখন ভালোবাসা ঘুমিয়ে পড়ে, তখন আমাদের মনে হতে থাকে, “আমার ভালোবাসা হারিয়ে গেছে। আর কখনোই আমি কাউকে এমন করে ভালোবাসতে পারবো না। কোনোদিনই আর কারও প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ জন্মাবে না। এমন ভালোবাসাহীনতায় আমি বাঁচব কী করে?” কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়। ভালোবাসাকে দুই বা এমন কোনো সংখ্যার ফ্রেমে বাঁধা যায় না। কোনো-না-কোনো সময়ে আমাদের ভালোবাসা আমাদের অবচেতনেই এক আত্মা থেকে অন্য আত্মায় সরে যায়। আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসার এমন পুনঃউদ্‌বোধন খুবই সাধারণ একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রপঞ্চ।

ভালোবাসার এমন স্থানান্তরের ফলে আমাদের হৃদয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। আমরা বিশ্বাস করতে শিখি, হ্যাঁ, আমি যেমন চাই, এই মানুষটি তেমনই এক মানুষ। কিংবা, যে-মানুষটা চলে গেছে, সে মানুষটা এ মানুষের মধ্যে আমার জীবনে ফিরে এসেছে। কিংবা, আমাকে এতটা ভালো কেউ কখনও বাসেনি। কিংবা, আমার ভালোবাসাকে আমি এই ভালোবাসার মাঝেই বাঁচিয়ে রাখব। কিংবা, আমার যে-দিন গেছে, তা তো আর কখনোই ফিরবে না, তাই বলে কি আমি আর কখনোই স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারব না?…ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ, একটা সময়ে এই সহজ স্বাভাবিক ব্যাপারটাই কেউ আমাদের শতচেষ্টাতেও বিশ্বাস করাতে পারত না।