গীতায় অবতারতত্ত্ব: ১৫



এই ব্যাখ্যা গীতার অদ্বৈতীয় গূঢ়তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ—ঈশ্বরকে জগতের বাইরে কোনো পর্যবেক্ষক হিসেবে নয়, বরং জগতের মধ্যেই ক্রিয়াশীল চেতনা হিসেবে দেখা। শঙ্করাচার্যের ভাষায়—“ঈশ্বরঃ করণকার্যরূপেণ সর্বত্র বর্ততে।” অর্থাৎ, ঈশ্বরই সব কারণ ও কার্যরূপে প্রকাশমান।

এভাবে দেখা যায়, “দৈব পরিকল্পনা” কোনো বাহ্যিক ইচ্ছার ফল নয়; এটি ধর্ম ও অধর্মের অন্তর্গত প্রতিক্রিয়া-বৃত্তি। পাপ বা অবনতি যতই বাড়ে, তার বিপরীতে একটি প্রতিসংহারী শক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভূত হয়—যেমন অন্ধকার যত ঘন হয়, ততই সূর্যের আলোকে প্রত্যাশা করে দিগন্ত।

যখন ভগবান বলেন—“আমি নিজেকে নিজে সৃষ্টি করি”—তার অর্থ হচ্ছে, বিশ্বের নিজস্ব ধর্মানুসারে, ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের জন্য পরম শক্তি নিজেই প্রকাশিত হয়। কোনো ব্যক্তিগত প্রয়াস, ইচ্ছা বা হুকুম প্রয়োজন হয় না; এটি স্বয়ংসিদ্ধ বিধান।

এই উপলব্ধির মধ্যেই “অবতার”-এর আধুনিক দার্শনিক ব্যাখ্যা নিহিত—এখানে ঈশ্বর আর কোনো ব্যক্তিস্বরূপ হস্তক্ষেপকারী নন, বরং বিশ্ববিধির স্বয়ংক্রিয় নৈতিক নীতি, যা ন্যায় ও ধর্মের ভারসাম্য রক্ষা করে।

তাই শ্রীকৃষ্ণের এই বাণী—“ময়া হতাংস্ত্বং জহি মা ব্যথিষ্ঠা”—আসলে একটি জ্ঞানবাণী—যা অর্জুনকে শিখিয়েছিল, “তুমি কর্তা নও; কর্তা সেই চিরন্তন চেতনা, যার বিধান চিরকাল চলমান।” এই শিক্ষাই গীতার পরম তত্ত্ব—জগৎ হলো ঈশ্বরের লীলার স্বয়ংচল নৃত্য, যেখানে কর্মই তাঁর প্রকাশ, আর সময়ই তাঁর অবতার।

শ্রীকৃষ্ণ গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের সূচনায় কর্মযোগকে ব্যক্তিগত কোনো যুগ-মানুষের সম্পত্তি হিসেবে নয়, বরং চিরন্তন জ্ঞান হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন—“ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্। বিবস্বান্‌ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষ্বাকবে’ব্রবীত্‌।।”—(৪.১), যার অর্থ, “এই অবিনাশী যোগ আমি সূর্যদেব বিবস্বানকে শিখিয়েছিলাম; বিবস্বান মনুকে বলেছিলেন, মনু আবার ইক্ষ্বাকুকে বলেছিলেন।” একই প্রবাহ আর-একটি পঙ্‌ক্তিতে আরও স্পষ্ট করেন—“স ঐবায়ং ময়া তে’দ্য যোগঃ প্রোক্তঃ পুরাতনঃ।।” (৪.৩)—“আজ তোমাকে যে-যোগ বললাম, সেটি সেই প্রাচীন যোগই।” এখানে “অব্যয় যোগ” কথাটি ঘোষণা করে যে, সত্য-যোগ কোনো ইতিহাস-নির্ভর মতবাদ নয়; এটি ব্রহ্মচেতনার এক ধারাবাহিক স্মরণ, যা যুগে যুগে, ধারায় ধারায়, গুরু-শিষ্যের সংগতিতে প্রবাহিত হয়েছে এবং কালের আচ্ছাদনে আংশিক আচ্ছন্ন হলেও স্বরূপে কখনও ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না।

গীতার ৪.১ অংশে শ্রীকৃষ্ণ যে তিনটি নাম উচ্চারণ করেছেন—বিবস্বান্‌, মনু, ও ইক্ষ্বাকু, তাঁরা পৌরাণিক অর্থে মানবসভ্যতার প্রাথমিক প্রতীক, আবার দার্শনিক অর্থে মহাজাগতিক চেতনার ধাপগুলির প্রতিরূপ।

বিবস্বান্‌ (Vivasvān)—সূর্যদেব, যাঁকে ঋগ্‌বেদে “অদিতি-পুত্র” বলা হয়েছে। তিনি জ্যোতি ও জ্ঞানের প্রতীক। গীতার ভাষায়, কৃষ্ণ প্রথমে এই “অব্যয় যোগ” সূর্যকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, কারণ সূর্যই আলোক ও প্রাণের সর্বপ্রথম উৎস। দার্শনিক অর্থে সূর্য মানে “চিত্‌”—চেতনার নিত্য জ্যোতি। তাই বিবস্বান্‌ আসলে সেই বিশ্বচেতনার প্রতীক, যার আলোতে সমস্ত কর্ম ও জ্ঞান উদ্‌ভাসিত হয়।

মনু (Manu)—মনুষ্যজাতির আদি পিতৃপুরুষ, যিনি “মনুষ্য” শব্দটিরও মূল। মনুর মাধ্যমে সূর্যের জ্ঞান মানববোধে অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ, চেতনার আলোক (বিবস্বান্‌) যখন প্রতিফলিত হয় মানবমননে, তখনই তা কর্ম, ধর্ম ও সামাজিক নিয়মের রূপ নেয়। তাই মনু হচ্ছেন “মন”-এর প্রতীক—বিবেক ও সংযমের প্রতিনিধি। বৈদিক পরম্পরায় তিনি “মহামনু” বা “স্বায়ম্ভুব মনু”, যিনি মানবজাতির ধর্মসংহিতা প্রবর্তন করেন।

ইক্ষ্বাকু (Ikṣvāku)—মনুর পুত্র, সৌরবংশের (সুর্যবংশ) প্রতিষ্ঠাতা রাজা। তাঁর মাধ্যমে এই যোগ-জ্ঞান রাজকর্ম ও সমাজজীবনের মধ্যে প্রবর্তিত হয়। অর্থাৎ, চেতনার জ্যোতি (বিবস্বান্‌) থেকে মানবচেতনা (মনু), তা থেকে সামাজিক ও কর্মজগত (ইক্ষ্বাকু)—এই ধারাতেই যোগের পরম্পরা প্রবাহিত।

তাত্ত্বিকভাবে, এই তিনজন একধরনের মহাজাগতিক রূপান্তরের স্তর—বিবস্বান্‌ সূর্যচেতনা বা জ্ঞানের উৎসের প্রতীক, মনু মননের জাগরণের প্রতীক, আর ইক্ষ্বাকু জ্ঞান ও মননের কর্মে প্রকাশের প্রতীক।

কৃষ্ণের এই বাণী “ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্‌” কেবল পৌরাণিক ইতিহাস নয়; এটি ব্রহ্মজ্ঞান থেকে মানববোধ, আর মানববোধ থেকে জীবনের কর্মে আত্মপ্রকাশ—এই যোগের চিরন্তন প্রবাহের প্রতীক।

এই ঘোষণার পরেই অর্জুনের স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা—“অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ। কথমেতদ্বিজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবান্‌ ইতি।।” (৪.৪)—“আপনার জন্ম তো পরে, আর বিবস্বানের জন্ম বহু পূর্বে; তবে আপনি কীভাবে প্রথমে তাঁকে এই যোগ শিখিয়েছিলেন?” কৃষ্ণ উত্তরে যে বেদান্তীয় বাণী উচ্চারণ করেন, তাতেই ধরা পড়ে ঈশ্বরচেতনার কালাতীত স্বরূপ—“বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন। তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ।।” (৪.৫)—“হে অর্জুন, তোমারও এবং আমারও বহু জন্ম অতীত হয়েছে; আমি সেগুলো সবই জানি, তুমি জানো না।”

এখানে “আমি” শব্দটি দেবকীপুত্র কৃষ্ণের সীমাবদ্ধ ব্যক্তিত্ব নয়; এটি বিশ্বরূপ চেতনার স্বঘোষণা, যেখানে স্মরণ মানে ঘটনাক্রমের স্মৃতি নয়, বরং কালকে অতিক্রম করে থাকা চৈতন্যের সর্বজ্ঞতা। এই “আমি” অদ্বৈত অর্থে “অহং ব্রহ্মাস্মি”—অপরিবর্তনীয় সত্চিদানন্দের আত্মপ্রকাশ; বিশিষ্টাদ্বৈতে অন্তর্যামী ঈশ্বর, যিনি সকলের অন্তরে থেকেই ধারাকে চালনা করেন; দ্বৈতে সর্বশক্তিমান প্রভু, যাঁর জ্ঞান কালের ঊর্ধ্বে; ভেদাভেদে শক্তিময় নিত্যসত্তা, যাঁর আভায় জীব-প্রকৃতি নিজের কর্মপথে চলে; শুদ্ধাদ্বৈতে আনন্দময় লীলা, যেখানে স্মরণ মানে আনন্দস্বরূপের নিত্য-উন্মীলন।

এর পর কৃষ্ণ নিজেই তাঁর “জন্ম” শব্দের আড়ালের দার্শনিক অর্থ উন্মোচন করেন—“অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্। প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।।” (৪.৬)—“আমি জন্মহীন, অবিনশ্বর, এবং সকল ভোতার ঈশ্বর হয়েও, নিজের প্রকৃতির উপর অধিষ্ঠিত থেকে, নিজেরই মায়াশক্তি দ্বারা প্রকাশ লাভ করি।” ভগবান বোঝাতে চাইছেন যে, তিনি সাধারণ জীবের মতো কর্মের ফলস্বরূপ জন্মগ্রহণ করেন না। তিনি জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত, নিত্য এবং সকলের প্রভু। তবুও তিনি স্ব-ইচ্ছায় তাঁর যোগমায়া নামক বিশেষ শক্তিকে আশ্রয় করে মানুষের রূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন— শুধুই জগতের কল্যাণের জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য। এই জন্ম তাঁর লীলা, এটি কোনো বাধ্যবাধকতা নয়।

“অজ” মানে জন্মহীন; “সম্ভবামি” মানে সৃষ্টি হওয়া নয়, বরং “প্রকাশিত হই।” অদ্বৈত বেদান্ত এখানে বলে—ব্রহ্ম কখনও সত্যার্থে জন্ম নেন না; মায়া-উপাধির দ্বারা ব্রহ্মস্বরূপ চিত্‌ নানা রূপে উদ্‌ভাসিত হন, সূর্যের অপরিবর্তিত অস্তিত্ব যেমন আলোর নানা প্রতিবিম্বে প্রকাশিত হয়, তেমনই। “সম্ভবামি” তাই আক্ষরিক জন্ম নয়, আচ্ছাদন-ভেদী আত্মপ্রকাশ; অব্যয় সত্তা রূপের খেলায় অংশ নিলেও স্বরূপে অপরিবর্তিত।

বিশিষ্টাদ্বৈত এই পঙ্‌ক্তিকে পড়ে অন্তর্যামী-ঈশ্বরের করুণাময় আত্মপ্রকাশ হিসেবে—ধর্মের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ঈশ্বর নিজের ঐশ্বর্য (বিভূতি) জাগিয়ে তোলেন, জীব-সমষ্টির শরীরধারী আত্মার মতো সমগ্র জগতের ভিতর থেকে কার্যকর হন, অথচ ঈশ্বর-স্বরূপে অব্যয়।

দ্বৈত বেদান্তে এখানে প্রভুর ইচ্ছাকৃত অবতরণ; ঈশ্বর ও জীব চিরভিন্ন, তাই “আত্মমায়য়া” মানে পরমেশ্বরের অজেয় শক্তিতে কালের মধ্যে প্রবেশ করে ধর্মসংস্থাপন, যেখানে কর্তা একমাত্র ঈশ্বর, আর জীব তাঁর ইচ্ছার অনুগত নিমিত্তমাত্র।

ভেদাভেদ দৃষ্টিতে “প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায়” জানায়—প্রকৃতি ঈশ্বর-শক্তির আশ্রিত-অবস্থা; ঈশ্বর ও জগৎ ভিন্নও, অভিন্নও; অবতার সেই শক্তির সঞ্চালন, যাতে ঈশ্বর-স্বরূপ অচল সত্তা শক্তিময়ভাবে চলমান হয়।

শুদ্ধাদ্বৈতে এটি আনন্দলীলা—আনন্দ-ঈশ্বর স্ব-ইচ্ছায় প্রেম, করুণা ও সৌন্দর্যের তরঙ্গে প্রকাশমান হন; জন্ম নয়, আনন্দের উদ্‌ভাস।

এসব শ্লোকের গূঢ় সংগতি তখনই স্পষ্ট হয়, যখন “অব্যয় যোগ”-কে ইতিহাসের ধারাবাহিক মতবাদ নয়, বরং স্মৃতিরূপ এক ব্রহ্মচেতনার নিত্য-প্রবাহ হিসেবে দেখা যায়। গীতা (৪.১)-য় গুরুপরম্পরা কেবল নামক্রম নয়; এটি চেতনার ধারাবাহিক স্ব-উন্মোচন, যেখানে বিবস্বান্‌ থেকে মনু, মনু থেকে ইক্ষ্বাকু—রূপ বদলালেও যোগের সত্তা অপরিবর্তিত থাকে। গীতা (৪.৩)-য় “পুরাতন যোগ” আজ নবরূপে প্রকাশিত—এ যেন মেঘ সরলে সূর্য আবার দেখা দেওয়া; সূর্য নতুন নয়, আচ্ছাদন সরে গেছে। গীতা (৪.৪)-র প্রশ্নে ধরা পড়ে মানুষের সময়বদ্ধ বোধ—যে মনে করে, জ্ঞানের উৎসও কালের ভেতর; গীতা (৪.৫)-র উত্তরে ঈশ্বরজ্ঞান সময়ের উপর প্রভুত্ব ঘোষণা করে—বহু জন্মের অন্তরেও চেতনা নিত্যজাগরূক; অবিদ্যা জীবকে ভুলিয়ে দেয়, ঈশ্বরচেতনা কিছুই ভোলে না। আর গীতা (৪.৬)-য় “অজো’পি সন্নব্যয়াত্মা… সম্ভবাম্য আত্মমায়য়া”—এই বাক্যে আছে অবতারের সর্বোচ্চ দার্শনিক ব্যাখ্যা—প্রকাশ আছে, পরিবর্তন নেই; উন্মীলন আছে, উৎপত্তি নেই; লীলা আছে, লয় নেই—কারণ ব্রহ্ম শেষপর্যন্ত অব্যয়, অনাদি, অদ্বিতীয়।

অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, দ্বৈত, ভেদাভেদ ও শুদ্ধাদ্বৈত—পাঁচ ধারাই তাই এক মহাসূত্রে গাঁথা পড়ে। অদ্বৈত বলে, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য; শাস্ত্র-পরম্পরা ব্রহ্মস্মরণের নিত্য-প্রবাহ। বিশিষ্টাদ্বৈত বলে, অন্তর্যামী ঈশ্বরই যোগের উৎস, যিনি জীব-জগতের শরীর-স্বরূপের মধ্যে থেকে ধর্মের ভারসাম্য রক্ষা করেন। দ্বৈত বলে, প্রভু অবতারে কর্তা, জীব তাঁর আদেশ-অনুবর্তী যোদ্ধা, যোগ ঈশ্বরসেবার নীতি। ভেদাভেদ বলে, ঈশ্বর ও শক্তির যোগে অবতারের গতিময়তা; জীব-প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরশক্তি জেগে ওঠে। শুদ্ধাদ্বৈত বলে, সবই আনন্দলীলা; যোগ হলো প্রেমময় আত্মসমর্পণের জ্ঞান।

কিন্তু ভাষা ও ভঙ্গি আলাদা হলেও রস এক—“অব্যয় যোগ” হলো ব্রহ্মের নিত্য উদ্‌ভাস, শাস্ত্র তার স্মৃতির ধারক, গুরুপরম্পরা তার সজীব স্রোত, আর অবতার তার করুণাময় উন্মেষ। ফলে এই কথোপকথনে “আমি”—শব্দটি শেষাবধি সীমিত ব্যক্তিকে নয়, বরং চেতনারই অভিন্ন উজ্জ্বলতাকে নির্দেশ করে—যিনি অজ, অব্যয়, অনাদি; যাঁর দ্বারা যোগ কখনও জন্মায় না, কেবল জেগে ওঠে; যাঁর মধ্যে ধর্ম কখনও সৃষ্টি হয় না, কেবল নিজ ভারসাম্যে ফিরে আসে; এবং যাঁর স্মরণেই কর্ম জ্ঞান হয়ে যায়, জ্ঞান ভক্তিতে স্নিগ্ধ হয়, ভক্তি অদ্বৈত উপলব্ধিতে একীভূত হয়—যেখানে শ্লোকের প্রতিটি শব্দ দ্বন্দ্ব নয়, বরং একটি প্রাচীন, শান্ত, অবিনাশী সঙ্গীতের অনুরণন, যা আজও অন্তরের গভীরে অনাহত ধ্বনির মতো বেজে ওঠে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে, কৃষ্ণের “আমি”-বোধ এক সর্বজনীন ঈশ্বরস্বরূপ স্বীকৃতি। সেই চেতনা-শক্তি কালান্তরে বিভিন্ন ব্যক্তির, যুগের ও সংস্কৃতির মাধ্যমে ধর্মসংস্থাপনার কাজ করে। তাই তিনি বলেননি—“আমি হব,” বরং বলেছেন, “আমি আছি, ছিলাম এবং থাকব।” ব্রহ্মসূত্র (২.১.১৪)-এর ভাষায়—“তদনন্যত্বমারম্ভণশব্দাদিভ্যঃ”—কার্য কারণ থেকে ভিন্ন নয়; অর্থাৎ জগৎ, কর্ম ও ধর্মচক্র সবই ব্রহ্মেরই স্বগতি।

যখন ভগবান বলেন—“এই যোগ আমি বিবস্বানকে বলেছিলাম”—এর অর্থ এই নয় যে, কৃষ্ণ নামের ব্যক্তি সূর্যদেবের কাছে উপস্থিত ছিলেন, বরং এটি সেই এক পরম জ্ঞানের ধারাবাহিকতা, যা যুগে যুগে আত্মপ্রকাশ করে। এই চিরন্তন জ্ঞানই—কর্মযোগ, অবতারতত্ত্ব ও বিধির স্বয়ংক্রিয় ধর্মচক্র—যা কখনও হারিয়ে যায় না, কেবল অবিদ্যার আবরণে অদৃশ্য হয়, পরে প্রয়োজনবশত পুনরায় উদ্‌ভাসিত হয়।

ঈশ্বরের “জন্ম” আসলে তাঁরই নিজস্ব শক্তির প্রকাশ, আর সেই শক্তি যুগে যুগে যে-রূপে প্রকাশিত হন, সেটিই অবতার; কিন্তু যিনি প্রকাশিত হচ্ছেন, সেই চেতনা চিরন্তন—অজ, অব্যয়, সর্বব্যাপী ও নিত্য বিদ্যমান ব্রহ্ম।

এই অংশে যে-তত্ত্বটি উদ্‌ভাসিত হয়েছে, তা-ই ব্রহ্মজ্ঞান এবং অবতারতত্ত্ব-এর অন্তর্নিহিত ঐক্য। “ব্রহ্মবিদ্‌ ব্রহ্মৈব ভবতি”—এই মহান উপনিষদীয় উক্তি (মুণ্ডক উপনিষদ ৩.২.৯)-র অর্থ শুধু জ্ঞানের ফল নয়, বরং অস্তিত্বের রূপান্তর। যে-ব্যক্তি ব্রহ্মকে জানে, সে আর ব্রহ্ম থেকে পৃথক থাকে না; কারণ জানার এই ক্রিয়া কোনো বুদ্ধিগত অনুধাবন নয়, এটি অস্তিত্বের একত্রীকরণ—জানাই হয়ে ওঠা।