এক। আমার খুব ইচ্ছে করে, তোমার সঙ্গে গল্প করি। আমার খুব ইচ্ছে করে, তোমার গল্প শুনে হাসি। আমার খুব ইচ্ছে করে, তোমার কাছে সবই বলি। অথচ আমার প্রতিটি দিনই ঠিক এইভাবেই কাটে... দিনের শুরু কি শেষ, দুই-ই হয় তোমায় ছাড়া। এত বছর পরও, আজও এসব ভাবি ছবির ফ্রেমে ফুলের মালায় তোমায় আটকে রেখে। দুই। জীবনটা কেন যে এরকম, বুঝি না। যে বোঝে, সে থাকতে পারে না; যে বোঝেই না, সে-ই লেপটে থাকে। আমার চোখে-ঠোঁটে-গালে তুমি লেগে আছ। আমার আঙুলে-হাতে-কাঁধে তুমি লেগে আছ। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা এসে চোখে-মুখে পড়লে তোমায় ভাবি... অদ্ভুত রকমের ভালো লাগে। তিন। যে কবিতার বইটি থেকে মুখে-আঙুল-রাখা তোমায় কবিতা পড়ে শোনাচ্ছিলাম, ওটি আমার হাঁটুর পাশে আধখোলা পড়ে আছে। তুমি তখনও ঘুমিয়ে আছ আমার কোলে মাথা রেখে। তোমার বাঁ হাতের তর্জনীর কিছুটা মুখের ভেতরে। সারামুখে ছড়ানো বিস্রস্ত চুলের রাশি। সারাচোখে ছড়ানো নির্ভার, নিরুত্তাপ ঘুম। ঘুম ভেঙে এইসব দেখছিলাম। দেখে দেখে তোমার চুলে বিলি কাটছিলাম। যারা দুর্ভাগা, ওরা কেবল স্বপ্নেই এমন করে ঘুম ভাঙতে দেখে। চার। আমি ক্ষয়ে যাচ্ছি, আমি বালির মতন ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছি। নিজেরই আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ক্ষয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, বহুবছর ধরে তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি। ছটফট করতে করতে আমার ভেতরে যন্ত্রণা হচ্ছে। যন্ত্রণা বাড়ছে। ব্যথায় নীল হয়ে উঠছে সমস্ত অনুভূতি, ভাবনা। আজ আমার হৃদয় কেবলই জলের প্রতীক্ষায়। পাঁচ। যখন আমরা আর বুঝতে পারি না, আমাদের কী করতে হবে, খুব সম্ভবত তখনই আমরা আসল কাজটি শুরু করি। যখন আমরা আর বুঝতে পারি না, আমাদের কোন পথে যেতে হবে, খুব সম্ভবত তখনই আমরা আসল যাত্রাটি শুরু করি। যে মন পড়ে না সাগরে, সে কি আর সাঁতার শেখে? যে স্রোত পায় না বাধা, সে কি আর চলতে শেখে? ছয়। ওদের জন্য মানুষ অপেক্ষা করে থাকে, তাই ওরা রাত জাগে। ওদের কথা শোনার জন্য মানুষ অপেক্ষা করে থাকে, মানুষের কথা শোনার জন্য ওদের অপেক্ষা করে থাকতে হয়, তাই ওরা রাত জাগে। আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকে না। আমিও কারও জন্য অপেক্ষা করে থাকি না। আমার যা কথা, তার সবই নিজের সঙ্গে। তবুও আমি কেন রাত জাগি? সাত। তুমি ছিলে না… এটা ভাবতে মন কখনোই চায় না। তুমি থাকবে না… তা-ও ভাবতে মন চায় না। ইদানীং সবই মিথ্যে মনে হয়! অথচ এই যে তুমি আছ… এটাই হয়তোবা সবচেয়ে বড়ো মিথ্যে! আট। ছাদে কিংবা বারান্দায় যাও। একটু একা হও। চোখটা বন্ধ করে দু-হাতে নিজেকে জড়াও। লম্বা করে নিঃশ্বাস নাও। বৃষ্টিতে ভেজা ফুলগুলির সব ঘ্রাণ তোমাকে দিয়ে দিলাম… তোমার বুকের ভেতরে হার্টটা যেখানে রক্ত পাম্প করছে, অক্সিজেন পাঠিয়ে দিচ্ছে সমস্ত শরীরে, সেই অক্সিজেনে মিশে থাকবে ফুলের সবটা ঘ্রাণ… তোমার নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে আজ শুধুই ফুলের ঘ্রাণ… নয়। যা-কিছুতে আমার যত ভয়, তার প্রতিটিই স্পর্শের অতীত। ভাবনা। কথা। ভুলবোঝাবুঝি। ভালোবাসা। যৌনতা। আঘাত। অনিশ্চয়তা। এইসব আমি আমার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করি। তবু খুব চেষ্টা করেও ওদের কাউকেই আমি ছুঁতে পারি না, দেখতে পারি না। এ কারণেই আমার মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে তীব্র অস্তিত্বগুলি অনস্তিত্বের একেকটা রাজ্য। দশ। আমাকে ফেলে এভাবে চলে গেছ, এটা যখনই মাথায় আসে, তখন কী-একটা তীব্র ক্রোধ এসে ভর করে সমস্ত শরীরে ও মনে, তার সঙ্গে অসীম অভিমান... অভিমানটা তোমাকে ভেবে ভেবে এমনভাবে বাড়তে থাকে, যেন তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ, কিংবা যেন ওতে তোমার কিছু এসে যায়! এগারো। কষ্ট পেয়েছ? কথাগুলো খুব কঠিন শুনতে হয়েছে! কী বলব! তোমার ধৈর্য দেখে অবাক হই। তোমার ভালোবাসার ধরন দেখেও অবাক হই। এভাবে কে ভালোবাসতে পারে! আমাকে সহ্য করতে পারে, আমার এত অপূর্ণতা গ্রহণ করতে পারে! আমার এত 'না' নিতে পারে! আমার মনে পড়ে না, এত বছরে আমি তোমাকে কোনও ব্যাপারে দশবার 'হ্যাঁ' বলেছি কি না! কখনও তোমার কোনও কথা রেখেছি কি না! মাঝে মাঝে মনে হতো, তোমাকে ভালোবাসি বলাটাও আমার উচিত না। আমার মতন এত শুকনো করে কেউ ভালোবাসে কি না আমার জানা নেই! আর সেটা কেউ এভাবে গ্রহণ করে আসতে পারে দীর্ঘসময় ধরে, তোমাকে না দেখলে তা বুঝতাম না। বারো। যদি জানতাম, এভাবে তোমাকে হারিয়ে ফেলব, তবে সেই সময়গুলিতে না ঘুমিয়ে তোমাকে আরও একটু বেশি করে দেখে নিতাম। এখন কেবল ঘুমিয়েই কাটাই। ঘুমিয়ে পড়লে তুমি রোজ স্বপ্নে এসে পড়ো। তেরো। অনেক দিন হয়ে গেল, চলে গেছ। তবু আজও এক তুমি বাদে আর কাউকেই ভালোবাসতে এ হৃদয় শিখল না। চৌদ্দ। আজ হঠাৎ পাখিরা চুপ! যেন ওরাও জেনে গেছে, তুমি চলে গেছ! এই শব্দহীনতার শব্দে নিজের হৃৎস্পন্দন গুনি। পনেরো। তুমি আমাকে ভালোবাসো, এর চাইতে বড়ো সৌভাগ্য আর নেই। তোমার সঙ্গে একই ছাদের নিচে আমাকে বাঁচতে হয় না, এর চাইতে বড়ো সৌভাগ্য আর নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি...দূর থেকে, দূরে সরে থেকে। ষোলো। হ্যাঁ, তোমাকে খুব মনে পড়ে। এতটাই মনে পড়ে, নিজের অস্তিত্বের একটা টুকরো হঠাৎ হারিয়ে গেলে ঠিক যেমন হয়। জানি, জীবন তবু এগোয়। এ-ও জানি, আমার জীবনটা তোমাকে রেখে কখনোই এগোয় না। সতেরো। অনেক দিন পর, তুমি সেদিন আমাকে কিছু সময়ের জন্য, আমার নিজের মতো করে বাঁচতে দিয়েছিলে তোমার অস্তিত্বের একটা অংশ দিয়ে। তোমাকে ধন্যবাদ। আঠারো। যদি জানতে চাও, বিগত দিনগুলির সমস্ত কষ্ট, বিগত দিনগুলির সমস্ত গ্লানি, বিগত দিনগুলির সমস্ত কান্না মুছে ফেলে বাঁচতে চাই কি না, তবে উত্তর দেবো, চাই না যদি সেসবের সাথে তোমার স্মৃতিকেও মুছে ফেলতে হয়। উনিশ। দুঃখ হচ্ছে সেই নীরবতা, যা তোমার সমস্ত কণ্ঠে এসে ভর করে ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন তুমি বুঝে যাও, তোমার দুঃখ বোঝার মানুষটি আর নেই। বিশ। ইদানীং প্রায়ই জ্বর হয়। জ্বর হলে কোত্থেকে যেন তুমি এসে পড়ো! ইদানীং জ্বর কমলেই আমার ভীষণ কান্না পায়। আমার সুস্থতা লাগবে না, আমার শুধুই তোমাকে লাগবে।