গীতায় অবতারতত্ত্ব: ১০



মনস্তত্ত্বের দিক থেকেও এই শ্লোক (৪.২৪) গভীর তাৎপর্য বহন করে। সাধারণ মানুষ নিজেকে কর্মের কর্তা ভাবে—“আমি করছি, আমি অর্জন করছি”—এই ধারণাই মানসিক অস্থিরতার মূল। কিন্তু “ব্রহ্মার্পণম্‌” চেতনা সেই অহংবোধ ভেঙে দেয়। যখন কর্ম ঈশ্বরার্পিত হয়, তখন মন স্বাভাবিকভাবে শান্ত হয়, কারণ আর কিছুই নিজের বলে থাকে না। আধুনিক নিউরোথিওলজির আলোচনায় দেখা যায়—যখন মানুষ প্রার্থনা, ধ্যান বা নিঃস্বার্থ কর্মে মনোনিবেশ করে, তখন মস্তিষ্কের ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক, যা অহংবোধের কেন্দ্র, তা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়; আর প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স—যা মনোযোগ, সংযম ও সহানুভূতির উৎস—তা সক্রিয় হয়। এর ফলে কর্ম নিজেই ধ্যান হয়ে ওঠে, এবং মন প্রবেশ করে “ব্রহ্মসমাধি”-র অবস্থায়—যেখানে কাজ ও জ্ঞান আর পৃথক থাকে না।

অদ্বৈত বেদান্ত এই শ্লোককে জ্ঞান ও কর্মের সেতুবন্ধন হিসেবে দেখে। জ্ঞানহীন কর্ম মানুষকে বেঁধে ফেলে, আর কর্মহীন জ্ঞান স্থবির হয়ে যায়; কিন্তু যখন জ্ঞান কর্মকে আলোকিত করে, তখন কর্মই জ্ঞানের প্রকাশ হয়ে ওঠে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৪.৪.৫) বলা হয়েছে—”যথাকারী যথাচারী তথা ভবতি। সাধুকারী সাধুর্ভবতি, পাপকারী পাপো ভবতি। পুণ্যঃ পুণ্যেন কর্মণা ভবতি, পাপঃ পাপেন।”—"মানুষ যেমন কাজ করে, যেমন আচরণ করে, সে তেমনই হয়। পুণ্য কাজ করে পুণ্যবান হয়, পাপ কাজ করে পাপী হয়। পুণ্য কর্মের দ্বারা সে পুণ্যলোক লাভ করে, পাপ কর্মের দ্বারা পাপলোক।" এটি শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতার কর্মযোগ-এরও মূলভাবকে সমর্থন করে, যেখানে বলা হয়েছে: কর্মের ফলের উপর নির্ভর করেই জীবের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। মানুষের বর্তমান অবস্থা তার অতীতের কর্মের ফল, এবং ভবিষ্যৎ বর্তমানের কর্মের উপর নির্ভর করে। কারণ ও কার্য (Cause and Effect) এর অলঙ্ঘনীয় নিয়ম অনুসারে, মানুষের প্রতিটি কর্মই তার চরিত্র, ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ অস্তিত্বকে গঠন করে।

মানুষ যেমন কাজ করে, সে তেমনই হয়ে ওঠে; আর ছান্দোগ্য উপনিষদ (৩.১৪.১)-এ বলা হয়েছে—“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”—সবই ব্রহ্ম। এই দুটি তত্ত্ব এখানে এক হয়ে গেছে: কর্মও ব্রহ্ম, কারণ কর্মের মধ্যেই ব্রহ্মের স্পন্দন।

আজকের যুগে এই শ্লোককে এক সর্বজনীন যোগপথ হিসেবে বোঝা যায়। বিজ্ঞানী, শিক্ষক, সেবক, শিল্পী—যে-ই হোন, যদি নিজের কাজকে ব্রহ্মার্পণ হিসেবে করেন, তবে সেই কাজই সাধনা হয়ে ওঠে। চিকিৎসক যদি রোগীর সেবাকে ঈশ্বরসেবা মনে করেন, কৃষক যদি নিজের পরিশ্রমকে সৃষ্টির যজ্ঞে অংশগ্রহণ মনে করেন, শিক্ষক যদি শিক্ষাদানকে জ্ঞানযজ্ঞ ভাবেন—তবে সকলেই এই “ব্রহ্মকর্মসমাধি”-র অবস্থায় প্রবেশ করেন।

শেষপর্যন্ত এই শ্লোক আমাদের শেখায়, যজ্ঞ কেবল অগ্নিতে দান নয়; এটি অহংকারের দহন, কামনার বিলয়, আর চেতনার দীপ্তির উন্মোচন। যখন মানুষ উপলব্ধি করে—“আমি কিছুই করি না, সব ঈশ্বরের দ্বারাই ঘটছে”—তখন সে কর্ম থেকে মুক্ত হয়, কারণ কর্ম আর পৃথক কিছু থাকে না। তখন জীবন নিজেই যজ্ঞ, আর যজ্ঞের ফল মুক্তি নয়—বরং সেই মুহূর্তের মধ্যেই ঈশ্বরসাক্ষাৎ। এটাই গীতার বাণী—কর্মে জ্ঞান, জ্ঞানে ভক্তি, আর ভক্তিতে চিরন্তন একতা—ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবি—এই এক চেতনার জাগরণই মানবজীবনের পরম সাধনা।

এই যজ্ঞতত্ত্বের দার্শনিক ব্যাখ্যা—গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে (৪.১৬-৩২) বিধৃত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ যজ্ঞকে কেবল অগ্নিতে আহুতি দান হিসেবে ব্যাখ্যা করেননি; বরং বলেছেন, প্রত্যেক কর্মই যজ্ঞ হতে পারে, যদি তা ঈশ্বরজ্ঞানে সম্পাদিত হয়। প্রথমে তিনি বলেন—“তত্ত্বে কর্ম প্রবক্ষ্যামি যজ্ঞজ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসে’শুভাৎ।” (৪.১৬) অর্থাৎ, “আমি তোমাকে কর্মের তত্ত্ব বলব; তা জেনে তুমি সমস্ত অশুভ থেকে মুক্ত হবে।”

এরপর তিনি নানা প্রকার যজ্ঞের বর্ণনা দেন—দ্রব্যযজ্ঞ (বস্তুদানের মাধ্যমে), তপযজ্ঞ (তপস্যার মাধ্যমে), যোগযজ্ঞ (ইন্দ্রিয়সংযমের মাধ্যমে), জ্ঞানযজ্ঞ (ব্রহ্মজ্ঞান সাধনার মাধ্যমে)। এবং শেষে উপসংহার টানেন—“কর্মজান্‌ বিদ্ধি তান্‌ সর্বানেবং জ্ঞাত্বা বিমোক্ষ্যসে।” (৪.৩২) অর্থাৎ, “এইভাবে যজ্ঞরূপে সমস্ত কর্মকে জানো; তাতে তুমি মুক্ত হবে।”

কর্ম যদি স্বার্থ, ফল বা অভিমানমুক্ত হয়—তবে সেটি যজ্ঞ। আর যদি কেবল প্রথা বা পরম্পরার জন্য করা হয়, তবে তা কর্মবদ্ধতা-র পুনরাবৃত্তি। এই কারণেই শ্লোক (৪.২৩)-এ কৃষ্ণ বলেছেন—“যজ্ঞায়াচরতঃ কর্ম সমগ্রং প্রবিলীয়তে।” অর্থাৎ, “যিনি যজ্ঞবুদ্ধি নিয়ে কাজ করেন, তাঁর সমস্ত কর্ম বিলীন হয়ে যায়।”

এই বিলয় মানে কর্মের অভাব নয়—বরং কর্মের সীমাবদ্ধতা লুপ্ত হয়ে যাওয়া। যখন কর্তা জানেন, ‘আমি কর্তা নই—কর্ম, উপকরণ, উপাস্য—সবই সেই এক চেতনা’, তখন তার কর্ম আর ফলের যোগসূত্রে বাঁধা থাকে না। তখন কর্মই হয়ে ওঠে অকর্ম—অর্থাৎ এমন কর্ম, যা বন্ধন সৃষ্টি করে না।

“যজ্ঞে আহুতি”-র উদাহরণে এর রূপকটি গভীর। যখন ঘৃত অগ্নিতে ফেলা হয়, তখন তা আলাদা সত্তা নিয়ে থাকে না—অগ্নির রূপে মিশে যায়। তেমনি, সাধক যখন ঈশ্বরার্পণ করে কর্ম করেন, তখন তাঁর কর্মের স্বাতন্ত্র্য বিলীন হয়, এবং কেবল ব্রহ্মরূপ কার্যই অবশিষ্ট থাকে। এই অবস্থায় আর কর্তার অহংকার থাকে না; থাকে কেবল চেতনার একত্ববোধ।

অদ্বৈত বেদান্ত এই তত্ত্বকে বলে “ব্রহ্মকর্মসমাধি”—অর্থাৎ এমন অবস্থা, যেখানে চেতনা কেবল ব্রহ্মে নিমগ্ন, এবং সমস্ত ক্রিয়াই ব্রহ্মের মধ্যেই সম্পন্ন। শঙ্করাচার্য তাঁর ভাষ্যে বলেন—“যিনি কর্মে ব্রহ্মবুদ্ধি লাভ করেছেন, তাঁর কর্ম আর কর্ম নয়, জ্ঞানই হয়ে ওঠে।”

এখানেই গীতার সর্বোচ্চ যোগতত্ত্ব প্রকাশ পায়—যখন কর্ম আর ভক্তি আলাদা থাকে না; জ্ঞান, যজ্ঞ ও উপাসনা একত্র মিলিত হয়। তখন আর কোনো ‘অন্য’ থাকে না—সবই ব্রহ্ম।

এই অবস্থাই প্রকৃত মুক্তির সূচনা। তখন মানুষ যাকে ‘কর্ম’ বলে জানে, সেটি আর ব্যক্তিগত প্রয়াস নয়, বরং ব্রহ্মের লীলামাত্র। তখন কর্মফলও ব্রহ্ম, উদ্দেশ্যও ব্রহ্ম, আর কর্মীও ব্রহ্ম।

তাই এই শ্লোকের অন্তর্নিহিত অর্থ এই—যে-ব্যক্তি সর্বত্র ব্রহ্মদর্শন লাভ করেছে, তাঁর সমস্ত জীবনযাত্রাই যজ্ঞে পরিণত হয়। তাঁর নিঃশ্বাসও আহুতি, তাঁর চিন্তাও প্রার্থনা, তাঁর কর্মও উপাসনা। তখন জীবন ও যজ্ঞ এক হয়ে যায়—“যজ্ঞো বৈ বিশ্বসৃষ্টিঃ” (শতপথ ব্রাহ্মণ এবং উপনিষদে বর্ণিত সৃষ্টির প্রক্রিয়ার দার্শনিক সারকথা)—"নিশ্চয়ই যজ্ঞ বিশ্বসৃষ্টিস্বরূপ" বা "যজ্ঞই বিশ্বসৃষ্টি"। এই প্রাচীন বাণী তখন বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে।

এই ব্যাখ্যাটি গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ২৪তম শ্লোক—“ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্‌। ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা।।”—এর এক উৎকৃষ্ট বেদান্তীয় বিশ্লেষণ, যেখানে যজ্ঞ-এর বহিরঙ্গ রূপ থেকে অন্তরঙ্গ আত্মদর্শনে প্রবেশ করা হয়েছে।

এখানে ‘অর্পণম্‌’ শব্দটি ধাতু-রূপে এসেছে—“অপাতে অনেন ইতি অর্পণম্‌”—অর্থাৎ যে পাত্র বা উপায় দ্বারা অগ্নিতে হব্যদ্রব্য অর্পণ করা হয়, তাকে বলা হয়েছে অর্পণ। ঐ ‘অর্পণ’-কেও ব্রহ্মরূপ মনে করতে হবে, কারণ ব্রহ্ম সর্বব্যাপী—পাত্র, উপাদান, ক্রিয়া, কর্তা—সবেতেই তাঁরই প্রকাশ।

তিল, যব, ঘৃত প্রভৃতি যজ্ঞদ্রব্যগুলিও ব্রহ্ম, কারণ সেগুলি জড় পদার্থ নয়; চেতনারই রূপান্তর। “ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্‌”—অর্থাৎ যে-অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়, সেই অগ্নিও ব্রহ্ম; যে-ব্যক্তি আহুতি দেন, তিনি নিজেও ব্রহ্ম; এবং যে-ক্রিয়া দ্বারা আহুতি সম্পন্ন হয়, সেটিও ব্রহ্মতত্ত্বর প্রকাশমাত্র।

“ব্রহ্মকর্মসমাধিনা”—এখানে ‘সমাধি’ মানে যোগ বা নিমগ্নতা। যেমন যজ্ঞকারী ব্যক্তি যজ্ঞের সব দ্রব্য, অগ্নি, কর্তা, ক্রিয়া—সব কিছুকেই ব্রহ্মরূপে উপলব্ধি করেন, তেমনি যে-ব্যক্তি প্রতিটি কর্মে কর্তা (যিনি করেন), করণ (যন্ত্র বা উপায়), কর্ম (যা করা হচ্ছে) এবং ফল—সব কিছুকেই ব্রহ্মরূপে অনুভব করেন, তাঁর কর্ম ব্রহ্মে লীন হয়ে যায়।

তখন তাঁর পক্ষে কর্মের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকে না—সবই ব্রহ্মস্বরূপ। কর্ম আর জড় নয়; তা চেতনারই অভিব্যক্তি। আর তাই “ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যম্‌”—যিনি এই অবস্থায় স্থিত, তাঁর গন্তব্যও ব্রহ্ম, কারণ তাঁর চেতনা ও কর্ম উভয়ই ব্রহ্মে লীন।

এই উপলব্ধির দার্শনিক তাৎপর্য হলো—কর্মে জ্ঞান ও ভক্তির ঐক্য। কর্তা যখন নিজেকে ঈশ্বরের নিমিত্তরূপে উপলব্ধি করে, তখন তাঁর প্রত্যেক কর্ম যজ্ঞে পরিণত হয়, প্রতিটি নিঃশ্বাস আহুতির মতো ঈশ্বরার্পণ হয়ে যায়। কর্ম তখন আর বন্ধন সৃষ্টি করে না, বরং মুক্তির মাধ্যম হয়।

এই অবস্থাই গীতার বাণী অনুযায়ী “অকর্তৃত্ববোধ” ও “নিষ্কাম কর্ম”-এর চূড়ান্ত রূপ—যেখানে কর্তা, কর্ম ও কর্মফল তিনটিই ব্রহ্মে একীভূত হয়ে যায়, আর সাধকের জীবন হয়ে ওঠে এক অবিরাম যজ্ঞ, ঈশ্বরচেতনার অন্তহীন আরাধনা।

এই অংশটি গীতার জ্ঞানযোগ-এর এমন এক সূক্ষ্ম স্তর উন্মোচন করছে, যেখানে ঈশ্বরকে বাইরে নয়—প্রত্যেক কর্ম, অনুভব ও অভিজ্ঞতার অন্তরস্থ চৈতন্যে উপলব্ধি করতে শেখানো হয়েছে। গীতা এখানে দেখাচ্ছে, কীভাবে জীবনের প্রতিটি সাধারণ ক্রিয়াও—যেমন ভোজন, দান, কর্ম—এক অনন্ত যজ্ঞে রূপান্তরিত হতে পারে, যদি তা ব্রহ্মজ্ঞানে নিমজ্জিত হয়। এই উপলব্ধিই সেই “ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবিঃ” (৪.২৪)-এর পরিণত রূপ—যেখানে কর্তা, কর্ম, করণ, ও কর্মফল—সব একাকার হয়ে যায় ব্রহ্মে।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে নিচের ছয় স্তরের শিক্ষা আসলে এক অনন্ত সত্যের ধাপে ধাপে উন্মোচন—যেখানে বহুতার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক পরম ঐক্য। এখানে কর্তা, কর্ম, উপকরণ, ভোগ্য ও ভোক্তা—সবই সেই এক ব্রহ্মচেতনার বহুমুখী প্রকাশ। গীতার “যজ্ঞ” ধারণা কোনো ধর্মীয় আচারের বৃত্তান্ত নয়; এটি ব্রহ্মের নিজস্ব লীলা, যেখানে অসীম চেতনা নিজেই নিজের মধ্যে উৎসর্গ করছে, নিজেকে নিজের দ্বারা জানছে।

অদ্বৈত বেদান্তের মূল বাণী—“ব্রহ্ম সত্যং জগৎ মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ”—এই উপলব্ধিই গীতার যজ্ঞদর্শনের কেন্দ্রে। জগৎ মিথ্যা মানে এই নয় যে, তা অস্থিত; বরং এর স্বতন্ত্র বাস্তবতা নেই, এটি ব্রহ্মচেতনারই প্রতিফলন। সেই ব্রহ্মই কর্তা, সেই ব্রহ্মই কর্ম, সেই ব্রহ্মই ক্রিয়ার ফল। কর্মের মধ্যে যদি এই ঐক্যবোধ জাগে, তবে প্রতিটি কাজই হয়ে ওঠে আত্মব্রহ্মের আরাধনা।

প্রথম স্তরে গীতা (১৩.১৩)-য় বলা হয়েছে—“সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতো’ক্ষিশিরোমুখম্‌। সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।।” অর্থাৎ, ঈশ্বরের হাত-পা, চোখ-মুখ সর্বত্র বিস্তৃত; তিনি সর্বত্র বর্তমান। এই উপলব্ধি বলে, কর্মে যে-হাত নড়ে, যে-পা চলে, যে-জিহ্বা কথা বলে—সবই সেই এক অদ্বিতীয় চেতনারই যন্ত্র। তখন “আমি দিচ্ছি”, “আমি করছি” এই অহংকার লুপ্ত হয়ে যায়; থেকে যায় কেবল এই বোধ—ঈশ্বর নিজেই ঈশ্বরকে অর্পণ করছেন।

দ্বিতীয় স্তরে, ভোজ্য পদার্থও ব্রহ্ম। গীতা (৯.১৬)-য় কৃষ্ণ বলেন—“অহম্‌ হি হবি, অহমেব আজ্যম্‌।”—“আমি হবি, আমি আজ্য।” অর্থাৎ যা-কিছু অর্পণযোগ্য, যা-কিছু গ্রাহ্য—সবই সেই এক চেতনার রূপ। উপনিষদের বাণীও তা-ই নির্দেশ করে—“অন্নম্‌ ব্রহ্মেত্যুপাসীত”—অন্নকেও ব্রহ্ম বলে জানো, কারণ এটি তাঁরই দৃশ্যরূপ। অদ্বৈত দৃষ্টিতে, দান আর গ্রহণ আলাদা নয়—দানই গ্রহণ, কারণ দাতা ও গ্রহীতা উভয়েই ব্রহ্ম।

তৃতীয় স্তরে, ভোজনকারীও ব্রহ্ম। গীতা (১৫.৭)-য় শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ।”—“জীবাত্মা আমারই চিরন্তন অংশ।” অর্থাৎ, ভোক্তা কোনো পৃথক আত্মা নয়; সে সেই এক চেতনারই অংশ, যিনি ভোগ্য পদার্থে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। এই উপলব্ধিতে কর্তা ও কর্ম, ভোক্তা ও ভোগ্য—সব ভেদ মুছে যায়; থাকে কেবল এক অবিভক্ত সত্তা, যা নিজের লীলায় নিজেকে উপভোগ করছে।

চতুর্থ স্তরে, দেহের ভেতরের অগ্নিও ব্রহ্ম। গীতা (১৫.১৪)-য় বলা হয়েছে—“অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ। প্রাণাপানসমায়ুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্বিধম্‌।”—“আমি জীবদেহে বৈশ্বানর অগ্নি হয়ে চতুর্বিধ অন্ন হজম করি।” আধুনিক ভাষায়, metabolism—এই প্রক্রিয়াটিও চেতনারই ক্রিয়া। দেহ, যা আমাদের কাছে পৃথক এক যন্ত্র বলে মনে হয়, অদ্বৈত উপলব্ধিতে সেটি হয়ে ওঠে ঈশ্বরেরই মন্দির—যজ্ঞমণ্ডপ, যেখানে তিনি নিজেকে নিজেই উৎসর্গ করছেন।