কালীকে ভগবানের সর্ববিজয়িনী শক্তিরূপে অর্চনা করা হয়। প্রতিমায় আমরা দিগম্বরী কালীকে দেখি শায়িত-শান্ত-সমাহিত শিবের উপর দণ্ডায়মানা অবস্থায়। তিনি লোলরসনা, কৃপাণপাণি, নৃমুণ্ডুমালিনী, ভীষণা, ভয়ক্ষরা, আবার বরাভয়দায়িনী। শিব একদিকে যেমন রুদ্র, আবার তিনি প্রশান্ত, মঙ্গলময়। এ যেন মহাশান্তির উপর পরাশক্তির প্রতিষ্ঠা, তাই কালীর ধারক ও আশ্রয় শিব। পৃথিবী হতে ভগবদ্বিদ্রোহী দানবদলকে নির্মূল করে, জগৎকে অন্যায়, অবিচার, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা ও কলুষমুক্ত করে মর্ত্যের বুকে সত্য, সুষমা, সামঞ্জস্য, শান্তি, প্রেম ও কল্যাণকে প্রতিষ্ঠা করার কাজ এই মহাশক্তি কালী করে চলেছেন।
কালীমূর্তি মৌনী ভাষায় ইঙ্গিত দিচ্ছেন—রসনাকে সংযত করো, লোভকে পরিহার করো। বাক্সংযমের অভাবে ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে যে-অনর্থের সৃষ্টি হয়, তা ভয়াবহ। অসুরের প্রতি কালীর প্রচণ্ড আক্রোশ। যারা ভগবদ্ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সত্য ও জ্যোতির বিধানকে যারা উপহাস করে, তাদের উপর তিনি নির্মম আঘাত হানেন। তিনি চূর্ণ করেন অহংকারীর দর্প। উৎপীড়কদের বাধ্য করেন তাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে। জলপ্লাবন, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিবাত্যা, বিপ্লব ও বিদ্রোহ—এসবের পেছনে রয়েছে কালীশক্তির ক্রিয়া। জগতের এবং মানুষের পরিবর্তনের জন্য এই সমস্ত সংঘটিত হয়। হিন্দুরা এমন বিশ্বাস ধারণ করে।
বাংলাদেশ শক্তিসাধনার পীঠভূমি। বাংলার দেশপ্রেমিকেরা, দেশসেবকেরা বাংলাকে জানেন মা রূপে। দেশ শুধু মাটি-পাথরের জড় পদার্থ নয়। মাতৃভূমি চৈতন্যশক্তির প্রতিভূ। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে স্বদেশ সকলেরই মা।
হেমন্তের শিশিরসিক্ত অমাবস্যার নিশীথ-রাতে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। সারাজগত যখন সুপ্তিমগ্ন, স্বপ্নবিভোর—মাতৃপূজারী ও সাধক তখন জেগে ওঠেন মায়ের অর্চনায়, আরাধনায়। সাধকের দৃষ্টিতে অনন্ত আঁধারে মায়ের দিব্যজ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়। মাটির প্রতিমায় চিন্ময়ী মায়ের আবেশ হয়। রক্তজবা কালীর প্রিয় ফুল; এই ফুল শক্তির প্রতীক। তন্ত্রসাধনায় কালী পরাৎপরা শক্তি। কালীর রয়েছে বিবিধ রূপ। বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নভাবে তাঁর প্রকাশ। মহাযোগী মাতৃসাধক সত্যদ্রষ্টা শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন, "অধিমানস স্তরে মহাকালী হিরন্ময়ী।" সাধক রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ, বামাক্ষ্যাপা এবং আরও অনেক সিদ্ধযোগী কালীর দর্শন পেয়েছেন, কালীর সাথে একাত্ম হতে পেরেছেন।
শ্রীঅরবিন্দের মধ্যেও হয়েছিল কালীর আবেশ এবং অধিষ্ঠান। অধ্যাত্মসাধনায় ত্বরিতগতিতে যাঁরা এগিয়ে যেতে অভিলাষী, কালীশক্তির কৃপা তাঁদের জন্য বিশেষ সহায়ক। কালী শক্তিমানদের পূজিতা ও আরাধ্যা, কিন্তু দুর্বলেরা তাঁকে ভয় করে। হিন্দুশাস্ত্রে আছে, দুর্বলেরা আত্মাকে অর্থাৎ ভগবানকে লাভ করতে পারে না। মিথ্যার যারা দাসত্ব করে, শান্তি তাদের জন্য নয়। স্বাধীনতা তাদের কাছে স্বেচ্ছাচারিতা, ফলে তাদের উপর আসে মহাকালীর প্রচণ্ড আঘাত।
মানবজীবনকে বিষাক্ত ও ক্লিষ্ট করে তুলেছে তার হঠকারিতা, মিথ্যাচার, কপটতা। জীবন হতে পারত সম্পূর্ণ সরল ও সহজ, যদি মানুষের মন তার মধ্যে নিয়ে না আসত অনাবশ্যক সব জটিলতা। ভগবদ্বাণী শুনতে ও বুঝতে হলে মনকে করতে হবে প্রশান্ত, অচঞ্চল। বুদ্ধদেব বলেছেন, "মানসিক চাঞ্চল্যের মতো দুঃখ-দুর্ভোগ আর নেই।" অচঞ্চল-স্থির-প্রশান্ত মনের মধ্যেই আসতে পারে সত্যের জ্যোতি।
সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দোষদুষ্ট মনোভাবের বহুঊর্ধ্বে আসীন কবি নজরুল অপূর্ব সব শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন। একটি গানে তিনি লিখেছেন, "বল রে জবা, বল, কোন সাধনায় পেলি শ্যামামায়ের চরণতল…" আরেকটি গানে আছে: "কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন…" এমন আরও অপূর্ব সব ভগবদ্-সুরসৃষ্টি নজরুলের আশ্চর্য অবদান।
তাঁকে অনুভব করে সাধক রামপ্রসাদ গেয়েছেন: কালো রূপ অনেক আছে, এ বড়ো আশ্চর্য কালো, যারে হৃদ্মাঝারে রাখলে পরে হৃদয়পদ্ম করে আলো।
শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাস ও ঐকান্তিক আকুলতায় যে-নামেই, যে-রূপেই ঈশ্বর কিংবা তাঁর শক্তিকে আহ্বান করা হোক না কেন, তিনি ভক্তের বিশ্বাস ও গ্রহণসামর্থ্য অনুযায়ী সাড়া দিয়ে থাকেন। পৃথিবীর কোনো ধর্মপ্রবর্তকই কারও ধর্মবিশ্বাসের উপর আঘাতদানের উপদেশ বা নির্দেশ দেননি। ভগবানের কৃপা সকলের উপর সমভাবে প্রসারিত। তাঁকে জানার, লাভ করার রয়েছে বিভিন্ন পথ, বিভিন্ন সাধনপদ্ধতি। এই পদ্ধতিগুলির মধ্যেও সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। তাই এসব নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ায় কেবলই বিপথগামী নির্বোধেরা।
সাধারণত পার্থিব বাসনা-কামনা পূরণের অভিলাষে এবং আপদ-বিপদ ও সংকটমুক্ত হয়ে সুখী-সমৃদ্ধ জীবনযাপনের জন্য লোকে কালীপূজা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষের প্রার্থনা মা পূর্ণ করেও থাকেন, কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের মতো কালীপ্রতিমার সামনে গিয়ে ধন-সম্পদের পরিবর্তে আর কে প্রার্থনা করতে পেরেছে: "মা, আমাকে তুমি জ্ঞান-বিবেক-বৈরাগ্য দাও।"! পার্থিব সুখ-সম্পদ-সৌভাগ্য'কে অস্বীকার করে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের বিদূষী স্ত্রী মৈত্রেয়ীর মতো স্বামীকে আর কে বলতে পেরেছে: "যা দিয়ে আমি অমৃতকে পাবো না, তা দিয়ে আমি কী করব?"!
নশ্বর বস্তুর প্রতি মানুষের অন্ধ আসক্তি ও আকর্ষণ তাকে বঞ্চিত করে রেখেছে তার অমর সত্তার নিত্যসান্নিধ্য থেকে। একদিন বৈদিক ঋষির অন্তর হতে হয়েছিল উদ্গীত: "আমাকে অসত্য হতে সত্যে, অন্ধকার হতে জ্যোতিতে, মৃত্যু হতে অমৃতে নিয়ে যাও।" অন্তরের নিবিড় প্রার্থনার দ্বারা মানুষ কলুষ-কালিমামুক্ত হয়ে উঠতে পারে; হয়ে উঠতে পারে স্বর্গের মানুষ, সত্যের মানুষ, দিব্যমানুষ।
মানুষের আয়ুষ্কাল সীমাবদ্ধ। অনন্তকাল ধরে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। যে বিশেষ অর্থে আমাদের জীবনটা আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে, সে সম্বন্ধে আমরা মোটেই সচেতন নই। সবসময়ই আমাদের চেতনা থাকে মায়াচ্ছন্ন, তমসাবৃত, অনৃতশাসিত। জাগতিক সুখ-দুঃখের নিগড়ে আত্মবিস্মৃত হয়ে, শত সমস্যা-জর্জরিত জীবন নিয়ে আমরা কালক্ষেপণ করি। তাই আমরা অপরা-প্রকৃতি ও রাক্ষসী মায়ার হাতে লাঞ্ছিত। অচিৎ-সত্তার আবরণে আজ ঢাকা পড়ে আছে আমাদের চিরন্তন ভগবদ্-সত্তা। সত্যের স্বরূপকে আবিষ্কার করতে পারলে আমরা জীবনে লাভ করতে পারি অমৃতত্ব, পরম আনন্দ, মুক্তির শান্তি। ভগবদ্ সাযুজ্যের আনন্দের কাছে জাগতিক সুখ, আরাম, ভোগ অতি তুচ্ছ।
জগদ্জননীর সাথে চেতনার সংযোগের ফলে আসে আমাদের প্রকৃত মুক্তি, মোক্ষ, আনন্দ ও শান্তি। মায়ের কৃপাতে নির্বাণও লাভ করা যায়। আর এই যে নতুন যুগের দাবি মানবজীবনের রূপান্তর এবং দিব্য মানবগোষ্ঠীর আবির্ভাব, তা-ও সম্ভব হবে ভগবদ্শক্তির করুণায়। মায়ের চরণে আত্মসমর্পণের ফলে আসে মায়ের সাথে অন্তরের সংযোগ। ভক্তি ও ভালোবাসা দ্বারা আত্মসমর্পণ পূর্ণতা লাভ করে।
জগদীশ্বরীর বিভিন্ন রূপের মধ্যে কালী প্রলয়ঙ্করী শক্তি। ঐকান্তিক ভক্তি, নিষ্ঠা ও বিশ্বাসে পূজা করলে প্রতিমায় মায়ের প্রাণাবেশ ঘটে। প্রতিমাও যেন কথা বলেন, যদি আমরা তাঁর দিকে হৃদয়কে মেলে ধরতে পারি। সকল ধর্ম বিশ্বাস করে, ভগবান রয়েছেন সবখানে। প্রতিমায় তিনি নেই, এই অন্ধধারণা ভগবানের সবখানে বিদ্যমানতাকে উপহাস করে। আসল কথা, ঈশ্বরকে সর্বজীবে, সর্বভূতে দর্শন করার দৃষ্টিলাভ করতে হবে এবং তা সাধনা ও ভগবদ্কৃপাসাপেক্ষ। স্থূল দৃষ্টির দ্বারা সত্যকে দর্শন করা যায় না।
সৃষ্টির প্রগতি এগিয়ে চলেছে তার দিব্য পরিণতি ও সার্থকতার দিকে। ভগবানের ইচ্ছাকে তিমিরাচ্ছন্ন এই সংসারে সার্থক করে তোলার জন্য কালীশক্তির রয়েছে বিশেষ কর্তব্য। মর্ত্যের বুকে যে সত্যের চেতনা ও দিব্য জীবনকে প্রকট করে ধরতে হবে, তার জন্য কালীশক্তির উৎস অতিমানস শক্তি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং পৃথিবীর রূপান্তরের কাজ নিত্য সংঘটিত হয়ে চলেছে। একে বাধা দিয়ে রুখে দেবার সাধ্য কারও নেই। ভগবান সুদূরের বস্তু নন, তিনি রয়েছেন সমগ্র বিশ্বকে জড়িয়ে; তাঁকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। সময় এসেছে; এই যুগের ডাক—অতিমানস ভগবদ্শক্তির সাথে মিলে গিয়ে তাঁকে সহযোগিতা করো, যদি চাও জীবনের রূপান্তর ও অনন্ত প্রগতি।
কালীর কাছে তাঁর চরণে আমাদের প্রার্থনা, তিনি যেন জগৎ হতে সমস্ত পাপ, মিথ্যাচার ও আসুরিকতার বিলোপসাধন করে পৃথিবীতে নামিয়ে নিয়ে আসেন পরম আনন্দ ও শান্তি। তাঁর কৃপায় জগত মধুময় হয়ে উঠুক, সকল সত্তা সেই দিব্যচেতনা লাভ করুক, যার ফলে আসবে পরম সুখ ও শান্তি।