গীতায় অবতারতত্ত্ব: ১২



পৃথিবীসহ সমস্ত সৃষ্টি তাঁর শরীর-স্বরূপ, এবং তিনি অভ্যন্তর থেকে সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। এই অন্তর্যামী, চিরন্তন ও মৃত্যুহীন সত্তাই হলো প্রতিটি জীবের আসল আত্মা। এটি উপনিষদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, যা ঈশ্বরকে শুধু স্রষ্টা হিসেবে নয়, বরং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্তা হিসেবেও তুলে ধরে।

বিভূতিযোগ এই অন্তর্যামীরই রঙিন মানচিত্র: হিমালয়ে স্থিরতার জ্যোতি, সমুদ্রে গভীরতার অনন্ততা, অর্জুনে বীর্যের দীপ্তি—সবই একই আত্মার খেলা। ঈশা উপনিষদ এই অভিজ্ঞতাকে সংক্ষেপে বলে: “ঈশাবাস্যমিদং সর্বং” (১)—সমস্তই ঈশ্বরাবৃত; আর যে-জ্ঞানী “যঃ সর্বাণি ভূতানি আত্মন্‌য়েবানুপশ্যতি” (ঈশা ৬-৭)—সব জীবকে নিজেরই আত্মা বলে দেখে, তার কাছে ‘অন্য’ বলে কিছু থাকে না।

অদ্বৈতের স্বর বাঁচিয়ে গীতার এই অধ্যায়কে বোঝার সহজ উপায় হলো—“রূপ বদলালেও আলো এক।” যেমন এক সূর্য সহস্র জলে সহস্র প্রতিচ্ছবি ফেলে, আলো তবু একটিই থাকে; তেমনি ‘হিমালয়’, ‘সাগর’, ‘অর্জুন’, ‘বসুদেব’—এই সব নামে যে-বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠছে, তার অন্তরালে চৈতন্য এক ও অভিন্ন। এই একত্বেরই ঊষা শোনায় তৈত্তিরীয় উপনিষদ (২.৬.২) এবং ছান্দোগ্য উপনিষদ (৬.২.৩): “স একঃ ‘বহু স্যাম্‌ প্রজায়েয়া’”—একমাত্র সত্তা বহু হয়ে প্রকাশিত হতে ইচ্ছা করলেন। বহুত্ব সেই একের লীলা; বহুত্ব মিথ্যা নয়, বরং একত্বেরই গতিময় তান।

সৃষ্টির প্রারম্ভে যখন কেবল সেই এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্ম বা 'সৎ' (যা একমাত্র সত্য) বিদ্যমান ছিলেন, তখন তিনি সংকল্প করলেন বা কামনা করলেন যে, তিনি আর এক থাকবেন না, বরং বহু রূপে প্রকট হবেন। এই সংকল্পটিই হলো সৃষ্টির মূল কারণ। অর্থাৎ, ব্রহ্মের নিজের ইচ্ছায় এবং নিজের মধ্যে থেকেই এই দৃশ্যমান বৈচিত্র্যময় জগৎ (বহু) সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তাঁর নিজের শক্তিকে বহুত্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যে সেই এক ব্রহ্মই বহু রূপে বিদ্যমান। জীব, জগৎ, ও ব্রহ্ম (ঈশ্বর) মূলগতভাবে অভিন্ন। এই জগৎ ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন কিছু নয়, বরং ব্রহ্মেরই প্রকাশ। অদ্বিতীয় ব্রহ্ম আকাঙ্ক্ষা করলেন যে, তিনি যেন বহু হন এবং প্রকাশিত হন—এভাবেই এই জগৎ সৃষ্টি হলো।

এখানে “আমি” সর্বনামটির বিশেষ দার্শনিক অর্থ আছে। শ্রীকৃষ্ণ যখন বলেন “অহম্‌”—অর্থ ‘বাসুদেব নামে এই ব্যক্তি’ নয়; অর্থ ‘সেই আত্মা’, যার জ্যোতিতে ব্যক্তি কি ব্যক্তিত্ব সব উদ্‌ভূত। তাই “পাণ্ডবানাং ধনঞ্জয়ঃ”—অর্জুন-নামের ‘আমি’ নয়, অর্জুনে প্রকাশিত ধৈর্য-শৃঙ্খলা-সমর্পণের প্রতিনিধি আত্মা; “স্থাবরাণাম্‌ হিমালয়ঃ”—পাথরের গাদার ‘আমি’ নয়, স্থিত ও সমাহিত মহিমার আত্মা; “সাগরোহস্মি”—জলের ভৌত স্তূপ নয়, অন্তহীনতার ধ্বনি—সবই আত্মা-চৈতন্যের স্পষ্টীকরণ। এইজন্যই অধ্যায়টির দার্শনিক মর্ম ধরা পড়ে অষ্টাদশ অধ্যায়ের বাণীতে: “ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশে অর্জুন তিষ্ঠতি” (১৮.৬১)। ঈশ্বর হৃদয়ে; বাইরের সমস্ত বিভূতি সেই অন্তরেরই বহি-প্রতিবিম্ব।

অদ্বৈত অনুশীলনে এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল ভাবুক কবিতা নয়, বরং জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য বোধ। কোনো মানুষকে দেখলে তার গুণে-দোষে আটকে না থেকে যে-চৈতন্য তাকে সচল রাখছে, তাকে অনুভব করা—এটাই “দ্রষ্টা-বোধ”। কর্মক্ষেত্রে কোনো অসামান্য দক্ষতাকে ‘ব্যক্তির অহং’ বলে বর্জন না করে, তাকে ‘চৈতন্যের বিভূতি’ বলে সসম্মানে গ্রহণ করা—এটাই অহং-শিথিলতার যোগ; নিজের ভেতরে যখন স্থিরতা আসে, তখন ‘হিমালয়’ আমার ধ্যানের মেরুদণ্ড হয়ে ওঠে, ‘সাগর’ আমার গ্রহণশীলতার বিস্তার, ‘অর্জুন’ আমার কর্তব্যনিষ্ঠা, ‘মকর’ আমার প্রাণস্পন্দনের উল্লাস। ফলে বহুত্বের ভিড়ে আমি আর বিচ্ছিন্ন নই—সবকিছুর মধ্যে নিজেরই আত্মবোধকে চিনতে শিখি।

উপনিষদের প্রিয় দৃষ্টান্ত “নদী-সমুদ্র” এখানে বিশেষ সহায়ক। অসংখ্য নদী ভিন্ন নাম-রূপে বয়ে যায়, শেষে সমুদ্রে মিললে নাম-রূপ লয় পায়—জল কিন্তু জলই থাকে। তেমনি “রূপ-নাম-গুণ-কর্ম” মিলিয়ে যে বহুরূপ জগৎ, জ্ঞানের সমুদ্রে সেখানে কেবল আত্মাই থাকে। তাই গীতা বার বার স্মরণ করায়: "মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়। ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণাইব।।" (৭.৭)—"হে ধনঞ্জয়, আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই। সুতোয় যেমন মণিগুলো গাঁথা থাকে, তেমনই এই সমস্ত কিছু আমাতেই গাঁথা আছে।" অর্থাৎ, আমার (আত্মার) অতিরিক্ত আর কিছুই নেই; অর্থাৎ আত্মার বাইরে কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নেই, যা আমাকে ঘিরে রেখেছে—আমি তথা আত্মাই সব রূপে নিজের সাথেই আলাপ করছি।

এ উপলব্ধি কোনো নিষ্ক্রিয় বাতিক নয়; বরং কর্মকে উজ্জ্বল করে। জ্ঞান যখন বলে—“যা দেখছি, যা করছি, সবে আত্মারই লীলা”—তখন কাজের অহং সরে দাঁড়ায়; সেবা হয়ে ওঠে সহজ, ন্যায় হয়ে ওঠে স্বাভাবিক, করুণা হয়ে ওঠে স্বতঃস্ফূর্ত। তখন “ভোগ” আর ব্যক্তিগত তৃষ্ণার তৃপ্তি নয়; তা হয় “প্রসাদ”—যজ্ঞের অবশিষ্ট, যা গীতা (৪.২৪, ৪.৩১)-য় ব্রহ্ম-সমাধির সেতু বলে ধরা হয়েছে: কর্তা-কর্ম-কারণ-করণ—সবই এক ব্রহ্মচেতনায় দীপ্ত, আর সেই বোধেই কর্ম মুক্ত।

এইভাবে বিভূতিযোগ অদ্বৈতের এক অতি ব্যাবহারিক অধ্যায়। এটি শিখিয়ে দেয়—বহুরূপ জগৎকে অস্বীকার নয়; বহুরূপে এককে দেখা। জগৎ চলমান, রূপান্তরশীল; কিন্তু যে-আলো এই চলনে দৃশ্যমানতা দেয়, সে আলো অপরিবর্তিত। জলের তরঙ্গে ভিজে আমরা যদি কেবল তরঙ্গ গুনতে থাকি, সমুদ্র হারাই; আর যদি সমুদ্র দেখতে দেখতে তরঙ্গ অস্বীকার করি, জীবন হারাই। অদ্বৈতের সঠিক সাধনা হলো—তরঙ্গে সমুদ্র দেখা, রূপে আত্মা দেখা, বিভূতিতে ব্রহ্ম দেখা। তখন হিমালয় কেবল পর্বত থাকে না—সে হয়ে ওঠে অন্তঃস্থিত স্থিতির ধ্যানমন্ত্র; সাগর কেবল জলরাশি থাকে না—সে হয়ে ওঠে গ্রাহ্য-অগ্রাহ্যের সীমা ভেঙে দেওয়া আত্ম-সম্প্রসারণ; অর্জুন কেবল যোদ্ধা থাকে না—সে হয়ে ওঠে কর্তব্যে অবিচল সাক্ষীচৈতন্যের নিদর্শন।

শেষপর্যন্ত, অদ্বৈতের এক বাক্যে বিভূতিযোগের সার হলো: “যদিদং কিঞ্চ (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ২.৬.২ ও ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩.১২.১)—"এই যা-কিছু" বা "যা-কিছু এখানে আছে" (Whatever exists here)—সবই আত্মা; আত্মা ছাড়া কিছু নয়।” এই দৃষ্টিই ভক্তিতে মাধুর্য, কর্মে দক্ষতা, জ্ঞানে স্থিতি এনে দেয়। আর তখন গীতার বাণী হৃদয়ের নিজস্ব কণ্ঠ হয়ে ওঠে—“অহম্‌ আত্মা গুঢ়াকেশ”—আমি-আত্মাই সকলের অন্তরে; আমি-আত্মাকেই সকল রূপে প্রণাম।

এখানেই গীতা আমাদের শিক্ষা দেয়, বিভিন্নতা আসলে ঐক্যের প্রকাশ। নদী, পর্বত, প্রাণী, দেবতা, মানুষ—সবকিছুই সেই এক ব্রহ্মের অসীম বিকাশ। তাই বলা যায়, “ঈশ্বরের অতিরিক্ত কিছু নেই, তাঁর বাইরে কোনো শূন্যতা নেই, কোনো বস্তুও নেই যা তাঁকে ব্যতীত বিদ্যমান।” ছান্দোগ্য উপনিষদ (৩.১৪.১)-এর বাণী—“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম।”—এই উপলব্ধিরই ভিত্তি।

গীতার (১২.৫) শ্লোকটি গভীরভাবে আধ্যাত্মিক মনোবিজ্ঞানের এক সত্য প্রকাশ করে। শ্রীকৃষ্ণ এখানে অর্জুনকে বোঝাচ্ছেন যে, “অব্যক্ত”-এর উপাসনা—অর্থাৎ যিনি নাম, রূপ, গন্ধ, শব্দ ও আকারের অতীত, সেই চিরনিরাকার ব্রহ্মের ধ্যান—এক অত্যন্ত সূক্ষ্ম, জটিল ও ক্লেশসাধ্য পথ।

“ক্লেশোহধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্‌”—যারা চেতনা অব্যক্ত ব্রহ্মে নিবিষ্ট করতে চায়, তাদের ক্লেশ বা কষ্ট অধিক; কারণ “অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে”—দেহধারী জীবদের পক্ষে অব্যক্ত, রূপহীন ব্রহ্মে গতি বা মিলন অত্যন্ত কঠিন।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, অব্যক্ত ব্রহ্ম মানে সেই “নির্বিশেষ সত্তা”, যিনি সকল বিশেষণ, সমস্ত গুণ, সমস্ত আকার ও পার্থক্যের ঊর্ধ্বে। উপনিষদ একে বলে—“নেতি নেতি”—না এটি, না সেটি। ব্রহ্মকে বোঝানো যায় না, দেখা যায় না, বলা যায় না; তাঁকে কেবল উপলব্ধি করা যায় চিত্তের নিঃশেষ প্রশান্তিতে।

এখানেই সাধনার জটিলতা। কারণ দেহ, ইন্দ্রিয় ও মন—এই তিন স্তরেই আমাদের অভিজ্ঞতা গঠিত হয়। মানুষ রঙে দেখে, শব্দে শোনে, স্পর্শে অনুভব করে, ভাবনায় গড়ে তোলে। কিন্তু অব্যক্ত ব্রহ্ম সব ইন্দ্রিয়ের সীমার বাইরে। তাই গীতা বলছে, দেহবৎ জীবদের জন্য এই উপাসনা কঠিন, কারণ তাঁদের মন প্রায়ই রূপ, রং, শব্দ ও ভাবনার মধ্যে আটকে যায়।

যেমন কেউ যদি আকাশকে ধরতে চায়—আকাশ সর্বত্র আছে, কিন্তু কোনো রূপে ধরা যায় না। তেমনি অব্যক্ত ব্রহ্মও সর্বত্র বিরাজমান, কিন্তু ইন্দ্রিয়ের কোনো মাধ্যমে তাঁকে অবলম্বন করা যায় না। তাই অনেক সাধক রূপমূর্ত ঈশ্বরোপাসনা দিয়ে শুরু করেন—যেমন কৃষ্ণ, রাম, দেবী বা শিবের মূর্তিতে ঈশ্বরকে অনুভব করা—কারণ সেই রূপ ধ্যানের অবলম্বন দেয়, মনকে একাগ্র করে।

গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ ভক্তির দুই দিকের এক চিরন্তন সমন্বয় প্রকাশ করেছেন—একদিকে রূপময়, সগুণ, ব্যক্ত ঈশ্বরের প্রতি প্রেমভক্তি, আর অন্যদিকে রূপাতীত, নির্গুণ, অব্যক্ত চৈতন্যের প্রতি ধ্যান। এখানে তিনি কোনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেননি; বরং এই দুই পথকে একই পরম সত্যে মিলিয়ে দিয়েছেন। প্রথমে তিনি বলেন—“ময়্যাবেশ্য মনো যে মা নিত্যযুক্তা উপাসতে, শ্রদ্ধয়া পরয়া উপেতাঃ তে মেযুক্ততমা মতাঃ।” (গীতা ১২.২)—অর্থাৎ, “যারা সর্বদা আমার মধ্যে মন নিবিষ্ট করে, অটল শ্রদ্ধা ও ভক্তি নিয়ে উপাসনা করে, তাদের আমি সর্বোত্তম যোগী বলে মনে করি।”

এই শ্লোকের মধ্যেই সগুণ ভক্তির মৌল সারবস্তু নিহিত। মানুষ স্বাভাবিকভাবে রূপ, নাম, গন্ধ ও শব্দে আকৃষ্ট—তাই ঈশ্বরকে রূপমূর্তি, কাহিনি, ও লীলারূপে অনুভব করাই তার কাছে সহজতর পথ। শ্রীকৃষ্ণ এই মনস্তাত্ত্বিক সত্যকেই স্বীকার করেছেন। তাঁর কথার অন্তরে রয়েছে গভীর সহানুভূতি—মন, যা বিচলিত, তাকে একাগ্র করার জন্য কিছু দৃশ্যমান অবলম্বন প্রয়োজন। সেই অবলম্বনই ঈশ্বরের রূপ।

এই রূপময় ভক্তির বাস্তব উদাহরণ ভারতীয় আধ্যাত্মিক পরম্পরায় অসংখ্য। মীরাবাই কৃষ্ণরূপে প্রেমকে উপলব্ধি করেছিলেন; রামকৃষ্ণ পরমহংস কালীমূর্তিতে সর্বব্যাপী ব্রহ্মচেতনাকে অনুভব করেছিলেন; তুলসীদাস রামরূপে সেই চিরন্তন প্রেমকে প্রকাশ করেছেন। তাঁদের কাছে রূপ ছিল চেতনার দরজা—রূপকে ধরে তারা অব্যক্তের দিগন্তে পৌঁছেছিলেন। এই রূপোপাসনা মনের অস্থিরতা শান্ত করে, হৃদয়কে কোমল করে, ভক্তকে আত্মসমর্পণের দিকে নিয়ে যায়। তাই গীতা বলে, যে-মন ঈশ্বরমূর্তিতে স্থির হয়, সে আসলে নিজেরই চেতনার পরিশুদ্ধ রূপে স্থিত হয়। রূপভক্তি মানুষকে অনুভব করায়—ঈশ্বর দূরে নন, অন্তরেই বাস করেন।

এরপর কৃষ্ণ বলেন—“যে ত্বক্ষরমনির্দেশ্যমব্যক্তং পরিবাসতে, সর্বত্রগমচিন্ত্যঞ্চ কূটস্থমচলন্ধ্রুবম্‌। সন্নিয়ম্যেন্দ্রিয়গ্রামং সর্বত্র সমবুদ্ধয়ঃ, তে প্রাপ্নুবন্তি মামেব সর্বভূতহিতে রতাঃ।” (গীতা ১২.৩-৪)—অর্থাৎ, “যারা অব্যক্ত, অনির্দেশ্য, সর্বব্যাপী, চিন্তাতীত, অপরিবর্তনীয় ও ধ্রুব ব্রহ্মের ধ্যান করে, ইন্দ্রিয়কে সংযত রাখে, সর্বত্র সমবুদ্ধি ধরে, এবং সর্বভূতের মঙ্গলে রত থাকে, তারাও শেষপর্যন্ত আমাকেই লাভ করে।” এখানে ‘অব্যক্ত’ মানে সেই চেতনা, যিনি সমস্ত রূপের ঊর্ধ্বে—যাকে চোখে দেখা যায় না, শব্দে ধরা যায় না, ভাবনায় বন্দী করা যায় না, কিন্তু যিনি প্রত্যেক জীবের অন্তঃস্থ উপস্থিতি। এই নির্গুণ উপাসনা হলো অদ্বৈত বেদান্তের ধ্যানপথ—যেখানে ঈশ্বর ও ভক্ত, দাতা ও গ্রহীতা, কর্তা ও কর্ম—সব পার্থক্য মুছে যায়, এবং কেবল এক চৈতন্যই থাকে।

কিন্তু এই পথ সহজ নয়। গীতা পরে সতর্ক করে বলে—“ক্লেশোহধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্‌। অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে।” (গীতা ১২.৫)—“যারা অব্যক্ত পরমাত্মায় মন স্থাপন করে, তাদের ক্লেশ অধিক, কারণ দেহধারী জীবদের পক্ষে অব্যক্তের উপাসনা কঠিন।” কেন কঠিন? কারণ মানুষ ইন্দ্রিয়নির্ভর প্রাণী। আমরা দেখি, শুনি, স্পর্শ করি, চিন্তা করি—সবই রূপ ও বৈচিত্র্যের মাধ্যমে। কিন্তু অব্যক্ত ব্রহ্ম সেই সমস্ত সীমার বাইরে। তাই অব্যক্তে ধ্যান করা মানে মন ও ইন্দ্রিয় উভয়কেই অতিক্রম করা।

যেমন, কেউ যদি আকাশকে ধরতে চায়—আকাশ সর্বত্র আছে, কিন্তু স্পর্শযোগ্য নয়; তেমনি অব্যক্ত ব্রহ্মও সর্বত্র উপস্থিত, কিন্তু ইন্দ্রিয় ও চিন্তায় ধরা দেয় না। এই কারণেই শঙ্করাচার্য ব্যাখ্যা করেছেন—“নির্বিশেষ ব্রহ্ম”-এর উপলব্ধি মানে এমন এক চৈতন্য-অবস্থা, যেখানে চিন্তা, ইচ্ছা, রূপ বা সময়ের কোনো প্রভাব নেই। এই অভিজ্ঞতা একমাত্র নিস্তরঙ্গ চিত্তেই সম্ভব।