উপদেশ দেবার আগে

আসুন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শিখি।

কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ
পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসংমূঢ়চেতাঃ।
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রূহি তন্মে
শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্॥ (গীতা, ২/৭)

অর্থ: আমার সহজাত (ক্ষত্রিয়) প্রকৃতি চিত্তের দীনতায় অভিভূত হয়ে পড়েছে, আমি আমার ধর্ম বা কর্তব্য সম্বন্ধে বিভ্রান্ত; তাই আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি: আমার পক্ষে যা মঙ্গলকর, তা নিশ্চিতরূপে বলুন। আমি আপনার শিষ্য; আমি আপনার শরণাগত, আমাকে উপদেশ দিন।

এখানে অর্জুন যখন কায়মনোবাক্যে শরণাগত হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে মনুষ্যজীবনের প্রকৃত কর্তব্য সম্পর্কে উপদেশ চাইলেন, তার পরেই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে গীতার শিক্ষা দিলেন। (এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, সর্বজ্ঞানের অধীশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজ থেকে গায়ে পড়ে উপদেশ দেননি কিন্তু!)

মনুসংহিতায় আছে: "নাপৃষ্টঃ কস্যচিদ্ ব্রূয়াৎ (ন অপৃষ্টঃ = নাপৃষ্টঃ)", অর্থাৎ কেউ যদি কোনো প্রশ্ন না করে, তবে তাকে অযাচিতভাবে উপদেশ দিয়ো না। আহা, কী সহজ ও চমৎকার বাক্য!

জিজ্ঞাসু ব্যক্তিকেই কেবল উপদেশ দেওয়া উচিত, কেননা উপদেশের দরকার হলে যে-ব্যক্তি আমার শরণাপন্ন হতেন না, গায়ে পড়ে তাঁকে উপদেশ বা পরামর্শ দিতে চাওয়া নিঃসন্দেহে কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেয়। আমি যদি নিজে নিজেই ভেবে নিই: "আমি আপনার গুরু; আমি (গায়ের জোরে) আপনাকে শরণাগত করেছি, আমার উপদেশ নিন।", তাহলে আমার মতন চিড়িয়া খাঁচার বাইরে ঘোরাঘুরি করাটা পৃথিবীর জন্য অমঙ্গলজনক, কেননা চিড়িয়াখানার দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জন করাই আমার 'যথাযথ' দায়িত্ব বা কর্তব্যকর্ম।

অর্জুন যখন অনুভব করলেন, তাঁর কিছু উপদেশের দরকার, তখন তিনি কিন্তু রাম-শ্যাম-যদু-মধু'র কাছে যাননি, শ্রীকৃষ্ণের কাছে গিয়েছেন। এখন আপনিই ভাবুন, কোনো রাম-শ্যাম-যদু-মধু যদি অযাচিতভাবে গায়ে পড়ে নির্লজ্জের মতো অর্জুনকে উপদেশ দিতে দৌড়ে চলে আসে, তখন অর্জুনের কতটা বিরক্ত লাগে! অযোগ্য লোকের পরামর্শ ও উপদেশ—দুই-ই বিষতুল্য, সুতরাং সর্বতোভাবে বর্জনীয়।

অনেকেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে চুলকানির মলম বিক্রি করেন। (করতেই পারেন, যাঁর জীবিকা যেমন।) তাঁর নিজের শরীরের চুলকানি কেন সারছে না অনেক দিন ধরে, আমি সেদিকে যাচ্ছি না, কেননা ওসব নিতান্তই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার—আরেক জনের ব্যক্তিগত কিছু নিয়ে আমার কখনোই বিন্দুমাত্র‌ও আগ্রহ থাকে না। কিন্তু যখন তিনি বার বার আমার চোখের সামনে এসে নিতম্ব নাড়িয়ে নেচে নেচে ক্রমাগত বলতে থাকেন, আসুন আমাদের গাড়ির নিকট, দেখুন আমাদের মলমখানা. . . তখন তো আমার তাঁকে জুতো খুলে পেটাতে ইচ্ছে করে না, কারণ আমার সময় ও জুতোর সামান্য হলেও দাম আছে।