বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৩.৭.৩) ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন—“যো ভূমিমধ্যস্থো যং ভূমির্ন বেদ, যস্য ভূমিঃ শরীরম্, যো ভূমিমন্তরঃ যময়তি, এষ ত আত্মা অন্তর্যামী অমৃতঃ।।” অর্থাৎ, “যিনি পৃথিবীর মধ্যে অবস্থান করেন, যাঁকে পৃথিবী জানে না, যাঁর জন্য পৃথিবীই শরীরস্বরূপ, যিনি ভেতর থেকে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করেন—তিনিই তোমার আত্মা, অন্তর্যামী ও অমৃতস্বরূপ।”—“যিনি ভূমির মধ্যে অবস্থান করছেন, যাকে ভূমি জানে না, অথচ ভূমি যাঁর শরীর”—এই ঈশ্বরই সব কিছুর অন্তরে বিদ্যমান নিয়ন্তা।
এই শ্লোকের তাৎপর্য হলো—ঈশ্বর কোনো বাহ্য অধিষ্ঠাতা নন; তিনি প্রতিটি জগৎ-উপাদানের অন্তরে অবস্থান করে তাকে ভিতর থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন। “অন্তর্যামী” অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ নিয়ন্তা—যিনি বাইরে থেকে নয়, অন্তর থেকে সব কিছুর গতিবিধি পরিচালনা করেন।
জীবের ভিতরের আত্মা এবং বিশ্বচেতনার অন্তর্যামী ঈশ্বর এক ও অভিন্ন। এই জ্ঞানই আত্মবিদ্যা—যেখানে জানা যায় যে, “আমি পৃথক নই; আমিই সেই এক চেতনা, যা সকলের মধ্যে বিরাজমান।” এই উপলব্ধি থেকেই উদ্ভব হয় উপনিষদের চূড়ান্ত বাণী—“অহং ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৪.১০), আমি ব্রহ্ম।
ভগবদ্গীতায় (৯.১০) শ্রীকৃষ্ণ বলেন, আমার অধিপতিত্বে প্রকৃতি সচরাচর জগৎকে চালনা করে; এই কারণেই জগতের সমস্ত গতি চলমান—যা উপনিষদের অন্তর্যামী তত্ত্বেরই পুনরুচ্চারণ।
অন্তর্যামী তত্ত্ব মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অর্থবহ। মানুষের অন্তরে এক নীরব, অদৃশ্য চেতনা কাজ করে, যা বাহ্য অভিজ্ঞতার বাইরে থেকেও চিন্তা, ইচ্ছা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। নিউরোসায়েন্সের ভাষায়, এটি “inner awareness”—যা মস্তিষ্কের সব প্রক্রিয়াকে সমন্বয় করে।
“অন্তর্যামী” কোনো দূরের ঈশ্বর নয়—তিনি আমাদের অন্তরের আত্মা, যিনি একই সঙ্গে জগতের, প্রকৃতির ও মানুষের অন্তঃস্থ চেতনা। এই তত্ত্ব ঘোষণা করে—জীব ও ব্রহ্ম এক, এবং সেই এক চেতনা ভেতরে ও বাইরে সর্বত্র প্রকাশিত।
“হেতুনানেন কৌন্তেয় জগদ্বিপরিভর্ততে”—অংশে কৃষ্ণ ব্যাখ্যা করছেন, এই ঈশ্বরচেতনার উপস্থিতির কারণেই সমগ্র বিশ্বচক্র চলমান। সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়—এই তিনটি কর্মই প্রকৃতির দ্বারা সম্পন্ন হয়, কিন্তু তার অন্তঃরাধার চেতনা হলেন কৃষ্ণ নিজেই। অর্থাৎ, প্রকৃতি যন্ত্র, আর ঈশ্বর সেই যন্ত্রচালক।
আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায়ও আমরা এটি একধরনের কসমিক অর্ডার বা universal intelligence হিসেবে ভাবতে পারি—যা প্রতিটি পরমাণু, প্রতিটি জীব, প্রতিটি ক্রিয়ার অন্তরে এক সমন্বিত সংগতি বজায় রাখে। যেমন কোয়ান্টাম ফিজিক্সে বলা হয়, “The observer is not separate from the observed”—চেতনা নিজেই বস্তুজগতের কার্যকারিতার অন্তর্নিহিত অংশ।
গীতার এই শ্লোক তাই বলে—জগৎ চলমান, কিন্তু তার চালক এক চেতনা; প্রকৃতি প্রকাশিত, কিন্তু তার অন্তরালেই আছেন ঈশ্বর। কৃষ্ণ এভাবেই বলছেন—“আমি নই কেবল দর্শক; আমি সেই শক্তি, যার দ্বারা প্রকৃতি নৃত্য করে, এবং সেই নৃত্যই জগতের জীবন।”
অর্থাৎ, সৃষ্টির প্রতিটি গতি, বিকাশ, ও বিনাশ—সবই পরম চেতনার এক নিখুঁত নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া। এখানে কোনো আকস্মিকতা নেই; প্রতিটি প্রাণ, প্রতিটি জন্ম, প্রতিটি কর্ম এক মহাযোজনার অংশ। এই মহাযোজনার উদ্দেশ্য একটাই—বদ্ধ জীবাত্মাদের ধীরে ধীরে চেতনার পরিপূর্ণতা ও পরমেশ্বরপ্রাপ্তির পথে এগিয়ে দেওয়া।
ভগবদ্গীতা (৭.১৪)-য় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—“দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া। মামেব যঃ প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।।” অর্থাৎ, “আমার এই গুণময়ী মায়া দুরতিক্রম্য; কিন্তু যারা আমার শরণ নেয়, তারা এই মায়াকে অতিক্রম করে।”
এই শ্লোক মানুষের আধ্যাত্মিক ও মানসিক অবস্থার এক গভীর ব্যাখ্যা দেয়। এখানে “গুণময়ী মায়া” বলতে বোঝানো হয়েছে সেই প্রকৃতি, যা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই তিন গুণে গঠিত। এই তিন গুণের ভারসাম্যই নির্ধারণ করে মানুষের চিন্তা, আচরণ ও জীবনদৃষ্টি। সত্ত্ব (প্রকাশ ও জ্ঞান), রজঃ (গতি ও আকাঙ্ক্ষা), তমঃ (অবস্থা ও অন্ধকার)—এই তিন শক্তি মানুষকে ক্রমাগত দোলাচলের মধ্যে রাখে।
“দৈবী” শব্দটির অর্থ হলো—এই মায়া দুষ্ট নয়, এটি ঈশ্বরীয়। অর্থাৎ, মায়া কোনো শত্রু নয়; এটি ঈশ্বরচেতনারই এক অংশ, যা মানুষের অভিজ্ঞতার জগৎ তৈরি করে। এই মায়া মানুষকে শেখায়, অনুভব করায়, বিভ্রান্তও করে—তবে শেষপর্যন্ত এই বিভ্রান্তিই জাগরণের পথ খুলে দেয়। তাই কৃষ্ণ বলেন, এই মায়া “দুরত্যয়া”—অতিক্রম করা কঠিন, কারণ যতদিন মানুষ “আমি-আমার”-এর অহংবোধে আবদ্ধ থাকে, ততদিন সে এই গুণচক্রে বন্দি থাকে।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানে এটিকে বলা যায় ego-loop—অর্থাৎ আত্মকেন্দ্রিক অভ্যাসের এক চক্র, যেখানে মানুষ নিজের চিন্তা ও ইচ্ছার দাস হয়ে পড়ে। সে ভাবে—“আমি করব, আমি অর্জন করব, আমি নিয়ন্ত্রণ করব।” কিন্তু গীতা শেখায়, এই জগতে কোনো কিছুই “আমি”-র দ্বারা নয়, “তাঁর” দ্বারাই ঘটে। তাই কৃষ্ণ বলেন—“মামেব যঃ প্রপদ্যন্তে”—যে আমার শরণ নেয়, অর্থাৎ যে নিজের ইচ্ছাকে ঈশ্বরের ইচ্ছায় সমর্পণ করে, সে-ই মায়া অতিক্রম করতে পারে।
এখানে “প্রপত্তি” বা “শরণাগতি” মানে কোনো অন্ধ বিশ্বাস নয়; বরং অহংকারের বিলয়। যেমন একটি নদী যখন সাগরে মিশে যায়, সে তার নাম হারালেও নিজের সত্তা হারায় না—বরং বৃহত্তর সত্তায় মিলিত হয়। তেমনি মানুষ যখন ঈশ্বরের চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়, তখন তার কর্ম, চিন্তা ও অনুভব—সবই ঈশ্বরচেতনার প্রবাহে রূপান্তরিত হয়।
এই অবস্থাই মুক্তি। এটি কোনো কর্মত্যাগ নয়, বরং “কর্মে থেকেও অকর্তা থাকা”—যেমন গীতা (৪.১৮)-এ কৃষ্ণ বলেছেন—“কর্মণ্যকর্ম যঃ পশ্যেত্ স বুদ্ধিমান্ মনুষ্যেষু।”—যে কর্মের মধ্যে অকর্ম ও অকর্মের মধ্যে কর্ম দেখতে পারে, সে-ই সত্য জ্ঞানী।
এই শ্লোক তাই শেখায়—মায়া আসলে অজ্ঞানের নয়, শিক্ষার ক্ষেত্র। এটি সেই পর্দা, যা আত্মাকে নিজের আলো থেকে পৃথক রাখে যতক্ষণ না সে ঈশ্বরচেতনার দিকে মুখ ফেরায়। আর যখন সে ঈশ্বরের শরণ নেয়, তখন সেই পর্দাই আলোকের আচ্ছাদনে পরিণত হয়—অজ্ঞান জ্ঞানে, মায়া ভক্তিতে, আর সীমা অসীমে রূপান্তরিত হয়।
এই মায়া অতিক্রম করাই পরমেশ্বরের পরিকল্পনার মূলে অবস্থিত। জড়জগৎ হচ্ছে চেতনার জন্য এক বিদ্যালয়—যেখানে জীবাত্মা নিজের সীমা অতিক্রম করার সাধনা করে। যতদিন সে জড়বস্তুর অধিকার চায়, ততদিন সে জড়ের অধীন; কিন্তু যখন সে ঈশ্বরের ইচ্ছার নিমিত্ত হয়ে কর্ম করে, তখনই সে মুক্ত হয়।
কুরুক্ষেত্রের সেই সংকটমুহূর্তে—যখন অর্জুন শোক, মোহ আর কর্তৃত্ববোধের টানে ধনুক নামিয়ে বসেছেন—কৃষ্ণ তাঁর চোখে একটি অন্য দৃষ্টি বসিয়ে দেন। বিশ্বরূপ-দর্শন করানোর পর কৃষ্ণ বলেন, “ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্বমেব। নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্।।” (ভগবদ্গীতা ১১.৩৩)। অর্থাৎ, “এই যোদ্ধারা আমার দ্বারাই পূর্বেই নিহত হয়েছে; তুমি শুধু নিমিত্তমাত্র হও।” এখানে “নিমিত্তমাত্র” কথাটিই মূল—তুমি কর্তা নও; তুমি সেই বৃহত্তর বিধানের মাধ্যমে কাজ করো, যা আমার চেতনায় আগেই নির্ধারিত। এই বাণী গীতার পূর্বতন শিক্ষা—“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন” (২.৪৭)-এর প্রাণ: কর্তব্যে দাঁড়াও, কিন্তু কর্তার অহং ও ফললোভ থেকে মুক্ত হও।
কীভাবে বোঝা যায় “পূর্বেই নিহত”? বিশ্বরূপে কৃষ্ণ নিজেকে “কালোঽস্মি”—সময়রূপে পরিচয় দেন (১১.৩২)। কাল বা সময় হচ্ছে সেই অদৃশ্য ধারক—যেখানে জন্ম, বৃদ্ধি ও ক্ষয় এক ছন্দে ঘটে—”কালোঽস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো লোকান্ সমাহর্ত্তুমিহ প্রবৃত্তঃ। ঋতেঽপি ত্বাং ন ভবিষ্যক্তি সর্বে যেঽবস্থিতাঃ প্রত্যনীকেষু যোধাঃ।।” অর্থাৎ—কালোঽস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো: আমি মহাকাল (সময়/মৃত্যু), লোকসমূহকে বিনাশ করি এবং এখন প্রবৃদ্ধ (প্রবল) হয়ে উঠেছি। লোকান্ সমাহর্ত্তুমিহ প্রবৃত্তঃ: এই জগৎকে সংহার (ধ্বংস) করার জন্য আমি এখানে আবির্ভূত হয়েছি। ঋতেঽপি ত্বাং ন ভবিষ্যক্তি সর্বে: তুমি যুদ্ধ না করলেও, বিপক্ষ সেনাদলের সম্মুখে উপস্থিত এই যোদ্ধাদের কেউই বেঁচে থাকবে না (অর্থাৎ, এদের মৃত্যু পূর্বনির্ধারিত)।
জীবনের ঘটনা সময়-তন্তুতে গাঁথা; আমরা যা “এখন করছি” ভাবি, তা বৃহত্তর বিধানের অক্ষরেই লেখা। উপনিষদের ভাষায়—“এষ ত আত্মা অন্তর্যামী অমৃতঃ”—অন্তর্যামী সেই চেতনা, যিনি ভেতর থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন (বৃহদারণ্যক ৩.৭.৩)। ওই অন্তর্যামী-ই যখন “কালোঽস্মি” বলে উঠেন, তখন স্পষ্ট হয়—আমরা যন্ত্র নই, কিন্তু আমরা এক বিশাল সংগীতের বাজিয়ে; স্রষ্টা-সুরকার কৃষ্ণ, আমরা শুধু বাঁশি—“নিমিত্তমাত্র”।
এখানে “নিমিত্তমাত্র” মানে অক্ষমতা নয়; বরং শুদ্ধ ক্ষমতার সঠিক স্থাপন। একজন দক্ষ সার্জন যেমন জীবনের জন্য অস্ত্রোপচার করেন, কিন্তু মনে রাখেন—শরীর সেরে ওঠে শরীরের অন্তর-প্রকৃতির বিধানে; চিকিৎসক “নিমিত্ত”, আর জীবনের আরোগ্য “অন্তর্যামীর কাজে”—তেমনি অর্জুনের কাজ যুদ্ধ করা, কিন্তু “আমি-ই কর্তা” এই অহং ছেড়ে। তাই গীতায় কৃষ্ণ আরেক জায়গায় বলেন—“কর্মণ্যকর্ম যঃ পশ্যেত্ স বুদ্ধিমান্ মনুষ্যেষু।” (৪.১৮)—কর্মে থেকেও যে অকর্তৃত্বের সত্য দেখে, সে-ই জ্ঞানী। এখানেই গীতার “কর্মযোগ”—কর্ম ত্যাগ নয়, কর্তার-অহং ত্যাগ।
“পূর্বেই নিহত”—এই কথায় কি তবে—সব পূর্বনির্ধারিত? গীতা ভাগ্যবাদ শেখায় না; শেখায় ঈশ্বর-সংগত কর্তব্য। “সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ। ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি।।” (২.৩৮)—সমচিত্তে কর্তব্যে দাঁড়াও, তবে পাপ জড়াবে না। কাজ তোমার, কিন্তু কেন্দ্রে তুমি নও; কেন্দ্রে সত্য। ইশাবাস্য উপনিষদ বলে—“ঈশাবাস্যমিদং সর্বং”—সবই ঈশ্বরাবৃত (ইশা ১)। যখন কাজকে ঈশ্বর-আশ্রয়ে রাখি, তখন কাজের ফল স্বাভাবিক নিয়মে আসে; আমরা ফল-আসক্তির দাস হই না, আবার কাজ-ভীতিও আমাদের ধরে না।
বিশ্বরূপ-পর্বে কৃষ্ণ আরও স্পষ্ট করেন—“দ্রোণং চ ভীষ্মং চ জয়দ্রথং চ… হতান্ মায়েৎ”—“দ্রোণ, ভীষ্ম… আমার দ্বারাই ইতিমধ্যে সংহত” (১১.৩৪-এর ভাবার্থ)। অর্থাৎ, নৈতিক-ধর্মীয় ধারার যে-রূপান্তর ইতিহাসে ঘটতেই হবে, তার ধারা ঈশ্বর-চেতনায় স্থির; অর্জুন সেখানে ধর্মরক্ষার নিমিত্ত মাত্র। এই জন্যই যুদ্ধ “স্বধর্ম”—নির্বিচার হিংসা নয়; অন্যায়-দমন, অধর্ম-নিগ্রহ। গীতার নীতিতে—অহিংসা মানে অন্যায়কে অক্ষুণ্ণ রাখা নয়; বরং দয়া ও ন্যায়ের ভারসাম্য। তাই কৃষ্ণ আগে সমবৃত্তি শিখিয়ে তবে অস্ত্র তুলে দেন—“সমে কৃত্বা… যুজ্যস্ব” (২.৩৮)।
“নিমিত্তমাত্র” হওয়া দৈনন্দিন জীবনেও খাঁটি উদাহরণে ধরা পড়ে। শিক্ষক পড়ান, কিন্তু শেখানোর কেন্দ্র শিক্ষক নন—জ্ঞান; শিক্ষক নিমিত্ত, জ্ঞান-সঞ্চার ঈশ্বর-অনুগ্রহে। কৃষকের বীজ বোনা—বীজ, মাটি, বৃষ্টি, সূর্য—সব মিলিয়ে ফসল; কৃষক নিমিত্ত, “উদ্ভূত” জীবনের সঞ্জীবন ভেতরের বিধানে। সংগীতে সেতার-বাদক বাজান, তবু অনুরণন ধরে রাখে রাগের অন্তঃসুর; বাদক নিমিত্ত, সুরই অধিষ্ঠান। গীতার ভাষ্যকারেরা (শঙ্কর, রামানুজ, মাধ্ব, জীবার গৌড়ীয় টীকাগুলি) একই কথা নানা ভঙ্গিতে বলেন—অহংকার ছেড়ে ঈশ্বর-সংগত কর্তব্যই ধর্ম।
এই বাণীর একটি কোমল আধ্যাত্মিক রূপ হলো শরণাগতি। “দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া। মামেব যঃ প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।।” (৭.১৪)—গুণময়ী মায়া কঠিন, কিন্তু শরণাগতে তা পেরোনো যায়। শরণাগতি অন্ধ নির্ভরতা নয়; এটি অহং-শূন্যতা—আমি করবই, কিন্তু “আমার জন্য” নয়; সত্যের জন্য, ঈশ্বরের জন্য, কল্যাণের জন্য। তাই গীতা সমাপনে বলে—“সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং বৃজ” (১৮.৬৬)—সব ভঙ্গিমা ছেড়ে সত্যকে কেন্দ্রে রাখো, আমি তোমায় বহন করব। এখানে “ত্যাগ” মানে দায়িত্ব ফেলে দেওয়া নয়; বরং কেন্দ্র-পরিবর্তন—নিজেকে কেন্দ্র থেকে সরিয়ে ঈশ্বরকে কেন্দ্রে আনা।
উপনিষদের অন্তর্যামী-তত্ত্বও এই বোধকে দৃঢ় করে—“যো ভূমিমধ্যস্থো… এষ ত আত্মা অন্তর্যামী অমৃতঃ” (বৃহদারণ্যক ৩.৭.৩)। অন্তরেই তিনি নিয়ন্তা—বাইরে বিশ্বরূপ, ভেতরে বিবেক-রূপ। যখন অর্জুন “আমি কর্তা” এই মোহ ছেড়ে “আমি নিমিত্ত”—এই বোধে স্থিত হলেন, তখনই তাঁর হাতে ধনুক ফিরে এল, কিন্তু হৃদয়ে নেমে এল সমতা। এই সমতাই গীতার যোগ—“যোগঃ কর্মসূ কৌশলম্” (২.৫০-এর মর্ম)—কর্মে দক্ষতা মানে ফল-কামনা নয়, ঈশ্বর-কেন্দ্রিক মনন।