গীতায় অবতারতত্ত্ব: ১



‘অবতার’ শব্দের দার্শনিক ও ঐতিহাসিক প্রয়োগ ভারতীয় ধর্মচিন্তার একটি বিশেষ পর্বে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বৈদিক সাহিত্যে এই শব্দের কোনো উল্লেখ নেই, কারণ সেই যুগে ঈশ্বর বা দেবতা ভাবনাটি ছিল মূলত কসমিক শক্তির প্রতীক—ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, মিত্র প্রভৃতি দেবতা প্রকৃতির শক্তির প্রতিমূর্তি; তাঁরা মানুষের মতো রূপে অবতীর্ণ হন না। কিন্তু ক্রমে যখন চেতনার দার্শনিক বিবর্তন ঘটতে থাকে এবং ঈশ্বরের ভাবনা মানুষের আত্মানুভূতির সঙ্গে যুক্ত হয়, তখনই ‘অবতার’ ধারণা আত্মপ্রকাশ করে।

খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর পরে রচিত পৌরাণিক সাহিত্য—বিশেষত বিষ্ণু পুরাণ, ভাগবত পুরাণ, নৃসিংহ-তাপনীয় উপনিষদ প্রভৃতিতে—‘অবতার’ শব্দটি প্রথম বারের মতো স্বতন্ত্র বিশেষ্যরূপে ব্যবহৃত হয়। এখানে ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করেন না কেবল ব্রহ্মতত্ত্বরূপে, বরং মানবিক রূপে, যাতে মানুষ তাঁর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এই ধারণা গীতার সেই মহান নীতিতে প্রতিধ্বনিত—“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত, অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্‌” (গীতা, ৪.৭) অর্থাৎ, “যখনই ধর্মের অবনতি হয় এবং অধর্মের উত্থান ঘটে, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ (সৃষ্টি) করি।”

অদ্বৈত-দৃষ্টিতে, শ্লোকটি গভীরভাবে প্রতীকী। এটি ঈশ্বরের কোনো ঐতিহাসিক আগমন নয়, বরং এক চেতনার পুনর্জাগরণ। ধর্মের অবনতি মানে মানুষের অন্তরে সত্যচেতনার ক্ষয়, আর অধর্মের উত্থান মানে অবিদ্যার বৃদ্ধি। তাই “আমি নিজেকে সৃষ্টি করি”, এই উক্তি প্রকৃতপক্ষে বোঝায় যে, অনন্ত ব্রহ্ম যখন মায়ার আচ্ছাদনে আংশিকভাবে আচ্ছন্ন হয়, তখন নিজেরই সুষমা পুনরুদ্ধার করতে সেই চেতনা নতুনভাবে জেগে ওঠে।

শ্রীশঙ্করাচার্য বলেন, ঈশ্বর নিত্য, অজ, অবিকৃত। তাই তাঁর কোনো জন্ম নেই। কিন্তু লোকসংগ্রহার্থে (গীতার শ্লোক ৩.২০, ৩.২৫, ৩.২৬)—অর্থাৎ জগৎকল্যাণের জন্য—পরের হিতার্থেই যেন তিনি দেহধারী রূপে প্রকাশ পান। এটি আসলে জন্ম নয়, এক মায়াময় প্রকাশ। যেমন সূর্য আকাশে স্থির থেকেও জলে প্রতিফলিত হয়, তেমনি ঈশ্বর নিজে নেমে না এসে নিজ আলোয় প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করেন।

অদ্বৈত বেদান্তের আলোকে গীতার এই তিনটি শ্লোক—(৩.২০) “কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ”, (৩.২৫) “সক্তাঃ কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত”, এবং (৩.২৬) “ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্”—প্রকৃতপক্ষে কর্ম ও জ্ঞানের অদ্বৈত ঐক্য ব্যাখ্যা করে। এখানে ভগবান কৃষ্ণ যে-নীতির কথা বলছেন, তা কেবল বাহ্যকর্মের প্রশংসা নয়, বরং সেই কর্মের অন্তর্গত চেতনার রূপান্তর। কারণ অদ্বৈত দর্শনে কর্ম নিজে না ভালো না মন্দ—তার প্রকৃতি নির্ধারিত হয় কর্তার চেতনার দ্বারা।

এখানে ভগবানের নির্দেশ কেবল নৈতিক বা সামাজিক কর্তব্যের আহ্বান নয়, বরং জ্ঞানের বাস্তব রূপে কর্মের পরিণতি। “জনক প্রভৃতি রাজারা কর্ম করেই সংসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন”—এই উক্তিটি বোঝায় না যে, কর্মই মুক্তির কারণ; বরং এটি নির্দেশ করে যে, মুক্ত ব্যক্তি কর্ম ত্যাগ করেন না, কারণ তাঁর কাছে কর্ম আর জ্ঞান—দুই-ই এক চেতনার প্রকাশ। অদ্বৈত মতে, “সংসিদ্ধি” মানে আত্মসিদ্ধি—অর্থাৎ সেই জ্ঞান, যেখানে কর্তা, কর্ম ও কর্মফল তিনের ভেদ মুছে যায়। জনক রাজা মুক্ত অবস্থায় থেকেও রাজধর্ম পালন করেছিলেন, কারণ তাঁর দৃষ্টিতে রাজ্য, প্রজা, কর্তব্য—সবই ব্রহ্মেরই প্রকাশ। তাঁর কর্ম কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছার ফল নয়; তা ছিল ঈশ্বর-চেতনার স্বতঃপ্রকাশ, যেমন সূর্য আলো দেয়, বায়ু প্রবাহিত হয়, নদী বয়ে চলে।

শঙ্করাচার্য এই জায়গায় বলেন—“জ্ঞানোত্তরবস্থা অবস্থায়াপি লোকসংগ্রহার্থম্ ঈশ্বরপ্রেরিতঃ কর্মানুস্থানম্।” অর্থাৎ, জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের জন্য নয়, ঈশ্বরের প্রেরণায় কর্ম করেন। অদ্বৈতবাদের ভাষায়, এটি “অহংকার-লয়ের পরের কর্ম”—যেখানে কর্তা নিজেই বিলুপ্ত হয়েছে, কেবল ব্রহ্মচেতনার গতি অবশিষ্ট। সেইজন্যই জ্ঞানীর কর্ম কোনো ফলবদ্ধ ক্রিয়া নয়; এটি লীলা—চেতনার আনন্দ-প্রকাশ। বৃহদারণ্যক উপনিষদের (১.৪.১০ ) “অহং ব্রহ্মাস্মি” উপলব্ধি যখন পরিপূর্ণ হয়, তখন কর্ম হয় না, বরং কর্ম ঘটে; কর্তা থাকেন না, থাকে কেবল কার্যধর্ম। এইভাবে জনকের রাজ্যপালন, কৃষ্ণের উপদেশ, এমনকি ঋষিদের তপস্যাও অদ্বৈত দৃষ্টিতে ব্রহ্মেরই গতিরূপ।

দ্বিতীয় শ্লোকটি এই সত্যকে কর্মযোগের পরিসরে প্রতিষ্ঠিত করে। অজ্ঞান ব্যক্তি ফলের আকর্ষণে কর্ম করেন, কিন্তু জ্ঞানী করেন অনাসক্তভাবে। এই অনাসক্তিই অদ্বৈতের কেন্দ্রীয় নীতি। এই শ্লোকের মূল ভাবটি—অদ্বৈত চেতনার সাক্ষীভাব (sākṣī-bhāva)—এক গভীর অন্তর্দৃষ্টির শিক্ষা। কৃষ্ণ এখানে বলতে চেয়েছেন যে, সাধারণ মানুষ কর্মে লিপ্ত হয় কর্তার অহংকার নিয়ে, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি বুঝে ফেলেন যে, কর্ম হচ্ছে, কিন্তু কর্মের পেছনে কোনো “আমি” নামের কর্তা নেই। কর্ম প্রকৃতির গুণগণের সংঘর্ষমাত্র—“প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ” (গীতা ৩.২৭)। অর্থাৎ, প্রকৃতির তিনটি গুণ—সত্ত্ব, রজ, তম—এই তিনের পারস্পরিক ক্রিয়া থেকেই জগতের সমস্ত কর্ম প্রকাশিত হয়; কিন্তু আত্মা, সেই চিরসাক্ষী সত্তা, কখনোই প্রকৃতপক্ষে কিছু করে না।

অদ্বৈত বেদান্তে এই সত্যটিই ‘অকর্তৃত্ব’—আত্মা না কর্তা, না ভোক্তা; সে কেবল জ্ঞানের আলোকধারা, যার উপস্থিতিতে কর্ম-অকর্মের নানান রূপ প্রতিভাত হয়। যেমন সূর্য কেবল আলো দেয়, কিন্তু আলোয় যা যা ঘটে, তার কোনো দায় সূর্যের উপর পড়ে না; ঠিক তেমনই আত্মা কেবল চেতনা দেয়, কিন্তু কর্ম করে প্রকৃতি। মানুষ বলে “আমি করি”, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি করে, আর ‘আমি’-বোধ তার সঙ্গে লেগে থাকা অজ্ঞানজনিত প্রতিফলনমাত্র। এই ‘আমি’র আবরণই মায়া।

যখন জ্ঞানী ব্যক্তি বুঝে ফেলেন যে, “আমি” আসলে সেই চেতনা—যার মধ্যে কর্ম ঘটছে, কিন্তু আমি নিজে কর্তা নই—তখন তাঁর মন থেকে অহংকার, ফলেচ্ছা ও আসক্তি একেবারে দূর হয়ে যায়। তখন তিনি কর্মে থাকেন, কিন্তু কর্মে লিপ্ত হন না। যেমন আকাশের মধ্যে ঝড়-বৃষ্টি চললেও আকাশ নিজে অক্ষত, অনাহত; তেমনি জ্ঞানীর মধ্য দিয়ে কর্ম চললেও তাঁর অন্তর অনাহত চেতনার শান্তিতে স্থির থাকে।

এই দৃষ্টিই অদ্বৈতের কেন্দ্রীয় অভিজ্ঞতা—“আমি কর্তা নই; আমি সাক্ষী।” এই সাক্ষীভাব আসলে নিস্ক্রিয়তা নয়, বরং এক পরম সতর্ক উপস্থিতি। এই অবস্থায় মানুষ সব কাজ করে, কিন্তু অন্তরে কোনো স্পর্শ পড়ে না। গীতায় এই অবস্থার নামই “নিষ্কাম কর্ম”—যেখানে কর্ম করা মানে ঈশ্বরচেতনার লীলায় অংশ নেওয়া, কিন্তু ফলের প্রতি আকর্ষণ না থাকা।

অজ্ঞান ব্যক্তি ভাবে, “আমি করলে তবেই হয়,” আর জ্ঞানী জানেন, “সবই স্বতঃসিদ্ধ, আমি শুধু তার প্রকাশক্ষেত্র।” এখানেই অহং থেকে অনাসক্তির যাত্রা, আর অনাসক্তি থেকেই অদ্বৈত জ্ঞানের সূচনা। যখন ‘আমি’র সীমা ভেঙে যায়, তখন দেখা যায়—কর্ম, প্রকৃতি, আত্মা—সবই এক চেতনার স্পন্দন, আর সেই চেতনা নিজে নিঃক্রিয়, তবু সর্বক্রিয়ার মূল।

অদ্বৈতের ‘সাক্ষীভাব’ (sākṣibhāva) হলো চেতনার এমন অবস্থান, যেখানে কর্ম ঘটে, কিন্তু সেই কর্মের সঙ্গে আত্মা জড়িত নয়। যেমন আয়নায় প্রতিফলিত ছবি আয়নাকে স্পর্শ করে না, তেমনি কর্মও আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই কৃষ্ণ বলছেন—জ্ঞানের অভাবেই মানুষ ভাবে, “আমি করি”; কিন্তু জ্ঞানী জানেন, “কর্ম আমার দ্বারা নয়, ব্রহ্মের দ্বারা।” অজ্ঞান ব্যক্তি কর্তার অহং-এ জড়িয়ে পড়ে, তাই কর্মফল তাকে বেঁধে ফেলে। জ্ঞানী সেই একই কর্ম করেন, কিন্তু অনাসক্তভাবে, ফলে কর্মও আর বন্ধনসৃষ্টিকারী হয় না। এই অবস্থাকেই শঙ্করাচার্য “অহংকারশূন্য কর্ম” বলেছেন।

এই তৃতীয় শ্লোকের (৩.২৬) মাধ্যমে অদ্বৈত বেদান্তের এক গভীর ও সূক্ষ্ম সত্য প্রকাশিত হয়েছে—জ্ঞান যখন পরিপূর্ণ হয়, তখন সেই জ্ঞানীর হৃদয়ে কেবল প্রজ্ঞা (jñāna) নয়, সঙ্গে সঙ্গে করুণাও (karuṇā) স্বাভাবিকভাবে জেগে ওঠে। কারণ যিনি উপলব্ধি করেছেন—“সবই ব্রহ্ম”, তাঁর কাছে আর কেউ “অন্য” নয়। অজ্ঞ বা জ্ঞানী, গৃহী বা সন্ন্যাসী, কর্মে লিপ্ত বা ধ্যাননিবিষ্ট—সবাই একই চেতনার ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি।

অদ্বৈত জ্ঞানে “ভেদ” মুছে যায়, কিন্তু “ভালোবাসা” গভীর হয়। সেইজন্যই পরম জ্ঞানী কোনো অবস্থাতেই অজ্ঞের সাধনপথ ভেঙে দেন না। তিনি জানেন, প্রত্যেকের সাধনা এক চিরন্তন ব্রহ্মযাত্রার অংশ, যেখানে একেকজন একেক ধাপে অবস্থান করছে। কেউ কর্মযোগের স্তরে, কেউ ভক্তির স্তরে, কেউ জ্ঞানযোগের সীমায়; কিন্তু সবাই একই সত্তার দিকে এগোচ্ছে।

যদি জ্ঞানী ব্যক্তি অজ্ঞের সামনে বলেন, “তুমি যা করছ, তা বৃথা, সবই মায়া”—তবে অজ্ঞের মন বিভ্রান্ত হয়ে যাবে, শ্রদ্ধা হারাবে, সাধনা ভেঙে পড়বে। তাই শঙ্করাচার্য উপদেশ দেন—“অজ্ঞানানাম্‌ বুদ্ধিভেদং ন জনয়েত্‌”—অর্থাৎ, অজ্ঞানদের মানসিক বিভ্রান্তি ঘটানো উচিত নয়।

এখানেই করুণা ও প্রজ্ঞার ঐক্য। জ্ঞানী নিজে জানেন যে, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, তবু তিনি নিজেকে সাধারণ কর্মীর মতো আচরণে রাখেন, কারণ তাঁর কাছে কর্ম আর জ্ঞান আলাদা নয়। তিনি জানেন, কর্মও ব্রহ্ম, অজ্ঞানও ব্রহ্ম, সাধনাও ব্রহ্ম। তাই তিনি কর্ম থেকে পালিয়ে যান না; বরং কর্মের মধ্যে থেকেও স্থিত থাকেন সেই চিরনিষ্ক্রিয় চেতনার শান্তিতে।

‘যুক্ত’ শব্দটির মানে এখানে সেই অবস্থান—যেখানে মানুষ জগতে থেকেও জগতের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। যেমন পদ্মপাতা জলে থেকেও জলে ভেজে না, তেমনি জ্ঞানী ব্যক্তি কর্মের মাঝে থেকেও কর্মে লিপ্ত হন না। তাঁর অন্তরে সর্বদা এক নিস্তরঙ্গ সমবৃত্তি কাজ করে—তিনি জানেন, যা ঘটছে, তা চেতনারই লীলা। তাই তিনি নিজে যুক্ত থেকেও কর্মাতীত। এই যুক্ততা কোনো আসক্তি নয়, বরং সচেতন অংশগ্রহণ—যেখানে করুণা তাঁকে পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত রাখে, আর প্রজ্ঞা তাঁকে আত্মার নিস্পৃহ শান্তিতে স্থির রাখে।

এই শ্লোকের শিক্ষা হলো—সত্যিকার জ্ঞানী কখনও জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন না, বরং জগৎকে আলিঙ্গন করেন সেই একত্ববোধের ভিতর দিয়ে। তাঁর জ্ঞান শুষ্ক দর্শন নয়; তা হয়ে ওঠে করুণার পরম প্রকাশ। এই জন্যই অদ্বৈত জ্ঞান শেষপর্যন্ত কেবল তত্ত্ব নয়, বরং প্রেম, করুণা ও কর্মের নিঃস্বার্থ একীকরণ—ব্রহ্মজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত করুণা-চেতনার সক্রিয় রূপ।

জ্ঞানী ব্যক্তি বাহ্যত কর্মী, কিন্তু অন্তরে তিনি কেবল সত্তা—অকর্তা, অবিকৃত, নিরুপাধি। তাঁর কর্ম আর জ্ঞান ভিন্ন নয়; তাঁর জ্ঞানই কর্ম, আর কর্মই তাঁর জ্ঞানের প্রকাশ। যেমন অগ্নির সঙ্গে তাপ অবিচ্ছেদ্য, তেমনি জ্ঞানীর চেতনার সঙ্গে কর্মের প্রকাশও এক।

এই তিনটি শ্লোক একত্রে অদ্বৈতের এক বিশুদ্ধ দর্শন প্রকাশ করে: কর্মে থেকে কর্মাতীত থাকা, জগতে থেকে জগতের ঊর্ধ্বে ওঠা, কর্তব্য পালন করেও কর্তার অহং ত্যাগ করা। জনক, কৃষ্ণ বা যে-কোনো জ্ঞানী—তাঁদের কর্ম ‘আমি করি’ এই মানসিকতা থেকে নয়, বরং ‘ব্রহ্ম স্বতঃপ্রকাশিত’ এই উপলব্ধি থেকে। সেই উপলব্ধিতেই মুক্তি নিহিত; কারণ যেখানে কর্তা নেই, সেখানে বন্ধনও নেই—যেখানে কর্ম ব্রহ্মচেতনার স্বতঃপ্রবাহ, সেখানেই মুক্তির পূর্ণতা।

তাই দেখা যায়, তিনটি শ্লোকই একই স্রোতে মিশে যায়—কর্ম, জ্ঞান, ও ভক্তির ঐক্যে। জনকের কর্ম ছিল নিঃস্বার্থ কর্তব্য, জ্ঞানীর কর্ম হয় সাক্ষীভাব থেকে, আর করুণাময় কর্ম হয় অন্যদের চেতনা জাগাতে। অদ্বৈত দর্শনে বলা হয়, “কর্ম করোমি, তু কর্ম ন কৃতং ময়া”—একজন জ্ঞানী ব্যক্তি সমস্ত কাজ সম্পাদন করেন, কিন্তু তিনি নিজেকে সেই কাজের কর্তা বা ফলের ভোগী মনে করেন না। “কর্ম ঘটে, কিন্তু আমি করিনি, কারণ “আমি” নামের কোনো পৃথক কর্তা নেই।” কর্ম তখন কেবল ব্রহ্মেরই লীলা।