খাটুশ্যাম

মহাভারতের কাহিনি থেকে আবির্ভূত খাটুশ্যাম বাবাজির আখ্যানটি বলছি।

ভীমের পৌত্র অর্থাৎ ঘটোৎকচের পুত্র বর্বরীক ছিলেন অসাধারণ একজন বীর। রাজস্থানে, বর্বরীক খাটুশ্যাম মন্দিরে খাটুশ্যাম হিসেবে পূজিত হন; এবং গুজরাটে, তিনি বলিয়াদেব হিসেবে পূজিত হন। তিনি সবসময় দুর্বলের পক্ষে লড়াই করার নীতিতে আবদ্ধ ছিলেন, যার কারণে তিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশ না নিয়ে পুরো যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে হাজির ছিলেন। কঠোর তপস্যার বলে বর্বরীক দেবী কামাক্ষ্যার কাছ থেকে শক্তিশালী এক অস্ত্র পান—যা ছিল তিনটি তীর; আবার অগ্নিদেবের উপাসনা করে পেয়েছিলেন দিব্যধনুক। এই তিনটি তীর ও ধনুক দিয়েই তিনি ত্রিভুবনে অজেয় হয়ে ওঠেন। ওই তিনটি তীর শত্রুপক্ষের দিকে নিক্ষেপ করলে চোখের পলকে সেগুলি শত্রুপক্ষকে চিহ্নিত করত এবং মৃত্যুদান করে ফের তূণীরে ফিরে আসত। তবে এখানে একটা শর্ত ছিল: এই অস্ত্র ব্যবহার করে তিনি শুধু দুর্বলের হয়েই লড়াই করতে পারবেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কথা জানতে পেরে বর্বরীক মহাভারত যুদ্ধের সাক্ষী হবার জন্য যুদ্ধে অংশ নিতে চাইলেন। তিনি তাঁর মা রাজকুমারী মৌরভিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যে-পক্ষ হেরে যাবার উপক্রম হবে, তাদের সাথেই তিনি যোগ দেবেন। মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে একটি নীল ঘোড়ায় চড়ে বর্বরীক যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে র‌ওনা হলেন। তিনি যদি পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধে নামতেন‌ও, তবু এখানে একটা সমস্যা ছিল। ওই অস্ত্রে কৌরবদের সকল যোদ্ধাকে ধ্বংস করা গেলেও কৃপাচার্য, ভীষ্ম, অশ্বত্থামার মৃত্যু ঘটানো শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে কৌশলগত কারণেই সম্ভব ছিল না; কেননা, সেক্ষেত্রে কৌরবরা দুর্বল হয়ে পড়ত এবং বর ও মায়ের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বর্বরীককে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতেই হতো।

তাই ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্বরীককে রাস্তায় থামান শক্তি পরীক্ষা করার জন্য; এমনকী তিনি তাঁকে উপহাস করার চেষ্টা করেছিলেন এটা বলে যে, তিনি মাত্র তিনটি তীর নিয়ে অত বড়ো যুদ্ধে যাচ্ছেন! বর্বরীক উত্তর দিলেন, তাঁর একটি মাত্র তীর এক মিনিটেই সমস্ত প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। প্রথম তীরটি সেইসব লক্ষ্যকে চিহ্নিত করবে, যা তিনি ধ্বংস করতে চান। যদি তিনি এরপর দ্বিতীয় তীরটি ব্যবহার করেন, তবে এটি সেসকল লক্ষ্য চিহ্নিত করবে, যা তিনি ধ্বংস করতে চান না। অতঃপর তৃতীয় তীরটি ছেড়ে দিলে, এটি চিহ্নিত সমস্ত লক্ষ্য ধ্বংস করবে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এই বলে যে, তিনি যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, তার পাশের একটি অশ্বত্থ (পিপুল) গাছের সমস্ত পাতা তীরের সাহায্যে বেঁধে দিতে হবে। বর্বরীক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তাঁর প্রথম তীরটি মুক্ত করার জন্য চোখ বন্ধ করে ধ্যান শুরু করেন। তখন কৃষ্ণ বর্বরীকের অজান্তেই গাছের একটি পাতা ছিঁড়ে তাঁর নিজের পায়ের নিচে রাখলেন।

বর্বরীক তাঁর প্রথম তীরটি ছেড়ে দিলে এটি গাছের সমস্ত পাতা চিহ্নিত করে ফেলে এবং অবশেষে কৃষ্ণের পায়ের চারপাশে ঘুরতে শুরু করে। বিস্মিত হয়ে কৃষ্ণ বর্বরীককে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তাঁর পায়ের চারপাশে তীর এমনভাবে ঘুরছে।

বর্বরীক ব্যাখ্যা করলেন যে, তাঁর পায়ের নিচে একটি পাতা আছে এবং তীরটি এটিকে লক্ষ্য করেই ঘুরছে। বর্বরীক কৃষ্ণকে কষ্ট পেতে না চাইলে ওখান থেকে সরে যাবার পরামর্শ দেন। কৃষ্ণ অবিলম্বে তাঁর পা তুললেন এবং অবাক হয়ে দেখলেন যে, প্রথম তীরটি সেই লুকিয়ে-রাখা পাতাটিকে চিহ্নিত করেছে।

যখন তৃতীয় তীরটি শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়া হলো, তখন সেটি কৃষ্ণের পায়ের নিচে লুকোনো পাতাটি-সহ সমস্ত পাতা সংগ্রহ করে এবং সেগুলিকে একসাথে বেঁধে দেয়।

এটা দেখে কৃষ্ণ এই উপসংহারে পৌঁছেন—তীরগুলো এতটাই শক্তিশালী এবং অমূল্য ছিল যে, বর্বরীক তাঁর লক্ষ্যগুলো সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকলেও তাঁর তীরগুলো ঠিক‌ই তাঁর লক্ষ্যবস্তুগুলোকে খুঁজে বের করতে এবং সনাক্ত করতে পারে। এভাবে, কৃষ্ণ বর্বরীকের অভূতপূর্ব ক্ষমতা সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি পান। তিনি তখন বর্বরীককে জিজ্ঞেস করলেন, যুদ্ধে তিনি কার পক্ষে থাকবেন। বর্বরীক জানালেন, যে-পক্ষ দুর্বল, তিনি তার জন্য লড়াই করবেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন, যুদ্ধে কৌরবদের পরাজয় অনিবার্য। কৃষ্ণ তখন বর্বরীকের কাছ থেকে ভিক্ষে প্রার্থনা করেন এবং বর্বরীক কৃষ্ণকে তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী যে-কোনো কিছু দেবার প্রতিশ্রুতি দেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ বর্বরীককে তাঁর মাথাটি দিতে বললেন। বর্বরীক হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি ব্রাহ্মণকে তাঁর আসল পরিচয় প্রকাশ করতে অনুরোধ করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন বর্বরীককে তাঁর ঐশ্বরিক রূপের দর্শন দিলেন। তিনি বর্বরীককে বুঝিয়েছিলেন যে, যুদ্ধের আগে সবচাইতে সাহসী ক্ষত্রিয়ের মাথাটি বলি দিতে হবে। বর্বরীককে শ্রীকৃষ্ণ ক্ষত্রিয় যোদ্ধাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী বলে মনে করতেন এবং তাই তাঁর মাথাটিই দান করাতে চেয়েছিলেন।
কৌরবদের ১১ অক্ষৌহিণীর তুলনায় পাণ্ডবদের মাত্র ৭ অক্ষৌহিণী সৈন্য ছিল, তাই তিনি পাণ্ডবদের তুলনামূলকভাবে দুর্বল বলে মনে করেন এবং তাই তাদের সমর্থন করতে চেয়েছিলেন। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি তাঁর মাকে এমন একটি প্রতিশ্রুতি দেবার আগে (দুর্বল পক্ষকে সমর্থন করার বিষয়ে) এর পরিণতি সম্পর্কে গুরুত্ব সহকারে ভেবেছিলেন কি না। বর্বরীক ধরে নিয়েছিলেন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল পাণ্ডব পক্ষের প্রতি তাঁর সমর্থন তাদের বিজয়ী করবে। কৃষ্ণ তখন তাঁর মায়ের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রকৃত পরিণতি প্রকাশ করলেন।

কৃষ্ণ বললেন, তিনি যে-পক্ষকেই সমর্থন করুন না কেন, তাঁর শক্তির কারণে এই সমর্থন অপর পক্ষকে দুর্বল করে দেবে। কেউ তাঁকে হারাতে পারবে না। অতঃপর, যেহেতু তিনি দুর্বল-হয়ে-পড়া অন্য পক্ষকে সমর্থন করার জন্য পক্ষ পরিবর্তন করতে বাধ্য হবেন (তাঁর মাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কারণে), সে কারণে, একটি প্রকৃত যুদ্ধে, তিনি উভয় পক্ষের মধ্যে দোদুল্যমান পক্ষ নিতেন, অর্থাৎ বারংবার পক্ষ বদলাতে বাধ্য হবেন, যার ফলে উভয় পক্ষের সমগ্র সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত কেবল তিনিই থেকে যাবেন। অবশেষে, কোনো পক্ষের কেউই বিজয়ী হবে না এবং তিনিই একমাত্র বেঁচে থাকবেন। তাই, শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ এড়িয়ে গিয়ে তাঁর মাথা বলিদান করার আদেশ দেন।

ভগবানের আদেশ মেনে নিয়ে বর্বরীক কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে তাঁর মস্তক উৎসর্গ করলেন। তিনি কৃষ্ণের কাছ থেকে এমন বরও পেয়েছিলেন যে, কলিযুগে তিনি কৃষ্ণ হিসেবে পূজিত হবেন। কৃষ্ণ তাঁকে শুধু আশীর্বাদই দেননি, সঙ্গে এটাও ঘোষণা করেছিলেন যে, বর্বরীকের ভক্তরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদ পাবেন এবং হৃদয়ের গভীর থেকে কৃষ্ণ তথা শ্যামের নাম উচ্চারণ করলে তাঁদের মনের সমস্ত ইচ্ছে পূরণ হবে। খাটুশ্যামজি তাই ভক্তদের মনস্কামনা পূরণের জাগ্রত দেবতা।

বর্বরীক অনুরোধ করেছিলেন, যদিও তিনি তাঁর মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন, তবুও তিনি সাক্ষী হয়ে যুদ্ধটি শেষ পর্যন্ত দেখতে চান। শ্রীকৃষ্ণ বর্বরীকের ইচ্ছে মঞ্জুর করেছিলেন। খণ্ডিত মস্তকটি যুদ্ধক্ষেত্রকে উপেক্ষা করে কাছেই একটি পাহাড়ের উপরে রাখা হয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হলে বিজয়ী পাণ্ডব ভাইয়েরা নিজেদের মধ্যে তর্ক করতে থাকেন এটা নিয়ে যে, তাঁদের বিজয়ের পেছনে ভূমিকা কার। এতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই পরামর্শ দেন—বর্বরীকের কাটা-মাথাটি কুরুক্ষেত্রের পুরো যুদ্ধ দেখেছেন এবং তাঁকেই এই বিচারটি করার অনুমতি দেওয়া উচিত। অনুমতি দিলে বর্বরীকের সেই প্রত্যক্ষসাক্ষী-মস্তক দাবি করেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ‌ই পাণ্ডবদের জয়ের নেপথ্যনায়ক ছিলেন, কারণ তাঁর পরামর্শ, উপস্থিতি, কূটকৌশল এবং যুদ্ধের পরিকল্পনা ছিল জয়ের জন্য অপরিহার্য। উল্লেখ্য, গীতার বাণী শোনার মহাসৌভাগ্য যে-কয়জনের হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে বর্বরীকও ছিলেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর মস্তক দান করার কারণে খাটুশ্যামজি শীশ কে দানি (মাথার দাতা) নামেও পরিচিত। এ ছাড়াও তিনি অঞ্চলভেদে এইসকল নামেও পরিচিত: হারে কা সাহারা (পরাজিতদের সমর্থন)—হারে কা সাহারা, খাটুশ্যাম হামারা [আমরা দুশ্চিন্তায় আছি, কিন্তু আসুন, চিন্তা না করি; খাটুশ্যাম আমাদের সাথে আছেন!]; তিন বাণধারী (তিন তীরের বাহক); লাখা-দাতারি (মহান দাতা); লীলা কে আসওয়ার (লীলা ঘোড়ার সওয়ার); খাটু নরেশ (খাটুর রাজা); কলিযুগ কে অবতার (কলিযুগের ঈশ্বর); শ্যাম পেয়ারে (প্রিয় শ্যাম); বলিয়া দেব (দেব যিনি নিজেকে বলি দিয়েছেন); মোরচাদিধরক (ময়ূরের পালকের তৈরি লাঠির বাহক); শ্যাম বাবা (মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত নাম); বারিশ কা দেবতা (বৃষ্টির ঈশ্বর); ইয়ালাম্বার (ইয়ালাম্বার ছিলেন একজন কিরাত যোদ্ধা এবং নেপালের কিরাত রাজ্যের প্রথম রাজা); আকাশ ভৈরব (আকাশের (শিব) ঈশ্বর); সাভা ভক্কু দেব (আকাশের অভিভাবক); ওয়াঙ্গা দিয়া (আকাশসুরক্ষার ঈশ্বর); হাতু দিয়া (বিশুদ্ধ মদিরা ঈশ্বর—যিনি আশীর্বাদস্বরূপ মদ দেন); আজু দিয়াঃ (পূর্বপুরুষের ঈশ্বর)।

কলিযুগ শুরু হবার বহু বছর পর, বর্তমান রাজস্থানের খাটু (সীকর জেলায় অবস্থিত) গ্রামে মাথাটি সমাহিত করা হয়েছিল। কলিযুগ শুরু হবার পর পর্যন্ত স্থানটি অস্পষ্ট ছিল। তারপর, একদিন এক গরুর থোকা থেকে দুধ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রবাহিত হতে শুরু করে…যখন‌ই সে সমাধিস্থলের কাছাকাছি আসে। এ ঘটনায় বিস্মিত হয়ে স্থানীয় গ্রামবাসীরা জায়গাটি (বর্তমানে ‘শ্যামকুণ্ড’ নামে পরিচিত) খুঁড়লে মাটিচাপা-পড়ে-থাকা মাথাটি প্রকাশ পায়। মাথাটি একজন ব্রাহ্মণের কাছে হস্তান্তর করা হয়, যিনি অনেক দিন ধরে তাঁর পূজা করেছিলেন—পরবর্তীতে কী করা হবে, তা সম্পর্কে ঐশ্বরিক প্রকাশের অপেক্ষায়। খাটুর রাজা রূপসিং চৌহান তখন স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে একটি মন্দির স্থাপন করেন এবং ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে মন্দিরে প্রতিমাস্থাপন করা হয়। উল্লেখ্য, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে বর্বরীক জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ফাল্গুন মাসের দ্বাদশী তিথিতে তিনি তাঁর মাথা (শীশ) কৃষ্ণকে দান করেছিলেন।

খাটুশ্যাম বাবাজি অনেক পরিবারেই পারিবারিক দেবতা হিসেবে পূজিত হন। বাংলাদেশের ফরিদপুরে গত ত্রিশ বছর ধরে প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে খাটুশ্যাম বাবাজি পূজিত হয়ে আসছেন। সেদিন রাত্রিব্যাপী ভজন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেহেতু ভক্তরা ঐতিহ্যগতভাবে সম্মিলিতভাবে রাত্রিযাপন করেন। ভক্তরা ভজন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং ভজন গায়কদের ভক্তিমূলক গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের লোকজন মহাউৎসবমুখর ও আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে খাটুশ্যামজিরূপী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা করেন। পুজোয় জন্মাষ্টমীর মতো করে ভগবানের প্রিয় ৫৬ রকমের ভোগ নিবেদন করা হয়। সারারাত ধরে ভজনসংগীত ও নানান প্রসাদাস্বাদনের মহাআয়োজন চলতে থাকে, ভোররাতের দিকে সবাই মিলে বড়ো আনন্দ নিয়ে আবির খেলে। প্রাণের এমন মিলন সত্যিই খুব দৃষ্টিনন্দন এবং সুন্দর অনুভূতির জন্ম দেয়।

মারোয়াড়িদের এই ধর্মীয় উদ্‌যাপনটি কতটা যে চমৎকার, চোখে না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না। তাঁদের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন পদের সুস্বাদু খাবার, নিজস্বতায় সমৃদ্ধ কৃষ্টি-সংস্কৃতি, অপূর্ব আতিথেয়তা, আবেগপূর্ণ বর্ণিল অংশগ্রহণ—এসব অনুষঙ্গ আপনাকে সারারাত ঘুমোতেই দেবে না। ঘুমোলেই নিশ্চিতভাবে মিস করবেন! ভারত থেকে আগত ভজনসংগীতের শিল্পীরা রীতিমতো মাতিয়ে রাখেন, মাতাল করে রাখেন। বিশেষ করে, অভিজিৎ কোহারের কথা তো আমি ভুলতেই পারব না! একজন আর্টিস্ট ক্লান্তিহীনভাবে হাসিমুখে ৫০-৬০টা ভজন পরিবেশন করে গেছেন এবং তাঁর পারফরম্যান্স উপস্থিত সকলের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে—এমন ঘটনা তো ক্বচিৎ ঘটে। আমি ভীষণভাবে মুগ্ধ হয়েছি অভিজিতের ভজন শুনে ও দেখে। আমি সাধারণত নিজ থেকে কার‌ও সাথে সেলফি তুলি না, তেমন একটা আগ্রহবোধ করি না। তবে সেদিন নিজেই অভিজিতের পাশে গিয়ে সেলফি তুলেছি—তাঁকে অনুরোধ করতে আমার ভালো লেগেছে। ওই রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি, তা নয়; বরং এভাবে বলি, ফাগুনের সেই একাদশীর পুণ্যতিথিতে উৎসবের মহাস্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে নিতে পেরে যে-অভিজ্ঞতা আমার ঝুলিতে জমা হয়েছে, তা মনে করে বহু বহুদিন ধরে সুখ ও উত্তেজনা অনুভব করব।

তাঁদের আতিথেয়তা, সম্মানপ্রদর্শন, আন্তরিকতা কখনোই ভুলব না; মনে হয়েছে, আমিই হোস্ট—গেস্ট ন‌ই, ওখানে আমার পরিবারের লোকজন‌ই রয়েছেন। এ আমার‌ই কৃষ্ণোৎসব, অস্তিত্বের প্রিয় অংশ। উৎসবের আয়োজন করেছেন যিনি, তাঁকে আমি ‘মামা’ ডাকি। মামা আমাকে বেশ কিছু উপহার দিয়েছেন, সেগুলির মধ্যে নাড়ুগোপালটি কী যে সুন্দর আর নান্দনিক, লিখে বোঝাতে পারব না। সামনের বার নিমন্ত্রণ না করলেও সময়মতো ঠিক ঠিক গিয়ে হাজির হয়ে যাব। ফ্যাকাশে এই জীবনটাকে একটু হলেও রঙিন করে যা-কিছু, আমার কাছে তা-ই ধর্ম।