“বাই, জেনি।” হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে ব্যাগট্যাগ-সহ সিজান বেরিয়ে এল বাইরে। জেনিও চলে গেল। ওর আবার পাসপোর্ট না ভিসার ব্যাপারে যেন কী কাজ আছে।
প্লেনেই আলাপ ওর সাথে। দারুণ স্মার্ট মেয়ে। এশিয়া ঘুরতে বেরিয়েছে। একাই কথায় কথায় ও যখন বলল, দিল্লিতে নয়, ঢাকাতেই নামবে, অবাক হয়েছিল সিজান। বলে কী! এশিয়াতে বাংলাদেশের কথাই ওর আগে মনে পড়ল? পরে বলেছিল, আসলে তা নয়। ওর এক পেনফ্রেন্ড আছে ঢাকায়, তার আমন্ত্রণেই প্রথমে বাংলাদেশে যাচ্ছে জেনি, মিস জেনিফার রেনল্ড।
গমগম করছে লাউঞ্জের ভেতরটা। এখানে-ওখানে ছোটো ছোটো জটলা। ভেতরের আওয়াজে মাইক্রোফোনের ঘোষণা শোনার উপায় নেই। ঢাকা।
কোথায় যাব এখন? ভাবল সিজান। বাসাতেই উঠব প্রথমে? না কি অফিসেই ফিরব সটান? ঘড়ি দেখল। নাহ্, অফিস-আওয়ার এখনও শেষ হয়নি। তাহলে যাওয়া যায়। দেখা যাক।
জেনির মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। দারুণ সপ্রতিভ মেয়ে। ইতোমধ্যেই ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেছে। আর আমেরিকাতে তো সেই ছোট্টবেলা থেকেই। এবার এশিয়া। আফ্রিকাতেও নাকি যাবে। থাকে, অনেকের দেশ-বিদেশে ঘোরার বাতিক থাকে…মনে মনে স্বীকার করল সিজান।
অবশ্য ওর নিজের এ বাতিক ছিল না কোনোদিনই। ছোটোবেলায় মা-বাবা সুন্দরবন দেখতে গিয়েছিলেন। সিজান তখন নয় বছরের। সে যায়নি তাঁদের সাথে। একবার শুধু খালার বাড়িতে ছিল পাকা আঠারো দিন। ছিল, কিন্তু এখনকার সিজানের সাথে সে সিজানের অনেক তফাৎ।
আশফাকুর রহমান সিজান এখন এক বিদেশি বিজনেস ফার্মের বড়ো অফিসার। এখন তাকে লন্ডন, হংকং, নিউইয়র্ক করেই বেড়াতে হয়। কাজ আর কাজ। কাজের কি অভাব আছে? এই তো দু-সপ্তাহ কাটিয়ে এল আমস্টার্ডামে। ফিরল আজ। কল্পনায় জেনিকে বিচার করল সিজান। চেহারাটা তো সুন্দরই। ফিগারটাও আকর্ষণীয়। তদুপরি ফ্রাঙ্ক। এককথায় বেশ চার্মিং। সিজান মনে মনে বুঝল, জেনিকে ভালো লেগেছে ওর।
একটু পরেই মনে হলো, জেনি আমেরিকান মেয়ে। ধ্যুৎ শালা, ওদের আবার চরিত্র-ফরিত্র থাকে নাকি? যত্তসব! এরচে বরং, হ্যাঁ, মিলু অনেক ভালো। কেমন চঞ্চল, ভালো, লক্ষ্মী মেয়ে। সিজানের মনে পড়ল, যাবার আগে ও বলে গিয়েছিল, এবারের ট্যুরটা শেষ হোক। ফিরে এসেই তোমাকে বউ বানাব, তুমি দেখে নিয়ো। মিলু কিছু বলেনি তখন। শুধু শার্টের বোতাম নাড়তে নাড়তে মিষ্টি হেসেছিল। হাসলে ওকে দারুণ সুন্দর লাগে।
চারপাশে তাকিয়ে বোকা বনে গেল সিজান। মানুষের কথাবার্তার গুঞ্জনে ভরপুর লাউঞ্জেই দাঁড়িয়ে ও এতক্ষণ। ধ্যত্তোর, এসব আবার কী ধরনের ভাবনা! অফিসে যাওয়াটাই যে এখন বিশেষ জরুরি। আরেহ্, জরুরিই যদি না হবে, তবে কি আর বিদেশে একমাস না থেকেই হুট করে দেশে ফিরতে হয়! শালা! এই জেনিটাই আমাকে ডোবাল। পা বাড়ায় সিজান।
আরেহ্ সিজান, তুমি! একই সঙ্গে কয়েকটা কারণে দাঁড়িয়ে পড়ল সিজান। এক, ওকে ডাকছে এক মহিলা। না, না, মহিলা নয়, তরুণী। দুই, কেউ ছুটে আসছে ওর দিকে। ছুটে আসছে, ধাক্কা লাগবে নির্ঘাত। হাঁটা না থামালে, যেমনি ভাবে…তাতে এত লোকের ভিড়ে...ওফ্। তিন, ওই মহিলার ‘সিজান’ ডাকটা ঠিক মিলুর ডাকের মতোই, মিষ্টি।
এ মিলুই! সিজানকে সামনে দেখে ভারি অবাক। রাগও হয়েছে, আবার খুশিও হয়েছে। ফেরার আগে একটা চিঠি তো অন্তত দিতে পারত ও। লোকটা নিষ্ঠুর।
“কী ব্যাপার, মিলু! তুমি এখানে?” সামলে নিয়েছে সিজান। সে-ও অবাক।
“সেটা তো আমারও প্রশ্ন। তুমি না এগারো তারিখে ফিরবে লিখেছিলে। আজই যে হঠাৎ?”
মিলুর প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য সিজান সবে মুখ খুলেছে, এমনি সময় সে দেখল, জেনি এগিয়ে আসছে।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে-থাকা ভাবী দম্পতির সামনে এসে দাঁড়াল জেনি। বলল, তোমরা কি পরস্পরের পরিচিত?
জেনির অবাক চাউনি দেখে এক বার সিজানের মুখের দিকে তাকাল মিলু। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল। সিজান বলল, চিনি না।
“মানে? ও তো আমার…!” থেমে গেল সিজান। ওর যেন আর কিছু বলার নেই।
“কী? ও তোমার কে?” আস্তে করে প্রশ্ন করল জেনি। মিলু শঙ্কিত, ভাবছে, সিজান কি আবার বউ-টউই বলে বসবে নাকি?
যাহ্ দুষ্টু…ও…!
সিজান ভাবছে, কী বলব? বিয়ে তো এখনও হয়নি। তবে কি প্রেমিকা? ধুর, বাজে শোনায়! তা ছাড়া কী বলা যায়? কী?
জেনি ভাবছে, কী বলবে সিজান? যা-ই বলুক, সামনের মানুষ দুটোকে আমার ভুলে যেতে হবে চিরতরে। ব্যাগের ভেতরে সযত্নে রাখা সিজানের ঠিকানাটাও ফেলে দিতে হবে। আর কালই, সম্ভব হলে আজই পালাতে হবে এদেশ ছেড়ে।