যেমন ভগবদ্গীতা (৪.৩৫)-য় শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“যথা জ্ঞানমাশ্রিতঃ, ততো মোক্ষ্যস সেশুভাত্।।”—অর্থাৎ, “যখন তুমি জ্ঞানে আশ্রয় নেবে, তখন তুমি সমস্ত অশুভ থেকে মুক্ত হবে।” এখানে “অশুভ” মানে কেবল পাপ বা দুঃখ নয়; এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে অবিদ্যা, আসক্তি ও দ্বৈতবোধের সকল আবরণ।
জ্ঞান যখন আত্মবোধে পরিণত হয়, তখন মানুষ উপলব্ধি করে—সে পৃথক সত্তা নয়, বরং একই চেতনার এক তরঙ্গ; জগৎ, ঈশ্বর ও আত্মা—তিনটি এক অনন্ত সত্তার প্রকাশ। এই উপলব্ধিই “মোক্ষ”—যেখানে জ্ঞানী ব্যক্তি আর জগৎকে প্রতিদ্বন্দ্বী বা পর বলে অনুভব করেন না, বরং সব কিছুর মধ্যেই ব্রহ্মরূপ চেতনার অবিচ্ছিন্ন উদ্ভাস অনুভব করেন। এই অবস্থায় “ব্রহ্মভাবনা” কেবল চিন্তন নয়, বরং অভিজ্ঞতা—যেখানে জানা, জানানো ও জানার বস্তু, তিনটিই এক অবিভক্ত সত্তায় বিলীন হয়ে যায়।
মুন্ডক উপনিষদ (৩.২.৯)-এ বলা হয়েছে—“ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মৈব ভবতি”, অর্থাৎ “যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনিই ব্রহ্ম হয়ে যান।” এই সংক্ষিপ্ত বাণীর মধ্যেই নিহিত আছে সমগ্র বেদান্তের অন্তর্লীন সত্য। এখানে “জানা” মানে বুদ্ধিগত উপলব্ধি নয়; এটি এমন এক প্রত্যক্ষ আত্মঅভিজ্ঞতা, যেখানে জাননাকারী, জানা ও জানার বস্তু—এই তিনের বিভেদ বিলীন হয়ে যায়। জ্ঞানী তখন আর পৃথক সত্তা নন; তাঁর চেতনা সর্বচেতনার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়।
শ্রীকৃষ্ণ এই অবস্থারই প্রতিমূর্তি—তাঁর “আমি” কোনো ব্যক্তিগত অহং নয়, বরং সেই পরম চেতনার স্বপ্রকাশ। গীতায় তিনি বলেন—“যঃ পশ্যতি তথা আত্মানমেকং সর্বভূতেষু তিষ্ঠতম্” (১৩.২৯)—অর্থাৎ “যিনি সর্বভূতের মধ্যে একই আত্মাকে দেখেন, তিনিই সত্যদ্রষ্টা।” এই উপলব্ধিতেই ধরা পড়ে ব্রহ্মজ্ঞান—যেখানে দেখা মানেই মিশে যাওয়া, আর জ্ঞান মানেই অভিন্নতায় প্রতিষ্ঠা।
মানুষ কেবল সৃষ্ট জীব নয়; সে সেই চেতনারই অংশ, যা সর্বত্র, সর্বকালে বিরাজমান। অবিদ্যা ও অহংকারে যখন সে নিজেকে সীমাবদ্ধ ভাবে, তখন সে দেহ-মনের পরিসরে বন্দি থাকে; কিন্তু জ্ঞানের আলোয় যখন তার অন্তর পরিশুদ্ধ হয়, তখন সে উপলব্ধি করে—“আমি সেই চেতনা, যা সমস্তের মধ্যে বিরাজমান।” এই উপলব্ধিই মুক্তি—যেখানে ব্যক্তি চেতনা পরমচেতনার সঙ্গে এক হয়ে যায়, নিঃশব্দ ও অনন্ত ব্রহ্মরূপে।
এই বাক্যাংশ—“আমি ধনঞ্জয়, আমি হিমালয়, আমি মকর, আমি সাগর”—প্রাচীন ভারতীয় ভাববাদী সাহিত্যের সেই মহামন্ত্রধারার অন্তর্গত, যেখানে আত্মা বা ব্রহ্মচেতনা সব রূপ ও উপাদানের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম বলে উপলব্ধি করে।
“আমি ধনঞ্জয়” মানে অর্জুন নয়, বরং কর্মযোগী সত্তা—যে কর্মের মধ্যে থেকেও আসক্তিহীন। এখানে ধনঞ্জয় কর্মনিষ্ঠ চেতনার প্রতীক, যে নির্বিকল্প থেকে বিকল্পে, আবার বিকল্প থেকে নির্বিকল্পে ফিরে আসে, চিরচেতনার প্রবাহরূপে।
“আমি হিমালয়” স্থিতি, নীরবতা ও ধ্যানের গম্ভীর প্রতীক। হিমালয় হলো চিত্তের অচল অবস্থান, যেখানে চিন্তা থেমে যায়, কেবল আত্মজ্যোতি স্থির থাকে।
“আমি মকর” জলের গভীরতা ও অদৃশ্য প্রবাহের প্রতীক—অর্থাৎ অবচেতন চেতনার সেই স্তর, যেখানে সকল প্রাণশক্তি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। মকর সেই আদিশক্তির গূঢ় প্রতিমা, যিনি সৃষ্টির অন্তর্লীন গর্ভ।
“আমি সাগর” বোঝায় অসীমতাকে—সমস্ত নদী, সমস্ত স্রোত, সমস্ত নামরূপ যেখানে এসে একাকার হয়। সাগর হলো ব্রহ্মচেতনার পূর্ণ ঐক্যরূপ প্রকাশ, যেখানে সকল ভেদ বিলীন।
এই চারটি বাক্য একসঙ্গে ঘোষণা করে আত্মার সর্বব্যাপী ঐক্যবোধ—“অহং সর্বম্”—যেখানে কর্তা, কর্ম, উপকরণ, প্রকৃতি ও পরম সত্য—সবই একই চেতনার অনন্ত প্রকাশ।
এই উপলব্ধিই সাধারণ মানুষের মধ্যেও সম্ভব। “আপনি এবং আমি যদি ব্রহ্মবিদ্ হয়ে যাই, তবে আমরাও সেই একই ব্রহ্মপদে প্রতিষ্ঠিত হতে পারি”—এ কথাটির মধ্যে কোনো কাব্যিক অতিশয়োক্তি নেই; এটি উপনিষদীয় সত্য। ব্রহ্ম সর্বত্রই আছেন, তাই তাঁর জ্ঞানও সর্বজনীনভাবে প্রাপ্তিযোগ্য। যে জ্ঞানী ব্যক্তি তাঁর মধ্যে ও বাইরে কোনো ভেদ অনুভব করেন না, তিনি কৃষ্ণচেতনারই ধারক।
স্বামী চিন্ময়ানন্দজি মানবপ্রকৃতির বিশ্লেষণে মানুষের তিনটি স্তর নির্ধারণ করেছেন—তামসিক, রাজসিক ও সাত্ত্বিক। এই ত্রিবিধ মানবপ্রকৃতি আসলে গুণত্রয়ের দ্বারা নির্ধারিত চেতনার তিনটি অবস্থান, যার মধ্য দিয়ে মানুষ পশুত্ব থেকে দেবত্বের দিকে উত্তরণের পথ অতিক্রম করে।
তামসিক মানুষ সেই, যিনি তমোগুণে আচ্ছন্ন—অজ্ঞান, অলস, ভীত ও লোভপরায়ণ। তাঁর জীবন মূলত আত্মবিস্মৃতির প্রতীক; তিনি নিজের অন্তরের জ্যোতি চিনতে পারেন না, ফলে চেতনার পরিবর্তে প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হন। তাঁর চিন্তা ও কর্ম পশুত্বপ্রবণ, কারণ তাঁর মনের আয়নায় ব্রহ্মচেতনার প্রতিফলন প্রায় সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন। তমোগ্রস্ত মানুষ যেন গভীর অন্ধকারে বন্দি—চেতন জ্যোতি উপস্থিত, কিন্তু দেখা যায় না।
রাজসিক মানুষ সেই, যিনি রজোগুণে প্রাধান্যশীল—কর্মোদ্যম, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্পৃহা যার চালিকাশক্তি। তিনি তামসিক মানুষের মতো স্থবির নন; তাঁর মধ্যে শক্তি, বুদ্ধি ও উদ্যোগ আছে, কিন্তু সেই শক্তি এখনও অহংকার ও ফলেচ্ছার দ্বারা পরিচালিত। রাজসিক মানুষ নিজের “আমি”কে কেন্দ্র করে বিশ্বকে গড়তে চান; তাঁর কার্য প্রবল, কিন্তু তার ভিতরে স্থিতি নেই। তাই তাঁর জীবন আলো ও অন্ধকারের সন্ধিক্ষণ—উজ্জ্বল, কিন্তু অশান্ত; গতিময়, কিন্তু ক্লান্তিকর।
সাত্ত্বিক মানুষ সেই, যিনি সত্ত্বগুণে প্রতিষ্ঠিত—শান্ত, সংযত, বিবেকী, জ্ঞানপ্রবণ ও করুণাময়। তাঁর চিত্ত দীপ্ত কিন্তু স্থির, ক্রিয়াশীল কিন্তু অনাসক্ত। এই অবস্থাতেই মানুষের অন্তর ঈশ্বরের প্রতিফলনের পাত্র হয়ে ওঠে; তাঁর মধ্যে আর ব্যক্তিগত অহংকারের ছায়া থাকে না, থাকে কেবল পরম চেতনার স্বচ্ছ প্রতিফলন।
স্বামী চিন্ময়ানন্দজি বলেন, সকলেই ঈশ্বরেরই অবতার—কিন্তু গুণের আচ্ছাদন ভেদে তাঁদের প্রকাশের রূপ ভিন্ন। তমোগ্রস্ত মানুষ পশুবৃত্তির অবতার—অচেতন ও আসক্ত। রাজোগ্রস্ত মানুষ মানববৃত্তির অবতার—চঞ্চল, উদ্যমী, কিন্তু সীমাবদ্ধ। আর সাত্ত্বিক মানুষ দেববৃত্তির অবতার—যিনি জ্ঞানে, শান্তিতে ও প্রেমে ঈশ্বরীয় দীপ্তিতে উদ্ভাসিত।
এই শেষ স্তরেই মানুষ প্রকৃত অর্থে “অবতারস্বরূপ”—কারণ সত্ত্বগুণে চেতনা যখন বিশুদ্ধ হয়, তখন ঈশ্বরের দীপ্তি তাতে প্রতিফলিত হয়। ভগবদ্গীতা (১৪.১৭)-য় শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানম্”, অর্থাৎ “সত্ত্বগুণ থেকেই জন্ম নেয় জ্ঞান।” এই বাণীই সাত্ত্বিক মানুষের জীবনে বাস্তবায়িত হয়—তাঁর জ্ঞান আর বুদ্ধিজাত নয়, বরং অস্তিত্বজাত; তাঁর অন্তর যেন আয়না, যেখানে ঈশ্বর নিজেই নিজের মুখ দেখে।
এই সাত্ত্বিক মানুষই প্রকৃত অর্থে “ঈশ্বরীয় মানুষ”—divine man—যার মধ্যে সত্ত্বের উজ্জ্বল ভারসাম্য ঈশ্বরীয় চেতনার প্রকাশ ঘটায়। কৃষ্ণ, রাম, বুদ্ধ, যিশু—যে সকল ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্ব মানবসমাজে জ্ঞানের, প্রেমের ও মুক্তির আলোক নিয়ে এসেছেন—তাঁরা এই দেববৃত্ত মানবতার পরিপূর্ণ রূপ। তাঁদের জীবন প্রমাণ করে, যখন চেতনা সত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মানুষ আর কেবল মানুষ থাকে না—তখন সে ব্রহ্মচেতনারই স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে, জগদ্গুরুর এক জীবন্ত প্রতিমা।
ভগবদ্গীতা (১৪.১৭)-য় শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানম্”—অর্থাৎ, “সত্ত্বগুণ থেকে জন্ম নেয় জ্ঞান।” এখানে “সত্ত্ব” মানে কেবল নৈতিক শুদ্ধতা নয়; এটি চেতনার এক ভারসাম্যময় ও উজ্জ্বল অবস্থা, যেখানে মন প্রশান্ত, স্থির ও স্বচ্ছ। তিনটি গুণ—সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—প্রকৃতির তিন ধারা বা প্রবণতা। রজঃ অস্থিরতা ও ক্রিয়াশীলতার প্রতীক; তমঃ অন্ধকার, জড়তা ও অজ্ঞানতার প্রতীক; আর সত্ত্ব হলো সেই মধ্যস্থ, ভারসাম্যপূর্ণ আলোক, যার মধ্যে চিত্ত স্বচ্ছ হয়ে নিজের অন্তর্গত আত্মপ্রভা উপলব্ধি করতে পারে।
যখন মন রজোগ্রস্ত থাকে, তখন তা ক্রিয়া ও কামনায় ব্যস্ত; আর তমোগ্রস্ত হলে তা নিস্তেজ ও অবিদ্যায় আচ্ছন্ন হয়। কিন্তু সত্ত্বগুণের প্রাধান্যে মন হয়ে ওঠে দীপ্ত, কিন্তু অচঞ্চল—যেমন শান্ত হ্রদে সূর্যের প্রতিচ্ছবি নিখুঁতভাবে ধরা পড়ে, তেমনি সত্ত্বগুণে পরিশুদ্ধ চিত্তে ব্রহ্মচেতনা প্রতিফলিত হয়। সেই প্রতিফলনই জ্ঞান—যা বাইরের বিষয়বস্তুর জ্ঞান নয়, বরং নিজের স্বরূপের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি।
অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়, জ্ঞান কখনও সৃষ্ট বস্তু নয়; এটি সর্বদা উপস্থিত, কিন্তু তমঃ ও রজঃ দ্বারা আচ্ছন্ন। সত্ত্বগুণের বিকাশ মানে সেই আচ্ছাদন সরে যাওয়া। তাই “সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানম্”—এই বাণী আসলে বোঝায়: চেতনা যখন স্বচ্ছ ও সংবিৎ অবস্থায় স্থিত হয়, তখন আত্মজ্ঞান স্বতঃপ্রকাশিত হয়। সত্ত্বগুণ কোনো লক্ষ্য নয়; এটি সেই অবস্থা, যার মধ্যে জ্ঞানের নিজস্ব জ্যোতি অবরোধহীনভাবে উদ্ভাসিত হয়—যেখানে জানা ও জানার বস্তু একাকার হয়ে যায়, আর আত্মা নিজেকেই চিনে ফেলে।
যে-মানুষ সত্ত্বে অবস্থিত, তার চেতনা ঈশ্বরীয় হয়ে ওঠে, কারণ সত্ত্বগুণই ঈশ্বরস্বরূপ জ্ঞানের উন্মোচন ঘটায়। তখন তার মন শান্ত, বুদ্ধি তীক্ষ্ণ, হৃদয় নির্লোভ, আর বিবেক জাগ্রত—এই অবস্থাতেই সে উপলব্ধি করে, “আমি নই কর্তা, আমি নই ভোক্তা—আমি সেই চিরন্তন চেতনা, যিনি সর্বত্র।”
এজন্যই বলা যায়—অবতারত্ব কোনো ব্যক্তির একচেটিয়া অধিকার নয়। যে-মানুষ নিজের মধ্যে ঈশ্বরচেতনা উপলব্ধি করে, তিনিই অবতাররূপে প্রকাশিত হন—হোক তিনি কৃষ্ণ, রাম বা কোনো অজ্ঞাত সত্ত্বগুণপ্রধান সাধক।
গীতাধ্যানে ব্যাসদেব যখন উচ্চারণ করেন—“কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্”, তখন এই প্রণাম কোনো মানবীয় নায়ককে উদ্দেশ করে নয়; এটি এক বিশ্বাত্মার প্রতি নতশির হওয়া। এখানে “কৃষ্ণ” মানে দেবকীপুত্র নয়, বরং সেই চেতনার প্রতীক, যিনি “অন্ধকারে কৃষ্ণ”—অর্থাৎ জ্ঞানের আলো দিয়ে অজ্ঞানতাকে দূর করেন। কৃষ্ণ নামের মধ্যেই নিহিত আছে “কর্ষণ” বা “আকর্ষণ”—যিনি সমস্ত জীবকে নিজের দিকে টানেন, সেই পরম চুম্বকস্বরূপ চেতনা। ব্যাসদেব যখন বলেন “জগদ্গুরু”, তখন তিনি বলেন না “কোনো যুগের গুরু”, বরং “সকল যুগের, সকল প্রাণের, সকল চেতনার গুরু”—যিনি জীবকে তার নিজস্ব আত্মস্বরূপে জাগিয়ে তোলেন।
“জগদ্গুরু” অর্থাৎ সমগ্র জগতের শিক্ষক—এই অভিধা বোঝায় যে, কৃষ্ণ সেই পরম জ্ঞানচেতনার প্রকাশ, যিনি কালের, জাতির বা সংস্কৃতির সীমায় আবদ্ধ নন। তিনি শিক্ষা দেন কর্মের মধ্যেও অদ্বৈত বোধের, সংসারের ভেতরেই মুক্তির। তাঁর শিক্ষা কোনো ধর্মবিশ্বাস নয়, বরং চেতনার বিজ্ঞান—যেখানে জীবকে শেখানো হয়, কীভাবে নিজের মনের, কর্মের ও ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়েই ব্রহ্মচেতনাকে উপলব্ধি করা যায়।
ব্যাসদেবের “কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্” আসলে এক ধ্যানবাক্য—এক মননীয় উপলব্ধি। তিনি যে-কৃষ্ণকে বন্দনা করছেন, তিনি কালো দেহধারী গোপাল নন, বরং জগতের অন্তর্গত নিত্যসচেতনতা, যিনি সমস্ত রূপের মধ্য দিয়ে, সমস্ত কণ্ঠের মাধ্যমে, সমস্ত যুগের মানুষকে জ্ঞানের দিকে আহ্বান জানান। এই চেতনারই অপর নাম “যোগেশ্বর”—যিনি যোগ বা ঐক্যের প্রভু, যাঁর মধ্যে জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি একত্রে মিলিত। যোগেশ্বর মানে সেই সত্তা, যিনি বিচ্ছিন্নতাকে মুছে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি করেন—জীব ও ঈশ্বরের, ভাব ও বুদ্ধির, কর্ম ও জ্ঞানের মধ্যে।
তাই ব্যাসদেবের প্রণাম শেষপর্যন্ত পরম ব্রহ্মের প্রতি—যিনি কৃষ্ণরূপে প্রকাশিত হয়ে মানুষকে নিজের মধ্যে পুনরায় ফিরিয়ে দেন, স্মরণ করিয়ে দেন, “তুমি ভিন্ন নও, তুমি সেই চেতনা, যে-চেতনা থেকে জগতের সমস্ত গতি, আলো, প্রেম ও জ্ঞান উদ্ভব হয়।”
এই “জগদ্গুরু” এবং “যোগেশ্বর” উপাধিগুলি কৃষ্ণের ব্যক্তিগত গুণবর্ণনা নয়; এগুলি তাঁর ব্রহ্মস্বরূপ চৈতন্যাবস্থার স্বীকৃতি। কারণ কৃষ্ণ ছিলেন ব্রহ্মবিদ্—অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছিলেন। মুণ্ডক উপনিষদ (৩.২.৯)-এর ঘোষণা—“ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মৈব ভবতি”—“যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনিই ব্রহ্ম হয়ে যান”—এই শাস্ত্রবাক্য কৃষ্ণের জীবনেই পরিপূর্ণ অর্থে সত্য হয়েছে।