আলোর আকাশ

ভোরের আলো ফুটেছে বেশিক্ষণ হয়নি। ঠিক এমন এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। অপস্রিয়মাণ অন্ধকার ঘন হয়ে ঘিরে আছে আমাদের চারপাশ। এরই মধ্যে ক্রমশ ঢুকছে ঊষার প্রথম আলোকরশ্মি মাকড়সার ক্ষীণ জালের মতো করে; ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে দিগন্ত, উদীয়মান সূর্যের উষ্ণ আলোর নরম স্পর্শ আমাদের অনুভবের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বাসের সুবাতাস। এ বিশ্বাস নিজের মনের শক্তিতে সঞ্চারিত হয়ে যায় নিমিষেই।




যুক্তিবাদী মন যদি এখানে দেখে কেবলই অন্ধকার, তবে এই ভ্রমের দায় মনের মালিকের। চেতনার বোধশক্তির অক্ষমতা মানুষের দৃষ্টিশক্তিকে বাধা দিতে পারে, এমনকি সাময়িকভাবে হলেও মানুষকে দৃষ্টিশূন্য‌ করে দিতে পারে। অন্ধত্ব কখনোই আলোর আগমনকে রুখতে পারে না; যারা দেখতে শিখে নেয়, যারা সচেতন ও সজাগ, তারা ঠিকই সঠিক সময়ে সঠিকভাবে আলোর ঝরনাধারার খোঁজ জেনে যায় এবং ওতে নিজেকে ধুয়ে নেয়। খোঁজ জানাটা অনেক বড়ো অর্জন।




পুরোনো পৃথিবী ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে; এমনকি বিলুপ্ত হয়ে চলেছে। কিন্তু কীভাবে? মানুষের ভেতরকার চেতনা এক স্তর হতে অন্য স্তরে উন্নীত হয় কখনো কখনো। যখন হয়, তখন সেখানে দুইটি গতি থাকে: এক। মানুষ নিজেই বর্ধিত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ক্রমবর্ধমান এই চেতনা বিস্তৃত হতেই থাকে; হতে হতে অগ্রসর হয় পাশে-থাকা দিগন্তের অভিমুখে। মানুষের অন্তর তথা মানুষ নিজেই যেন বড়ো হতে থাকে ক্রমেই—দিগন্তের আয়তনে। দুই। আকাশে হঠাৎ বিশেষ একটি বিন্দুতে স্থির হয়ে মানুষ আকাশ ভেদ করে মাথা তোলে আরও ঊর্দ্ধস্থিত কোনো বিন্দুতে—যেমনি করে লোকে জলের মধ্য থেকে মাথা তোলে। মানুষ তখন থাকে এমন এক আকাশে, যা ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকে ঊর্দ্ধের দিকে। এভাবে নিজেকে উপরে থেকে আরও উপরে নিতে নিতে মানুষের কেবল মাথার‌ই নয়, চেতনারও ঊর্দ্ধারোহণ ঘটে। আসে একেকটা নতুন আকাশ, সেগুলি প্রসারিত হয়ে ছোটে নানান বলয়ে—জল যেমনি ছড়িয়ে যায় চারিদিকে। এমনি করে পুরোনো আকাশগুলি সরে যায় দূরে, মিলিয়ে যেতে থাকে দিগন্তের কোলে, একসময় মুছে যায়। মানুষ তখন নিচের আকাশগুলি ফেলে অনেক উঁচুর আকাশে অবস্থান করছে। সেই জায়গায় একলাফে পৌঁছোনো যায় না, অসীম সাধনায় নিচের অনেকগুলি আকাশ পেরোনো চাই সেখানে যেতে চাইলে। উঁচুতে ওঠার প্রথম ধাপ: নিচ থেকে শুরু করা। আকাশ পেরোতে চাইলে মানুষকে সাধনার মাধ্যমে মাটি থেকে উঠতেই হয়।




নতুন সৃষ্টির বেলায় সবসময়ই এমন একধরনের অভ্যুত্থান ঘটে চলে। বিলীয়মান আকাশের মাঝে মানুষ যখন থাকে, তখন সে নিজেই টের পায় না, কখন যে তার জগৎ প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে, আগের জগৎ গুটিয়ে চলে গেছে বিলুপ্তির পথে। প্রলয় আসে তখনই, যখন লয়কে মানুষ সহজ ও স্বাভাবিকভাবেই নিতে শেখে। মানুষ জানুক না জানুক, মানুক না মানুক—একের পর এক আকাশ লুপ্ত হয়ে যায় আর হতেই থাকে, পরবর্তী নতুন আকাশে নিজের জায়গা খুঁজে নিতে না পারলে জীবনে অবধারিতভাবেই দুর্ভাগ্য নেমে আসে।




কিছু জিনিস বিশ্বাস করে নিতে হয় এবং সে অনুযায়ী কাজ করে যেতে হয়। চাইলে তর্ক করতে পারেন, প্রমাণ খুঁজতে পারেন। ওতে সময় নষ্ট হয় কেবলই, কিছুতেই এগোতে পারবেন না সামনে। যা ঘটার, তা ঘটবেই। সময়ের সাথে এগোতে চাইলে নিজের আত্মার উপর গভীর বিশ্বাস রাখা দরকার, অত তর্ক করে কোনো কূলকিনারা পাবেন না, বরং সময়ের চেয়ে পিছিয়ে পড়বেন।




মানুষ হিসেবে জন্ম নেবার সবচাইতে বড়ো সুবিধে: মানুষ নিজেরটা নিজেই বেছে নিতে পারে। সে নিজের পথ বেছে নিতে পারে। কেউ বেছে নেয় সামনের দিকে এগোনোর পথ, কেউ বেছে নেয় স্থির হয়ে থাকার পথ, কেউ বেছে নেয় পেছোনোর পথ। স্থির হয়ে থাকার পথটি বেছে নেয় যারা, ওরাও একসময় পিছিয়েই পড়ে, কেননা সময় তো আর থেমে থাকে না। তাই পথ মূলত দুইটি: এগোনোর এবং পেছোনোর।




আমরা কে কোথায় আছি? ভগবান জানেন।
ভগবানকে কোথায় পাবো? আত্মা জানেন।




তিনটি সত্তা: আমি, তুমি এবং তোমার-আমার মাঝে একটি শবদেহ।
শবদেহেই থেকে যাব, না কি আমি থেকে যাত্রা আরম্ভ করে তুমি'তে পৌঁছে যাব, তা নিতান্তই আমাদের ব্যাপার।




ভগবানের দিকে তাকালে একটিই বার্তা জানা যায়—সময় দ্রুত এগিয়ে চলেছে!
Content Protection by DMCA.com