দিদি তখন বললেন, ‘যে মানুষটার কথা মাথায় নিয়ে কষ্ট পাচ্ছ, সে কি জানে ব্যাপারটা?’ আমি বললাম, ‘সম্ভবত জানে না।’ ‘তাহলে তার কি কিছু এসে যায় তোমার এমন মানসিক অবস্থায়?’ ‘না, যায় না।’ ‘আচ্ছা, ধরে নাও, সে জানে, তুমি যে কথাটা মাথায় নিয়ে আছ। তুমি যে আসলেই ওর কথাটাকে এখনও বহন করে যাচ্ছ, এটাতে কিন্তু সে একধরনের শান্তি পাচ্ছে, কেননা সে তো চেয়েইছে তোমাকে কষ্ট দিতে! কী, শান্তি পাচ্ছে না সে তোমাকে যন্ত্রণায় থাকতে দেখে?’ ‘হ্যাঁ, তা পাচ্ছে।’ ‘তাহলে তো সে তোমাকে যে উদ্দেশ্য নিয়ে কথাটা বলছে, সেটা তো সফল হলো, তাই না?’ ‘হ্যাঁ, ঠিক।’ ‘তুমি যদি সেটা মাথায় না রাখতে, ঝেড়ে ফেলে দিতে, তাকে উপেক্ষা করে ও তার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে তোমার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে, তাহলে কি সে সফল হতে পারত?’ ‘না, পারত না।’ ‘তাহলে লাভটা কার হচ্ছে? তার, না কি তোমার?’ ‘তার।’ ‘তুমি তাকে ও তার কথাকে পাত্তা বা গুরুত্ব না দিলেই তো বরং সে যন্ত্রণা বা অস্বস্তিতে থাকত। ঠিক না?’ ‘হ্যাঁ দিদি, ঠিক।’ ‘তাহলে তো তুমি সবই বুঝো আসলে। বুঝেও তবে মন খারাপ করে কেন আছ? কেন নিজেকে যন্ত্রণায় রেখে রেখে তাকে জিতিয়ে দিচ্ছ? তুমি তো তার মাথাতেই নেই! আর যার মাথায়ই তুমি নেই, তাকে মাথায় রেখে দিয়ে তুমি নিজে কষ্ট পেয়ে যাচ্ছ! কেন বলো তো?’
দিদির মতো একটা মানুষ যখন এভাবে করে বলে, তখন আসলে আর মন খারাপ থাকে না। তো আমি বললাম, ‘সে এমন করবে কেন? আমার কী দোষ এখানে?’ ‘দেখো, তুমি যেমন করে ভাবছ, সে এমন করবে কেন!...তুমি এটা কেন ভাবছ?’ ‘এইজন্যই ভাবছি, সে আমার সাথে যে আচরণটা করল, যে কথাগুলি বলল, আমি নিজে কখনও কারও সাথে এভাবে বলতাম না। আমি তার কাছ থেকে এটা ডিজার্ভ করি না।’ ‘ডিজার্ভ! এটা কী আবার? শোনো, দুনিয়ায় ডিজার্ভ-করা বলে কিছু নেই। তুমি কী আর্ন করলে বা কী আর্ন করলে না, তুমি কী আর্ন করতে বাধ্য হলে বা কী আর্ন করতে বাধ্য হলে না, হিসেব এইটুকুই!’ ‘আচ্ছা, সেটা নাহয় মানলাম। কিন্তু সে আমার সাথে যে আচরণটা করছে, এটা অহেতুক! আমি এমন কিছুই করিনি, যে কারণে সে এটা করতে পারে!’ ‘তার মানে তো তুমি ওর চেয়ে একজন বেটার পার্সন! আচ্ছা, তুমি কেন কাউকে বলতে না এগুলি? এগুলি কাউকে বলে, তাকে কষ্ট দিয়েও তো একধরনের মজা নিশ্চয়ই আছে, নইলে সেটা এমন করত না।’ ‘কারণ, এটা বলার মতো, কাউকে অহেতুক কষ্ট দেওয়ার মতো রুচি আমার নেই।’ ‘তাহলে তোমার রুচি তার থেকে ভালো। নাউ কাম টু দ্য পয়েন্ট! এখন যে লোকটা তোমার মতো হতে পারেনি---সে যে কারণেই হোক, পারেনি, তোমার মতো মানসিকতার হতে পারেনি, তুমি তার মতো কারও কাছ থেকেও এর চেয়ে বেটার কিছু আশা করছ কেন?’
স্টপ এক্সপেক্টিং ফ্রম পিপল। এক্সপেক্ট নাথিং ফ্রম পিপল। নাথিং! নাথিং! নাথিং! কারণ প্রত্যেকটা মানুষের নিজস্ব একটা জীবন আছে। তুমি তার কাছ থেকে কিছুই এক্সপেক্ট করবে না। সে তার জীবনের অভিজ্ঞতা, তার জীবনের শিক্ষা নিয়ে তার জীবনটা চালাচ্ছে। এর বাইরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে জানেই না কী করে এর বাইরে গিয়ে বাঁচতে হয়। জীবন তাকে এটা শেখায়নি। অনেককেই দেখবে, এমন কারও সামনে সিগারেট ধরান, যে লোকটি সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারেন না। হয়তো তিনি জানেন, কাজটা করা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু তিনি এটা কেয়ার করবেন না। কেননা উনি শুধু নিজে বাঁচতে শিখেছেন, অন্যকে বাঁচতে দিতে শেখেননি। এইটুকু লজ্জা, সংকোচ বা বিবেক তাঁর নেই। বাঁচতে হয় অন্যকে বাঁচতে দিয়ে, এটা মাথায় রাখতে হবে যদি সত্যিই মানুষ হও। এখন তোমার এই লোকের জীবনের শিক্ষা হচ্ছে, অন্যকে আঘাত করা। কিন্তু তোমার নিজের জীবনের শিক্ষা তো সেটা নয়। তুমি তো তার চাইতে মানসিকভাবে এমনিতেই একটা বেটার জায়গাতে আছ। তোমার তো সেটা ভেবে ভেবে অনেক হ্যাপি ফিল করা উচিত। কী, উচিত না?’ ‘হুঁ।’
‘এই যে দেখো স্করপিয়ন কামড়ায়, সে আসলে কেন কামড়ায়? এটা কি তার কোনও অপরাধ?’ ‘স্করপিয়ন কামড়ায়, কারণ স্করপিয়ন শুধু কামড়াতেই পারে, এর বাইরে অন্য কিছু করতে সে শেখেনি। এটা তার অপরাধ নয়। এটা তার স্বভাব।’ ‘দ্যাটস ইট! কামড়ানো ছাড়া স্করপিয়ন অন্য কিছুই করতে পারে না। এটা কিন্তু স্করপিয়নের দোষ না। এটা হচ্ছে স্করপিয়নের বৈশিষ্ট্য। একটা মানুষের দোষ এবং বৈশিষ্ট্য, এই দুইটা জিনিসের মধ্যে পার্থক্য আছে। তুমি যদি এখন কাউকে কামড়াও, সেটা তোমার দোষ হবে। স্করপিয়ন যে কামড়াচ্ছে, এটা ওর দোষ না, এটা ওর বৈশিষ্ট্য। যে মানুষটা তোমাকে আঘাত দিয়ে কথা বলছে, সেটা তার বৈশিষ্ট্য, তার দোষ না। তুমি যদি কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলো, এটা তোমার দোষ হবে, এটা তোমার বৈশিষ্ট্য হবে না। বুঝতে পারছ ব্যাপারটা?’ ‘হ্যাঁ, পারছি।’ ‘তাহলে যেটা তার বৈশিষ্ট্য, ওটার জন্য তুমি মানুষটাকে খারাপ বলবে কী করে, বলো? বরং, তুমি যে তার কাছ থেকে ওই মন খারাপ করে-দেওয়া জিনিসটা গ্রহণ করেছ, কিংবা সে যে এটা ওটা তোমাকে বলতে পেরেছে, কেননা ওই সুযোগটা তুমি তাকে দিয়েছ, কিংবা তার কাছাকাছি অবস্থান করেছ বা তাকে তোমার কাছাকাছি অবস্থান করতে দিয়েছ---এটাই তোমার দোষ। তুমি স্করপিয়নকে নিয়ে খেলতে গেছ, এইজন্য স্করপিয়ন তোমার আঙুলে কামড় দিয়েছে। এটাই তোমার দোষ। স্করপিয়নের এখানে কোনও দোষ নেই।’
দিদির এই কথাগুলি শুনে আমি তো পুরোই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি! আমি দিদিকে বললাম, ‘তাই তো, কথা তো সত্যি! এভাবে করে কেন ভেবে দেখলাম না কখনও?’ ‘শোনো সুশ, সমাজে কিছু মানুষ আছে স্করপিয়নের মতো। ওরা শুধু কামড়াতেই জানে অন্যকে। যেহেতু ওদের জীবন ওদের আর অন্য কিছুই শেখায়নি, ওদের ঈশ্বর ওদের আর অন্য কিছু শেখায়নি, সেহেতু দোষটা ওদের না। ওদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। এটাই নিয়ম। তাহলে ওদের কাছে থাকবে কারা? ওরাই, যারা ওদেরই মতো স্করপিয়ন। ওরা নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করে মরে যাক, তোমার তো কিছু এসে যায় না, তাই না? কারণ তুমি তো আসলে ওরকম নোংরাভাবে ফাইট করতে শিখোনি।’ ‘ঠিক, দিদি।’ ‘রাস্তায় হাঁটার সময় নিজেই সাবধানে হাঁটবে। তুমি নিজে অসতর্ক হয়ে চলার কারণে তোমাকে যদি একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দেয়, এতে যদি তোমার শরীরে কোনও ক্ষতি হয়, তবে সে ঘটনার পর যা-ই ঘটুক না কেন, তোমার ওই ক্ষতি কিন্তু পূরণ হবে না কিছুতেই। কিছু মানুষ রাস্তায় চলার সময় বেপরোয়া চলে, ওদের শেখানোর চাইতে নিজে সাবধানে চলা সহজ। পৃথিবীর সবাইকে শেখানোর দায়িত্ব তো আর তোমার নয়!’ ‘দিদি, আমি তোমার সাথে একমত।’ পরে আমি আমার নিজের লাইফেও দেখেছি, আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না ঠিক, কিন্তু মার খাওয়াকে খুব ভয় পাই। মরে যাব, এটা আমাকে ভয় পাইয়ে দেয় না, কিন্তু মার খেতে খেতে বেঁচে থাকব, এটাতে আমার অনেক ভয়। মার খেয়ে বেঁচে থাকতে অনেক কষ্ট হয়। এত কাজ করার থাকে, সেগুলি করব, না কি যুদ্ধ করব ছোটোলোকদের সাথে? ওদের তো তেমন কোনও কাজ নেই, আমার সাথে যুদ্ধ করতে পারাই হয়তো ওদের গোটা জীবনের সবচাইতে বড়ো অর্জন!
ওরা যখন বুড়ো হবে, তখন নাতি-নাতনিদের কাছে করার মতো কিছু গল্প তো লাগবে! আমি একজন ভালো মানুষের কথা জানি, যিনি ছিলেন পটুয়াখালী সরকারি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। অত্যন্ত সৎ, ধার্মিক ও পরোপকারী মানুষ ছিলেন তিনি। একবার তাঁর এলাকার এক স্কুলের নৈশপ্রহরি তাঁর বিরুদ্ধে জমিজমা-সংক্রান্ত একটা মিথ্যা মামলা দায়ের করে। এর ফলে ওঁকে অনেক অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। দুই বছর পর তিনি স্বাভাবিকভাবেই মামলায় জয়লাভ করেন। তো সেই নৈশপ্রহরিকে এলাকার কেউ একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা, তুই স্যারের বিরুদ্ধে এই মিথ্যামামলাটা করলি কেন?’ সেই প্রহরির উত্তরটা ছিল মনে-রাখার মতো। ‘দেখেন, আমি নিজেও জানতাম, মামলাটা মিথ্যা, এটা টিকবে না। কিন্তু এটা করেছি বলেই তো স্যারকে এমন নাকানিচুবানিটা খাওয়াতে পারলাম। আমার এখানেই আনন্দ। আমি ছোটোবেলায় দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া করতে পারি নাই। তাই লেখাপড়া জানে, এমন কাউকে আমি সহ্য করতে পারি না। স্যারকে সবাই এত সম্মান করে, এটা আমার পছন্দ হয় না। দেখেন, আমি ভালো করেই জানি, স্যারের প্রস্রাবের ফেনার একটা বুদ্বুদের সমান মানুষও আমি না। অথচ মামলা করেছি বলেই উনি আমার সাথে সমঝোতা করতে চেয়েছেন বারবার। এই দুই বছরে উনি আমার বাসায় এসেছেন কয়েকবার, প্রতিবারই আমি ওঁর সাথে খারাপ ব্যবহার করে ওঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। এলাকার মানুষ এখন আমাকে একনামে চেনে, অনেকেই সম্মান করে, ভয় পায়। এটাই আমার আনন্দ। মামলাটা চালাতে গিয়ে আমার অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে, কিন্তু সেটার বিনিময়ে আমি অনেক কিছুই পেয়েছি। অনেক সময় দিতে হয়েছে মামলার পেছনে, স্যারকেও দিতে হয়েছে সময়। ভেবে দেখেন, আমার সময়ের চাইতে স্যারের সময়ের দাম কিন্তু অনেক বেশি। এখানেই আমার জয়। আমি স্যারকে বাধ্য করেছি আমাকে নিয়ে ভাবতে, আমাকে সমীহ করে চলতে। স্যারকে আমি মানসিকভাবে আঘাত করতে পেরেছি, বিভিন্ন দিক দিয়েই স্যারের অনেক ক্ষতিও হয়ে গেছে এই দুই বছরে। এটাই আমার সুখ, আমার তৃপ্তি।’ হ্যাঁ, কিছু মানুষ আছে, যারা শুধু মারতেই জানে। তারা নিজেরাও মার খেয়ে খেয়ে বড়ো হয়েছে, তারা অন্যকেও মারতে মারতে আরও বড়ো হয়।
আবার কিছু মানুষ আছে, যারা মার খেয়ে বড়ো হয়নি বা নিজেরা মার খেলেও তারা জানে, মার খেতে খুব কষ্ট হয়। এজন্য তারা অন্যকে আর মারে না। তারা হচ্ছে মানবিকবোধসম্পন্ন মানুষ। পৃথিবীতে অনেক মেধাবী, অনেক সফল, এবং এমন আরও অনেক কিছু হওয়ার চেয়ে মানবিক হওয়াটা বেশি জরুরি। মানবিক হওয়া, আমার মতো আর-একটা মানুষকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করা, আর-একটা মানুষকে মানুষের চোখে দেখা---এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। এটা দিদি আমাকে প্রায়সময়ই বলতেন। ওঁকে আমি কখনওই দেখব না, ওঁকে আমি কখনওই দেখিনি, কিন্তু ওঁর অস্তিত্ব আমি টের পাই। এখনও টের পাই। তখন তো খুব ভালোভাবেই টের পেতাম, যখন ওঁর সাথে আমার প্রতিদিন কথা হতো। এখনও প্রতিদিন এমন একটা দিন আসে না, যেদিন আমি গায়ত্রী তালরেজার জন্য একটু হলেও প্রার্থনা করি না, মন থেকে চাই না---মানুষটা ভালো থাকুক, মানুষটা সুস্থ থাকুক, মানুষটা আনন্দে থাকুক। মজার বিষয় হলো, যখন আমার লাইফে সব থেকে বেশি দরকার ছিল ওঁকে, তখন উনি আমার লাইফে এসেছেন, দীর্ঘদিন আমার লাইফে থেকেছেন। যখন আমার জীবনে সাফল্য চলে এল, যখন আমার কষ্টের দিনগুলি শেষ হয়ে গেল, তখন কীভাবে যেন উনি হারিয়ে গেলেন আমার লাইফ থেকে, একেবারেই হারিয়ে গেলেন।
আমাদের জীবনটা কেমন, জানেন? জীবনে আমরা যেটা চাই, সেটা পাই না, কিন্তু যা আমাদের দরকার, তা ঠিকই পেয়ে যাই। উনি ঠিক ততদিনই আমার লাইফে ছিলেন, যতদিন ওঁকে আমার দরকার ছিল। এটা প্রকৃতিরই একটা খেলা। যখন আমাদের কোনও কিছু প্রকৃতি দিতে চায়, তখন আমাদের কোনও না কোনও উপায়ে, উছিলায়, অজুহাতে প্রকৃতি সেটা পাওয়ার রাস্তাটা আমাদের করে দেয়। বাকি কাজ আমাদের। নিজের চেষ্টায়, আন্তরিকতায়, পরিশ্রমে সেটা পেতে হবে। দিদির মতন মানুষ হচ্ছেন আমাদের জীবনে অ্যানজেলের মতো। যখন এমন কাউকে আমাদের দরকার হবে, তখন এমন কেউ কোত্থেকে জানি এসে ঠিকই আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে যায়। যখন আমাদের কাজ শেষ, তখন তাকে আমরা আর খুঁজে পাই না। একটা নিছক ধন্যবাদ জানানোর সুযোগটাও অনেক সময় পাওয়া যায় না। এমন মানুষ সমস্ত ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতার অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। আর-একটা অবাক-করা ব্যাপার, প্রায়ই দেখা যায়, এমন মানুষের কোনও বিপদআপদ হলে তখন সে মানুষটার পাশে দাঁড়ানোর ন্যূনতম সুযোগটাও পাওয়া যায় না। আসলে এরা সৃষ্টিকর্তাপ্রেরিত মানুষ, এদের ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, এদের অস্তিত্ব আর কাজটা কেবল অনুভব করা যায়। এর বেশি কিছু নয়।
সেসময় আমার মানসিকতায় কিছু সমস্যা ছিল। আমার যখন মনে হলো, আমি আমার লাইফে অনেক কিছু পেয়ে গেছি, মানে আমার দৃষ্টিতে আমি অনেক কিছু পেয়ে গেছি, তখন দেখা গেল, ওঁর সঙ্গে আমার একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে---সেটা ব্যস্ততার কারণেই হোক, কিংবা এমনও হতে পারে, ওঁকে আমি হয়তো ভুলেই গেছি, কিংবা মনে থাকলেও ওভাবে হয়তো মনে নেই। সেই কারণেই ওঁর সাথে আমার একটা অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। তখন দেখা গেছে, ওঁর যখন ক্যানসার হয়েছিল, তখন ওঁর সঙ্গে আমি যোগাযোগ করতাম, কিন্তু উনি অসুস্থ ছিলেন বলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন না। আমি টেক্সট পাঠাতাম, সেগুলি আনসিন পড়ে থাকত। এরপর আমি আবারও পাঠাতাম। দিদির সাথে আমার কোনও ইগো নেই, কোনও অভিমান নেই। এই একটা মানুষের কাছে এসে আমার সমস্ত ইগো, অহংকার, অভিমান একেবারেই জল হয়ে যেত। কথার কথা বলি, দিদি যদি আমাকে জুতো খুলেও পেটান, তা-ও আমি ওঁর পায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকব। আমি ধরে নেব, নিশ্চয়ই এই প্রহারের মধ্যেই আমার মঙ্গল লুকিয়ে আছে।
আমি প্রতিদিনই দিদির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতাম। এই মানুষটা আমাকে মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। এই মানুষটার সঙ্গে কথা হলে আমার মনে হতো, জীবনে বেঁচে থাকারও নিশ্চয়ই কোনও একটা কারণ আছে, বেঁচে-থাকাটা নিরর্থক কিছু নয়। জীবনে এই বেঁচে-থাকাও একটা আনন্দের বিষয় বা বেঁচে থাকলেও আমি কিছু একটা পাবই পাব। পৃথিবীতে আমি খালিহাতে ফিরে যাবার জন্য আসিনি। কিংবা মনে হতো এই যে প্রতিদিন কাটাচ্ছি, প্রতিদিন যাপন করছি, এটার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। আমি যে ভাবছি, আমি যে সৃষ্টি করছি, আমি যে কিছু করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি, এসবের মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। এই যে আমি বেঁচে থাকলে কখনও না কখনও অন্তত একটা মানুষের হলেও উপকার করতে পারব, একটা মানুষ আমাকে দেখে শিখছে, কিংবা আমি যে জীবনটাতে বেঁচে আছি সে জীবনটা অনেকেই চায়, কিন্তু পায় না, যা আমাকে ঈশ্বর দিয়েছেন তা-ও তো অনেকেই পায়নি---এসবও তো বেঁচে-থাকার এক-একটা আনন্দ। এমন অনেক কিছুই শিখতাম ওঁর কাছ থেকে।
তো যেটা বললাম, ওঁকে আমি কখনও দেখিনি, ওঁর সাথে আমার কথা হয়েছে মাত্র দুইবার ফোনে। প্রতিদিনই চ্যাটিং হতো। উনি আমাকে গড়ে তোলেন ওরকম দূরে থেকেই। এই মানুষটার উপস্থিতি আমার পুরো হৃদয়ে অত্যন্ত তীব্র ছিল। ওঁর খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টেক্সটও আমি খুব গুরুত্ব দিয়ে একাধিকবার পড়তাম। যখন আমি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হলাম, তখন উনি কীভাবে যেন হারিয়ে গেলেন আমার জীবন থেকে। এরপর তো আমার আগের আইডিটাই চলে গেল কিছু অতি-উৎসাহী মানুষের চেষ্টায়, সেই আইডির অনেকেই চলে গেল। সেই আইডি চলে যাওয়ার পর, আমি এই আইডি থেকে ওঁকে অসংখ্যবার টেক্সট পাঠিয়েছি, কিন্তু উনি এগুলি দেখতেন না, দেখেও রিপ্লাই করতেন না। হয়তোবা ওঁর মনে হতো, এটা ফেইক আইডি। হয়তোবা অসুস্থ হওয়ার পর উনি আগের জিনিসগুলি ভুলে গেছেন। এমনও হতে পারে, উনি ব্যস্ত হয়ে গেছেন, কিংবা কোনও-না-কোনও কারণে---অভিমান থেকে হোক বা নিঃস্পৃহতা থেকে হোক, উনি আর আগের মতো যোগাযোগ রাখেননি।
ওঁর কাছ থেকে শেখা একটা দর্শনকে আমি নিজের মতো করে বলি। আমরা ঈশ্বরের বা আল্লাহ্র বা গডের কাছে যখন প্রার্থনা করি, তখন আমরা বারবার বলি, আমি অনেক পাপ করেছি, আমাকে ক্ষমা করো। আমরা এটা কেন বলি? এটা আমরা এজন্যই বলি, আমাদের ভেতরে যে ইগো, যেটাকে আমরা বাংলায় বলি অহম্ বা অহং, সেটা আমাদের মাথানত করতে দেয় না, নতিস্বীকার করতে দেয় না। আমি যখন কারও কাছে সারেন্ডার করি, কমপ্লিটলি সারেন্ডার করি, তখন…আমরা তো দোষে গুণে মানুষ, যদি গুণগুলিকে মাথায় রাখি, তাহলে কখনওই সারেন্ডার করা সম্ভব না, অর্থাৎ নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করা সম্ভব না। সারেন্ডার করার প্রধান শর্ত হচ্ছে, আমাদের দোষগুলি স্বীকার করতে হবে, ভুলগুলি স্বীকার করতে হবে। নিজের সমস্ত দম্ভ, অর্জন, অহমিকা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে সমর্পণ করতে জানতে হয়। এইজন্যই আমাদের এই সারেন্ডার করার ব্যাপারটা হচ্ছে আসলে নিজের হৃদয়ের প্রতি। কারণ আমাদের ভেতরে যে আয়নাটা আছে, ওই আয়নাটা তো স্বচ্ছ। আমরা চাইলেও ওখানে লুকাতে পারি না কিছুই। তো সেটার সামনেই আমরা নিজেকে সারেন্ডার করে দিই এবং ওই আয়নায়, আমাদের যতগুলি দোষ আছে, সেগুলিকে নিজের চোখের সামনে নিয়ে আসি।
এভাবে করে নিয়ে এসে, আসলে তখন আমরা নিজেকেই মেসেজ পাঠাই, নিজের অন্তরে এই মেসেজ পাঠাই যে আমাদের এত ইগো রাখার কিছুই নেই, এত অহংকার রাখার কিছু নেই। আমাদের জীবনটা ভুলে ভরা এবং এই একটা মানবজীবন কিছুটা হলেও সফল করার জন্য, সে-ভুলগুলি থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে। আমার অহংকার করার মতো কিছুই নেই। আমার ব্যর্থতা, আমার ভুল, আমার অন্যায় এই সবকিছু নিয়েই আমি বারবার বলতে থাকি। এটাই হচ্ছে সারেন্ডার করা, আত্মসমর্পন করা। এই কাজটা ঈশ্বরের কাছে করে মানুষ। এটার আর-একটা দিক আছে। আমরা যখন ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সঁপে দিই, বলি যে, আমি পাপী, আমি অপরাধী, আমাকে ক্ষমা করো, তখন আমাদের ব্রেইনে এই মেসেজটা চলে যায়,---এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা ক্ষমা পাচ্ছি। ফলে আমরা নিজেকে অনেকটাই নির্ভার অনুভব করি এবং কিছু আফসোস ও অনুশোচনা থেকে মুক্তি পাই। যেহেতু আমাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছেই, সেহেতু আমরা যদি অপরাধবোধটা নিজের হৃদয়ে জিইয়ে রেখে রেখে জীবন পার করে দিই, তবে আমাদের সামনের কাজগুলিও ব্যাহত হবে, জীবনযাপনের কষ্ট আরও বাড়বে। তাই কিছুটা হলেও এসবের ভার ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করার মধ্য দিয়ে আমরা মূলত নিজের হৃদয়কেই হালকা করে দিই, নিজের মস্তিষ্ক থেকে কিছু বিগত পাপের দহন নামিয়ে নিই। এটাই ধর্মের কাজ---নিজের হৃদয়কে জীবনযাপনের জন্য প্রতিনিয়ত প্রস্তুত করা,---হোক তা ধ্যানের মাধ্যমে, হোক তা প্রার্থনার মাধ্যমে, হোক তা প্রকৃতির কাছে গিয়ে সময় কাটানোর মাধ্যমে, হোক তা অন্য কোনও উপায়ে।
আমার চোখে, গায়ত্রী তালরেজা আমার ঈশ্বরের মতো। কেন? ঈশ্বর যেমনি করে আমাদের হৃদয়কে জাগিয়ে তোলেন, ঠিক তেমনি করেই উনি আমার হৃদয়কে জাগিয়ে গেছেন দিনের পর দিন,---অক্লান্তভাবে, নিঃস্বার্থভাবে। আমি ওঁকে সব সময় বলতাম, ‘আমি অকৃতজ্ঞ, আমি তোমার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারিনি, তোমার খোঁজখবর নিতে পারিনি, তুমি আমাকে ক্ষমা করো, তুমি আমার সাথে রেগে থেকো না। নীল কেমন আছে, বলো। তারপর মহেশ জিজাজি কেমন আছে, বলো। তুমি কেমন আছ, বলো। তুমি সুস্থ আছ তো?’ উনি কিন্তু এগুলি দেখতেন এবং রিপ্লাই করতেন না। সেটা আমার আরও ভালো লাগতো। কেন ভালো লাগত? কারণ আমি ওঁর সাথে ঠিকমতো যোগাযোগ না-রেখে, ওঁর খোঁজখবর না-নিয়ে, ওঁর কাছে অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না-করে যে কিছু দোষ করেছি, তার প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে। উনি আমাকে ইগনোর করছেন, উনি আমার টেক্সটগুলি দেখেও রিপ্লাই করছেন না, উনি আমার প্রতি একধরনের তাচ্ছিল্য দেখাচ্ছেন। আমি এরকম করেই ভেবে নিতাম। এটা কিন্তু আমার কাছে একধরনের প্রায়শ্চিত্ত। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমি এই প্রায়শ্চিত্ত-করতে-হওয়াটা ডিজার্ভ করি। যার ফলে এটাও আমাকে একধরনের তৃপ্তি দিচ্ছিল।
মানুষ যখন ঈশ্বরের কাছে দোষস্বীকার করে, নিজেকে পাপী বলে, নিজেকে ভুলে-ভরা মানুষ বলে, দ্বিধা না-রেখে পূর্ণ সততায় নিজের সব অপরাধ বলে দেয়, তখন কিন্তু সে একধরনের তৃপ্তি পায়। সে নিজের ইগোটাকে ধুলোয় নামিয়ে ফেলে এবং সে ভাবে, আমি তো এখন পুরোপুরি নগ্ন হয়ে গেলাম। আমি তো আমার নিজের আয়নার সামনে নগ্ন হয়ে গেলাম। আমার তো এখন ধারণ করার মত, অহংকার করার মতো শরীরে আর কিছুই নেই। মনের মধ্যেও কোনও কিছু নেই। আমি আজ রিক্ত, শূন্য, ঠিক সেই প্রথম দিনটার মতো, যেদিন আমি এই পৃথিবীতে এসেছিলাম। সে মুহূর্তে সে একইসাথে নিজেকে নিঃস্ব ও অসহায় অনুভব করার পাশাপাশি একধরনের তীব্র অনুশোচনায় বিদ্ধ হয়, এবং ঠিক তখনই সে মুক্তির পথে হেঁটে যাচ্ছে, এমনটা ভেবে নেয়। সে ক্ষমা পাচ্ছে, স্রষ্টা মহান বলেই তার মতো একটা পাপীকে ক্ষমা করে দিচ্ছেন। তখন আসলে এইসব কারণেই মানুষ আবেগ থেকে কান্নাকাটি করে। এই কান্নাকাটি প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিকর্তার কাছে বা নিজের কাছে। সকল ধর্মেই এর বিধান আছে। নিজের কাছে কান্না করলে হয় কী, পরেরদিন সকালে উঠে সে ভাবে, আগেরদিন আমি সব পাপ ও কালিমা স্বীকার করে ফেলছি। মনে মনে কলুষমুক্ত হয়ে নিজেকে সে তখন হালকা অনুভব করে, নিজের মনের মধ্যে একধরনের নতুন তেজ অনুভব করে। নিজের ভেতর থেকে এমনি করে পাপের বোঝা নামিয়ে নিলে বাঁচতে অনেক সুবিধা হয়। আত্মশক্তি বাড়ে, মানুষের কল্যাণ করার ইচ্ছেও বাড়ে, পুরনো পাপের পথে আর কখনও পা না বাড়ানোর অনুশাসন মনের মধ্যে আপনাআপনিই তৈরি হয়ে যায়।
এটা খ্রিষ্টান ধর্মেও আছে। খ্রিষ্টান ধর্মে ফাদারের কাছে গিয়ে মানুষ কনফেশন (নিজের দোষস্বীকার করে পরিত্রাণকামনা) করে। এটার একটাই কারণ---তখন ফাদার বলেন, প্রভু, তুমি তাকে ক্ষমা করো। সে ক্ষমা চাইছে তোমার কাছে, তুমি তাকে আশ্রয় দাও।…একটু ভাবুন তো, একটা মানুষ যদি সারাক্ষণই অনুশোচনায় বাঁচে, তাহলে তো সে একটা সময় ধ্বংস হয়ে যাবে। সে একসময় জ্যান্তলাশ হয়ে যাবে। এতটাই তীব্র দহন সহ্য করে করে বেঁচে থাকবে, এটাও কী করে সম্ভব! সেই পাপের অনুশোচনা নিয়ে বেঁচে থাকাটা সবচাইতে কষ্টের, যে পাপের সমস্ত দায়ভার ও দোষ আমার একার। ধর্ম মানুষকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে। স্রষ্টার কাছে পাপস্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে নিজের হৃদয় থেকে কিছু ভারী পাথর নেমে যায়, তখন মানুষ ভালো থাকে। এমনও হতে পারে, যার প্রতি আমি অন্যায় করলাম, প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে আমি তার, তার পরিবারের, কিংবা অন্য অনেক মানুষকে তাদের বেঁচে-থাকার পথে সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। পুণ্যে পাপ কাটে। তাই যত বেশি পুণ্য করা যায়, মনের শক্তি ততই বাড়ে।
যা-ই হোক, আমরা যেখানে ছিলাম। যখন ফাদার তার সামনে ঈশ্বরকে বলেন, হে পরমপিতা, তুমি তোমার এই সন্তানকে ক্ষমা করে দাও, তাকে আশ্রয় দাও, তাকে দিয়ে ভালো কাজ করাও…ইত্যাদি কথাবার্তা, তখন কিন্তু সে একধরনের শক্তি পায়। সে ভাবে, হ্যাঁ, ঠিক আছে, আমি ক্ষমা পেয়েছি, এখন আমি নতুন শক্তিতে আবার কাজ করব; আমি যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন আর কখনও এই ভুলটি করব না; আমি মানুষের সেবা করে বাঁচব, এতে আমার ও আমার পরিবারের মঙ্গল হবে, অন্যকে শান্তিতে বাঁচতে দেবো, নিজেও শান্তিতে বাঁচব। এইসব ভাবনার অনেক মূল্য আছে। যদি আগের ভুলের কথা তার মনে থাকে, তখন সে এই ভুলটা আর দ্বিতীয়বার করবে না। মানুষকে যেহেতু বেঁচে থাকতে হচ্ছেই, সেহেতু মানুষটা ভালো কিছু করেই বেঁচে থাক। একটা মানুষের মধ্যে যদি অনুশোচনা, পাপবোধ সব সময়ই কাজ করে, তাহলে তো সে জীবনে আর কিছুই করতে পারবে না। তার দু-একটা ভালো কাজ করার থাকলেও সেটা করতে পারবে না। সে ভাববে, আমি তো এমনিতেই খারাপ, আমার আর ভালো কাজ করে কী হবে? খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের সমাজে কিছু মানুষ হজ্ব করে এসে নিজেকে শুদ্ধতার পথে বাঁচিয়ে রাখেন, মানুষের কল্যাণ করেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন। এর তাৎপর্য অসীম। কেননা এই মানুষটা তাঁর বাকি জীবনে নিজে সুন্দর করে বাঁচবেন ও অন্যকেও সুন্দর করে বাঁচাতে সাহায্য করবেন। হিন্দুরা তীর্থ করে আসার পরও একই কাজটা করেন। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও একই কাজ করেন। ধর্মের এইসব দর্শন, এইসব অনুশাসন, এইসব পদ্ধতি অনেক মানুষকে চমৎকার পথে বাঁচতে প্রভূত সাহায্য করে।
মানুষ সবচাইতে বেশি চায় নিজের মনের কষ্ট আর অন্তর্দহন থেকে মুক্তি। এইজন্যই মানুষ সারেন্ডার করে; বলে, আমি পাপী, আমি গুনাহগার বান্দা, আমাকে মাফ করো…ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা আসলে মানুষ নিজেকেই বলে, নিজের হৃদয়কে কিছুটা ভারমুক্ত করে ফেলে। ভেতর থেকে আফসোস, যন্ত্রণা, চাপাকষ্টের অনুভূতিগুলিকে বের করে দেয়। ভেতর থেকে কান্নাগুলি, ব্যথাগুলি, পাপবোধগুলি বের করে দেয়। তখন মানুষ হালকা হয়, মানুষের মধ্যে একধরনের শক্তি তৈরি হয়। এমন শক্তি তৈরি হলে সে পরেরদিন আবার নতুন শক্তিতে কাজ করতে পারে। ব্যাপারটা প্রকৃতপক্ষে এরকমই। তো আমি ওঁকে মেসেজ পাঠালে উনি হয়তো সিন করতেন, রিপ্লাই করতেন না। তখন আমার কাছে মনে হতো, আমি এটা ডিজার্ভ করি। এটা আমার প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে এবং এটা আমার একধরনের স্যালভেশন এবং আমি ওঁকে আরও বেশি বেশি করে নক করতাম। চাইতাম, উনি আমার টেক্সটের রিপ্লাই না দিক, এতে আমি যে কষ্টটা পাচ্ছি, এটাই আমার প্রাপ্য। আমি ওঁর খোঁজখবর রাখিনি ঠিকমতো, প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর ওঁকে ঠিকঠাক মনে রাখিনি বা মনে রাখলেও ওঁকে তা জানাইনি, উনি অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু আমি ওঁর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। হয়তো আমি নক ঠিকই করেছিলাম আমার নতুন আইডি থেকে, উনি ব্যস্ততায় হোক বা যে কারণেই হোক, খেয়াল করতে পারেননি বা খেয়াল করেও রিপ্লাই দেননি কিছু না কিছু কারণে। আমি তো সেই কারণটা জানার যথেষ্ট চেষ্টা করিনি, ওঁর জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি এ জীবনে, যেখানে আমার এই নতুন জীবনটা অনেকটা ওঁরই দেওয়া!
এমন কিছু মানুষ আপনার জীবনে থাকবেন, আসলে ‘কিছু মানুষ’ নয়, মাত্র ‘দুই-একজন মানুষ’ আপনার থাকবেন, যাঁদের আপনি দিনের পর দিন নক করে গেলে তারা যদি রিপ্লাই না-ও দেয়, তারপরও আপনি সে মানুষটার প্রতি অন্ধ ভালোবাসা বলেন, আপনার অগাধ বিশ্বাস বলেন, আপনার শ্রদ্ধা বলেন, সরাতে পারবেন না। আপনি যদি কৃতজ্ঞ হন, তবে আপনার মন তা করতে কিছুতেই সায় দেবে না। যে মানুষের মধ্যে কৃতজ্ঞতা নেই, সে মানুষ তো জানোয়ারেরও অধম। ভেবে দেখুন, আপনার জীবনেও এমন মানুষ কেউ-না-কেউ আছেনই। তো দিদি হচ্ছেন আমার জীবনে ওরকমই একজন মানুষ। আমি এভাবে ভাবি, আমাকে যদি ওঁর জন্য আমার দেহের একটি অঙ্গও দান করতে হয় কখনও, আমি সেটার জন্যও প্রস্তুত থাকব। ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতাবোধ, শ্রদ্ধা এরকম একটা ব্যাপার। আমি তো জানি, উনি যদি না থাকতেন সেসময় আমার জীবনে, তবে আমি তো হারিয়েই যেতাম। আমি তো লাইফে কিছুই পেতাম না। আমি সেসময় ধরেই নিয়েছিলাম, জীবনে যদি কিছু করতে না পারি, তার চাইতে মৃত্যুও শ্রেয়। উনিই আমাকে বাঁচিয়েছেন সেখান থেকে। এজন্য আমার সারাজীবনে আমার মা-বাবার পর আমি যদি কাউকে স্মরণ করি, সেটা হচ্ছেন উনি। তাই, সত্যিই ওঁর প্রতি আমার রাগ ক্ষোভ অভিমান অহংকার ইগো কিচ্ছু নেই। উনি তো আমার জীবনে এমন এক মানুষ, যাঁর পায়ের ধুলোর কাছে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হলেও আমার কোনও আপত্তি থাকবে না, বরং নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবব।
কিছুদিন আগে উনি আমাকে বললেন, ‘সুশ, তোমার উপর আমি রাগ করব কেন? কী বলো এসব! লল (lol)!’ দেখুন, কত সহজে সবকিছুকে একতুড়িতেই সমাধান করে দিলেন! কারও প্রতি রাগ অভিমান পুষে রাখার মতো সময় বা মানসিকতাই ওঁর নেই! উনি হচ্ছেন আমার সারাজীবনে দেখা সব থেকে স্মার্ট মানুষ। ওঁর চেয়ে স্মার্ট কারও সাথে আমার এখনও পরিচয় হয়নি। অনেক বড়ো বড়ো অপরাধ, অনেক বড়ো বড়ো ভুল, অনেক সিরিয়াস জিনিসকে উনি খুব সহজভাবে নিতে পারেন। ওঁকে আসলে ছোটোখাটো কিছুই কখনও স্পর্শ করে না। একজন মানুষকে চেনা যায়, কী কী বিষয় তাঁকে বিচলিত করে তুলছে বা ভাবাচ্ছে, তা দেখে। যিনি যত বড়ো, তিনি তত সহজে ছোটো বিষয়কে উপেক্ষা করতে পারেন, ভুলে যেতে পারেন। তিনি তো নিজেকে সারাক্ষণই নানান কাজে ব্যস্ত করে রাখেন বা বিভিন্ন ভাবনায় নিজেকে নিযুক্ত রাখেন। সময় কোথায় অত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস নিয়ে ভাববার?
উনি সবসময় বলতেন, বেঁচে-থাকার চেয়ে বড়ো কোনও আশীর্বাদ আর নেই। তুমি যে বেঁচে আছ, এটাই হচ্ছে, তোমার কাছে সব সমস্যার সবচাইতে বড়ো সমাধান। এটার কাছে সব সমস্যাই হচ্ছে গৌণ। তো জীবনে যে-কোনও সমস্যা এলে সেটাকে হাসিমুখে নাও, সহজভাবে নাও। তোমার গায়ে যেন সেটা স্পর্শ না করে। সামনের দিকে যেতে হবে তো! যদি পথের সমস্ত কাঁটা নিয়েই ভাবতে থাকো, গায়ে আটকাতে থাকো, তবে এগোবে কী করে? ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে যে যত কম উদ্বিগ্ন, জীবনে সে তত বেশিদূর হাঁটতে পারে। কেন, তা জানো? তুমি বেঁচে থাকলে দেখবে কী, পরেরদিন তুমি এমন একটা সমস্যায় পড়বে, ওই সমস্যাটার কাছে এই সমস্যাটা কোনও কিছুই না। এইজন্য বড়ো সমস্যা বলে আসলে কিছু নেই। ওসবকে এড়িয়ে যেতে তুমি পারবে না, বরং বড়ো বড়ো সমস্যায় অল্প বয়সে পড়াই ভালো। তাহলে সামনের সকল সমস্যাকে নস্যি মনে হবে! তুমি যে বেঁচে আছ, এটা হচ্ছে সকল বড়ো সমস্যার সমাধান, মনে রেখো। দিদি এটা বলতেন আমাকে। এ মানুষটার সাথে কোনও দিন দেখা হয়নি, কোনও দিন কথাও ওরকমভাবে হয়নি, কিন্তু আমার জীবনে এই মানুষটার অস্তিত্বই সব থেকে ধ্রুব, সব থেকে জ্যান্ত, সব থেকে জ্বলন্ত।
আমি ওঁর ওয়ালে যাই, গিয়ে দেখি, উনি কী কী ছবি পোস্ট করলেন! উনি অনেক মজা করেন, অনেক ঘুরে বেড়ান এবং উনি লাইফকে খুবই সহজভাবে নেন। মানুষকে সাহায্য করেন, মানুষের জন্য ভাবেন। কণামাত্রও সংকীর্ণতা নেই ওঁর মধ্যে, চলাফেরায় ও ভাবনায় উনি অনেক উদার মনের। কে কী করছে না করছে, এটা নিয়ে ওঁর কোনও মাথাব্যথা নেই। ওঁকে আমি দেখছি, উনি এমন একটা মানুষ, যিনি এই পৃথিবীর কাউকেই একেবারে ওয়ান পার্সেন্টও জাজ না করে থাকতে পারেন! উনি কখনওই কাউকে জাজ করেন না। কে কীভাবে আছে না আছে, কী করছে না করছে, ওটা তার নিজস্ব এক্সপেরিয়েন্স, ওটা তার নিজস্ব একটা লাইফস্টাইল, ওটা তার নিজস্ব একটা বলয়। যদি কেউ কারও কোনও ক্ষতি না করে তার নিজের মতো করে বাঁচে, তবে এটা নিয়ে দিদির কোনও মাথাব্যথা নেই। উনি মানুষকে যথাসাধ্য সাহায্য করেন, মানুষকে সত্যিই ভালোবাসেন, মানুষকে সিমপ্যাথি দিয়ে দেখেন। কখনও কাউকে বিরক্ত করা কিংবা কখনও কারও লাইফ নিয়ে ইন্টারফিয়ার করা, এগুলি আমি কখনও ওঁকে করতে দেখিনি। কেউ বিপদে পড়লে, কারও পাশে দাঁড়াতে হলে, কেউ হতাশায় ডুবে গেলে, কেউ জীবন নিয়ে নানান সংকটের মধ্য দিয়ে গেলে, সবার আগের গায়ত্রীদিদি হাজির হয়ে যাবেনই তাঁর সমস্ত ইচ্ছা ও সামর্থ্য সাথে নিয়ে! হ্যাঁ, ওঁর আর-একটা দিক, উনি খুব পশুপ্রেমিক। পশুদের নিয়ে কাজ করে, এমন কিছু সংগঠনে উনি নিয়মিত ডোনেট করেন। ওঁর একটা বড়ো কুকুর আছে, সে কুকুরটা নীলের খেলার সঙ্গী, ওঁদের পরিবারের একজন সদস্য।
(চলবে…)