গীতায় অবতারতত্ত্ব: ১১



পঞ্চম স্তরে, ভোজনরূপ ক্রিয়াও ব্রহ্ম। গীতা (৯.১৬)-য় আবারও বলা হয়েছে—“অহমহুতম্‌।”—“আমি সেই আহুতি।” এই বোধ জাগলে জীবনের সমস্ত ক্রিয়াই এক অন্তর্যাগে রূপান্তরিত হয়। কাজ, খাওয়া, কথা বলা, শ্বাস নেওয়া—সবই তাঁর লীলা। ঈশোপনিষদ (১) এবং শ্রীমদ্‌ভগবদ্গীতার (৪.৩৭) দার্শনিক সিদ্ধান্ত—“যেন সর্বাণি কর্মাণি ব্রহ্মণি সম্পদ্যন্তে।” সূত্রটি জ্ঞান এবং কর্মের একটি সুন্দর সমন্বয়। এটি বলে যে, যখন কোনো ব্যক্তি পূর্ণ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে, তখন তার সকল কর্ম কেবল কর্তব্য হিসেবে সম্পন্ন হয়, ফলের আশা থাকে না; তাই সেই কর্ম আর বন্ধন সৃষ্টি না করে স্বয়ং ব্রহ্মের চেতনায় বিলীন হয়ে যায়। জ্ঞানী জানেন, সব কর্মই ব্রহ্মে লীন হচ্ছে, কারণ কর্ম নিজেই ব্রহ্মচেতনার বিকিরণ।

ষষ্ঠ স্তরে, ভোজনের ফলও ব্রহ্ম। গীতা (৪.৩১)-য় কৃষ্ণ বলেন—“যজ্ঞশিষ্টামৃতভূজো যান্তি ব্রহ্ম সনাতনম্‌।” অর্থাৎ, “যারা যজ্ঞের অবশিষ্ট অমৃত ভাগ গ্রহণ করে, তারা সেই চিরন্তন ব্রহ্মে পৌঁছায়।” এখানে ফল মানে বস্তুগত লাভ নয়—এটি সেই আনন্দ, যা অহংকারমুক্ত কর্মের পর আসে। জ্ঞানী জানেন, তাঁর প্রাপ্ত ফলও তাঁর নয়; সেটি ব্রহ্মেরই প্রতিফলন, ব্রহ্মেরই তৃপ্তি।

এই ছয় স্তর মিলিয়ে গীতার অদ্বৈত বাণী প্রকাশ পায়—কর্মের মধ্যেই জ্ঞান, জ্ঞানের মধ্যেই ভক্তি, ভক্তির মধ্যেই মুক্তি। গীতা (৪.১৮)-য় কৃষ্ণ বলেন—“কর্মণ্যকর্ম যঃ পশ্যেত্‌”—যে কর্মের মধ্যে অকর্ম দেখে, সে-ই সত্য জ্ঞানী। কারণ তার কাছে কর্ম আর আলাদা কিছু নয়; সেটি চেতনারই নৃত্য। তখন “আমি করছি” ধারণা বিলুপ্ত হয়, আর কর্ম নিজেই হয়ে ওঠে ধ্যান।

অদ্বৈত বেদান্তের এই পরম শিক্ষা—“কর্মণি ব্রহ্মদর্শন”—মানে "কর্মের মধ্যে ব্রহ্মকে দেখা" বা "কর্মকে ব্রহ্মরূপে দর্শন করা"। যেমন সূর্য আলো দেয় কিন্তু অহংকার করে না, নদী প্রবাহিত হয় গৌরব জানে না—তেমনি জ্ঞানী কর্ম করেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে, অহংবোধহীনভাবে। তখন জীবন হয়ে ওঠে এক অন্তহীন যজ্ঞ—যেখানে দাতা, দান ও দানগ্রহীতা তিনিই। এই অবস্থায় কর্ম আর মুক্তি আলাদা থাকে না; কর্মই ব্রহ্মানন্দ, আর ব্রহ্মানন্দই জীবনের সর্বাঙ্গীণ যজ্ঞ।

গীতার এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জানায়—যখন সাধক উপলব্ধি করেন যে, যে দেয়, যা দেয়, যেখানে দেয়, কেন দেয়—সবই ব্রহ্ম, তখন তার প্রতিটি কর্ম, প্রতিটি নিঃশ্বাস যজ্ঞে পরিণত হয়; তার জীবন ঈশ্বরের অন্তর্লীলা হয়ে ওঠে, আর কর্মযোগ পরিণত হয় জ্ঞানযোগে, যেখানে কর্মের মধ্যে জ্ঞান ও ভক্তি একাকার হয়ে অনন্তে মিলিয়ে যায়।

এই তত্ত্ববোধের মূল সূত্রটি হচ্ছে—“ব্রহ্ম সর্বস্ব”, এবং জগৎ তারই ক্রিয়ারূপ প্রকাশ। গীতা ও উপনিষদ উভয়েই এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে যে, যা-কিছু দৃশ্যমান, পরিবর্তনশীল, উৎপন্ন ও নশ্বর—তা ব্রহ্মেরই এক গতিশীল প্রকাশ, আর যা অচল, অক্রিয়, নিরুপাধিক—তা ব্রহ্মের নিজস্ব স্বরূপ।

প্রকৃতির মৌল স্বরূপ হলো ক্রিয়া ও পরিবর্তন। পদার্থ কখনও স্থির নয়; ক্ষণক্ষণে রূপান্তরিত হচ্ছে। যে-অক্ষর ব্রহ্ম, তার শক্তিই প্রকৃতি; আর প্রকৃতি মানে পরিবর্তনশীলতা। তাই বলা যায়, পদার্থ আসলে ক্রিয়ারই একঘনীভূত রূপ। আমরা যাকে পদার্থ বলি, তা কেবল ইন্দ্রিয়ের বিভ্রমে স্থির মনে হয়; কিন্তু বাস্তবে তা সর্বদা সঞ্চরিত, লয়ের দিকে অগ্রসর।

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—“অক্ষরং ব্রহ্ম পরমং” (৮.৩)—অক্ষরই পরম ব্রহ্ম, অর্থাৎ সেই অবিনশ্বর সত্তা, যিনি কখনও ক্ষয়প্রাপ্ত হন না। ব্রহ্ম এখানে স্থিতি ও পরমত্বের প্রতীক; তিনি নিস্ক্রিয় নন, বরং তাঁর মধ্যেই সমস্ত সম্ভাবনার বীজ সুপ্ত থাকে। এই ব্রহ্ম যখন নিজের প্রকাশশক্তির মাধ্যমে জগতে প্রতিফলিত হন, তখন সেই প্রকাশশক্তিকেই বলা হয় প্রকৃতি।

এই প্রকৃতি কখনও মায়া নামেও অভিহিত হয়—যে-মায়া ব্রহ্মের স্বতঃস্ফূর্ত শক্তি, সৃষ্টির কারণ। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৪.১০)-এ এই সম্পর্ক স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে—“মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যাত্মায়িনং তু মহেশ্বরম্‌। তস্যাবয়বভূতৈস্তু ব্যাপ্তং সর্বমিদং জগৎ।।” অর্থাৎ “মায়াকেই প্রকৃতি বলে জানবে, আর মায়ার অধিপতিকে মহেশ্বর বলে জানবে; তাঁর অংশরূপ শক্তিগুলির দ্বারা সমগ্র জগৎ পরিব্যাপ্ত।” এখানে মায়া হল ব্রহ্মের ক্রিয়াশক্তি, আর মহেশ্বর সেই অক্ষর ব্রহ্ম, যিনি শক্তির নিয়ন্তা।

গীতাতেও একই সত্য উচ্চারিত—“ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্‌” (৯.১০)—আমার অধ্যক্ষতায় প্রকৃতি সচরাচর জগৎ সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, ব্রহ্ম বা ঈশ্বর নিজে নিষ্ক্রিয় থাকলেও, তাঁর শক্তি প্রকৃতি অবিরাম সৃজনক্রিয়ায় লিপ্ত। আর এই শক্তিই তাঁর “অক্ষর” স্বরূপে নিহিত ব্রহ্মচেতনাকে প্রকাশের রূপ দেয়।

ব্রহ্ম হলেন সেই চিরন্তন, অবিনশ্বর, পরিপূর্ণ চেতনা, যিনি নিজ শক্তি প্রকৃতির মাধ্যমে জগৎকে প্রকাশ, পালন ও লয় করেন। এই শক্তি ব্রহ্মের বাইরে নয়; যেমন সূর্য থেকে আলোক পৃথক নয়, তেমনি প্রকৃতিও ব্রহ্মের অন্তর্গত, তাঁরই সৃষ্টিশীল দিক।

এই উপলব্ধি বেদান্তের মূল দর্শন—ব্রহ্ম ও প্রকৃতি, পুরুষ ও শক্তি, চেতনা ও প্রকাশ—এই দুইয়ের ঐক্য। ব্রহ্ম অক্ষর, প্রকৃতি তাঁর চিরন্তন প্রকাশশক্তি; ব্রহ্ম জ্ঞানের পরমসত্তা, প্রকৃতি সেই জ্ঞানের ক্রিয়াশক্তি; আর উভয়ের সংযোগেই জগৎ, জীবন ও চেতনার অবিরত লীলা প্রবাহিত।

এই পরিবর্তনশীলতার মধ্যেই নিহিত আছে লয়। সব ক্রিয়া লয়ের পথে যাচ্ছে, কারণ যা উৎপন্ন হয়েছে তা নিতান্তই অনিত্য। গীতা (২.১৬)-এ বলা হয়েছে—“নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাভো বিদ্যতে সদঃ।” অর্থাৎ, “অসৎ (অস্থায়ী)-এর কোনো স্থায়ী সত্তা নেই, আর সত্য (চিরন্তন)-এর কোনো নাশ নেই।” সুতরাং যা পরিবর্তনশীল, তা নাশনীয়; আর যা অবিনাশী, তা পরিবর্তনাতীত ব্রহ্ম।

উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয়—এই তিন অবস্থা কেবল আপাতরূপ। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, স্থিতি নামের কোনো বাস্তব অবস্থা নেই—কারণ স্থিতিও ক্রমাগত পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা। যেমন, কোনো ব্যক্তির আয়ু যতই দীর্ঘ হোক না কেন, প্রতিক্ষণই সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। যে-মুহূর্ত অতিক্রান্ত হলো, সেই মুহূর্তেই তার আয়ুর এক অংশ লয় পেয়েছে। এই অর্থে দেখা যায়, মানুষের প্রতিটি শ্বাসই মৃত্যু-অগ্রগতি। সুতরাং জগতের প্রকৃত ধর্ম প্রলয়—নাশই তার স্বরূপ।

তবে এই নাশও চূড়ান্ত শূন্য নয়; নাশও ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত। অদৃশ্যের মধ্যে দৃশ্য লীন হয়, আর সেই অদৃশ্য চেতনা বা অক্রিয় তত্ত্বই হলো ব্রহ্ম। তাই বলা হয়, “নাস্তির অস্তিত্ব ভাবরূপ ব্রহ্মের উপরই নির্ভরশীল।” যা বিলীন হয়, তা ব্রহ্মের মধ্যেই বিলীন হয়, কারণ ব্রহ্মই একমাত্র অস্তিত্ব—“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.১)—“এই সমগ্র জগৎই ব্রহ্ম”; এবং “বাসুদেবঃ সর্বম্‌” (গীতা ৭.১৯)—“বাসুদেবই সর্বস্ব।”

এই অবস্থান থেকে দেখা যায়, সব কর্মই ব্রহ্মস্বরূপ, কারণ কর্মও সেই এক চেতনার গতি। “অর্পণরূপ যে-কর্ম, সে-ও ব্রহ্ম”—এই বাক্য তাই নিছক কাব্যিক উচ্চারণ নয়, এটি দর্শন। ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবিঃ ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্‌—এর মর্মই এই যে, যজ্ঞের সব উপাদান, ক্রিয়া ও কর্তা ব্রহ্মতত্ত্বে একীভূত।

যদি তা যজ্ঞে সত্য হয়, তবে তা সকল কর্মে সমানভাবে সত্য। লিখনের ক্ষেত্রেও—যে-কাগজে লেখা হচ্ছে, যে-কালি দিয়ে অক্ষর গঠিত হচ্ছে, যে কলম বা লেখনী সেই কর্ম করছে, এমনকি লেখক নিজেও—সবই ব্রহ্মরূপ। কারণ এই সকল ক্রিয়া, উপাদান ও চেতনা—সবকিছুই পরম ব্রহ্মের শক্তিপ্রবাহে চলমান।

যে-উপলব্ধিতে জগৎ ক্রিয়া, পদার্থ ও নাশ—সবই ব্রহ্মে লীন বলে প্রতীয়মান হয়, সেই উপলব্ধিই প্রকৃত জ্ঞান। তখন ব্যক্তি বুঝতে পারে—জগতের প্রতিটি গতি লয়ের পথে, কিন্তু সেই লয়ও চেতনারই এক রূপ; কিছুই প্রকৃত অর্থে বিলুপ্ত হয় না, বরং চিরচেতনার মধ্যেই রূপান্তরিত হয়।

এই জ্ঞানই কর্মকে যজ্ঞে পরিণত করে, কর্মফলকে ব্রহ্মে বিলীন করে, আর কর্মীকে কর্তার অহংকার থেকে মুক্ত করে। তখন কর্ম, পদার্থ, সময়, স্থিতি ও প্রলয়—সবই সেই এক অনাদি চেতনার নিত্য লীলা; আর সাধক তখন অভিজ্ঞতা করে—“আমি নয়, তিনিই সর্বত্র আছেন; আমি লিখছি না—তিনিই আমার হাত দিয়ে লিখছেন।”

গীতার এই পর্যায়ে ভগবান কৃষ্ণ এক গভীর বিশ্বদর্শনের উন্মোচন করেছেন—একটি অদ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মরূপ ঈশ্বরের অনন্ত বিকাশ ছাড়া অন্য কিছু নয়। তিনি নিজেই বলেছেন, “পাণ্ডবদের মধ্যে আমি ধনঞ্জয়, যাদবদের মধ্যে আমি কৃষ্ণ, স্থাবরদের মধ্যে আমি হিমালয়, নদীর মধ্যে আমি গঙ্গা, সরোবরের মধ্যে আমি সাগর, মৎস্যগণের মধ্যে আমি মকর, জয়ের মধ্যে আমি ছল”—অর্থাৎ, সব কিছুর মধ্যে আমি নিজেই আছি; সমস্ত শ্রেষ্ঠত্ব, শক্তি ও সৌন্দর্য আমারই দীপ্তি।

গীতার দশম অধ্যায়, বিভূতিযোগ অদ্বৈত বেদান্তের আলোকে এক অনন্য “কসমিক আত্মপরিচয়”, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বহুরূপ জগতের অন্তরে লুকোনো সেই এক চৈতন্যেরই আত্মপ্রকাশ করাচ্ছেন। "কসমিক আত্মপরিচয়" (Cosmic Self-Identity) বলতে বোঝায় একটি গভীর দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক উপলব্ধি, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে বিচ্ছিন্ন বা কেবল দেহধারী জীব হিসেবে নয়, বরং সমগ্র মহাজাগতিক অস্তিত্বের (Cosmos) একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনুভব করে।

যখন তিনি বলেন—“পাণ্ডবানাং ধনঞ্জয়ঃ” (আমি পাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুন), বা “যাদবস্মি বসুদেবঃ” (যাদবদের মধ্যে আমি বসুদেব), কিংবা “স্থাবরাণাম্‌ হিমালয়ঃ” (স্থির জিনিসের মধ্যে আমি হিমালয়)—তখন কৃষ্ণ আসলে ঘোষণা করছেন না যে, তিনি একজন ব্যক্তি হিসেবে সর্বত্র শ্রেষ্ঠ; বরং তিনি বোঝাতে চাইছেন, যেখানেই দৃঢ়তা, জ্ঞান, নীতি, বীরত্ব বা শৌর্য আছে, তা-ই তাঁরই প্রকাশ।

অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, এটি “ঈশাবাস্যমিদং সর্বম্‌” (ঈশা উপনিষদ ১)-এরই বাস্তব রূপ—এই জগৎ, দৃশ্যমান সব কিছুই ঈশ্বর দ্বারা পরিব্যাপ্ত। কৃষ্ণ এখানে বোঝাচ্ছেন যে, ঈশ্বর কোনো সীমিত ব্যক্তি নন; তিনি সেই চেতনা, যিনি প্রতিটি জীবের অন্তরে, প্রতিটি ঘটনার নেপথ্যে, প্রতিটি শক্তি ও প্রেরণার উৎস হিসেবে উপস্থিত।

যেমন তিনি বলেন—“অহম্‌ আত্মা গুঢ়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ” (গীতা ১০.২০)—“হে গুঢ়াকেশ (অর্জুন), আমি সমস্ত প্রাণীর হৃদয়স্থিত আত্মা।” অর্থাৎ, তিনি বাহিরের জগতে আলাদা ঈশ্বর নন; তিনি প্রতিটি হৃদয়ে যে জীবনীশক্তি, প্রেরণা ও সচেতনতা কাজ করছে, সেটিই। ‘গুঢ়াকেশ’ উপাধিটি অর্জুনের একটি বিশেষ গুণকে তুলে ধরে। শব্দটি সন্ধি বিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায়: গুঢ়াকা (Guḍākā) অর্থ: নিদ্রা বা অজ্ঞান। ঈশ (Īśa) অর্থ: প্রভু বা নিয়ন্তা। সুতরাং, গুঢ়াকেশ-এর অর্থ হলো: যিনি নিদ্রা বা অজ্ঞানের উপর জয় লাভ করেছেন বা নিদ্রাকে জয় করেছেন।

এই উপলব্ধি অদ্বৈত বেদান্তের “ব্রহ্ম সত্যং জগৎ মিথ্যা” তত্ত্বকে স্পষ্ট করে। জগৎ কোনো ভিন্ন সত্তা নয়, বরং ব্রহ্মচেতনারই বহুবিধ প্রকাশ। যেমন হিমালয়ে স্থিতির প্রকাশ, সাগরে গভীরতার, অর্জুনে বীর্যের, মকরে প্রাণশক্তির, তেমনি প্রতিটি গুণই এক চেতনার বিভিন্ন দিক।

কৃষ্ণের এই বাক্যগুলো দার্শনিকভাবে বোঝায়—জগতে যা-কিছু মহান, তা ঈশ্বর থেকে পৃথক নয়। তিনি সমস্ত কিছুর অন্তর্যামী; আর এই উপলব্ধিই মানুষকে শেখায়, ঈশ্বরকে খোঁজার জন্য আকাশ বা মন্দিরে নয়, নিজের হৃদয়ে ও কর্মে তাঁকে দেখতে হয়। কারণ সেই চেতনা, যিনি অর্জুনে যুদ্ধের সাহস হয়ে প্রকাশিত, তিনিই আমাদের মধ্যেও প্রেরণা, দয়া, জ্ঞান ও প্রেম হয়ে জেগে থাকেন।

অদ্বৈত বেদান্তে ব্রহ্ম এক ও অখণ্ড; নাম–রূপের যে-বৈচিত্র্য আমরা দেখি, তা একই সত্তার বিচিত্র প্রতিবিম্ব। বৃহদারণ্যক উপনিষদের “অন্তর্যামী ব্রাহ্মণ”-এ যাজ্ঞবল্ক্য বলেন, “যো ভূমিমধ্যস্থো যং ভূমির্ন বেদ… এষ ত আত্মা অন্তর্যামী অমৃতঃ” (৩.৭.৩)—পৃথিবীর ভেতরে যিনি অবস্থান করেন, যাকে পৃথিবী ‘বাহ্যবস্তু’ জেনে পায় না, তিনিই তোমার অন্তর্যামী, অমৃত আত্মা। পরমাত্মা বা ব্রহ্ম এই জগতের সব কিছুতেই বিদ্যমান (ভূমির মধ্যেও), কিন্তু জড় বস্তু তাকে জানতে পারে না।