গীতায় অবতারতত্ত্ব: ২



জ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম করেন, কিন্তু কর্তা হন না; ফল এলেও তা তাঁর নয়, না এলেও তাঁর নয়। তিনি জানেন—সবই ঈশ্বরের, বা অদ্বৈত ভাষায়, সবই ব্রহ্ম। তাঁর কাছে কর্ম আর মোক্ষের মধ্যে কোনো ফারাক নেই, কারণ দুটোই ব্রহ্মচেতনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। অজ্ঞানদের মতো তিনি কর্মে লিপ্ত, কিন্তু ভিতরে স্থিত আছেন সেই চিরসাক্ষী সত্তায়, যা কিছুই করে না, তবু সমস্ত কর্মের মধ্যে জ্বলে থাকে। এভাবেই গীতা অদ্বৈত জ্ঞানের পূর্ণ রূপে বলছে—কর্ম করো, কিন্তু কর্তা হয়ো না; জগতে থেকেও জগতের ঊর্ধ্বে থেকো; কারণ তোমার আসল স্বরূপ কর্মের কর্তা নয়, সেই নিস্পৃহ, সর্বব্যাপী ব্রহ্মচেতনা, যেখানে কর্তা, কর্ম ও কর্মফল—সব একাকার হয়ে যায়।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “ঈশ্বর অবতীর্ণ হন না, মানুষই অবতীর্ণ ঈশ্বর।” অর্থাৎ, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সেই এক চেতনা বিরাজমান। যখন কেউ নিজের অন্তরের ঐশ্বর্য জাগিয়ে তোলে, তখনই সে অবতাররূপে প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণ, রাম, বুদ্ধ, যিশু—সবাই একই ঈশ্বরচেতনার ভিন্ন কালের প্রকাশ।

রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈত মতে, ঈশ্বর যখন অবতীর্ণ হন, তখন সেই দেহও তাঁর নিজের ইচ্ছায় সৃষ্ট—কারণ তিনি কর্মবন্ধনে আবদ্ধ নন। অদ্বৈত ব্যাখ্যায় এ-ও বলা যায় যে, এই স্বেচ্ছাপ্রকাশ ব্রহ্মের লীলাময় প্রতিবিম্ব—নিজেই নিজের ভিতর আত্মপ্রকাশ।

ড. রাধাকৃষ্ণননের ভাষায়, “This descent of the Divine is not a coming from elsewhere, but a manifestation of the timeless Spirit in time.” অর্থাৎ, ঈশ্বর কোথাও থেকে আসেন না; তিনি কালের গর্ভে নিজেকে প্রকাশ করেন। শ্রীঅরবিন্দের মতে, অবতারত্ব হলো চেতনার বিবর্তনের প্রয়োজনীয় ভারসাম্য, যেখানে অনন্ত আত্মা সময়ের মধ্যে নিজের বিকৃতি সংশোধন করে।

মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল ইউং এই অবতারণাকে আত্মবিকাশের প্রতীক বলেছেন—যখন মনের গভীরে অহংকার ও অচেতনের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে যায়, তখন “অবতার”—অর্থাৎ Self—নিজেকে প্রতিফলিত করে ভারসাম্য আনে।

গীতার এই শ্লোক কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাবর্ণনা নয়; এটি চেতনার নিত্যচলমান ধর্মসংস্থাপনের প্রক্রিয়া। যখনই মানুষের মন বিভক্ত হয়, অহংকারে আচ্ছন্ন হয়, তখনই ঈশ্বরচেতনা নিজের ভিতর থেকেই জেগে ওঠে, নিজেরই অন্ধকারে আলোর সৃষ্টি করে।

এই অর্থে, “তদাত্মানং সৃজাম্যহম্‌” মানে—ঈশ্বর কোথাও থেকে আগমন করেন না, তিনি সর্বত্রই আছেন; কেবল আমাদের চেতনা যখন ভারসাম্য হারায়, তখন সেই একই চেতনা নিজের মধ্যে নতুন রূপে জেগে ওঠে। ঈশ্বরের অবতারণা তাই কোনো অতীতের অলৌকিক ইতিহাস নয়, বরং প্রতিটি যুগে, প্রতিটি চিত্তে, প্রতিটি জাগরণে—ব্রহ্মেরই নিজস্ব আত্মপ্রকাশ।

অবতারের এই তত্ত্ব একদিকে মহাজাগতিক ন্যায়বোধের রক্ষা, অন্যদিকে চেতনার পুনঃউন্মোচন। মানুষ ঈশ্বর থেকে পৃথক নয়—এটি উপনিষদ-এর চিরন্তন বাণী। “অহং ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক, ১.৪.১০)—“আমি ব্রহ্ম,” এবং “তৎ ত্বমসি” (ছান্দোগ্য, ৬.৮.৭)—“তুমি সেই”—এই দুই বাক্যই ঘোষণা করে যে, ঈশ্বর ও জীব, ব্রহ্ম ও আত্মা অভিন্ন। সুতরাং ঈশ্বর যখন অবতীর্ণ হন, তখন তা কোনো বাহ্যিক আগমন নয়; বরং চেতনার নিজেরই উন্মোচন—স্বপ্রকাশ।

এই দৃষ্টিতে, মানুষও ঈশ্বরেরই অবতার। প্রত্যেক মানুষের জন্ম এক বিশেষ দৈব উদ্দেশ্যের বহিঃপ্রকাশ—যেখানে পরম চেতনা নিজেকে সীমার মধ্যে প্রতিফলিত করে একটি নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদনের জন্য। অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে “তস্মাত্ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব... ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্বমেব নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্‌” (গীতা, ১১.৩৩) শ্লোকটি মানবকর্ম, ঈশ্বরনিয়তি, এবং আত্মজ্ঞান—এই তিন স্তরের গভীর ঐক্য প্রকাশ করে। এখানে ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে কেবল যুদ্ধ করতে বলছেন না, তিনি তাকে চেতনার এক পরম অন্তর্দৃষ্টিতে জাগিয়ে তুলছেন—যেখানে কর্তা ও কার্য, সময় ও ফল, সবই এক অনন্ত ঐক্যের মধ্যে বিলীন।

ঈশ্বরের “আমি পূর্বেই এদের নিহত করেছি” উক্তিটি কোনো কালিক ইতিহাস নয়; এটি সেই চেতনার দৃষ্টিকোণ, যেখানে সমস্ত ক্রিয়া ইতিমধ্যেই ব্রহ্মে ঘটিত। শংকরাচার্য বলেন—“কর্মসকল ঈশ্বরপ্রেরিত প্রাকৃতিক গুণগণেরই বিকার, আত্মা কখনও কর্তা নয়।” এই দৃষ্টিতে “ময়ৈবৈতে নিহতাঃ”—অর্থাৎ ‘আমার দ্বারাই এই কর্ম ইতিমধ্যেই সম্পন্ন’—এটি ঈশ্বরীয় নিয়মের (cosmic order) ঘোষণা। চেতনা-রূপ ব্রহ্ম নিত্য, কিন্তু তার প্রকাশ—প্রকৃতি ও গুণের মাধ্যমে—অনন্তরূপ কর্মে প্রবাহিত।

এই অবস্থায় “নিমিত্তমাত্রং ভব” মানে—তুমি কর্তা নও, তুমি সেই সর্বচেতনার যন্ত্রমাত্র, যার মধ্য দিয়ে কর্ম প্রকাশিত হচ্ছে। শংকর ব্যাখ্যা করেন যে, জ্ঞানী ব্যক্তি কর্তা নয়, কিন্তু কর্ম থেকে বিমুখও নন। তিনি কর্মে নিযুক্ত থাকেন, কারণ তাঁর কাছে কর্মই ব্রহ্মের লীলা। জনক, কৃষ্ণ বা যে-কোনো মুক্তপুরুষ—তাঁদের কর্ম ব্যক্তিগত নয়, তা ঈশ্বরের আত্মপ্রকাশমাত্র। তাই কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, “উত্থিত হও”—তুমি যুদ্ধ করো, কিন্তু বুঝে করো যে, এই যুদ্ধ তোমার নয়; এটি চেতনার নিজেরই প্রবাহ।

আধুনিক দার্শনিকরা এই কথাটিকে অস্তিত্বের এক সক্রিয় সন্ন্যাস বলে দেখেছেন। ড. রাধাকৃষ্ণনন বলেন—“The Divine does not act from outside but through us. The human will is the field for the manifestation of the divine will.” অর্থাৎ, ঈশ্বর বাইরে কোথাও থেকে নির্দেশ দেন না; মানুষই সেই ক্ষেত্র, যেখানে ঈশ্বরের ইচ্ছা প্রকাশ পায়। শ্রী অরবিন্দ এর ব্যাখ্যায় এই ‘নিমিত্তমাত্র’ অবস্থাই চেতনার বিবর্তনের অগ্রগতি—মানুষের মাধ্যমে ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করছেন, তাই তাঁর কর্তব্য পালন মানে ঈশ্বরের কাজ সম্পন্ন করা। বিবেকানন্দ এই একই ভাবকে প্রয়োগিক করে বলেছেন—“Work as worship; be the instrument, not the ego.” তাঁর কাছে ‘নিমিত্তমাত্র’ হওয়া মানে কর্ম থেকে পালানো নয়, বরং কর্তা-অহংকারের বিলুপ্তি।

রামন মহর্ষি এই শ্লোকের অন্তর্নিহিত অর্থকে আত্ম-অনুসন্ধানের ভাষায় বলেন: যখন কেউ সত্যিকারভাবে “কে আমি?” অনুসন্ধান করে, তখন দেখা যায়, কর্তা নামে যাকে ধরা হয়, সে কেবল মানসিক ধারণা। কর্ম হচ্ছে, কিন্তু কোনো কর্তা নেই। ‘নিমিত্তমাত্র’ হওয়া মানে আত্মা-স্বরূপে স্থিত থাকা—যেখানে কাজ চলতে থাকে, কিন্তু “আমি করছি” এই বিভ্রম থাকে না।

অদ্বৈতের দৃষ্টিতে ‘আমি’ যে কর্তা, এই বিশ্বাসই বন্ধন। ‘আমি’ যে নিঃসংশ্লিষ্ট চেতনা, এটাই মুক্তি। তাই কৃষ্ণের “নিমিত্তমাত্রং ভব” উপদেশ আসলে আত্ম-অভিজ্ঞতার পথ—কর্মে থেকেও কর্মাতীত হওয়া। যিনি জানেন যে সমস্ত ক্রিয়া প্রকৃতির গুণগণ দ্বারা সংঘটিত, আর আত্মা কেবল সাক্ষী, তাঁর কাছে জয় ও পরাজয়, কর্তা ও ভোক্তা, সবই ব্রহ্মে লীন।

গীতার এই শ্লোক “নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্‌।” (১১.৩৩)—তাই অদ্বৈতবাদের মহামন্ত্র—“হে সব্যসাচী, তুমি কেবল নিমিত্তমাত্র হও।” অর্থাৎ, “কর্ম করো, কিন্তু কর্তা হয়ো না।” ঈশ্বর প্রত্যেক জীবকে নিজের ইচ্ছা সাধনের নিমিত্তে ব্যবহার করেন। মানুষ যদি নিজেকে সেই নিমিত্তরূপে উপলব্ধি করতে পারে, তবে তার সমস্ত কর্ম ঈশ্বরার্পণ হয়ে মুক্তির পথে রূপান্তরিত হয়।

কর্ম চলছে, কিন্তু তা কর্মচেতনার নিজস্ব নৃত্য। যিনি এভাবে বুঝে কাজ করেন, তাঁর কাছে যুদ্ধও যোগ, কর্তব্যও ধ্যান, আর জীবন নিজেই ব্রহ্মের প্রকাশ। অর্জুনের যুদ্ধ তাই আমাদের সবার জীবনের প্রতীক—যেখানে সত্যিকার জ্ঞান মানে কর্তা থেকে সাক্ষীতে উত্তরণ; যেখানে সমস্ত কর্ম ঈশ্বরেরই লীলা, আর আমরা কেবল তাঁরই নিরহং (অহং তথা ‘আমি’ ভাবহীন) নিমিত্তমাত্র।

প্রকৃত বিচারে, অবতার ধারণা মানবচেতনার অন্তর্গত এক দার্শনিক উপলব্ধি—পুরাণের অলৌকিক কাহিনি নয়। মানুষ যখন বোঝে যে, তার জীবন, কর্ম ও সত্তা কোনো ব্যক্তিগত প্রয়াস নয়, বরং ঈশ্বরীয় পরিকল্পনার একটি যন্ত্রমাত্র, তখনই তার জীবন অবতাররূপ ধারণ করে। এই অবস্থায় ব্যক্তিসীমা গলে যায় সর্বজনীন চেতনার মধ্যে, আর কর্ম হয়ে ওঠে ঈশ্বরের লীলা।

গীতার একাদশ অধ্যায়ে অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের যে উপদেশ—”এই যোদ্ধারা আমার দ্বারাই পূর্বেই নিহত; হে সব্যসাচী, তুমি কেবল নিমিত্তমাত্র হও।”, সেখানে ‘নিমিত্তমাত্র’ মানে নিষ্ক্রিয় আত্মসমর্পণ নয়, বরং পূর্ণ সচেতন অংশগ্রহণ—কর্মের কেন্দ্রে থেকেও অহংকারমুক্ত থাকা।

‘সব্যসাচী’ নামটি অর্জুনের দক্ষতার প্রতীক—দুই হাতেই সমান পারদর্শী। তাই কৃষ্ণ যেন বলছেন, “তুমি তোমার সমস্ত শক্তি ও যোগ্যতা দিয়ে কর্ম করো, কিন্তু মনে রেখো, কর্তা তুমি নও—কর্ম ঈশ্বরেরই প্রকাশ।” এই উপলব্ধিই অদ্বৈত দর্শনের চূড়ান্ত শিক্ষা—যেখানে ঈশ্বর, মানুষ ও কর্ম তিনটি এক অনন্ত চেতনার প্রবাহে অভিন্ন হয়ে যায়।

এই উপদেশ গীতার সর্বব্যাপী কর্মযোগ-তত্ত্বের সারাংশ। কর্ম করো, কিন্তু কর্তার ভাব ছেড়ে; সম্পূর্ণ বুদ্ধি ও শক্তি ব্যবহার করো, কিন্তু ফলের দাবি রেখো না। গীতার আরেকটি শ্লোক—“তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর। / অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ ॥” (গীতা, ৩.১৯)—অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে জগৎ-জীবন-ঈশ্বরের সম্পর্ককে কর্মের মাধ্যমে বোঝার এক মহামন্ত্র। এখানে শ্রীকৃষ্ণ শুধুমাত্র কর্মের কর্তব্যবোধের কথা বলছেন না; তিনি বলছেন এক গভীর তত্ত্ব—কর্মই যখন অনাসক্ত চেতনার স্বাভাবিক প্রকাশ হয়, তখন সেই কর্ম মানুষকে ব্রহ্মতত্ত্বে স্থাপন করে।

অদ্বৈত বেদান্তের মূল ধারা অনুসারে, জগৎ-কার্য সমস্তই “নাম-রূপ-বিকার”-এর (nāma-rūpa-vikāra) মাধ্যমে এক অপরিবর্তনীয় চৈতন্যের প্রকাশ। তাই কর্মও কোনো বাস্তব পরিবর্তন নয়; বরং ব্রহ্মচেতনার অন্তর্লীলা, যা অনাদি-অনন্তভাবে প্রবাহিত। শঙ্করাচার্য তাঁর ভাষ্যে বলেন—“অসক্তঃ ইতি ফলাশাঅনুগ্রহিতঃ”—অর্থাৎ, যে-ব্যক্তি কর্মের ফলের দ্বারা আকৃষ্ট হয় না, সেই প্রকৃত অনাসক্ত; কারণ ফল-আকাঙ্ক্ষাই কর্তার জন্ম দেয়, আর কর্তার জন্মই দুঃখ-বন্ধনের মূল।

অদ্বৈত দৃষ্টিতে কর্ম ও কর্তা আলাদা নয়; কিন্তু “অহংকার” যখন চেতনার সর্বজনীন ঐক্য থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে, তখনই ‘আমি করছি’—এই ভ্রমের জন্ম। এই ভ্রমই সংসার, এই ভ্রমই দুঃখ। তাই গীতার এই নির্দেশ আসলে এক আত্মতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া—অসক্তভাবে কর্ম করো, অর্থাৎ কর্তা-ভাবকে বিলীন করো; কর্ম করুক চেতনা নিজেই, তুমি কেবল সেই চেতনার সাক্ষী। এই অবস্থায় কর্ম হয় নিস্পাপ, নিত্য, কারণ তার কেন্দ্রে কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছা নেই—শুধু পরম ইচ্ছার প্রতিফলন।

এখানেই গীতার কর্মযোগ এবং অদ্বৈতের জ্ঞানযোগ মিলেমিশে যায়। শঙ্কর বলেন—কর্ম অনাসক্তভাবে করলে তা চিত্তশুদ্ধি আনে; চিত্তশুদ্ধ চেতনা তখন ব্রহ্মজ্ঞানগ্রাহ্য হয়। অনাসক্ত কর্ম মানে এমন কর্ম, যা কর্তার মানসিক আসক্তি থেকে মুক্ত; যখন মন নিজের ফল-লোভ ও ভয় থেকে মুক্ত থাকে, তখন কর্মই ধ্যান হয়ে যায়।

আধুনিক অদ্বৈতচিন্তক স্বামী বিবেকানন্দ এই শ্লোককে বলেছেন “work without motive”—কাজ করো, কারণ কাজই তোমার ধর্ম, কোনো ফলের আশায় নয়। কারণ ফলের আশায় কাজ করা মানে কর্মের কেন্দ্রস্থলে নিজেকে স্থাপন করা; আর ফলবিমুখ কর্ম মানে কর্মের কেন্দ্রে ঈশ্বরকে স্থাপন করা। এইরূপ কর্মই “নিষ্কাম কর্ম”, যা পরিণামে আত্মবিমোচন।

শ্রী অরবিন্দ এই প্রসঙ্গে বলেন—গীতার কর্ম মানে কেবল জড়জগতে ক্রিয়াশীলতা নয়; এটি আত্মার এক ধারা, যেখানে চেতনা নিজেকে প্রকাশ করছে। অনাসক্ত কর্ম মানে নিজের অহং-কেন্দ্রিকতা অতিক্রম করে চেতনার সর্বজনীন স্রোতে মিলিয়ে যাওয়া। তখন কর্ম আর বাহ্য নয়, অন্তরের নৃত্য হয়ে ওঠে—যেখানে কর্তা ও ঈশ্বর একই তরঙ্গে নাচছে।

রামণ মহর্ষি-র দৃষ্টিতে, যখন “আমি করছি”-বোধ বিলুপ্ত হয়, তখনও কর্ম ঘটে—কিন্তু তা আর ব্যক্তিগত নয়, চৈতন্যের স্বপ্রকাশ। “Who is the doer?”—এই প্রশ্নের উত্তরেই কর্ম অনাসক্ত হয়; কর্তা বিলীন হলে কর্মের ফলও বিলীন। তখন যা ঘটে, তা ঈশ্বরেরই ইচ্ছা। এই অনাসক্ততা কোনো উদাসীনতা নয়; এটি চেতনার ঐক্য-বোধের স্বাভাবিক প্রকাশ।

আধুনিক দার্শনিক ব্যাখ্যায়, যেমন আলান ওয়াটসের ভাষায়, জীবনের সমস্ত কার্যকলাপ মহাসমুদ্রের তরঙ্গের মতো—তরঙ্গ নিজেকে আলাদা ভাবে না, সে তো কেবলই সমুদ্রের নৃত্য। যদি তরঙ্গ বলে, “আমি নিজে উঠছি”, তবে সেটি ভ্রান্তি; কিন্তু যদি সে জানে, “আমি সমুদ্র”, তখন তার ওঠানামা আর বন্ধন নয়, লীলা। গীতার এই শ্লোকের “অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম” ঠিক এই সমুদ্র-তরঙ্গ-সম্বন্ধই বোঝায়—কর্ম করো, কিন্তু নিজেকে কর্তা ভেবো না; কর্ম নিজেই ঈশ্বররূপে ঘটুক।