ঠিক কয় বছর আগে এরকমটা হয়েছিল, মনে নেই। তবে, এখনও এরকম হয়, হয়ে যাচ্ছে, এবং হয়ে যাবেও বোধ হয়।
একপাশে ধানখেত, অন্যপাশে সর্ষেখেত; সেসময় আর কোনও পাশ খেয়াল করিনি। এরই মাঝে আইল দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে, হলুদ-সবুজের খেলা; নাকি একটু দূরে যে নাড়াগুলো খড়ের গাদা হতে হতেও হয়নি, সেগুলোতে শাদাশাদা বকের ওড়াওড়ি---কোন সুন্দরটা বেশি সুন্দর, কিংবা এইসব সুন্দর আদৌ সুন্দর কি না, এইসব ভাবতে-ভাবতে কিংবা কোনওকিছুই ভাবছি না যেন, এমন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ধান-শর্ষে’র শীষে-শীষে যে হাজার বছরের পুরনো হাওয়াটি স্বচ্ছন্দে খেলে যায় সেই কখন থেকে, যেটা কেউই জানে না, সেই হাওয়া আমাকে এবং ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল৷ ও কে ছিল? ও সত্যিই কেউ ছিল? নাকি, পুরোটাই যাদু বাস্তবতার কোনও সরল গ্রাম্যপাঠ? কিংবা, অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড মুভির সবকটা অপূর্ব মুহূর্তের পুনর্চিত্রায়ন? কোনও কারণ ছাড়াই স্রেফ ইচ্ছে হলো বলে কিংবা হাতে বন্দুক আছে বলে কেউ আমাকে হত্যা করলে আমি যতটুকু কষ্ট কিংবা অভিমান নিয়ে মরে যেতাম, ছোটোবেলায় দৌড়াদৌড়ি করার পুরনো ধূধূ মাঠটাতে একঝাঁক শাদা বক ততটা কষ্ট কিংবা অভিমান নিয়ে শিকারীর শিকার হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করে ছিল কি না (মৃত্যুর ব্যাপারটা আদৌ অপেক্ষাতে হয় কি? ইসসস!! এতই সহজ?), সেটা পাশের মরামরা গাছগুলোর ওপর নিশ্চিন্তে বসে-থাকা ফিঙেগুলোও জানতো না বোধহয়৷ আমাদের হাতে শটগান ছিল না, তাই ফিঙেগুলো নির্ভাবনায় কিচিরমিচির করছিল এবং করে যাচ্ছিল---এমন নয়; ওরা নিঃশঙ্ক, কারণ ওরা কীভাবে যেনো জেনে গেছে, ওদের মাংস কেউ খায় না৷ যার মাংস খাওয়ার কেউ নেই, সে একই সাথে পরম নিশ্চিন্ত এবং কখনও-কখনও দুঃখীও বটে; দুঃখী, কারণ যার দিকে কেউই তাকায় না, আসলে তার দিকে কেউই তাকায় না তার মধ্যে তাকানোর কিছুই নেই বলে। সে একইসাথে বিধাতার আশীর্বাদ এবং অভিশাপপ্রাপ্ত। সেই ফিঙেগুলির মন এই ভেবে নির্ভার ছিল যে, বকগুলির চাইতে অসুন্দর কিংবা কম সুন্দর হলেও ওদের অতো দুঃখ নেই৷ ঈশ্বর কাউকেই সৌন্দর্য আর নিরাপত্তা দুই-ই একইসাথে দিয়ে এইখানে পাঠাননি৷ আপনা মাংসে হরিণা বৈরী৷ অল্প সুন্দর, অল্প বিপদ। যতকিছুই হোক না কেন, সুন্দর হতেই সকল আনন্দ। বিষাদের হিসেব রেখে জীবনের সুন্দরের বিকিকিনি কেউ করতে পারে না। এই সুন্দরের আনন্দেই মৃত্যু পিছলে-পিছলে এই আশ্চর্য বেঁচে থাকার অভিনয়ের নামই জীবন।
গ্রামের রাস্তা মেঠো হলে যতটা ভাল লাগে, পাকা হলে ততটাই মেজাজ খারাপ হয়৷ এটার কারণ হয়তোবা আমার অকৃত্রিমতার প্রতি ভালোবাসা যতখানি; তার চাইতে ঢের বেশি---আমাকে গ্রামে থাকতে হয় না, এই বাস্তবতা৷ মানুষের অনেক মাত্রার ভালোবাসাই বৈপরীত্যের প্রতি, কারণ সে নিজে সেখানে নেই। আমি ভাবি, আমি যেখানে নেই, সেখানেই সব সুখ! কে জানে! কোনও এক ভালোবাসা দিবসের পরের দিবসের সারাটি বিকেল কোনও এক গ্রামে কাটিয়ে সন্ধেবেলায় বইয়ের আড়ং বাতিঘরে এলাম৷ কোন সে গ্রাম? গ্রামের রকমফের আছে হয়তো, কিন্তু যেসব গ্রামকে ভালোবাসি কিংবা ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, সেসব গ্রাম কমবেশি একইরকমেরই। দুই সুন্দর গ্রামের দুই রকমের মুখ হয় না। ভালোবাসা দিবসে কেউই ভালোবেসে, অভালোবেসে, মন্দবেসে, অমন্দবেসে কিংবা ঘৃণাশেষেও একটি কাগুজে কাঁঠালচাঁপা পর্যন্ত দেয়নি৷ আচ্ছা, কেউ কি ঘৃণা করেছিল কখনও? নাকি, আমি ভালোবাসা ফুরিয়ে যাওয়ার পরের ঘৃণাটুকুরও অযোগ্য? নইলে ঘৃণাও শেষ হয়ে যেতো৷ হয়নি তো! ভাল কথা, ভালোবাসা শেষ হলে ঘৃণার শুরু হতেই হবে কেন? যে ভালোবাসার শেষ কিংবা শেষের শেষটুকু ঘৃণাতে হয় না, সে ভালোবাসা বড় ভাল ভালোবাসা। ভালো না বাসলে ঘৃণা করতেই হবে কেন? ভালোবাসার বিপরীত ঘৃণা হওয়ার কথা শুধু বাংলা দ্বিতীয় পত্রের বইতে, জীবনে নয়। আমার এভাবে করে খুব ভাবতে ইচ্ছে করে যে, ভালোবাসার উল্টোপিঠে ঘৃণা থাকার মানেই সেখানে মার্কস পাওয়া না-পাওয়ার কিছু একটা আছে, আর কোথাও নয়; আর কে না জানে, জীবনের সে সমীকরণ স্রেফ পার্থিব হিসেবের! ভালোবাসাকে কবে কোথায় কেন পার্থিব হতে হয়েছিল? আমি তো সে ঠিকানা পাইনি কখনও! আপনি পেয়েছেন?
কখনও কোনও এক ১৫ ফেব্রুয়ারিতে এইসব ঘটেছিল। আজকে এইসবের কিছুই ঘটেনি। তবে এমনকিছুও ঘটেনি যে এইসব ঘটলে ভুল কিছু ঘটতো। যা কিছু ঘটে না, তা কিছু কি সত্যিই ঘটে না? কিংবা যা কিছু ঘটে, তা কিছুর কতটুকুই বা ঘটে? গতকালকের পোশাকি ভালোবাসা দিবস তো ভালোবাসাবাসির দিবস। এই দিনকে সামনে রেখে (কিংবা পেছনে ফেলে) নিজেকে একটুখানি ভালোবাসলে কী এমন ভুল হয়ে যায়? অনেকদিনের পুরনো অভ্যেসে আমি তাই আজকে আমাকেই ভালোবেসে কিছু বই কিনে দিলাম৷ এই যে নিজের প্রতি নিজের আদিম ও অকৃত্রিম ভালোবাসা, মানে নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেম, দুই সময়ে হয়৷ এক৷ অন্যকেউ যখন ভালোবাসে, তার জন্যে নিজেকে ভালোবেসে বাঁচা, কারণ বেঁচে থাকলে আর কিছু পাওয়া যাক বা না যাক, ভালোবাসা তো অন্তত পাওয়া যাবে৷ পাওয়া যাবেই, এটাও হয়তো নয়। তবুও, ভালোবাসা পাবো, অন্তত সে আশায় হলেও তো বেঁচে থাকা যাবে! দুই৷ অতোটা অপ্রয়োজনীয় না হয়ে যাওয়া, যতটা হলে আর আফসোস ছাড়া বেঁচে থাকা যায় না৷ এই পৃথিবীতে সবচাইতে কষ্টের অনুভূতিটি হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়ার অনুভূতি। অবশ্য ফেসবুকে সবাই-ই কমবেশি নার্সিসিস্ট৷ প্রত্যেকেই চায়, অন্যেরা ভাবুক সে দেখতে নায়কনায়ক কিংবা নায়িকানায়িকা টাইপের৷ তার সবকিছুই ভাল৷ যার মাথাভর্তি চকচকে টাক, সেও প্রায়ই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভালোবাসে, “ওয়াও! আমার মাথাভর্তি কী ঘন সুন্দর পাঁচ-পাঁচটি লম্বা চুল!” বাংলার পাঁচের মত দেখতে যে, সেও আয়নায় রণবীর কাপুরকে দেখে! কোনও না কোনও সাইড থেকে ওকে দেখতে নিশ্চয়ই চকোলেট বয়ের মত দেখায়! ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সারাজীবনই সেই বিশেষ সাইডটা খুঁজে বেড়ায়। এতে কিন্তু খারাপ কিছু নেই। যে নিজেকে ভালোবাসে না, সে কাউকেই ভালোবাসতে পারে না। যে নিজেকে ভালোবাসে, সে নিজেকে সুন্দরভাবে তুলে ধরার জন্য যা যা করা দরকার, তা তা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। যে নিজে সুন্দর, তার চোখে অন্যদের সৌন্দর্য যতটা ধরা পড়ে, যে নিজে অসুন্দর, তার চোখে এর সিকিভাগও পড়ে না। তাই বলি, নার্সিসিজমের জয় হোক, ভালোবাসা ছড়িয়ে যাক, সুন্দর চারপাশে থাকুক, ঈর্ষা রাজ্যহারা হয়ে অনিকেত প্রান্তরে ঘুরে মরুক।
এইবারের বইমেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে একবার মাত্র। আজকে হঠাৎ করেই বইমেলায় ঘুরতে খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু হায়! আমি যে বইমেলার ধারেকাছেও নেই এই মুহূর্তে! রকমারি ডট কমে গেলাম। বইমেলার প্রায় বই-ই ওতে আছে। বেছে-বেছে এপার বাংলা আর ওপার বাংলার গোটা পঞ্চাশেক বই অর্ডার করে ফেললাম। আহা, আহা! পৃথিবীতে সবচাইতে শান্তির ৫টি অনুভূতির একটি হল বইকেনার অনুভূতি। এই অনুভূতি আমার রক্তে মিশে আছে। রক্তও যে কীভাবে করে টগবগিয়ে নাচে, সে শিহরণ যারা বই কেনে না, তারা কীভাবে বুঝবে? অবশ্য, আমি ‘বই’ শব্দটা ব্যবহার করেছি প্রতীকী অর্থে। বই মানে আনন্দ। আমি আনন্দ কেনার কথা বলছি---সময় দিয়ে, কিংবা অর্থ দিয়ে! আমি বই কিনেছি আমাকে ভালোবেসেই, একথা এইজন্যই পূর্ণ সততা নিয়ে বলছি, কারণ নানান পরিস্থিতিতে ভালো না বেসেও ‘ভালোবাসি’ বলে ফেলাটা যতটা সহজ, ভালোবাসা ছাড়া গাঁটের পয়সা খরচ করা ততটাই কঠিন৷ ভালোবাসার মানুষটি আপনি প্রচণ্ড ভালোবাসা সত্ত্বেও শুধু ভালোবাসাটা প্রকাশের কিংবা ওর পছন্দমতো প্রকাশের অক্ষমতায় বিরক্ত হয়ে যত সহজেই ছেড়ে চলে যায়, বই তত সহজে ছেড়ে যায় না৷ এর কারণ দুটো৷ এক৷ বই তো অচল, কারণ সে চলতে পারে না, তাই অপেক্ষা করে থাকে কখন পোকায় কাটবে, কেটেকুটে পেটে নিয়ে ওকে সচল করে দেবে৷ দুই৷ তখুনি পড়ে ফেলতে না পারুন, এমনকি যতটা সময় কেটে গেলে পরে ‘অন্তত কিছুটা হলেও পড়ে ফেলতে পারা উচিত’---এ অনুভূতির জন্ম হয়, সেইসময়েও পড়তে না পারুন, ওতেও ওর কিচ্ছুটি এসে যায় না; স্রেফ বুকশেলফে থাকলেও সে প্রশংসিত হয় অকৃপণভাবে, এমনকি কোনও না কোনও জেনারেশনের কাজেও লেগে যেতে পারে কখনও-কখনও৷ সে কাজে লেগে যাওয়ায় আমরা অনেক অমূল্য রত্নও পেয়ে যাই। অমিতাভ ঘোষ কিন্তু অমিতাভ ঘোষ হয়েছিলেন তাঁর ছোটো মামার সংগ্রহের বইগুলো পড়ে৷ অথচ, অমিতাভ ঘোষের মামা স্রেফ অমিতাভ ঘোষের মামা-ই রয়ে গেলেন৷ অবশ্য অমিতাভ ঘোষের মামা হওয়াটাও কম প্রাপ্তির কিছু নয়। অমন একজন অমিতাভ ঘোষের মামা হওয়ার জন্যও তো এক লাইব্রেরি বই কিনে ফেলা যায়! এইরকম নজির আরও অনেক আছে৷
সেইদিন মেলায় গিয়ে আর আজকে রকমারিতে ঢুঁ মেরে-মেরে বইমেলার বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে মনে হল, কিছু পুরনো কথা আবারও একটু এদিকওদিক করে বলা যায়।
When a true genius appears in the world you may know him by this sign; that the dunces are all in confederacy against him.
সুইফটের এই কথাটার সময়ে ফেসবুক ছিল না৷ থাকলে, উনি হয়তো বলতেন,
When a genius appears on Facebook you may doubt him by this sign; that the dunces are all in confederacy for him.
হায় ওপরে-ওঠা নিচুতলার জনপ্রিয় মানুষের সাবলীল অধোগামিতা!
জন কেনেডি টুলি তাঁর লেখা ছাপবার জন্যে প্রকাশকদের দরোজায় কড়া নাড়তে-নাড়তে অবশেষে আর প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে না পেরে প্রচণ্ড অভিমানে ৩১ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন৷ তাঁর লেখার ছেঁড়াফাটা নোংরা পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে পুত্রের মৃত্যুশোকে ব্যথাতুর তাঁর মা থেলমা টুলি, পার্সি ওয়াকারের কাছে যান৷ ওয়াকার সাহেব কলেজে পড়াতেন, টুকটাক লিখতেনও৷ তিনি প্রথমে পাণ্ডুলিপি পড়তেই রাজি হননি৷ “আমার ছেলে এই লেখা ছাপতে না পেরে অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে নিয়ে আত্মহত্যা করেছে৷ আমি এটা আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি; দয়া করে অন্তত কয়েকপাতা পড়বেন, যদি ছাপবার যোগ্য না হয়, আমাকে আর খবর পাঠাবেন না, আপনিই ছুঁড়ে ফেলে দেবেন৷ আমি এটা ধরে নিয়ে সান্ত্বনা খুঁজে নেবো, হয়তো ওটা একটুও পড়ে দেখারই সময় হয়নি আপনার৷” এই বলে ওয়াকার সাহেবের টেবিলে পাণ্ডুলিপিখানি রেখে কোনও আশা ছাড়াই মা অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েন, যেভাবে করে অসহায় মা তাঁর শিশুকে অনাথাশ্রমে রেখে আসেন এই আশায় যে, ভাল থাক না থাক, অন্তত বেঁচে থাক৷.......... এরপর কী হয়েছিল, সেটা সবারই জানা৷ লেখকের মৃত্যুর ১১ বছর পর সর্বকালের অন্যতম সেরা অ্যামেরিকান কমিক মাস্টারপিস্ ‘অ্যা কনফেডারেসি অব ডান্সেস’ প্রকাশিত হয়, লেখককে মরণোত্তর পুলিৎজারও দেয়া হয়৷ ……….. তবে আমার খুব ভাবতে ইচ্ছে হয়, এমন সম্মাননার কী দাম আছে? যে ফুলের সৌরভ শুধুই অন্যদের মাতায়, সে ফুল যে কাঁটার চাইতেও অনেক বেশি করে গ্রহীতার বুকের মধ্যখানে বিঁধে! সন্তোষ সেনগুপ্তের গাওয়া একটা অপূর্ব গানের কথা মনে পড়ে গেলো ……… জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেনো তারে দিতে এলে ফুল ………
কমলকুমার-জীবনানন্দ’রা ছাপা হওয়া দূরে থাক, কেউ কখনওই পড়বেও না, এটা জেনেও কীসের মোহে লেখার প্রতি কতটা নিষ্ঠা আর ভালোবাসা নিয়ে উপন্যাস লিখতেন, সেটা এইসময়ে যাঁরা লিখছেন, তাঁরা একটু ভেবে দেখবেন, প্লিজ? আমরা অনেক আশা নিয়ে পড়তে বসি তো! শত ব্যস্ততার মধ্য থেকে সময় বের করে নিয়ে একেকটা বই পড়ে ফেলতে সে যে কী ভীষণ কষ্ট হয়, যাঁরা বই পড়েন না, অথচ লেখেন, কিংবা লিখতে-লিখতে বই পড়ার সময়ই বের করে নিতে পারেন না, তার খোঁজ তাঁরা পাবেন কীকরে? কতটা আস্থার জায়গা থেকে একজন পাঠক অজস্র পড়া-উচিত বই একপাশে সরিয়ে রেখে নতুন লেখকের বই পড়তে শুরু করে, সেটা মাথায় রাখলেও ইতর প্রাণীর মতো অতিপ্রসবের স্বেচ্ছাবেদনা থেকে বইয়ের মলাটে-থাকা নামধারী মানুষগুলি (তাদেরকে ‘লেখক’ বলতে যে স্থূলবুদ্ধি দরকার, সেটি আমার মাথায় নেই) নিজেদেরকে আর সাথে আমাদেরকে অনায়াসেই মুক্তি দিতে পারতেন! জোর করে কিংবা ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে নিজের অটোগ্রাফের বমিসমেত বই কিনিয়ে-দেয়া লেখক গোষ্ঠীর অহেতুক বৃদ্ধিতে সাহিত্যের বারোটা বাজতে দেখি প্রতি বইমেলায়ই। ফেসবুকে নিজের স্ট্যাটাসে বেশি লাইকের ‘শোচনীয় পরিণতি’ যদি হয় একখানা গ্রন্থপ্রসব, তাহলে তো বিপদ! স্ট্যাটাসদাতারা ফেসবুকে সুন্দর, লেখকরা বইমেলায়। বোঝে না, কেউ বোঝে না..............
বইমেলা আসে, তাই অনেকে লেখেন৷ আমরা পাঠকরাও এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে থাকি৷ হুমায়ূন আহমেদও বইমেলাকে সামনে রেখে উপন্যাস লিখতেন, ঈদকে সামনে রেখে নাটক লিখতেন। উনাকে দেখে উপলব্ধি করেছি, Writing for writing’s sake না হয়ে Writing for money’s sake মানেই যে বাজে কিছু, এটা সবসময় নাও হতে পারে। এরকম আরও বহু নজির আছে। সুনীলের অনেক লেখাই স্রেফ পয়সার জন্য লেখা। ভুলে গেলে চলবে না, এ দলে দস্তয়ভস্কির মতন মহৎ লেখকও আছেন। তাই ফরমায়েশের লেখামাত্রই খেলো, এমনটা বলা যায় না; সে ফরমায়েশ অর্থের তাগিদেই হোক, আর উপলক্ষের তাগিদেই হোক। কিন্তু হায়! একজন হুমায়ূন আহমেদ আর দ্বিতীয়টি হন না। তবুও বই দেখি, কিনি, কখনও-কখনও পড়ি৷ ইদানীং কিছু-কিছু বই পড়ার পর আমার প্রায়ই র্যাটাটুলি অ্যানিমেশন মুভিটার ইঁদুরটার মতো করে বলতে ইচ্ছে হয়, Anyone can write, that does not mean that anyone should. সুখের কথা, আমাদের মূষিক-স্বগতোক্তির ইচ্ছেটাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারার মতো কিছু লেখকের বইও আমরা সাম্প্রতিক সময়ে কিছু পেয়েছি।
দীর্ঘদিন ধরেই আমি এটা বারবারই নতুন করে আবিষ্কার করে আসছি, প্রেমে পড়ে না যাওয়াটা (নি)দারুণ সাশ্রয়ী একটা ব্যাপার। যে পরিমাণ কড়ি নিজের পকেট থেকে খসিয়ে বই-প্রেয়সীকে নিয়ে এইবারের (উত্তর)ভালোবাসা দিবসটি পার করে দিলাম, মানবী-প্রেয়সীকে অতো কম কড়িতে খুশি করে দিতে মন সায় দিত কি? হয়তো সে বিত্ত-হিসেবের কল্পনাপ্রমাদ নিতান্তই আমার মানসিক দৈন্য, তবুও...........
এভাবেই জীবন কেটে যাচ্ছে, অথচ এক ফোঁটাও রক্ত ঝরছে না! কী আশ্চর্য, তাই না!!