সিঁড়ি দিয়ে জলদি নামতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল সমর। মাস চারেক ধরে অফিস শুরু করলেও এখন পর্যন্ত সবকিছুর সাথে তাল মেলাতে পারেনি সে। পড়ে যাবার পর কী মনে করে জানি সিঁড়িকোঠাতেই হেলান দিয়ে বসে রইল। সেখান থেকে সরাসরি অফিসের মেইন গেইট দেখা যাচ্ছে। ওই মুহূর্তে রিকশা থেকে নামল একটি মেয়ে। রাস্তার এপার ওপার করতে করতে সামনের ইসলামী ব্যাংকে ঢুকে পড়ল মেয়েটি। একমিনিটের মধ্যেই আবার মোবাইলটা কানে নিয়ে বেরিয়ে আসছিল সে। সমর দেখল, এবার ওর দিকে, মানে অফিসের দিকেই এগিয়ে আসছে মেয়েটি।
জিনস-ফতুয়াপরা মেয়েটির জিনসের নিচ থেকে একটু ভাঁজকরা ছিল বলে তার পায়ের চকচকে আলতা চোখে পড়ল সমরের। ‘জিনসের সাথে আলতা?’ নিজের মনেই দ্বিধাটা ছুড়ল সে।
সমর দেখতে পেল, মেঘবর্ণের মাঝারি উচ্চতার মেয়েটি ঢোকার আগে আয়নায় এক বার মুখটা দেখে নিল। জলদি উঠে দাঁড়াতে গিয়েও বসেই রইল সমর, খুব ক্লান্ত লাগছিল তার। সে ভাবল, যে আসে আসুক গে। আমি এখানে নতুন, আমার কাছে তো কেউ আসবে না।
মেয়েটি তার কাছেই এসে বলল, ‘এক্সকিউজ মি, আপনি কি বলতে পারেন, এই অফিসে সমর চৌধুরী নামে কেউ আছে কি না?’ সমর জলদি উঠে দাঁড়িয়ে সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বলল, ‘জি বলুন, আমিই সমর আহ্সান চৌধুরী।’ মেয়েটি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না যে এই সিঁড়িতে বসে-থাকা লোকটিকেই খুঁজতে এসেছে সে, আর একেই তার ফ্যামিলি দুনিয়ার সব উপাধি দিয়ে ভূষিত করে রেখেছে! সে খুবই অবাক হচ্ছিল লোকটিকে এই অবস্থায় বসে থাকতে দেখে। সমর বলল, ‘ম্যাডাম, চলুন, অফিসরুমে গিয়ে বসা যাক।’
- জি হ্যাঁ, চলুন।
- বসুন। চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে সমর বলল। বলুন, কী সাহায্য করতে পারি আপনাকে।
- একটু তাড়া আছে আমার। যেটা বলতে এসেছিলাম শুনুন।
মেয়েটি আস্তে ধীরে বলতে শুরু করল, ‘আপনার বাসা থেকে সম্ভবত মেয়ে খোঁজা হচ্ছে আপনার বিয়ের জন্য। আপনার জন্য যে মেয়েদের দেখা হয়েছে, দুর্ভাগ্যবশত আমিও ওদের একজন। আপনার বাবা নাকি আমাকে পছন্দ করেছেন, শুনলাম। আর আমার বাবা-মা দুজনেই পছন্দ করেছেন আপনাকে। আমার বাবা আর আপনার বাবা খুব সম্ভবত একসাথে পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।’
- আপনি কি নিজাম-আঙ্কেলের কথা বলছেন?
- জি, উনিই আমার বাবা।
- ও, আচ্ছা আচ্ছা!
- সমর সাহেব, আমি একটা সিরিয়াস রিলেশনশিপে আছি। ও এখনও চাকরিটা পায়নি বলে বাসায় কিছু বলতে পারছি না। আমি ওকে বিশ্বাস করি। দ্রুতই ওর চাকরিটা হয়ে যাবে। আর এর মধ্যে আমার পড়াশোনাও শেষ হয়ে যাবে। আমি এই বিয়েতে আগ্রহী নই। কিছু মনে করবেন না, অভদ্রের মতো আপনার অফিসে চলে এলাম। বায়োডাটায় অফিসের অ্যাড্রেসটা দেওয়া ছিল। আপনি বাসায় গিয়ে বলবেন, ছবি দেখে আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি। বোঝাতে পেরেছি ব্যাপারটা, মিস্টার সমর?
- জি মিস…?
- কুহু।
- জি মিস কুহু, আমি বুঝতে পেরেছি। সবকিছুই বুঝতে পেরেছি।
বলার সময় সমর মুচকি মুচকি হাসল। ‘আজ তো অনেক কাজ, সময় দিতে পারছি না। আপনি কি আর-এক দিন আসতে পারবেন কাইন্ডলি?
- কী আশ্চর্য! আমার যা বলার ছিল বলেছি। আবার কেন আসব?
- আমার আর আপনার বাবা একজন আর-একজনের বন্ধু, সেই সম্পর্কেও তো আমরা কথা বলতে পারি। কী, পারি না? আসবেন, কেমন? আর আসার আগে কাইন্ডলি একটা মেসেজ দিয়ে আসবেন। বায়োডাটায় আমার ফোননম্বরও আছে।
- সরি, আমি আসতে পারব না। আমার কাজ আছে। যাই।
সমরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল কুহু। অফিস থেকে বেরিয়েই বীথিকে ফোন করল সে।
- হ্যালো বীথি, জলদি বাসায় আয়!
- কী হয়েছে রে?
- তুই জলদি আয়, তারপর বলছি।
- আচ্ছা, আসছি।
কুহু বাসায় ঢোকার সময়ই দেখে বীথি এসে গেছে। বীথি ওদের বাসার কাছেই থাকে, আসতে সময় লাগেনি তাই। কুহুর মা বললেন, ‘দেখেছিস বীথি, কী অবস্থা কুহুর? এভাবে কেউ পাত্রের সাথে দেখা করতে যায়?’
- মা, রাখো তো তোমার পাত্র!
- কী কথা হলো রে? বলা যাবে মাকে?
- মা, সে এমন কিছুই না, যাকে নিয়ে এত আগ্রহ দেখাচ্ছ তোমরা।
- আরে, ডাবল এমএ-করা একটা ছেলে, তা-ও আবার বিদেশে যেতে চায় পড়তে। হিস্ট্রিতে কত ভালো করেছে জানিস? অনেক ভদ্র ছেলে সে। আর…
- থামো! সেজন্যই তো বিয়ে করতে চাই না। অত ভদ্র হতে কে বলেছে ওকে? দেখা যাবে, বিয়ের রাতে জিজ্ঞেস করবে, ‘বলো তো, সতীদাহপ্রথা উচ্ছেদ করেছিলেন কে?’ এটা শুনে ফিক করে হেসে দিল বীথি।
- আরে কুহু, তোর বাবা যেদিন আমাকে দেখতে এসেছিল, সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল, বক্সারের যুদ্ধ হয়েছিল কত সালে?
- সিরিয়াসলি?
- হ্যাঁ রে!
- কী বলেছিলে?
- ১৯৭১!
- হা হা হা। তারপর?
- কপালের ঘাম মুছতে মুছতে তোর বাবা বলল, ‘একদম ঠিক।’ আরে, ওইদিন তোর বাবাই তো নার্ভাস ছিল। আমার ধারণা, সে ধরে নিয়েছিল, আমার উত্তর সঠিক।
সবাই একসাথে হেসে উঠল।
- যা-ই বলো মা, এই ধরনের ছেলেরাই সকালে উঠে পেপার পড়তে পড়তে বলে, ‘এই অমুকের মা, চা দাও।’ আজব! ‘অমুকের মা’ আবার কী কথা? আর জানো মা, এরা ছুটির দিনে, আগের দিনের পেপারগুলি আবার পড়ে, এটা দেখার জন্য যে কোনও খবর বাদ পড়ে গেছে না কি! এদেরকে কে বিয়ে করবে?
- ওমা! ভালো ছাত্র হওয়ার মানেই যে এসব আচরণ করবে, এটা তুই নিশ্চিত হচ্ছিস কী করে?
- আমি নিশ্চিত নিশ্চিত নিশ্চিত! এই বীথি, চল, রুমে চল।
বীথিকে রুমে ডেকে নিয়ে এক এক করে সব ঘটনা খুলে বলল কুহু।
- দ্যাখ বীথি, আমি নিজে তো তিনটা সেমিস্টার গ্যাপ দিয়ে বসে আছি, যদিও বাসায় জানে, একটা, তাই এত ভালো ছাত্রকে আমি পাত্র হিসেবে গ্রহণ করতে চাই না। একে কেন বিয়ে করতে যাব আমি? এই টাইপের ছেলেরা সবই বোঝে, এক মানুষের মন ছাড়া। আর যে আমার মনই বুঝবে না, তার ওইসব ছাইপাঁশ পড়াশোনা, ডিগ্রি, চাকরি হাবিজাবি কিছুই আমি বুঝতে চাই না।
- তবুও কুহু, একটু ভেবে দ্যাখ। সবকিছু শুনে কিন্তু আমার কাছে ওঁকে খুব খারাপ মনে হচ্ছে না।
- যে লোক নিজের অফিসের সামনের সিঁড়িকোঠায় বসে থাকে, তাকে নিয়ে আমার কোনও কিছুই ভাবার নেই আর।
- ঠিক আছে, যা ভালো মনে করিস। যা-ই হোক, সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে। আজকে যাই রে, কুহু।
সারারাতই ছটফট লাগল কুহুর। কেন লাগল, সেই কারণটা খুঁজতে গিয়ে আরও বেশি অস্থির লাগছিল তার। পরের দিনটাও অমন করেই কাটল। বিকেলে চুল বাঁধতে বাঁধতে বেখেয়ালি হয়ে কুহু নিজের সাথেই কথা বলছিল। ‘আচ্ছা, আমার কি ওই লোকের জন্যই এমন লাগছে? ধুউর, কী সব ভাবছি! এমন কেন হবে? লোকটাকে তো ভদ্রই মনে হলো, তবে আবার অফিসে কেন যেতে বলল? আর অত অল্প কথা বলে আমাকে ওরকম বিদায়ই-বা কেন করে দিল? লোকটা কি ফালতু টাইপের, না কি অনেক ভাব-নেওয়া টাইপের? হোক না যেমন হবে! আমি কেন ভাবতে যাব ওকে নিয়ে?’
রাত নয়টা-বারোতে কুহু মোবাইল হাতে নিয়ে বসল। ভাবল, ‘হ্যাঁ, তা-ই তো, আমার বাবা ওর বাবার বন্ধু। আমরা দেখা করতেই পারি। এটা আর এমন কী?’ মেসেজ লিখতে গিয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখে কুহু। ভাবে, ‘থাক, কী দরকার!’
রাত এগারোটা-নয়। সে টেক্সট পাঠাল, ‘হ্যালো, আমি কুহু।’
- কী খবর? সব ঠিক আছে?
অনেকক্ষণ এটা সেটা টাইপ করে, সব মুছে দিয়ে কুহু লিখে, ‘কালকে দশটার দিকে আসতে চাইছি।’
- আচ্ছা, আসবেন। কথা হবে। শুভ রাত্রি!
কুহুর এবার মেজাজ খারাপ হলো। সে ভাবল, ‘এ আবার কেমন লোক! এইটুকুতেই শুভরাত্রি? সে কি আমাকে ইগনোর করল? এত ভাব কীসের তার? এই দুনিয়ায় সে ছাড়া আর কেউ লেখাপড়া করে নাই? আমি গায়ে পড়ে যেতে চাইছি নাকি? সে যেতে অনুরোধ করল বলেই তো টেক্সট পাঠালাম! আশ্চর্য!’… ‘আচ্ছা, শুভ রাত্রি!’ ছয়বার লিখেও রাগ করে সে একবারও কিছু পাঠাল না। সাথে সাথে বীথিকে টেক্সট করে কুহু, ‘আমি কালকে সমরের ওখানে যাচ্ছি। তুইও যাবি আমার সাথে, আর কিছু শুনতে চাই না। সকাল দশটায়।’ রিপ্লাই এল, ‘আচ্ছা।’
সকালে বের হয় দুজনে।
- তুই না বললি যাবি না, কুহু?
- এত কথা বলিস কেন তুই?
- সরি রে। আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছিস? শুধু শুধু কাবাব মে হাড্ডি হব।
- কাবাব হওয়া এত সোজা না, গাধি! দুদিনেই কাবাব তৈরি হয় না।
‘এই তো, এসে গেছি।’ রিকশা থেকে নেমে কুহু বলল, ‘বীথি, তুই নিচেই দাঁড়া। আমি চিৎকার দিলে উঠে আসবি।’
- ওমা! চিৎকার কেন করবি?
- লোকটা খারাপও তো হতে পারে, তাই না?
- বীথি টিপ্পনী কেটে বলল, ‘তা খারাপ লোকের কাছে জেনে শুনে এলি যে?’
- চুপ! তুই অনেক বেশি কথা বলিস। আমি যাচ্ছি, তুই থাক।
কুহু উপরে চলে এল।
- আসব?
- আরে কুহু, আসুন আসুন।
কুহু মনে মনে ভাবল, দুদিনেই ‘মিস কুহু’ থেকে ‘কুহু’ বলা শুরু করে দিল? এ কেমন ফাজিল ছেলে! একটু পরে তুমি করে না বলা শুরু করে দেয় আবার!
- বসুন। কেমন আছেন?
- ভালো আছি।
- আমাদের অফিসের আদা-চা’টা খুবই দারুণ। চলুন, একসাথে খাই।
- আচ্ছা।
- তারপর, কী খবর? নাচের প্র্যাকটিস কেমন চলছে?
হতভম্ব হয়ে গেল কুহু। ও যে নাচের প্র্যাকটিস করে, সেটা এই ব্যাটা জানল কী করে?
- জি, ভালোই চলে!
জানালার পাশের চেয়ার থেকে কুহু একটু পর পর বীথিকে চেক করছে।
- বান্ধবীকেও উপরে আসতে বলুন না, একসাথেই আড্ডা দিই!
এটাও জানে লোকটা? সে কি ফলো করেছে আমাকে?...এটা ভেবে খুবই বিরক্ত লাগছিল কুহুর। কুহুর কুঁচকানো ভ্রূ যুগলের দিকে সমর পরের বিস্ময়টি ছুড়ে মারল…
- আপনি লালনের গান ভালোবাসেন, তাই না?
‘এটা তো ওর জানার কথাই না! সে কি আমার বাড়ির ভেতরেও নজরদারি করে নাকি? কিন্তু কীভাবে? এটা তো অসম্ভব! না কি লোকটা আন্দাজে ঢিল মেরে মেরে আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে?’ কুহুর উপরের ঠোঁটে এবার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। টেবিলের কোনা থেকে টিস্যুবক্সটি কুহুর দিকে এগিয়ে দিয়ে সমরের প্রশ্ন…
- মিস কুহু, কিছু বলতে চাইছেন, তাই না? বলে ফেলুন! আপনি অনেক কনফিউশনে ভোগেন জানি। তবুও বলে দিন, যা বলতে চাইছেন।
- অনেক হয়েছে, মিস্টার সমর। আপনি তখন থেকে কী সব আন্দাজে উলটাপালটা বলে বলে আমাকে বিব্রত করে যাচ্ছেন। সমস্যা কী আপনার?
সমর মুচকি হেসে বলল, ‘একটাও আন্দাজে বলিনি।’
- শুনুন, নিজেকে অত চালাক ভাবার কিছু নেই। দুনিয়ায় কেউই নিজেকে বোকা ভাবতে চায় না।
- দেখুন, আমি চালাক নই। শুধু একধরনের চেষ্টা করি মানুষকে বোঝার। এটা করতে ভালো লাগে। কুহু, একটি মেয়ে সব সময়ই চায়, তার মনটা কেউ বুঝুক। কখনও সেখানে ঝড় ওঠে, কখনও ঢেউ খেলে, আবার কখনও সেখানে মরুভূমির মতোই একরাশ নিস্তব্ধতা লেপটে থাকে। সেই গোপন-দুনিয়ায় এই ঝুমবৃষ্টি শুরু হয় তো একটু পরেই কাঠফাটা রোদ। আমার কাছে সবচেয়ে রহস্যময় মনে হয় একটা মেয়েকে বোঝা। এটা সব মেয়ের বেলাতেই সত্যি। আমার মা, বোন, ভাবি সবার বেলাতেই।
কুহু যেন এবার একটু নরম হলো।
- তাহলে এতক্ষণ যা-কিছু বললেন আপনি আমার সম্পর্কে, তার সবই স্রেফ অনুমান করে?
- কিছুটা অনুমান, কিছুটা অনুধাবন, কিছুটা লজিক।
- কীরকম?
- প্রথম দিন আপনি যখন এলেন অফিসে, আপনার জিনস একটু গোটানো ছিল বিধায় পায়ের পাতাটা ভালো করে দেখা যাচ্ছিল। জিনসের নিচে আলতা পরা দেখে ভাবলাম, এমনিই পরেছেন হয়তো, শখ করে। কিন্তু সেদিন শখে পড়লে আজও পরতেন, আজ আপনি পরেননি। ব্যাপারটা হয়তো এরকম যে, ওইদিনের আগের দিন আপনার নাচের কোনও প্রোগ্রাম ছিল, বাড়ি ফিরে ভালো করে পা না-ধুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, আর সকালে ওভাবেই চলে এসেছেন। এটা আমার অবজারভেশন। ভুলও হতে পারে।
- না, ঠিক হয়েছে। আগের দিন শিল্পকলায় প্রোগ্রাম ছিল। আমি একজন ক্লাসিক্যাল ড্যান্সার। এটা বুঝলাম, কিন্তু আমার উপর স্পাইইং কেন করতে গেলেন আপনি?
- মানে?
- নিচে আমার বান্ধবী দাঁড়িয়ে আছে, সেটা তো আপনার জানার কথা না, তাই না?
- ও আচ্ছা, শুনুন। আপনি ঢুকেই এতগুলি চেয়ার বাদ দিয়ে গিয়ে জানালার পাশেই বসেছেন, আর একটু পর পর নিচে তাকাচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছিল, কাউকে খুঁজছেন। আর একটা ছেলের সাথে দেখা করার সময় কোনও মেয়ে কাউকে নিয়ে এলে অবশ্যই তার বান্ধবীকে নিয়ে আসে, ভেরি সিম্পল! এটা বুঝতে শার্লক হোমস হতে হয় না নিশ্চয়ই?
- তাহলে এটা জানলেন কী করে যে আমি লালনগীতি ভালোবাসি?
- গতদিন আপনি একটা গান গুনগুন করছিলেন, সম্ভবত ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, আর আজকে গুনগুন করছেন ‘সময় গেলে সাধন হবে না’।
সমর একটু হেসে চেয়ার থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে বলল, ‘মিস কুহু, সময় গেলে কিন্তু আসলেই সাধন হবে না। হা হা হা।
…আচ্ছা, আর-এক কাপ চা দিতে বলি। না কি কোল্ড-ড্রিংক খাবেন?’
- না, চা-ই ঠিক আছে।
কুহু ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে আর কী বলবে। এই লোক তো সত্যিই অদ্ভুত!
চায়ের অর্ডার দিয়ে এসে সমর আবার বলল, ‘আপনি কনফিউশনে ভোগেন, কী করে বুঝলাম, এটা বলি। গত পরশুই আপনি বলে গেলেন এখানে আর আসবেন না, অথচ আজ এসেছেন ঠিকই। গতরাতে আমার মেসেজের রিপ্লাইয়ে আপনি মাত্র পাঁচটা শব্দ লিখতে গিয়ে সময় নিয়েছেন চব্বিশ মিনিট। আবার আজকে চোখে কাজল দিয়ে, পরে ধুয়ে ফেলেছেন, কারণ আপনাকে দেখতে ভালো লাগছে কি না, সেটা নিয়ে আপনি কনফিউশনে ভুগছিলেন।
- ছিঃ! আপনি এত অসভ্য! একটা মেয়েকে কেউ এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে? আর এত মেয়েলি ব্যাপার নিয়েও কোনও পুরুষ এভাবে ভাবে?
- আপনি আমার সামনাসামনি বসেছেন বিধায় আপনার চোখের লেপটে-যাওয়া কাজল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আর আমার বড়ো বোন যখন সাজগোজ ঠিকভাবে না হলে কাজল ধুয়ে ফেলত, আমি তখন লক্ষ করতাম। ওই অবস্থায় ওকে দেখতে ভূতের মতন লাগত, আমিও খুব খ্যাপাতাম। আপনাকে তো আর খ্যাপাতে পারছি না। হা হা হা…
কুহুর মাথা ঝিমঝিম করছে। কী করবে, কী বলবে, ভেবে পাচ্ছে না সে। হুট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কুহু।
- একি, চা-টা শেষ করে যান অন্তত!
- না, আমি যাব এখন।
- মিস কুহু, কোনও টেনশন নেই, আমি বাসায় বলে দেবো যে আমার আপনাকে পছন্দ হয়নি। কিন্ত ওই যে, ‘আপনার প্রেমিক আছে, সে চাকরির জন্য চেষ্টা করছে।’ এই মিথ্যেটা না বললেও হতো কিন্তু! আসলে যাচ্ছে না এই ব্যাপারটা আপনার সাথে। তার চেয়ে আপনার মুখে সত্যিটাই ভালো শোনাত।
- জি। তো সত্যিটা কী?
- এই তো, নিজেকে আরও একটু গুছিয়ে নিয়ে অন্য কাউকে গোছানোর ব্যাপারটা ভাবতে চান আপনি, সত্যি এটাই! মানে, আপনার সময় চাই আর-একটু, আপনি এখনই বিয়ের জন্য প্রস্তুত নন।
‘সমর সাহেব, আজ আমি আসি।’ বিদায় নেবার ভঙ্গিতে হেসে বলল কুহু।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে কুহু অনুভব করছিল, লোকটা যেন তার খুব আপন মানুষ, অথচ মাত্র দুই দিন কথা হয়েছে মানুষটার সাথে। এর মধ্যেই এত কিছু বুঝে ফেলল মানুষটা! সে ভাবল, লোকটা কি আসলেই অতটা অযোগ্য, যতটা সে ভেবেছিল? বাইরে থেকে পাথরের মতন শক্ত কুহুর ভেতর থেকে মাত্র কয়েকটি কথায় চিরআড়াল নরম-স্নিগ্ধ কুহুর নিবিড় অস্তিত্বের অনেকটুকু টেনে বের করে-ফেলা বোকা বোকা চেহারার লোকটিকে নিয়ে কি ভেবে দেখা যায় না আর-একবার?
হঠাৎ বীথির ধাক্কায় সম্বিৎ ফিরে পেল কুহু। ‘কিরে ডায়েরিটা ফেলে এসেছিস কেন? সমরভাই এসে দিয়ে গেলেন।’ হাত বাড়িয়ে মৃদু হেসে ডায়েরিটা নিল কুহু। রিকশা চলছে, বীথি আর কুহু দুজনই কেমন চুপ হয়ে আছে। কুহুর মন পুরোপুরিই নির্ভার, ডায়েরিটাতে সমরকে নিয়ে একটা লাইনও সে এখনও লেখেনি।