সহজ ভাষায়, ১১.৩৩ বলে—তোমার কাজ থেমে থাকবে না; তোমার অহং থেমে থাক। তুমি স্রোতে দাঁড়িয়ে দাঁড়াও, কিন্তু নিজেকে নদী ভেবো না; নদী যে-সাগরে গিয়ে মেশে, সেই সাগর-স্বরূপ সত্যকে চেনো। তবেই যুদ্ধেও শান্তি, কর্মেও মুক্তি, কর্তব্যেও আনন্দ। এইজন্যই গীতার সার কথা একরেখায় ধরা যায়—কর্ম করো, কর্তার “আমি”-টাকে করুণার হাতে ছেড়ে দাও; তুমি নিমিত্ত, কর্তা তিনি।
এই শিক্ষা কেবল অর্জুনের জন্য নয়; এটি সমস্ত মানুষের জন্য এক চিরন্তন নীতি। প্রত্যেক জীবের জন্ম এক পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য বহন করে—ঈশ্বর সেই জীবকে একটি নির্দিষ্ট কর্মের নিমিত্তে পৃথিবীতে পাঠান। তাই গীতার (৩.৩৩) শ্লোকটি—“সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতেঃ জ্ঞানবানপি। প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিঁ করিষ্যতি।।”—এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক সত্য উদ্ঘাটন করে। এখানে কৃষ্ণ বলেন, এমনকি জ্ঞানী, বিচক্ষণ ব্যক্তি—যিনি সত্য ও মায়ার ভেদ বোঝেন—তিনিও নিজের প্রকৃতি বা স্বভাবজাত গুণ অনুযায়ী কাজ করেন। “প্রকৃতি” এখানে কেবল বাহ্য পদার্থ নয়; এটি মন, প্রবৃত্তি, সংস্কার ও কর্মবৃত্তির সম্মিলিত ভিত্তি—যে-শক্তি মানুষের চিন্তা, অনুভব, আচরণ ও সিদ্ধান্তকে নির্ধারণ করে।
“প্রকৃতি” শব্দটি ভারতীয় দর্শনে এমন এক মৌলিক ধারণা, যা সমস্ত সৃষ্টির গতিশীল ভিত্তি। সাংখ্যদর্শনের মতে, পুরুষ (চৈতন্য বা চেতন সত্তা) এবং প্রকৃতি (অচেতন কিন্তু সৃষ্টিশক্তি)—এই দুইয়ের সঙ্গমেই জগৎ প্রকাশ পায়। কপিল মুনির সাংখ্যসূত্রে বলা হয়েছে—“প্রকৃতির্মহদাদি তত্ত্বানাম্” (সাংখ্যকারিকা, শ্লোক ৩)—অর্থাৎ, প্রকৃতি থেকেই “মহৎ” (বুদ্ধি), “অহংকার”, “তন্মাত্র”, “ইন্দ্রিয়” এবং শেষপর্যন্ত “স্থূল জগৎ”-এর উদ্ভব। তাই প্রকৃতি হল সেই মৌল শক্তি, যা চেতন পুরুষকে প্রতিফলিত করে দৃশ্যমান সৃষ্টিরূপে।
ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায়ে (৭.৪-৫) কৃষ্ণ যে দুটি প্রকৃতির কথা বলেছেন—অপরা প্রকৃতি ও পরা প্রকৃতি—তা ভারতীয় দর্শনের এক মৌল ভিত্তি। এই শ্লোকদুটি বোঝায় যে, সৃষ্টিজগৎ কেবল বস্তুজ নয়, তার অন্তরে আছে এক জীবন্ত চেতনা, যা সমস্ত গতিশীলতাকে অর্থ দেয়।
প্রথম শ্লোকে কৃষ্ণ বলেন—“ভূমিরাপনলোবায়ুঃ খং মনোবুদ্ধিরেব চ। অহঙ্কার ইতি মেঃ ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।” অর্থাৎ, “ভূমি (পৃথিবী), আপ (জল), অনল (অগ্নি), বায়ু, খ (আকাশ), মন, বুদ্ধি এবং অহংকার—এই আটটি উপাদান আমার প্রকৃতির নিম্ন রূপ।” এই অংশে কৃষ্ণ অপরা প্রকৃতি-র বর্ণনা দিচ্ছেন—এটি সেই প্রকৃতি, যা জড় ও পরিবর্তনশীল। এখানেই জগতের সমস্ত পদার্থ ও মনোবৃত্তির মূল উপাদান নিহিত। এই আটটি উপাদান মিলিয়ে গঠিত হয় দৃশ্যমান জগৎ এবং মানসিক ক্রিয়া—পৃথিবীর কঠিন রূপ, জলের তরলতা, আগুনের শক্তি, বায়ুর গতি, আকাশের বিস্তার, মন-বুদ্ধি-অহংকারের মনস্তাত্ত্বিক গঠন—সবই এই নিম্ন প্রকৃতির প্রকাশ।
তারপর দ্বিতীয় শ্লোকে তিনি বলেন—“অপরৈয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মেঃ পরাম্। জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ।।” অর্থাৎ, “এই নিম্ন প্রকৃতির অতিরিক্ত আরেক প্রকৃতি আছে—আমার পরা প্রকৃতি। সেটিই জীবসত্তা, যার দ্বারা এই জগৎ ধারণ করা হয়।” এখানে “পরা প্রকৃতি” মানে চেতনা বা চিদ্বোধ, যা জড়ের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করে। যেমন মৃতদেহে সমস্ত অঙ্গ বিদ্যমান, কিন্তু চেতনা নেই বলে তা প্রাণহীন—তেমনি অপরা প্রকৃতি কেবল জড় উপাদান, পরা প্রকৃতিই সেই জীবন্ত সত্তা, যা তাকে সক্রিয় করে।
এই দুই প্রকৃতির সম্পর্ক বোঝাতে গীতা (১৩.১৯)-এ কৃষ্ণ আরও বলেন—“প্রকৃতিঃ চ পুরুষশ্চৈব বিদ্ধ্যনাদি উভৌঅপি।” অর্থাৎ, “প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়ই অনাদি।”
এখানে প্রকৃতি বলতে বোঝানো হয়েছে কার্যশক্তি বা সৃষ্টিশক্তি, আর পুরুষ হল চেতনা, যা অক্রিয় কিন্তু উপস্থিত—দ্রষ্টা, সাক্ষী, অবিচল। প্রকৃতি চঞ্চল, পুরুষ স্থির; প্রকৃতি ক্রিয়াশীল, পুরুষ প্রত্যক্ষকারী।
এই সম্পর্কটি বোঝাতে একটি সহজ উদাহরণ নেওয়া যায়: যেমন বিদ্যুৎ ও বাল্বের সম্পর্ক। বাল্ব নিজে আলো দেয় না, কিন্তু বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে সে জ্বলে ওঠে। বিদ্যুৎই চেতনা, আর বাল্ব হলো প্রকৃতি—বাহ্য রূপ, যা সেই চেতনার প্রকাশ ঘটায়। বিদ্যুৎ ছাড়া বাল্ব জড়; বাল্ব ছাড়া বিদ্যুৎ অপ্রকাশিত। ঠিক তেমনই, পুরুষ ও প্রকৃতি দুই একত্রে থাকলে সৃষ্টির লীলা ঘটে।
সাংখ্যদর্শন এই তত্ত্বকে আরও বিস্তারিতভাবে বলে—“পুরুষার্থেবোহিতা সৃষ্টির্ভবতি।” অর্থাৎ, সৃষ্টির উদ্দেশ্য পুরুষের অভিজ্ঞতা। পুরুষ (চেতনা) নিজেকে জানার জন্য প্রকৃতিকে অবলম্বন করে। তাই সৃষ্টি কোনো বাইরের কারিগরি কাজ নয়, বরং চেতনার আত্মপ্রকাশ।
অদ্বৈত বেদান্ত এই দুই প্রকৃতির ঐক্য ঘোষণা করে। শংকরাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে বলেন—“অপরা প্রকৃতি মায়া, পরা প্রকৃতি চিদাত্মা।” নিম্ন প্রকৃতি মায়া বা ঈশ্বরের শক্তি, যা নাম-রূপের জগৎ সৃষ্টি করে; পরা প্রকৃতি হল স্বয়ং ঈশ্বরের চিদাত্মা, যা অচল ও চিরন্তন।
এই তত্ত্ব আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গভীর। নিউরোবিজ্ঞানের ভাষায়, আমাদের শরীর-মন “অপরা প্রকৃতি”—যেখানে ইন্দ্রিয়, নিউরন, হরমোন কাজ করে; কিন্তু সচেতন প্রত্যক্ষতা, অর্থাৎ “আমি আছি”—এই অনুভূতি, সেটিই “পরা প্রকৃতি” বা চেতনা। শরীর মেশিনের মতো কাজ করে, কিন্তু সচেতন অভিজ্ঞতাই তাকে অর্থ দেয়।
এই দুই প্রকৃতি—জড় ও চেতন—একই ঈশ্বরীয় সত্তার দুই রূপ। এক স্থিতি, অন্য গতি; এক শক্তি, অন্য তার জ্যোতি। তাই গীতার শ্লোক মানবজীবনের এক চিরন্তন সত্য শেখায়—জীবনের বাহ্য জগৎ যতই পরিবর্তনশীল হোক, তার অন্তরে যে-চেতনা, সেটিই অপরিবর্তনীয় ঈশ্বর।
গীতার শ্লোক ৩.৩৩-এ যখন কৃষ্ণ বলেন—“সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতেঃ জ্ঞানবানপি”, তখন তাঁর অর্থ হলো: জ্ঞানী ব্যক্তিও নিজের স্বাভাবিক গুণধর্ম অনুসারে কাজ করেন। মানুষের অন্তরের বুদ্ধি, মন, ইন্দ্রিয়, সংস্কার—সবই প্রকৃতির দ্বারা গঠিত। যতদিন সেই প্রকৃতির গুণসমূহ সক্রিয়, ততদিন তাদের প্রভাব এড়ানো যায় না। যেমন অগ্নি স্বভাবত দাহ করে, জল প্রবাহিত হয়, বায়ু গতি সৃষ্টি করে—তেমনি মানুষের মনও নিজের প্রকৃত গুণ অনুযায়ী আচরণ করে।
এই ধারণা গৌড়পাদাচার্যের মাণ্ডূক্যকারিকাতেও প্রতিধ্বনিত—তিনি বলেন, “প্রকৃতির্যথা স্বভাবেন প্রেরিতা গচ্ছতি স্বয়ম্।” অর্থাৎ, প্রকৃতি নিজের স্বভাবেই চলে; তাকে বাহ্যিক জোরে থামানো যায় না।
মনস্তাত্ত্বিকভাবে এটি এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি। মানুষ যতই আত্মনিয়ন্ত্রণ বা সংযমের চেষ্টা করুক, যদি নিজের প্রকৃতিকে না বোঝে—তাহলে সে কেবল দমন করবে, রূপান্তর নয়। তাই কৃষ্ণ এখানে “নিগ্রহঃ কিঁ করিষ্যতি”—এই সতর্কবাণী দেন; জোর করে দমন করলে প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া আরও প্রবল হয়।
উদাহরণস্বরূপ, একজন ক্রোধপ্রবণ ব্যক্তি যদি শুধু ক্রোধ দমন করে, কিন্তু তার কারণ ও শক্তিকে না বোঝে, তাহলে সেই ক্রোধ অবচেতনে জমে গিয়ে পরে অন্যভাবে প্রকাশ পায়। আবার, কেউ যদি নিজের সৃষ্টিশীল প্রবৃত্তিকে দমন করে, তা হতাশা বা অনুতাপের রূপ নিতে পারে। কৃষ্ণের শিক্ষা তাই স্পষ্ট—প্রকৃতিকে চিনে নাও, তাকে চেতনার আলোয় রূপান্তর করো; তবেই সে দাসত্ব নয়, যোগের উপকরণ হয়ে উঠবে।
অর্থাৎ, এই শ্লোকের সারমর্ম—মানুষের স্বভাব বা প্রকৃতি ঈশ্বরনিয়ন্ত্রিত শক্তি; জ্ঞানী ব্যক্তি তা দমন নয়, সমন্বয় করতে শেখেন। তাই গীতার ৯.১০ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৩.৭.৩ শ্লোকদ্বয়ের সমন্বয়ে অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়েছে—“প্রকৃতির্যস্য সর্বকারণম্ তস্যাশ্চ নিয়ন্তা ব্রহ্মৈব।” প্রকৃতি যেমন সৃষ্টির যন্ত্র, ব্রহ্ম সেই যন্ত্রের অন্তর্যামী নিয়ন্তা। জ্ঞানীর কাজ তাই প্রকৃতিকে অস্বীকার করা নয়, বরং নিজের ভেতরের পরা-প্রকৃতিকে চিনে, অপরাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা—এ-ই যোগ, এই-ই মুক্তির সূচনা।
এখানে কৃষ্ণের লক্ষ্য “অসাধ্য” বলে আত্মসমর্পণ নয়, বরং বাস্তববাদী আত্মবোধ। গীতা (৩.২৭)-য় তিনি বলেছেন—“প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ। অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।।”—অর্থাৎ, সমস্ত কাজ প্রকৃতির গুণদ্বারা সংঘটিত হয়, কিন্তু মোহগ্রস্ত মানুষ ভাবে, “আমি কর্তা।” এখানেই “প্রকৃতিঃ” মানে ঈশ্বরনিয়ন্ত্রিত নীতি-শক্তি, যা ব্রহ্মচেতনার মধ্য থেকে উদ্ভূত।
এই উপলব্ধি আধুনিক মনোবিজ্ঞানেও প্রতিধ্বনিত হয়। কার্ল ইয়ুং বলেছিলেন—মানুষের অবচেতনই তার প্রকৃত কার্যকারক শক্তি। ব্যক্তির ছায়াপক্ষ (shadow) এবং প্রবৃত্তি (instinct) অনেক সময় জ্ঞানের পরেও তাকে চালনা করে। একইভাবে ফ্রয়েডের তত্ত্বে প্রবৃত্তিগত মানসিক শক্তি সচেতন বুদ্ধির ওপর প্রাধান্য পায়। কৃষ্ণ যেন বলছেন—যতক্ষণ প্রকৃতির গুণজাল থেকে মুক্তি না আসে, ততক্ষণ সেই গুণই আচরণকে চালাবে।
কৃষ্ণ তবুও এখানে হতাশা দেন না। “নিগ্রহঃ কিঁ করিষ্যতি”—অর্থাৎ, দমন বা জোর করে সংযম কোনো স্থায়ী ফল দেয় না। প্রকৃতিকে অস্বীকার করলে সে প্রতিক্রিয়া করে, কিন্তু বুঝেশুনে, দেখেভেবে চেতনার আলোয় রূপান্তর করলে সে শান্ত ও সৃজনশীল শক্তি হয়ে ওঠে। তাই গীতা পরের শ্লোকেই (৩.৩৪) বলেন—“ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ। তয়োর্ন বশমাগচ্ছেত্ তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ।।”—রাগ ও দ্বেষ প্রকৃতির দিকচিহ্ন, তাদের দমন নয়, রূপান্তরই পথ।
এই শিক্ষার উদাহরণ সহজেই দেখা যায়: একজন সংগীতজ্ঞ যতই বিদ্বান হোন না কেন, তাঁর সুর নিজের রাগের প্রকৃতি অনুযায়ী প্রবাহিত হয়; বীজ যেমন তার গুণ অনুসারে অঙ্কুরিত হয়, মানুষও তেমনই নিজের প্রকৃতির দিকেই প্রবাহিত। তবে পার্থক্য এখানেই—জ্ঞানী জানেন তাঁর প্রকৃতি ঈশ্বরনিয়ন্ত্রিত; অজ্ঞানী ভাবে, সে নিজেই নিয়ন্ত্রক।
শেষপর্যন্ত, গীতার এই বাণী আমাদের শেখায়—সংযম মানে প্রকৃতিকে অস্বীকার নয়, তার সচেতন সমন্বয়। যেমন নদীর প্রবাহ বাঁধ দিয়ে থামানো যায় না, কিন্তু দিকনির্দেশে শক্তি পাওয়া যায়; তেমনি জীবনের প্রবৃত্তি দমন নয়, দীক্ষার প্রয়োজন। এই দীক্ষাই যোগ, যেখানে কর্মের ভেতর জ্ঞান, প্রকৃতির ভেতর পুরুষচেতনা, আর মানবের ভেতর ঈশ্বর প্রকাশ পায়। তাই কৃষ্ণের এই বাক্য আসলে আত্মজ্ঞান-ভিত্তিক মনোবিজ্ঞান: “নিজের প্রকৃতিকে চিনো, তাকে রূপান্তর করো, কিন্তু তাকে দমন কোরো না।”
অদ্বৈত বেদান্তের অন্যতম গভীর অন্তর্দৃষ্টি—যে-মানুষ নিজের ‘কর্তৃত্ববোধ’ বা ‘আমি কর্তা’ ধারণা ত্যাগ করে, সে-ই বুঝতে পারে যে, সমস্ত কর্ম, সমস্ত গতি, এমনকি নিজের চিন্তাভাবনাও ঈশ্বরেরই প্রকাশ। এখানে “আমি কর্তা” এই বোধটিই মায়ার মূল—কারণ এটি পৃথকতা সৃষ্টি করে: “আমি” এক আর “জগৎ” বা “ঈশ্বর” অন্য। কিন্তু যখন এই দ্বৈত ধারণা ভেঙে যায়, তখন বোঝা যায়—আমি যা করি, দেখি, ভাবি—সবই ঈশ্বরের শক্তিরই অভিব্যক্তি; আমি কেবল এক নিমিত্ত, এক মাধ্যম।
ভগবদ্গীতার (১১.৩৩) শ্লোকে কৃষ্ণ যেমন বলেন—“নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্”—অর্জুনকে নির্দেশ দেন, কর্তা নয়, বরং নিমিত্ত হও। এখানেই নিহিত জ্ঞানযোগের গভীর অর্থ—নিজেকে ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে উপলব্ধি করা।
এই অবস্থায় মানুষ আর ফলের চিন্তা করে না, অহংকার বা ভয়েও জড়ায় না। সে উপলব্ধি করে—“আমি কর্ম করি না, কর্ম আমার মাধ্যমে ঘটে।” এই দৃষ্টিভঙ্গিই কর্মযোগের মৌল তত্ত্ব, যা গীতা (২.৪৭)-এর বাণীতে প্রকাশিত—“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।” অর্থাৎ, কর্ম করো, কিন্তু ফলের প্রতি আসক্ত হয়ো না।
এই উপলব্ধি ধীরে ধীরে মানুষকে ভক্তিযোগে উন্নীত করে—কারণ যখন সে দেখে যে, সর্বত্র ঈশ্বরই কর্মের প্রেরণা, ফলের নিয়ামক, আর জীবনের অভ্যন্তরে সেই চেতনা নিজেই ঈশ্বরের প্রকাশ, তখন তার সমস্ত জীবন হয়ে ওঠে ঈশ্বরসেবা। তখন প্রত্যেক কর্তব্য, প্রত্যেক সম্পর্ক, প্রত্যেক নিঃশ্বাস—সবই আরাধনা হয়ে যায়।
গীতার সপ্তম অধ্যায়ের ঊনবিংশ (৭.১৯) শ্লোকে কৃষ্ণ তাই বলেন—“বাহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্মাং প্রপদ্যতে। বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ।।” অর্থাৎ, “অনেক জন্মান্তরের পর জ্ঞানী ব্যক্তি আমাকে উপলব্ধি করে বলেন—‘বাসুদেবই সর্বস্ব’; এমন মহাত্মা সত্যিই বিরল।”
এই শ্লোকের দার্শনিক তাৎপর্য অসাধারণ। এখানে “বাসুদেবঃ সর্বমিতি”—অর্থাৎ, “বাসুদেবই সব কিছু”—এই ঘোষণা একাধারে ভক্তিযোগ ও জ্ঞানযোগের পরম সংমিশ্রণ।
ভক্তের দৃষ্টিতে, এটি প্রেমের পরম সমর্পণ: “যা-কিছু আমি দেখি, যা-কিছু ভালোবাসি, তা সবই তোমার।”
জ্ঞানীর দৃষ্টিতে, এটি অদ্বৈত উপলব্ধি: “জগৎ বহুরূপ নয়, এক ব্রহ্মই বহু হয়ে প্রকাশিত।”