একবার একটা নামি ম্যাগাজিনের ফটোশ্যুটে একই ফ্রেমে বন্দি হবেন আমির খান আর শ্রীদেবী। ছবি তোলার জন্য সব রেডি। দু-জনে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ছবি তোলা হবে, ঠিক এমন সময় ক্যামেরাম্যান থমকে যান। একে তো শ্রীদেবী হাইটে আমিরের চেয়ে প্রায় দেড় ইঞ্চি লম্বা, আবার তার উপরে তিনি পরেছিলেন হাইহিল।
সেটের সবাই বুঝতে পারছিলেন যে, কোনো একটা সমস্যা হয়েছে, কিন্তু কেউ কিছুই বলছে না। ক্যামেরাম্যানও ভয় পাচ্ছেন নেগেটিভ কিছু বলতে, যদি রেগে গিয়ে 'দেবী' অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন আর সেট ছেড়ে চলে যান! ক্যামেরাম্যান মুখে কিছু না বলেও শ্রীদেবীকে চোখের ইশারায় কী যেন বললেন। আর সাথে সাথে শ্রী বুঝে ফেললেন ঘটনাটা। জুতোজোড়া খুলে এসে এমনভাবে পোজ দিলেন নবাগত 'চকলেট বয়' আমিরের সাথে যে, হাইটের পার্থক্য তো বোঝা গেলই না, বরং ম্যাগাজিনকেই হিট করে দিল সেই ছবি।
নিজের ছেলেবেলা নিয়ে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, “আমি খুবই লাজুক আর একাকী ধরনের ছিলাম। এতগুলো অপরিচিত মুখের সাথে বসে ক্লাস করতে খুব কষ্ট হতো। আমি ভিড় এড়িয়ে চলতাম। যখনি রুমে ৪/৫ জনের বেশি দেখতাম, আমি দৌড়ে মায়ের আঁচলের নিচে পালাতাম কিংবা বইপড়ার ভান করে নিজেকে আড়াল করে ফেলতাম।”
অথচ এই লাজুক মানুষটিই ক্যামেরার সামনে নিজেকে ক্ষুধার্ত সিংহী (রাশিতেও ছিলেন সিংহ) হিসেবে মেলে ধরতেন। ওই যে, বলে না, যার কাজ, তারে সাজে! পরবর্তীতে আরেকটি ইন্টারভিউতে শ্রী বলেন, “সেসময় আমিই একমাত্র (শিশু) তারকা ছিলাম, যার নিজস্ব মেক-আপের লোক ছিল।”
নাম ছিল শ্রী অম্মা আয়াঙ্গার, ডাকনাম পাপ্পি। পরবর্তীতে শোনা যায়, জন্মের পরে কপালের দিকে নাকি লাল জ্বলজ্বলে কিছু-একটা দেখা যায় বলে শ্রী'র সাথে দেবী জুড়ে দেওয়া হয়। আর সেই থেকেই শুরু ‘শ্রীদেবী’-র।
মাত্র চার বছর বয়সেই ‘কান্দন করুনাই’ সিনেমার মাধ্যেমে অভিনয় জগতে পা রাখেন দেবী। শ্রী’র বাবা নিজে যেমন ছিলেন আইনজীবী, তেমনি মেয়েকেও পরবর্তীতে সেই পেশাতেই নিয়ে আসবেন বলে মনস্থির করে রেখেছিলেন। যেমন আমাদের দেশে নাপিতের ছেলে নাপিত হবে, তার ছেলে আবার আরও বড়ো নাপিত হবে, এরকম করে ভাবা হয়; কিছুটা ওরকমই হয়তো ভেবেছিলেন তীক্ষ্ণ শ্রীদেবীর সহজসরল পিতা। কিন্তু ঈশ্বর স্বয়ং যার ভাগ্যে লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন লিখেছেন, সে আইনজীবী হতোই-বা কী করে!
বাবার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও মায়ের আগ্রহের কারণে সিনেমায় পথচলা নির্দ্বিধায় শুরু করেন ছোট্ট শ্রীদেবী। সেই তখন থেকেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেয়ে এবং মেয়ের ক্যারিয়ারের সাথে আঠার মতন লেগে ছিলেন। প্রথম সিনেমাতেই পোস্টারে শিশুশিল্পী হয়েও যথেষ্ট লাইমলাইট কুড়িয়ে নিয়েছিলেন তিনি। এবং, ওই সিনেমা দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি নায়িকা নন, দেবী।
নায়িকাদের একটা বয়সের পর বাধ্য হয়েই জায়গা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হয়, কিন্তু দেবী’কে জায়গা ছাড়তে হয় না। সেই প্রমাণ পাওয়া যায় ‘মাত্র’ ৪৯ বছর বয়সে সুদীর্ঘ গ্যাপ দিয়ে ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ সিনেমার মাধ্যমে সিনেমায় কাম-ব্যাক করার ঘটনায়, যে-সিনেমায় তাঁর অভিনয় আগুন জ্বেলে দেয় সমালোচকদের বুকে।
একটু পরিণত বয়সে এসে শ্রীদেবী বলেন, “আমার মা আমাকে অনেক ভালো ভালো তামিল ছেলের ছবি দেখান। আমি শুধু দেখি, কিন্তু মাথায় কিছু আসে না। আমার বিয়ে নিয়ে ভাবার ফুরসতটুকুই তো নেই, কাজের এত চাপ! কিংবা ভেতরে ভেতরে এত সুন্দর ছেলের ভিড়েও হয়তো আমি বিয়ে করতে চাইতাম ভালোবাসার জন্য।”
শ্রীদেবী ছিলেন আইসক্রিম, চকলেটের পাগল; ড্রাকুলার ফ্যান, বিশেষ করে মাইকেল জ্যাকসন ভক্ত। ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ সিনেমায় তাঁর মাইকেল জ্যাকসনকে অনুকরণ করে নাচার দৃশ্যটুকু অসাধারণ। তিনি আরও একজনের অন্ধভক্ত ছিলেন, যাঁকে দেখেই অভিনয় শিখেছিলেন বলে জানান তিনি। মানুষটি আর কেউ নন, চার্লি চ্যাপলিন। 'মিস্টার ইন্ডিয়া' সিনেমাতে একটা ছোট্ট সিন ছিল, যেখানে শ্রীদেবীকে চ্যাপলিনের অনুকরণ করতে হবে। সেই সিন এতই অসাধারণ হয় যে, অনেক বেশি সময় ধরে শ্যুট করেও পরিচালক কাট বলতে বাধ্য হন। কত লক্ষ মানুষ যে চ্যাপলিনকে দেখে তাঁর মতন হবার স্বপ্ন দেখতেন, সেই হিসেবটা বলা মুশকিল। চ্যাপলিনকে নিয়ে আরেক দিন বলব সময় নিয়ে। তোলা থাকল সেটা।
শ্রী ভালোবাসতেন ছবি আঁকতে, ছবি তুলতেও। মৃত্যুর কিছুদিন আগেই সোনম কাপুরের ‘সাওয়ারিয়া’ সিনেমার একটি লুককে ক্যানভাসে অসাধারণ রূপ দেন তিনি। একটা মজার তথ্য দিই। এরকম একজন বড়ো নায়িকা, যিনি ৫টা ভাষায় সিনেমা করেন প্রায় তিন শতাধিক, তিনি ভালো ইংরেজি জানতেন না। যে-ইন্ডিয়াতে, বিশেষ করে মুম্বাইয়ে আরও বহু বছর আগে থেকেই ইংরেজিকে কোনো ভাষা হিসেবে না ধরে স্কিল হিসেবে ধরা হতো, সেই দেশের প্রধান নায়িকা ভালো ইংরেজি জানেন না, বলতে গেলেও কনফিডেন্স পান না।
যখনই শ্রী’র কেউ সমালোচনা করতে চাইত, এই ইংরেজি না জানাকেই প্রথম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত তারা। শুরুতে হিন্দিও যে খুব ভালো বলতে পারতেন, তা-ও নয়। তাঁর অনেক সিনেমায় ডাবিংয়ের কাজ করে দিয়েছেন আরেক বলিউড ডিভা রেখা। মাঝে দু-জনের মধ্যে একটুআধটু সম্পর্কের টোকাটুকির কথা শোনা গেলেও শ্রীদেবী মনে করতেন, এই ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর একমাত্র বন্ধু হচ্ছেন রেখা। তাঁরা পরস্পরকে চিঠিও আদান-প্রদান করতেন দূরে থাকলে। রেখা শ্রীদেবীর খারাপ সময়ে এক ইন্টারভিউতে বলেন, “আপনারা ওকে ছয় মাস সময় দিন, তারপর দেখুন, ও কী জিনিস!” রেখা অত্যন্ত স্নেহ করতেন দেবী’কে।
‘হিম্মতওয়ালা’ সিনেমার ‘ন্যায়নো ম্যে সাপনা’ গান দিয়ে চারিদিকে হইচই ফেলে দেন শ্রীদেবী-ধর্মেন্দ্র জুটি। এই সিনেমাটিই বলিউডে শ্রীদেবীকে নায়িকা হবার জন্য আলাদা আসন করে দেয়।
‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ সিনেমার ‘কাটে ন্যেহি কাটতে ইয়্যে দিন, ইয়্যে রাত’ গানটি হিন্দি রোমান্টিক গানের লিস্টে আজীবন সেরার তালিকাতে থেকে যাবে। নীল শিফন শাড়ি পরে নায়কের সাথে কল্পনায় যে মোহনীয় ভঙ্গিতে নেচেছেন, যেভাবে বৃষ্টিতে ভিজে নায়ককে কাছে আসার আবেদন জানিয়েছেন, দেখে যেন মনে হয়, তাঁর নাচে প্রতিটি বডিপার্ট আলাদা করে কথা বলে। অথচ সেখানে ছিল না কোনো শরীর প্রদর্শনী, ছিল না কোনো অশ্লীল ভঙ্গিমা।
একই সিনেমার আরেক হিট গান ‘হাওয়া হাওয়াই’ সম্পর্কে তো আর নতুন করে কিছু বলার নেই। শুধু এটুকু বলি, গানের একটা অডিশনে কবিতা কৃষ্ণমূর্তি 'হাওয়া হাওয়াই' গানটা জাস্ট এমনিই গেয়ে রেকর্ড করেন, কিছু লিরিক্স ভুলভালও হয় তখন। আসলে সে গানটা গাওয়ার কথা ছিল আশা ভোঁসলের। যখন ফাইনালি সিলেক্ট করা হয় যে, কবিতার গানটিই যাবে সিনেমায়, তখন কবিতা ভয়ে ভয়ে বলেন, “আমার তো লিরিক্সে একটু ভুল আছে, এই গানটা আবার করতে হবে।” গানের পরিচালক বলেন, “কিছুই করার প্রয়োজন নেই। এই গানে শ্রীদেবী-জির নাচ আর এক্সপ্রেশনে মানুষ এমনই মজেছে যে, ওই সামান্য ভুল কেউ খেয়ালই করছে না।”
শোনা যায়, প্রেম ছিল মিঠুনের সঙ্গে, বিয়েও নাকি করেছিলেন তাঁরা গোপনে। আর সেসবের সাক্ষী ছিলেন রেখা। কিন্তু মিঠুন ছিলেন বিবাহিত। শ্রীদেবীর অত্যধিক জেদ এবং নানান আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের পরও শেষ পর্যন্ত তাঁদের একসাথে থাকা আর হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীতে পরিচালক বনি কাপুরের সাথেই (যিনি বহু আগে থেকেই পছন্দ করতেন শ্রীদেবী'কে) সাতপাকে বাঁধা পড়ে আবারও সমাজ থেকে আলাদা হয়ে যান। এর কারণ, বনিও ছিলেন বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক।
শ্রীদেবীই একমাত্র নায়িকা, যাঁকে সেই সময়ে অমিতাভের মতন সুপারস্টার, মানে লেডি সুপারস্টার বলা হতো। নিজের ইচ্ছেমতো হুটহাট পারিশ্রমিক বাড়ানোর সাহস ছিল অমিতাভের, আর তাঁর পরই সেই সাহসে ভাগ বসান শ্রীদেবীও। অমিতাভের সাথে দুটো সিনেমা করে একসময় তাঁর সাথে আর কাজ না করার মতন সাহসী সিদ্ধান্তও এসেছে তাঁর তরফ থেকে। চিন্তা করা যায়?
হেমা মালিনীকে মাথায় রেখে তৈরি করা প্লট ‘নাগিনা’র মতন সাপের সিনেমায় অংশ নিয়ে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। অথচ এই সিনেমা রিজেক্ট করেন হেমা, রিজেক্ট করেন তৎকালীন হার্টথ্রব জয়াপ্রদাও। ‘নাগিনা’ ছবির প্রতি শ্রীদেবী এতটাই অবসেসড হয়ে পড়েছিলেন যে, ঘুমোতে গেলেও ক্যারেক্টর থেকে বের হতে পারতেন না, এমনকি স্বপ্নেও তিনি সাপ দেখতেন!
অল্পবয়সে ঠিকঠাক পড়াশোনা করতে না পারার হতাশা সারাজীবনই বয়ে বেড়িয়েছেন যিনি, সেই মানুষই পরবর্তী জীবনে হতাশায় ভুগেছেন চেহারায় বয়সের ছাপপড়া নিয়ে। ২৫ বারেরও বেশি ছুরির নিচে গিয়ে অস্ত্রোপচার করেছেন নিজের বয়স ধরে রাখতে। এখানেও গুরু জ্যাকসনের পদাঙ্ক (!) অনুসরণ করেছেন তিনি।
এক রোববার সকাল নেমে এসেছিল মেরিলিন মনেরোর মৃত্যু দিয়ে, আরেক রোববার পৃথিবীর ঘুম ভাঙে প্রিন্সেস ডায়নার মৃত্যুসংবাদ দিয়ে। আবারও ওরকম অলক্ষুণে এক রোববারেই চলে যান শ্রীদেবী। শেষযাত্রায় লাল টুকটুকে দুর্গা সাজিয়েই ভারতবাসী তাদের দেবীকে বিসর্জন দেয়।
শ্রীদেবীর মৃত্যু এখনও এক রহস্য। কেউ বলেন, অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে বাথটাবে ডুবে মারা যান; কেউ বলেন, অতিরিক্ত অস্ত্রোপচারের সাইডইফেক্টে মারা যান; আবার কানাঘুষা শোনা যায়, বনি কাপুরই নাকি শ্রীদেবীর মৃত্যুর সাথে জড়িত।
লেখা শেষ করি তাঁর অভিনীত ‘চালবাজ’ সিনেমার একটি জনপ্রিয় ডায়লগ দিয়ে। তুঝ্যে তো ম্যায় অল-ইন্ডিয়া-স্টার বানকে দিখাউঙ্গি (তোকে আমি পুরো ভারতের তারকা হয়েই দেখাব)।
শুধুই ভারত নয়, ইন্টারন্যাশনাল স্টার হয়েই বিদায় নিলেন তিনি। ৫০ বছরের ক্যারিয়ার, ৫টি ভাষায় ছবি, ৩০০-র অধিক সিনেমা…!
শুধুই অভিনেত্রী হলে কি পারা যায় একজীবনে এতটা পথ হাঁটতে? একে হাঁটা বলে, না কি ওড়া? যাঁর পিঠে ঈশ্বর নিজহাতে গেঁথে দিয়েছিলেন ডানা—এরকম করে আর কে উড়তে পারে, দেবী ছাড়া? এরকম ডানাই-বা ঈশ্বর কাকে দিয়েছিলেন আর, এক শ্রীদেবী ছাড়া?