এখানেই কর্মযোগের সার। যোগ মানে পালিয়ে থাকা নয়, যোগ মানে অংশগ্রহণ—কিন্তু আসক্তিহীন অংশগ্রহণ। একজন চিকিৎসক যদি শুধুমাত্র অর্থ বা খ্যাতির জন্য রোগী দেখেন, তবে তা বন্ধন; কিন্তু যদি তিনি রোগীর কল্যাণে নিবেদিত থাকেন, তবে সেটি সেবা, সেটি যোগ। একজন শিক্ষক যদি ছাত্রদের মেধা জাগাতে আনন্দ পান, তবে তাঁর পাঠদানই উপাসনা। তেমনি, অর্জুনের যুদ্ধও, যখন তা ধর্মরক্ষার জন্য, তখন সেটি আর পাপ নয়, বরং কর্তব্যের সাধনা।
গীতার এই শিক্ষা একদিকে আধ্যাত্মিক, অন্যদিকে মনস্তাত্ত্বিক। এটি শেখায়—মানুষের সুখ-দুঃখ, জয়-পরাজয়, লাভ-ক্ষতি—সবই চেতনার পরীক্ষার ক্ষেত্র। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া মানে নিজের মনকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে সে আর বাইরের ঘটনার দোলায় ভাসে না। এ অবস্থাতেই জন্ম নেয় অন্তর্গত শান্তি, যা গীতার (২.৫৪-৫৫) ভাষায় “স্থিতপ্রজ্ঞতা”—যেখানে জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি একাকার হয়ে যায়।
কৃষ্ণের এই বাণী কেবল অর্জুনের জন্য নয়, প্রতিটি মানুষের জন্য এক অনন্ত উপদেশ—কাজ করো, কিন্তু শান্ত মনে; ভালোবাসো, কিন্তু আসক্ত হয়ো না; জয় বা পরাজয়কে সমভাবে গ্রহণ করো, কারণ দুটিই তোমাকে শেখানোর জন্য এসেছে। যে-মানুষ এই সমবুদ্ধি অর্জন করতে পারে, সে আর পাপ, ভয় বা দুঃখে জড়ায় না—সে নিজেই তখন মুক্ত, কারণ সে নিজের চেতনার মধ্যেই ঈশ্বরকে আবিষ্কার করে।
এখানেই জন্ম নেয় কর্মযোগের মূল বোধ—অকর্তৃত্ব। এই অবস্থায় কর্মফল আর বন্ধনকারী হয় না, বরং মুক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভগবদ্গীতার ৪.১৮ শ্লোকটি কর্ম ও অ-কর্মের আসল অর্থ বোঝানোর জন্য এক গভীর দার্শনিক সূচনা। কৃষ্ণ এখানে বলেন—“কর্মণ্যকর্ম যঃ পশ্যেত্ স বুদ্ধিমান্ মনুষ্যেষু”—অর্থাৎ, “যে কর্মের মধ্যে অ-কর্ম এবং অ-কর্মের মধ্যে কর্ম দেখতে পারে, সে-ই মানবদের মধ্যে প্রকৃত জ্ঞানী।”
এর অর্থ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়—আমরা সাধারণত “কর্ম” মানে বাহ্যিক কাজ, আর “অ-কর্ম” মানে নিষ্ক্রিয়তা বা না-করা—এইভাবে ভাবি। কিন্তু গীতার এই বাণী সেই সরল ধারণাকে ভেঙে দেয়। এখানে “কর্ম” বলতে শুধু বাহ্যিক দেহ বা বাকের কাজ বোঝানো হয় না, বরং অন্তরের উদ্দেশ্য, চেতনা এবং আত্মনিবেদনও বোঝানো হয়েছে।
যিনি কর্ম করছেন, কিন্তু সেই কর্মে “আমি কর্তা”—এই অহংকার নেই, তাঁর কাজ ঈশ্বরার্পিত; তাই সেই কর্ম আসলে অ-কর্ম—কারণ তাঁর কর্মে কোনো বন্ধন তৈরি হয় না। আবার, যিনি বাহ্যভাবে কিছুই করছেন না, কিন্তু মনে অহং, কামনা, বা ফলের চিন্তায় জড়িয়ে আছেন, তাঁর অ-কর্ম আসলে কর্ম—কারণ অন্তর থেকে তিনি ক্রিয়াশীল।
এভাবেই কৃষ্ণ দেখাতে চান—কর্ম বা অ-কর্মের মূল বিচার বাহ্যিক নয়, বরং মানসিক। যদি চেতনা বিশুদ্ধ হয়, যদি কর্ম ঈশ্বরার্পণ হয়, তবে তা আর বন্ধনের কারণ নয়। তাই তিনি বলেন, “যে কর্মের মধ্যে অ-কর্ম দেখে, অর্থাৎ যে জানে, কর্ম করেও নিঃস্বার্থ থাকা যায়; এবং যে অ-কর্মের মধ্যে কর্ম দেখে, অর্থাৎ যে বুঝে যায়, নিষ্ক্রিয় থাকলেও আসক্ত চিন্তায় জড়িয়ে থাকা একধরনের কর্ম—সে-ই সত্য জ্ঞানী, সে-ই যোগী।”
উদাহরণস্বরূপ, এক ভক্ত যখন সেবা করছে, সে কাজ করছে, কিন্তু তার মধ্যে অহং নেই—তার কর্ম ঈশ্বরের আনন্দের জন্য। অন্যদিকে, এক অলস ব্যক্তি কিছু না করেও সারাক্ষণ নিজের চিন্তা, দুঃখ ও অভিমান নিয়ে ব্যস্ত—সে বাহ্যত অ-কর্মী হলেও মানসিকভাবে কর্মে জড়িত।
এই শিক্ষা গীতার কর্মযোগের মূল কথা বোঝায়—নিষ্ক্রিয় হওয়া নয়, বরং নিঃস্বার্থভাবে সক্রিয় থাকা। কর্ম মানে ঈশ্বরচেতনার প্রকাশ, আর অ-কর্ম মানে আত্মবিস্মৃতি। তাই এই শ্লোক আমাদের শেখায়, সত্য যোগী সে-ই, যে কাজের মধ্যেও শুদ্ধ চেতনার স্থিতি রক্ষা করতে পারে।
সাধকের মুক্তি কোনো কৃতিসাধ্য অর্জন নয়—এটি স্বতঃসিদ্ধ। ঈশ্বর সর্বদা উপস্থিত, মুক্তিও সর্বদা বর্তমান; কিন্তু মানুষ নিজের অহংকার, ফলেচ্ছা ও কর্তার ভাব দ্বারা সেই মুক্তি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে। যখন এই অহংবোধ ক্ষয় হয়, তখন সে নিজেকে ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চিনতে শেখে। তখন তার কর্ম আর ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে নয়, ঈশ্বরার্পিত হয়; তার সাফল্য-ব্যর্থতা সমান হয়ে যায়; এবং জীবনের প্রতিটি কর্ম ঈশ্বরের লীলায় পরিণত হয়।
এই অবস্থায় বন্ধন, নরক, কৃতিফল—সবই মনের সৃষ্টি; কিন্তু মুক্তি, কল্যাণ, ভগবদ্প্রেম, ভগবদ্প্রাপ্তি—এসবই স্বতঃসিদ্ধ, কারণ এগুলি চেতনার প্রকৃত স্বরূপ। এই অকর্তৃত্ববোধই কর্মযোগের শীর্ষ বিন্দু—যেখানে মানুষ জানে, “আমি কিছুই করি না, আমি কেবল ঈশ্বরের নিমিত্ত।” তখন কর্ম আর জড় নয়, বরং ঈশ্বরীয় উপাসনা—আর সেই উপাসনাই তাকে মুক্তির পথে নিয়ে যায়।
এই উপলব্ধি যে, “পরমেশ্বরের বিধানে ‘হয়তো’ বা ‘হতে পারে’ বলে কিছু নেই”—হল ভগবদ্গীতা ও উপনিষদ-এর পরম তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ। এই জগৎ কোনো বিশৃঙ্খল ঘটনাপুঞ্জ নয়; এটি এক সুসংবদ্ধ, চেতনা-নির্দেশিত পরিকল্পনার প্রকাশ। এই পরিকল্পনাটি, গীতার ভাষায়, ঈশ্বরের যোগমায়া—যা জড় জগতে বদ্ধ জীবাত্মাদের মুক্তি ও আত্ম-উপলব্ধির সুযোগ করে দেয়।
ভগবদ্গীতার ৯.১০ শ্লোকটি প্রকৃতি ও ঈশ্বরের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে—যেখানে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে সমগ্র বিশ্বচেতনার নিয়ন্ত্রক ও উপাদান কারণ হিসেবে প্রকাশ করছেন। তিনি বলেন—“ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্”—অর্থাৎ, “আমার অধিপতিত্বে, আমার তত্ত্বগত নিয়ন্ত্রণে প্রকৃতি সচরাচর জগৎকে সৃষ্টি ও পরিচালনা করে।”
এখানে “প্রকৃতি” বলতে বোঝানো হয়েছে সেই মূল শক্তি বা সম্ভাবনা, যেখান থেকে সমগ্র সৃষ্টি উদ্ভূত হয়। আর “ময়াধ্যক্ষেণ” অর্থাৎ “আমার আধিপত্যে”—এখানে কৃষ্ণ নিজেকে সেই চেতনা-সত্তা হিসেবে নির্দেশ করছেন, যিনি নিঃসঙ্গভাবে, নিজের মধ্যে থেকেই, কিন্তু নিজের শক্তির দ্বারা জগৎকে প্রকাশ করেন।
এটি এমন নয় যে, ঈশ্বর আলাদা কোনো স্থানে বসে প্রকৃতিকে নির্দেশ দিচ্ছেন; বরং তিনি প্রকৃতির অন্তরস্থ চেতনা, যিনি সবকিছুর মধ্যে প্রবিষ্ট থেকে সব কিছু পরিচালনা করছেন। এই ধারণাটি উপনিষদীয় “অন্তর্যামী ব্রহ্ম”-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বৃহদারণ্যক উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের সপ্তম ব্রাহ্মণে অন্তর্ভুক্ত “অন্তর্যামী ব্রাহ্মণ” \অংশে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি উদ্দালক আরুণিকে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন—যে-চেতনা সব কিছুর ভেতরে অবস্থান করে, অথচ নিজে কখনও বাইরে প্রকাশ পায় না, তা-ই অন্তর্যামী ব্রহ্ম। শ্লোকটি—“যো ভূমিমধ্যস্থো যং ভূমির্ন বেদ, যস্য ভূমিঃ শরীরম্, যো ভূমিমন্তরঃ যময়তি, এষ ত আত্মা অন্তর্যামী অমৃতঃ।।” অর্থাৎ, যিনি পৃথিবীর মধ্যে অবস্থান করেন, যাকে পৃথিবী জানে না, যাঁর শরীর এই পৃথিবী, যিনি ভেতর থেকে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করেন—তিনিই তোমার আত্মা, অন্তর্যামী, অমৃতস্বরূপ।
এই শ্লোক ব্রহ্মকে জগতের অন্তর্নিহিত নিয়ন্ত্রক হিসেবে বর্ণনা করে। তিনি বাইরে থেকে নির্দেশ দেন না, ভেতর থেকেই সমস্ত উপাদান ও শক্তিকে একসূত্রে বাঁধেন। পৃথিবী তাঁর শরীর, অর্থাৎ ঈশ্বরই প্রকৃতির উপাদান কারণ (upādāna kāraṇa) ও নিমিত্ত কারণ (nimitta kāraṇa) উভয়। জগৎ তাঁর প্রকাশ, কিন্তু তিনি জগতের গুণে আবদ্ধ নন।
বেদান্ত দর্শনে “উপাদান কারণ” ও “নিমিত্ত কারণ”—এই দুটি ধারণা সৃষ্টির দুটি অপরিহার্য দিক। যে-পদার্থ থেকে কিছু তৈরি হয়, সেটি উপাদান কারণ (Upādāna Kāraṇa), আর যে প্রজ্ঞা, ইচ্ছা বা শক্তি দ্বারা সেই সৃষ্টি সম্পন্ন হয়, সেটি নিমিত্ত কারণ (Nimitta Kāraṇa)। এই পার্থক্যটি সহজেই বোঝা যায় দৈনন্দিন উদাহরণ থেকে—যেমন কুমার যখন ঘট বানায়, তখন মাটি হলো উপাদান কারণ, কারণ ঘট মাটিরই রূপান্তর; আর কুমার নিজে হলো নিমিত্ত কারণ, কারণ তিনিই সেই রূপদান বা সৃষ্টির প্রেরণাকারী।
অদ্বৈত বেদান্ত এই দুই কারণকে একত্র করে বলে—ব্রহ্মই এই জগতের অভিন্ন নিমিত্ত ও উপাদান কারণ। অর্থাৎ, ব্রহ্মই সেই চেতনা, যিনি নিজেই এই জগতের পদার্থরূপে প্রকাশিত এবং নিজেই সেই প্রকাশের কর্তা। তিনি কোনো বহিরাগত সৃষ্টিকর্তা নন, বরং নিজ চেতনার মধ্যেই জগতকে ধারণ ও প্রকাশ করেন।
এই সত্যটি ছান্দোগ্য উপনিষদে (৬.১.৪) ঋষি উদ্দালক তাঁর পুত্র শ্বেতকেতুকে শেখাচ্ছেন—“যথা সোম্য, একেন মৃত্পিণ্ডেন সর্বং মৃন্ময়ং বিজ্ঞাতং ভবতি।” অর্থাৎ, “হে প্রিয় পুত্র, যেমন এক মাটির ঢেলা জানলে সব মাটির বস্তুই জানা যায়।” এই উপমা বোঝায়, যেমন মাটি ঘট, প্রদীপ, মূর্তি—সব কিছুর উপাদান; তেমনি ব্রহ্মই সমস্ত সৃষ্টির মূল উপাদান, যা রূপ, নাম ও আকারে নানা হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
কিন্তু ব্রহ্ম কেবল উপাদানই নন; তিনিই সেই চেতনা বা বুদ্ধি, যার অধিপতিত্বে প্রকৃতি চলমান। ভগবদ্গীতায় (৯.১০) শ্রীকৃষ্ণ এই সত্য ঘোষণা করেন—“ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্। হেতুনানেন কৌন্তেয় জগদ্বিপরিভর্ততে।।” অর্থাৎ, “আমার অধিপতিত্বে প্রকৃতি সচরাচর জগৎকে উৎপন্ন ও চালনা করে; এই কারণেই জগতের সমস্ত গতি চলমান।” এখানে “ময়াধ্যক্ষেণ”—“আমার তত্ত্বনির্দেশে”—এ দ্বারা বোঝানো হচ্ছে, ঈশ্বরের নিমিত্ত-কারণত্ব; আর “প্রকৃতি সূয়তে”—“প্রকৃতি জন্ম দেয়”—এই অংশটি বোঝায়, উপাদান-কারণত্ব।
এভাবে গীতা ও উপনিষদ উভয়ই একমতে পৌঁছায়—ঈশ্বর বা ব্রহ্ম জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়ের একমাত্র কারণ, এবং সেই কারণ দ্বৈত নয়, অভিন্ন। তিনি নিজেই উপাদান, নিজেই কর্তা, আর নিজেই সব কিছুর অন্তর্লীন নিয়ামক।
এই দৃষ্টিভঙ্গি সুন্দরভাবে উদাহৃত হয়েছে মুন্ডক উপনিষদে (১.১.৭)—“যথা সোদেত গগনং মেঘঃ প্রাজ্ঞেন ধীয়তে বায়ুনা ইতি হি।” অর্থাৎ, “যেমন আকাশে মেঘের উদয় ও বিলয় বাতাসের প্রভাবে ঘটে, তেমনি ব্রহ্মের ইচ্ছা ও শক্তিতেই জগতের সৃষ্টি ও লয়।”
এখানেই অদ্বৈত দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য—ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছু নেই; জগৎ, জীব ও ঈশ্বর—এই তিন ভেদ কেবল নাম-রূপের পার্থক্য। ছান্দোগ্য উপনিষদের আরেকটি শ্লোকে (৬.৮.৭) বলা হয়েছে—“তৎ ত্বম্ অসি”—“তুমিই সেই”—যা এই ঐক্যের চূড়ান্ত ঘোষণা।
অর্থাৎ, যে-ঈশ্বর এই জগৎকে সৃষ্টি করেন, তিনিই তোমার অন্তরে আত্মারূপে বিরাজমান। তিনি বাহিরে বিশ্বরূপে প্রকাশিত, আবার অন্তরে চেতনা ও প্রজ্ঞারূপে অবস্থান করছেন। তিনিই সমস্ত সৃষ্টি, তিনিই সমস্ত কর্তা, এবং তিনিই চেতনার আদি ও অন্ত। এই উপলব্ধিই উপনিষদের সেই মহাবাক্যের প্রতিধ্বনি—“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.১)—অর্থাৎ “এই সমস্তই ব্রহ্ম”; ব্রহ্ম ব্যতীত কিছুই নেই।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৬.১৮) বলা হয়েছে—“যো ব্রহ্মাণং বিদধাতি পূর্বং যো বৈ বেদাংশ্চ প্রহিণোতি তস্মৈ। তং হ দেবমাত্মবুদ্ধিপ্রকাশং মুমুক্ষুর বৈ শরণমহম্ প্রপদ্যে।।” অর্থাৎ, “যিনি ব্রহ্মাকে (সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা) প্রেরণা দেন, যিনি বেদসমূহকে প্রকাশ করেন, যিনি আত্মবুদ্ধিকে আলোকিত করেন—তাঁকেই আমি মুক্তি কামনায় আশ্রয় গ্রহণ করি।” এই শ্লোক নির্দেশ করে যে, ব্রহ্ম কেবল সৃষ্টির প্রেরণাকারীই নন, তিনিই জ্ঞানের আলো, এবং সমস্ত চেতনার অভ্যন্তরস্থ নিয়ামক শক্তি।
তাই বলা হয়—ব্রহ্মই সৃষ্টির উপাদান কারণ, কারণ তিনিই সমস্ত অস্তিত্বের মৌল পদার্থ; তিনিই সেই চেতনা, যাঁর মধ্যে থেকে জগৎ উদ্ভূত হয়েছে। তিনিই নিমিত্ত কারণ, কারণ তাঁরই ইচ্ছা ও শক্তির দ্বারা সৃষ্টির কার্যক্রম সংঘটিত হয়। আর তিনিই অধিষ্ঠান কারণ, কারণ সমস্ত অস্তিত্ব তাঁর মধ্যেই স্থিত, এবং শেষে তাঁর মধ্যেই লয়প্রাপ্ত হয়।
ব্রহ্মই সব কিছুর আদি, মধ্য ও অন্ত—তিনিই উপাদান, কর্তা ও আশ্রয়। এই উপলব্ধিই আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মবিদ্যা, যা শেখায়, জগৎ কোনো বাহ্য পদার্থ নয়, বরং ব্রহ্মেরই স্ব-প্রকাশ; আর আত্মা কোনো সীমিত সত্তা নয়, বরং সেই ব্রহ্মেরই প্রতিফলন।
এই তত্ত্বের দ্বারা বোঝা যায় যে, জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন, পৃথক নয়। অর্থাৎ, জীবের অন্তরের যে-আত্মা, সে-ই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্যামী চেতনা। এটি সেই গভীর উপলব্ধি, যা বলে—আমার ভেতরের আত্মা কোনো সীমাবদ্ধ ব্যক্তি নয়; সে-ই সেই সর্বব্যাপী শক্তি, যা সব কিছুর ভিতরে থেকে সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে।