আজ সন্ধ্যায় ফেসবুকে একটা লেখা পড়ে আমার ঘরের দরজা লাগিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছি। অলক্ষিত শৈশবদাগ। খুব কষ্টের অশ্রু নাকি অনেক উষ্ণ হয়, আজ টের পেলাম। কেন কেঁদেছি?
তখন সবেমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছি। ক্লাস ওয়ানে পড়ি। সারাদিন হেসেখেলে বেড়াই। ছবি আঁকতে চাই। ছোটছোট ছড়া মুখস্থ বলে বড়দের চমকে দেই। পিঁপড়া মুখে দিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি। ভাইয়ার সাইকেলের চেইনে আঙুল আটকে ফেলি আর ব্যথায় সারাদিন তারস্বরে কাঁদি। সবার আদর পেতে চাই, কেউ বকলে ভ্যাঅ্যা করে কেঁদে ফেলি। সবার চোখের মণি হয়ে থাকি সবসময়ই।
একদিন কিছু একটা হল। লোকটাকে আঙ্কেল বলে ডাকতাম। পাশের বাসায় থাকত। সাথেসাথেই মাকে এসে সব বললাম। সেসময় কিছু হলেই মাকে বলতাম। আমি ছোটবেলায় খুব কথাবলা টাইপের ছিলাম।
মায়ের হাতে প্রচণ্ড চড় খেলাম। কেন মা এমন করল, বুঝিনি। কী অন্যায়, জানতেই পারিনি। আমার ছোট্ট গালটা সেদিন ভীষণ ফুলে গিয়েছিল। খুব রাগ হয়েছিল মায়ের উপর। তারপর কিছু ঘটনা ঘটল খুব দ্রুত। সেসব পারিবারিক ঘটনার কারণে আমাদের পুরো পরিবারকে পাশের জেলায় চলে যেতে হল। ভাইয়ার সামনে এসএসসি পরীক্ষা। কেবল সে থেকে গেল নানুর বাসায়। বাবা আইনজীবী। বাবার ক্যারিয়ার যখন তুঙ্গে, সে সময়টাতে হুট করে বার চেঞ্জ করায় বাবার ক্যারিয়ারে বিশাল ধ্বস নামে। আমাদের পরিবার তখন ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়ল। একসময় আমাদের বাড়ি বেচে দিতে হল। সব কিছু ঘটলো চোখের পলকেই। বাবা জলের দামে বাসা বেচে দিল। আমরা চলে গেলাম। ভাইয়া থেকে গেল। কলেজপড়ুয়া ভাইয়াকে আর কাছে পেলাম না। তারপর আন্ডারগ্রেডে সে চলে গেল জাপানে। তখন থেকেই সে দেশের বাইরে। ওর সাথে আমার দূরত্ব যা তৈরি হল, সেটা অনেকটা বাবাদের সাথে যেরকম থাকে, সেরকম। আমি নতুন পরিবেশে ধীরেধীরে বড় হতে থাকলাম একা।
ওই ছোট্ট আমার বুদ্ধিতে তখন একটা জিনিস খুব বুঝেছিলাম যে, যা কিছু হচ্ছে, সবই আমার জন্য। ছোটরা কিন্তু সব বুঝতে পারে। তীব্র আর্থিক অনটনে দিন যাচ্ছে তখন। মাঝেমাঝে আমার উপর বাবা খুব রেগে যেত। সব কিছুর জন্য আমাকে দোষ দিত। এমন কথাও আমাকে শুনতে হয়েছে, “জন্মের সময় গলাটিপে মেরে ফেললেই হত!” আমি খুব গুটিয়ে থাকতাম। বাবা-মা সবসময় বলত, “কাউকে কিছু বলবি না, বললে একেবারে মেরেই ফেলব!” তারাও কাউকে কিছু বলেনি, শুধু আমার নানুভাই জানতেন। আমিও কথা রেখেছিলাম। কাউকে বলিনি। আজ পর্যন্ত বলিনি।
তখনকার ছোট্ট আমার মনে এসব ঘটনা ভীষণভাবে দাগ কেটেছিল। মা-বাবা বলেছে কাউকে না বলতে, আবার আমার মনের মধ্যে খুব প্রশ্ন আসত—কেন? কত ‘কেন’ এসে ফিরে যেত সেসময়! ‘কেন’র অত্যাচার থেকে বাঁচতে পারলে ছোটোরা খুব সুখে থাকতে পারতো। মা-বাবা’র অহেতুক বকাঝকা ছোট্ট বাচ্চাদের ভাল লাগে না। আমি ভয়ে আমার সব জিজ্ঞাসাই চেপেই যেতাম। একটা সময় ওই ব্যাপারটাই ভুলে গেলাম। বড় হতে থাকলাম আর দশটা বাচ্চার মত। শুধু পার্থক্য ছিল এই যে, আমাকে কারও সাথে খুব একটা মিশতে দেয়া হত না। আমি খুব চাইতাম সবার সাথে মিশতে, খেলতে, ঘুরতে। কিন্তু বাসা থেকে ভীষণ কড়া করে বারণ করে দেয়া হয়েছিল। সেই ছোটবেলায়ই আমি অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলাম। কারও সাথে না মিশতে, না মিশতে কেমন জানি খুব গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলাম। একটা বাচ্চা ছেলে, সে কিনা খুব ভারিক্কি ভাব নিয়ে বড় হচ্ছে, ওকে ওরকম করেই বড় হতে হচ্ছে। ব্যাপারটা খুব কষ্টের।
যখন ক্লাস ফোর, ফাইভ, সিক্সে পড়তাম, তখন নিজেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ মনে হত। এমন অনুভূতি ভীষণ কষ্টের। নিজেকে কেমন যেন ভীষণ পাপিষ্ঠ মনে হত। ক্লাস নাইনে পড়ি যখন, তখন মানুষের জন্মরহস্য সম্পর্কে জানলাম বন্ধুদের কাছে। খুব বমিবমি লাগছিল প্রথম যেদিন জানলাম, সেদিন। কিন্তু তখনও বুঝিনি আমার সাথে কী হয়েছিল। বোকা ছিলাম যে! ছোটবেলায় আমার সাথে ঘটেযাওয়া ঘটনাটি বুঝেছিলাম কলেজে ওঠার পর। আমার এখনও মনে আছে। সেদিন সারারাত কেঁদে ভাসিয়েছি। একটা কলেজেপড়া ছেলে সারারাত কেঁদে ভাসিয়েছে—এর মানে বোঝো, প্রিয় সমাজ? না, তোমরা বোঝো না। কখনও বুঝবেও না। যত কষ্ট, যত কান্না, যত আফসোস—সবই যে ব্যক্তিগত! যার চোখ, তারই কান্না; বাকিদের কেবলই দেখেযাওয়া। আর সমাজ? সে তো কেবলই একটা ভণ্ড স্বৈরাচারী অবিবেচক সত্তা! সমাজের মতন কপট সংগঠন আর একটাও নেই। যা-ই হোক, এতোগুলি বছর পর ছোটবেলার প্রতিটি ঘটনা আমার কাছে পরিষ্কার হল। কেন আমরা পাশের জেলায় চলে গিয়েছিলাম, কেন বাসা বেচে দিতে হয়েছিল, কেন মা-বাবা বলেছিল, “কাউকে বললে মেরে ফেলব”, কেন ভাইয়ার সাথে সারাজীবনের জন্য একটা অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হল, কেন ছোটবেলায় কারও সাথে মিশতে দেয়া হত না আমাকে ………সব বুঝলাম। সব!
আমি দশ দিগন্তজোড়া আদর-ভালোবাসায় বড় হইনি। ছোটবেলায় কেউ আমাকে আদর করে গালটিপে চুমু দিয়েছে কিংবা কারও কথায় হেসে ফেলেছি, এইটুকুতেই বাবা-মা রেগে যেত। প্রচণ্ড মার খেতাম। বুঝতাম না, কেন। খুব কষ্ট হত আমার ওই ছোট্ট মনে। কিছুই ভেবে পেতাম না। বাবা-মা কেন আমার সাথে এমন করছে? আমি কী করেছি? কী আমার অপরাধ, তা না জেনেই দিনের পর দিন শাস্তি মেনে নিতে বাধ্য হওয়াটা ভীষণ কষ্টের। কোথাও বেড়াতে গেলে বাবা-মায়ের আশেপাশেই থাকতে হত। ওরা আমাকে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলতে দিত না। চুপচাপ বসে থাকতাম। আমি তোমাদের মত বড় হইনি। মার খেতেখেতে, ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে, সবসময়ই বয়সের চেয়ে বেশি বড় হয়েহয়ে বড় হয়েছি। আমার শৈশব বলে কিছু নেই। আমার শৈশবে আনন্দের কোনও স্মৃতি নেই। আছে যেটা, তা হল, ‘কিছু ভুল করে ফেললাম কি না’ এটা নিয়ে সদাসতর্ক থাকার অসংখ্য স্মৃতিগাথা। আমি আমার শৈশব নিয়ে কথা বলি না খুব একটা। আমার বাবা-মা যে আমাকে সেটা ভুলতে শিখিয়েছিল!
কিন্তু সব জানার পর একদিন খুব ক্ষেপে গিয়েছিলাম। বাবা-মা’কে বলেছিলাম, “কেন তোমরা আমার সাথে এমনটা করেছিলে?” তারা কিছুই বলেনি, কেবলই চোখের জল ফেলেছিল। আর তাতে আমার রাগটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। তোমরা কাঁদছ কেন? আমাকে তো তোমরা দুকূলভাসানো আদর-ভালোবাসায় বড় করনি! সবসময়ই ভয়ে কুঁকড়ে থেকেথেকে বড় হয়েছি। কাঁদব তো আমি! তোমরা কাঁদবে কেন?
সেদিন ব্লগে একজনের লেখায় দেখলাম, কষ্ট কী জিনিস, সেটা যেন কেউ উনাকে না বলে। কারণ, উনি নিজে একসময় যে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন, সেটার কাছে আমাদের সচরাচর কষ্টগুলো কিছুই নয়। উনার কথা হয়তবা ঠিক! তবে উনাকে একটা কথা খুব বলতে ইচ্ছে করছে। উনার কষ্টের কথা শুনে আমার হাসি পায়। একটা বাচ্চা ছেলে বাবা-মা’র ধমক খেতেখেতে বড় হচ্ছে, তাকে জানতে দেয়া হচ্ছে না কেন সে ধমক খাচ্ছে, সে সবসময়ই নিজের মধ্যে গুটিয়ে আছে কিছু ভুল করে ফেলার ভয়ে, অথচ সে এটাও জানে না কী করলে সে বকা খাবে না—এই কষ্ট আপনি বুঝতে পারেন, স্যার? বুকে হাত দিয়ে বলেন তো………বুঝতে পারেন? কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কীসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে! ছোটবেলায় না বুঝে পড়েছিলাম। এখন বুঝে উচ্চারণ করতেও ভয় পাই।
আমার বাবা-মা আমাকে নিয়ে ভীষণ গর্ব করে। আমার রিলেটিভরা তাদের সন্তানদের চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলে, “ওর মত হও।” এমনটা তো বলবেই! আমি যে ছাত্রজীবনে মোটামুটি প্রথম সারিতেই ছিলাম সবসময়ই। বাবা-মা একা হয়ে যাবে ভেবে বুয়েটে ইলেক্ট্রিক্যালে চান্স পেয়েও ভর্তি হইনি! রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়েছি।
আমার বন্ধুদের কাছে আমি আশ্রয়স্থল। আমাকে ছাড়া আড্ডা জমে না। আমার কাছে সবাই চাইতেই নোট পেয়ে যেত। আমিই অনেকের প্রেজেন্টেশন তৈরি করে জমা দিতাম। বন্ধুদের কাছের বন্ধুটি যে আমি! আমি না করলে কে করবে?
আমার প্রেমিকা আমাকে নিয়ে গর্ব করে। সবাইকে বলে, “ও কোনওদিন আমার হাত চেপে ধরেনি, জোর করে চুমু খেতে চায়নি, কখনও একটাও অশ্লীল কথা বলেনি। ওর মত ছেলেই হয় না। কার পুণ্যে যে আমি ওকে পেয়েছি, জানি না!”
এসব কথা বানিয়ে বলছি না। আমি আসলেই এমন ভাল ছেলে।
‘অলক্ষিত শৈশবদাগ’ পড়ে আজ কী যে হল! এই প্রথম মনে হল, জীবনে কেউ আমাকে গুরুত্ব দিল! আমার কথাই বলল। আমার যে বকা খেয়ে নয়, বাবা-মা’র আদর-ভালোবাসায় বড় হওয়ার কথা ছিল—সে কথা প্রথম কেউ বলল। আমি আজ পর্যন্ত কাউকে এই কথাটি বা এই ঘটনাটি বলিনি। আজ প্রথম বলছি। কেন বলছি, জানি না। কোনও হিসেবেই লেখক আমার এত কাছের কেউ নন, যাকে আমার এত গোপন কিছু বলা যায়! কিন্তু যখন আজ সন্ধ্যায় লেখাটি পড়ছিলাম আর কাঁদছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, লেখক আমার বড় আপন, উনি ছাড়া আমার কেউ নেই, আমি উনাকে সব জানাব, মনের মধ্যে শেকলে বাঁধা সব দুঃখী বর্ণকে মুক্তি দিয়ে পালকের মত নির্ভার হবো। ভীষণ একা আমি। আমাকে কেউ কোনওদিন বোঝেনি, খোঁজেনি। অনেক মানুষই পাশে ছিল, তবে তারা আমার খোঁজ নেয়নি কখনও, বরং সুযোগ পেলেই সবাই আমার আঘাতই করে গেছে, ওরা আমার দুর্বলতা নিয়ে হাসাহাসি করে আনন্দ পেয়েছে সবসময়ই। লেখকই তো প্রথম আমার খোঁজটা নিলেন! লেখকরা কেন আত্মার আত্মীয়, বুঝতে পারছি। আমি অরণ্য ভালোবাসি। বিভূতিভূষণ আর বুদ্ধদেব পড়ে কতবার যে অরণ্যপ্রেমে মজেছি, বারবারই মনে হয়েছে, আমি যেন লেখকের হাত ধরে হাঁটছি কোনও অরণ্যের মধ্য দিয়ে, বুনো ফুলের ঘ্রাণ আমায় মাতাল করে দিচ্ছে, ঘাসের সাথে আমার স্পর্শ-মিতালি হয়ে চলছে প্রতিটি মুহূর্তেই, দূরের কোনও এক পিউকাঁহা আমাকে আনমনা করে তুলছে ক্ষণেক্ষণেই, কত চিত্রার্পিত জঙ্গলের বিশুদ্ধ আদিমতায় হারিয়ে গেছি বারেবারে………খুব কৃতজ্ঞ হয়ে পড়তাম, মনে হত, লেখককে গড় হয়ে প্রণাম করি, অন্তত ধন্যবাদ জানিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়ে দিই আমায় এমন অনুভূতি উপহার দেয়ার জন্য। শুধুই পড়ে গেছি, কখনও সামান্য ধন্যবাদটুকুও দিতে পারিনি, সে সুযোগই যে নেই! আজ মনে হল, লেখককে কাছে পেয়েছিই যখন, কিছু লিখে পাঠাই। এই অঞ্জলি তাই আমার আজন্ম ব্যথার বিনম্র আহুতি!