গীতায় অবতারতত্ত্ব: ১৭



কৃষ্ণ দেহধারী হলেও দেহের দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তিনি দেহরূপে প্রকাশিত ব্রহ্মচেতনা—তাঁর বাণী, কর্ম ও ভাবের মধ্য দিয়ে বিশ্বচৈতন্যই কথা বলেছিল। “অহং ব্রহ্মাস্মি” বলার অধিকার কেবল মুখের নয়; এটি কেবল অন্তঃদৃষ্টি বা অনুভব দ্বারা প্রাপ্ত। যতক্ষণ সেই অনুভব হয়নি, ততক্ষণ মানুষ ভক্তি করে বলে “নমঃ শিবায়”—অর্থাৎ, “তাঁর প্রতি প্রণতি”; কিন্তু যখন অভিজ্ঞতা ঘটে, তখন উচ্চারণ হয়ে যায় “শিবোহম্‌”—“আমিই সেই চেতনা।”

“নমঃ শিবায়”—এই পঞ্চাক্ষরী মন্ত্র কেবল প্রণাম নয়, এটি মহাবেদান্তের হৃদস্পন্দন, যেখানে শব্দরূপে প্রকাশ পেয়েছে এক চিরন্তন আত্মজাগরণের আহ্বান। এখানে “নমঃ” শব্দটির অর্থ বাহ্যিক প্রণতি নয়; এটি আসলে নিজের অহংবোধ, কর্তার ভাব, আর পৃথকতার মায়াকে আত্মসমর্পণের অর্ঘ্যে বিলিয়ে দেওয়া। “শিবায়” মানে সেই চেতনা—যিনি “শম্‌” ধাতু থেকে উদ্ভূত, অর্থাৎ যিনি শান্ত, কল্যাণময়, এবং সর্বব্যাপী। সুতরাং “নমঃ শিবায়” মানে—“আমি আমার ক্ষুদ্র অহংকে বিসর্জন দিচ্ছি সেই পরম চৈতন্যে, যিনি আমারই অন্তরে স্বয়ং জাগ্রত।”

উপনিষদীয় অর্থে, এই মন্ত্র চেতনার একত্বকে প্রকাশ করে। কঠোপনিষদ (১.৩.১২)-এ বলা হয়েছে—“এই আত্মা সকল জীবের অন্তরে লুকিয়ে আছে, কিন্তু সূক্ষ্ম বোধসম্পন্ন, বিশুদ্ধ বুদ্ধিযুক্ত মানুষই তাঁকে প্রত্যক্ষ করতে পারে।” আত্মা বা ব্রহ্ম সকল জীবের হৃদয়ের গভীরে লীন হয়ে আছেন। তিনি স্থূল ইন্দ্রিয় বা সাধারণ বুদ্ধি দ্বারা প্রকাশিত হন না। সাধারণ মানুষ মায়া ও বাহ্যিক বিষয়ে আসক্ত থাকায় তাঁকে দেখতে পায় না। কিন্তু যে-ব্যক্তি যোগ, ধ্যান ও বৈরাগ্যের মাধ্যমে তাঁর বুদ্ধিকে অত্যন্ত একাগ্র ও সূক্ষ্ম করে তোলে, একমাত্র সেই সূক্ষ্মদর্শী যোগীই এই গুপ্ত আত্মাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।

এটি বোঝায় যে, আত্মজ্ঞান লাভ করতে হলে কেবল পাণ্ডিত্য নয়, অন্তর্মুখী ও সূক্ষ্ম বিচারশক্তি প্রয়োজন। “নমঃ শিবায়”-এর “নমঃ” সেই সূক্ষ্মতার দ্বার—যেখানে মন নত হয়, বুদ্ধি থেমে যায়, আর আত্মা নিজের উৎসের সঙ্গে এক হয়ে যায়।

শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে লিখেছেন—“নমঃ ইতি অনাত্মত্যাগঃ, শিবায় ইতি আত্মপ্রতিষ্ঠা।” অর্থাৎ “নমঃ” মানে অনাত্ম, অজ্ঞান, অহংবোধের ত্যাগ; “শিবায়” মানে আত্মায় প্রতিষ্ঠা—চিরন্তন সত্যে অবস্থিতি। এখানে প্রণতি মানে লয়, লয় মানে ঐক্য, আর ঐক্য মানেই ব্রহ্মাবস্থা। তাই “নমঃ শিবায়” মন্ত্রটি উচ্চারণ করার মধ্যেই নিহিত থাকে সেই অন্তর্গত যাত্রা—জড় থেকে চিত্‌, বহির থেকে অন্তর, দ্বৈত থেকে অদ্বৈতে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে, অভিনবগুপ্ত এই মন্ত্রকে ব্যাখ্যা করেছেন চিত্‌ ও শক্তির পরস্পর সংলগ্নতা হিসেবে। “নমঃ” সেখানে শক্তি-র প্রতীক—চেতনার গতিশীল প্রকাশ; আর “শিবায়” প্রতীক চিত্‌-এর—চেতনার নিস্তরঙ্গ নীরব ভিত্তি। শক্তি যখন নিজের উৎসে ফিরে যায়, তখনই উচ্চারিত হয় “নমঃ শিবায়”—অর্থাৎ, “আমি আমার উৎসে ফিরে যাচ্ছি।” তাই এই মন্ত্র উচ্চারণ মানে কোনো শব্দসাধনা নয়, বরং এক অভ্যন্তরীণ স্পন্দ—যেখানে চেতনা নিজেরই মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়।

স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে ‘বিশ্বেশ্বরাষ্টকম্‌’ নামের স্তোত্রের প্রারম্ভিক কলা হিসেবে গৃহীত—“নমস্তে অস্তু ভগবন্‌ বিশ্বেশ্বর বিশ্ভভাবন।”—“প্রণাম তোমায়, হে বিশ্বেশ্বর, হে বিশ্বস্রষ্টা।” এই প্রণামও কেবল বাহ্য ঈশ্বরের প্রতি নয়; এটি আত্মার নিজেরই দীপ্ত চৈতন্যরূপে নত হওয়া। গীতায় (১০.২০)-য় কৃষ্ণ বলেন—“আমি সমস্ত জীবের হৃদয়ে আত্মারূপে অবস্থান করছি।” তাই “নমঃ শিবায়” মানে এই আত্মার প্রতি প্রণতি, নিজেরই অন্তর্গত ঈশ্বরচেতনার প্রতি জাগরণ।

মনোবৈজ্ঞানিক স্তরে, এই মন্ত্রের প্রতিধ্বনি শোনা যায় অহংবিলয়ের নীরবতায়। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটি ego dissolution—যেখানে ব্যক্তি নিজের ক্ষুদ্র সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে এক গভীর ঐক্যবোধে স্থিত হয়। “নমঃ” হলো আত্মবিস্মৃতি, “শিবায়” হলো আত্মস্মরণ। যখন “আমি” বিলীন হয়, তখন কেবল থাকে “শিব”—অর্থাৎ চিরশান্ত চেতনা।

“নমঃ শিবায়” কোনো ধর্মীয় উচ্চারণ নয়, এটি এক দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক পরিণতি—যেখানে শব্দ হয়ে ওঠে ধ্যান, প্রণাম হয়ে ওঠে অভিজ্ঞতা, আর মানুষ হয়ে ওঠে চেতনার প্রতিধ্বনি। শেষপর্যন্ত এই মন্ত্র উচ্চারণ মানে—নিজের ভেতরের সেই নীরব, আলোকিত, শুদ্ধ সত্তার দিকে ফিরে যাওয়া—যিনি না জন্মেন, না মরণে বিলীন হন, কেবলই উদ্‌ভাসিত থাকেন চিরন্তন আনন্দে।

তাই এটি প্রার্থনা নয়—চেতনার প্রত্যাবর্তন; এক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আত্মোপলব্ধি। যখন কেউ হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারণ করে—“নমঃ শিবায়”—তখন সে এটা বলে না যে, “আমি তোমার কাছে নত হচ্ছি”, বরং বলে—“আমি তোমাকেই স্মরণ করছি, কারণ তুমিই আমি।”

এই অবস্থায় ভাষা ও বাচন প্রয়োজন হয় না, কারণ ব্রহ্মানুভব মৌন—মৌনই তখন বাণী হয়ে ওঠে। এই মৌনভাবই ব্রহ্মত্বের প্রকট প্রকাশ। তখন আর কোনো “আমি-তুমি” থাকে না; বিভক্ত সত্তাগুলি একীভূত হয়—“হিমালয়ও আমি, মকরও আমি, অশ্বথও আমি।” এটি অহংকারের উচ্চারণ নয়, বরং আত্মসত্তার বিলয়—যেখানে ভিন্নতা বিলীন হয়ে যায় অভিন্ন তত্ত্বে।

এই দৃষ্টিতে, অবতারত্ব মানে ঈশ্বরীয় ঐক্যস্মৃতি। যিনি উপলব্ধি করেন যে, দৃশ্য-অদৃশ্য, চেতন-অচেতন, ব্যক্তি-বিশ্ব—সবই এক অনন্ত চেতনার প্রকাশ, তিনিই ঈশ্বররূপ। কৃষ্ণও আমাদের থেকে পৃথক নন, আমরাও তাঁর থেকে পৃথক নই—যেমন তরঙ্গ সমুদ্র থেকে পৃথক নয়, সমুদ্রও তরঙ্গ থেকে পৃথক নয়।

যেমন স্বর্ণ থেকে কুণ্ডল বা মাকড়ি আলাদা নয়—তেমনি কৃষ্ণ ও আমরা, ঈশ্বর ও বিশ্ব, ব্রহ্ম ও প্রাণ—সবই একই চেতনার বহুরূপী দীপ্তি। এখানে কুণ্ডল মানে কানে পরার বৃত্তাকার অলঙ্কার, আর মাকড়ি মানে নাকের ছোটো রত্নখচিত অলঙ্কার—দুটির রূপ আলাদা হলেও উপাদান এক: স্বর্ণ। তেমনি জগতে যত রূপ ও নাম দেখা যায়—তাদের সারতত্ত্ব একক চেতনা, যাকে বেদান্ত বলে ব্রহ্ম।

জগতের প্রতিটি সত্তা, প্রতিটি রূপ, প্রতিটি আন্দোলন সেই এক চেতনারই প্রকাশ। স্বর্ণ যেমন কুণ্ডল, মাকড়ি, হার, মুকুট—সব রূপেই নিজেকে প্রকাশ করে, কিন্তু কোথাও স্বর্ণত্ব হারায় না, তেমনি ব্রহ্মচেতনা কর্ম, প্রেম, জ্ঞান ও জীবনের প্রতিটি তরঙ্গে নিজেকে প্রকাশ করে, অথচ কখনও নিজের ঐক্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয় না।

শঙ্করাচার্য ব্যাখ্যা করেছেন—“যথা স্বর্ণাৎ কৃতাঃ কুণ্ডলমাকড়িকাদয়ঃ নানাত্বং প্রতীয়ন্তে, স্বর্ণত্বং তু তাদৃক্‌”—“যেমন স্বর্ণ থেকে তৈরি কুণ্ডল বা মাকড়ি আলাদা বলে মনে হলেও, স্বর্ণত্ব এক থাকে, তেমনি জগৎ নানা রূপে প্রকাশিত হলেও তার তত্ত্ব এক।” এই উপলব্ধিই কৃষ্ণের ব্রহ্মস্বরূপ বাণীর কেন্দ্রে।

ভগবদ্‌গীতায় (১০.৮) শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“আমি সমস্ত কিছুর উৎস, সমস্ত কিছু আমার থেকেই প্রবাহিত।” এবং আরও বলেন—“হে ধনঞ্জয়, আমার বাইরে কিছুই নেই।” (গীতা ৭.৭) অর্থাৎ, সমস্ত সত্তা ঈশ্বরচেতনার ভেতরেই অন্তর্ভুক্ত, যেমন কুণ্ডল ও মাকড়ি স্বর্ণের ভেতরেই অবস্থিত।

এই উপলব্ধি যত গভীর হয়, ততই মানুষ অবতারস্বরূপে জেগে ওঠে—যেমন শ্রীমদ্‌ভাগবতে (১.৩.২৮)-এ বলা হয়েছে, “এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্। ইন্দ্রারিব্যাকুলং লোকং মৃড়য়ন্তি যুগে যুগে।।”

এতে চ অংশকলাঃ পুংসঃ: এখানে (পূর্বোক্ত বিবৃত) এই সমস্ত অবতারগণ হচ্ছেন সেই পরমপুরুষের (বিষ্ণুর) অংশ (আংশিক প্রকাশ) অথবা কলা (কলা-প্রকাশ বা বিভূতি)।

কৃষ্ণঃ তু ভগবান্ স্বয়ম্: কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান্।

ইন্দ্রারিব্যাকুলং লোকং মৃড়য়ন্তি যুগে যুগে: তাঁরা (এই অংশ ও কলা অবতারগণ) দেব-শত্রুদের দ্বারা (অসুরদের দ্বারা) উপদ্রুত জগৎকে যুগে যুগে এসে সুখী করেন (বা পরিত্রাণ করেন)।

এই শ্লোকটি শ্রীমদ্‌ভাগবতের মূল তত্ত্ব-নির্ধারক বাক্য হিসেবে পরিচিত। এটি ভাগবত পুরাণের প্রধান সিদ্ধান্ত— শ্রীকৃষ্ণই হলেন সকল অবতারের উৎস এবং স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান। অন্যান্য অবতার যেমন রাম, নৃসিংহ, বরাহ, মৎস্য, কূর্ম এবং এমনকি ক্ষীরোদশায়ী, গর্ভোদশায়ী ও কারণোদশায়ী পুরুষাবতারগণও (যাদের সমষ্টিগতভাবে 'পুংসঃ অংশকলাঃ' বলা হয়েছে) শ্রীকৃষ্ণের অংশ অথবা কলা।

এখানে “পুংসঃ অংশকলাঃ” বলতে বোঝানো হয়েছে—পরমপুরুষের (ব্রহ্মচেতনার) বিভিন্ন আংশিক প্রকাশ, অর্থাৎ অবতারদের সেই রূপ, যাঁরা নির্দিষ্ট যুগ, স্থান ও উদ্দেশ্যে ধর্মরক্ষার জন্য ব্রহ্মচেতনা থেকে প্রকাশিত হন। শ্রীমদ্‌ভাগবতের ভাষায়, পরমপুরুষ চিরন্তন ব্রহ্ম স্বয়ং কৃষ্ণরূপে পূর্ণভাবে অবতীর্ণ হন; আর বাকি অবতারগণ—যেমন রাম, নৃসিংহ, বরাহ, মৎস্য, কূর্ম প্রভৃতি—তাঁরই অংশ (partial manifestation) বা কলাভাগ (functional emanation)।

“অংশ” মানে চেতনার আংশিক প্রকাশ—যেমন সূর্য থেকে বিকিরিত রশ্মি সূর্যের দীপ্তিরই একটি ভাগ, কিন্তু সূর্যের পূর্ণত্ব নয়। আবার “কলা” মানে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা কার্যরূপে সেই চেতনার কার্যপ্রকাশ। যেমন বরাহ অবতার ছিলেন ভূমির উদ্ধারের শক্তির প্রতিমূর্তি, নৃসিংহ ছিলেন রক্ষার প্রতীক, রাম ছিলেন ধর্ম ও ন্যায়ের রূপ, আর মৎস্য-কূর্ম প্রভৃতি ছিলেন সৃষ্টি-সংরক্ষণের প্রতীক—তাঁরা প্রত্যেকে ব্রহ্মচেতনার বিশেষ দিকের প্রতিফলন।

এই তিন পুরুষাবতার—কারণোদশায়ী, গর্ভোদশায়ী ও ক্ষীরোদশায়ী—এঁরা আসলে বিশ্বসৃষ্টির তিন স্তরে ব্রহ্মচেতনার কার্যপ্রকাশ। কারণোদশায়ী হলেন কারণস্তরে—অর্থাৎ মহৎতত্ত্বে ব্রহ্মের অনন্ত সম্ভাবনা; গর্ভোদশায়ী হলেন জীবনের সূক্ষ্ম গর্ভে সেই চেতনার সক্রিয়তা; আর ক্ষীরোদশায়ী হলেন প্রতিটি হৃদয়ে বিরাজমান, জগতের অন্তঃপ্রেরক ঈশ্বরচেতনা। এই তিন পুরুষাবতারকে ভাগবত-তত্ত্বে বলা হয়েছে “অংশাবতার”, কারণ তাঁরা পূর্ণ ব্রহ্ম থেকে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে কার্যধর্মে প্রকাশিত।

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয়েছে “ভগবান্‌ স্বয়ম্‌”—অর্থাৎ চেতনার পরম পূর্ণতা। ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে শঙ্করাচার্য এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে বলেছেন—“অংশিনো হি অংশঃ”—“অংশ সবসময় অংশীর (সম্পূর্ণ সত্তার) উপর নির্ভরশীল।” অর্থাৎ সমস্ত অবতার, দেবতা, বিশ্ব—সব কিছুই সেই পূর্ণ ব্রহ্মচেতনার উপর নির্ভরশীল, কিন্তু কৃষ্ণরূপে সেই চেতনা স্বয়ং নিজেকে ব্যক্ত করেছে, অন্য কোনো ভিত্তি ছাড়া।

এই দৃষ্টিকোণ থেকেই শ্রীমদ্‌ভাগবতের মূল দর্শন স্পষ্ট হয়—অবতারগণ আছেন, কিন্তু তাদের উৎস এক। রাম, নৃসিংহ, বরাহ, কূর্ম, মৎস্য, এমনকি বিশ্বচেতনার তিন স্তরের পুরুষাবতারও—সবই শ্রীকৃষ্ণরূপ পরম ব্রহ্মের কার্যপ্রকাশ। তাই শ্রীমদ্‌ভাগবত (১.২.২৩)-এ বলা হয়েছে—“কৃষ্ণঃ তু ভগবান্‌ স্বয়ম্‌”—তিনি কেবল অবতার নন, সকল অবতারের উৎস।

এই তত্ত্বের মাধ্যমে ভগবত দর্শন এক সর্বজনীন অদ্বৈতবোধ প্রতিষ্ঠা করে—অর্থাৎ জগৎ ও ঈশ্বর, অবতার ও ভক্ত, অংশ ও পূর্ণ—সবই এক চেতনার নানা তরঙ্গ। যেমন নদীর জল সমুদ্রে মিশে গেলে আর আলাদা থাকে না, তেমনি সমস্ত অবতার, সমস্ত শক্তি, সমস্ত সত্তা—শেষপর্যন্ত সেই একক কৃষ্ণচেতনারই দীপ্ত প্রকাশ। এই কারণে বৈষ্ণব দর্শনে শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং ভগবান রূপে উপাসনা করা হয়।

যারা সত্ত্বগুণে বিশুদ্ধ, তারা নিজের মধ্যেই আত্মাকে দর্শন করে। তখন আর ঈশ্বরের সন্ধান বাইরে নয়, অন্তরে। গীতারই (১৮.৬১) ভাষায়—“ঈশ্বর সকল জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন।” ঈশ্বরের সন্ধান দূর আকাশে নয়; তিনি নিজের অন্তরে, সেই চৈতন্যে, যা অনুভবের মূল। যখন মানুষ এই সত্য উপলব্ধি করে, তখন তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে ওঠে জগদ্‌গুরুর বাণীর জীবন্ত প্রতিধ্বনি—তাঁর কর্ম, চিন্তা, প্রেম ও জ্ঞান, সবই ঈশ্বরচেতনার প্রতিফলন।

এই অবস্থায় মানুষ বুঝতে শেখে—কৃষ্ণ, রাম, বুদ্ধ, যিশু—যে নামেই তাঁকে ডাকা হোক, তিনি ভিন্ন কেউ নন; সেই এক চেতনারই বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন ভাব ও রূপে প্রকাশ। অবতার মানে ঈশ্বরের বাইরে থেকে আগমন নয়, বরং জগতে, মানবচিত্তে, ধর্মে ও প্রেমে ঈশ্বরচেতনার জাগরণ।

শেষপর্যন্ত, স্বর্ণ যেমন কুণ্ডল ও মাকড়ির মধ্যে নিজের দীপ্তি লুকিয়ে রাখে, তেমনি ব্রহ্মচেতনা প্রতিটি হৃদয়ে লুকিয়ে আছে—অজ্ঞানের আবরণ ভেদ করলেই তা প্রকাশিত হয়। তখন মানুষ আর ঈশ্বরের সন্ধান করে না, কারণ সে-ই ঈশ্বরচেতনার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তখন জীবনই হয়ে ওঠে গীতা, বাণী নয়—জাগ্রত চেতনার এক অবিরল প্রতিধ্বনি, যেখানে প্রতিটি শ্বাসে ধ্বনিত হয় সেই এক সত্য—“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.১)—অর্থাৎ “এই সমস্তই ব্রহ্ম।”