পড়ন্ত বিকেল উপভোগই যেন—আজকের এই বিষণ্ন মুহূর্তের মায়া কাটানোর একমাত্র উপায়; শুকনো পাতার জরাজীর্ণতাকে পাশ কাটিয়ে, চোখে পড়ল এক সবুজ বিন্দু, একটা সবুজ পত্র—যেন প্রাণের সঞ্চারে শিহরিত এ অশরীরী ছায়া।
বেলা পেরোলেই ওদের চায়ের দোকানে বড্ড ভিড় জমে...কী ভীষণ কোলাহল!
বীণু চলে গিয়েছে আজ চারটা বছর হলো; তবুও ওর নামটা আজও আমার কানে ফিসফিসিয়ে কে যেন বলে! অসহ্য এক সুরের সৃষ্টি করে আমার মস্তিষ্কে, এ থেকে পরিত্রাণের প্রত্যাশা আমি কেন করিনি—তার কোনো বিশেষ কারণ আমার জানা নেই।
বীণুর চোখদুটো প্রায়ই ঝাপসা হয়ে যেত...শুধু আমার ছুড়ে-দেওয়া প্রত্যাখ্যানে। সে যখন কাঁদতে শুরু করত, তার চোখে এক অকল্পনীয় মায়া এসে জমত, তবুও আমি ছিলাম এক মায়াহীন মানুষ।
আমি এখানে এসে মাঝেমধ্যেই বসে থাকি, বীণুর শেষ স্মৃতিটুকু স্পর্শ করতে।
অবশ্য আরও একটি বিশেষ কারণ রয়েছে।
আমার শরীরের ঘ্রাণ ছিল বীণুর সব থেকে পছন্দের; যা নিতে না পারলে সে ভীষণ অস্থির হয়ে উঠত! অবশ্য এখন আর ওর কোনো অস্থিরতা নেই, সব অভিমান ভুলে—শান্তি দিয়ে গিয়েছে আমাকে।
মাঝে মাঝে ভাবি—আমি তো এই শান্তিই চেয়েছিলাম...না কি?
বড্ড কোলাহল বেড়েছে, চায়ের দোকানে এমন কথার ফোয়ারা ছুটবে, এটাই স্বাভাবিক। হাসনাহেনা বীণুর ভীষণ পছন্দের ফুল, হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণ ভীষণ তীব্র।
আমাকে ঘিরে ওর অস্থিরতা ছিল—অসম্ভব রকমের বেশি, ঠিক এই কারণেই আমি ওর থেকে দূরত্ব নিয়েছিলাম; তবে বুঝতে পারিনি—ও এতখানি নিস্তব্ধতায় আমাকে ফেলে যাবে।
একবার বীণু আমায় বলেছিল, সে আমাকে চিঠি লিখতে চায়—চিঠিটা সে পাঠিয়েওছিল, তবে নামহীন সম্বোধনে; আমার ওপর কীসের যে এত অভিমান বীণুর, জানা নেই! অবশ্য, জানতে আমি কখনও চাইওনি।
আচ্ছা, জানতে চাইলেই কি—ও উত্তরটা দিত?
জীবনের বাস্তবতাগুলো বীণু কখনোই বুঝতে চাইত না; আজ যদি বেঁচে থাকত...হয়তো ওভাবে করেই জীবনটাকে কাটিয়ে দিত।
আবছা অন্ধকার আমার শরীরটা ছুঁয়ে গেল, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, আজানের ধ্বনিতে চারিদিকে পাখিদের ছুটোছুটি-শেষে যেন—প্রার্থনারত এক নতুন প্রহরের সূচনা।
আজ বীণুর কথা খুউব মনে পড়ছে, ওর গা ঘেঁষে থাকার স্বভাবটা—আমার ভীষণ আদরের ছিল। এখন কেমন আছে ও?
আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাওয়ার ইচ্ছেটা ছাড়া—আর তেমন কোনো চাওয়া বীণুর কখনোই ছিল না। আমাদের শেষ যেদিন কথা হয়েছিল, সেদিন কি আমার কথায় বীণু ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল? তা জানার সময় কেন হলো না আমার আর?
বীণুর এক অদ্ভুত গুণ ছিল, সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত;
ও আমাকে নিয়ে অনুভূতি লিখতে পারত। বীণু যে এর আগে কখনোই লেখালেখি করেনি—তা কখনোই বোঝা যেত না ওর লেখা পড়লে; আমাদের মুহূর্তগুলোকে সে এতটাই নিখুঁতভাবে শাব্দিক রূপ দিতে পারত।
লেখালেখির অভ্যেসটা আমার অনেক আগে থেকেই, লেখালেখির প্রতি অগাধ প্রেম থেকেই বীণুর এই গুণ আমাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল। ওর সমস্ত লেখাজুড়েই—ও আমাকে রেখেছিল; কারণ, বীণু আমাকে অসম্ভব ভালোবাসত।
আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল—ও কখনোই আমার অনুভব, আমার স্পর্শ, আমার কণ্ঠের আদর ছাড়া লিখতে পারত না; এই কথা—একবার সে-ই প্রথম আমাকে স্পষ্ট করে জানিয়েছিল।
আমি অবশ্য প্রথমে বিশ্বাস করিনি—তবে, সময় যত গড়াতে থাকল...বীণুর সেই কথাটিও যেন ধ্রুব সত্য হয়ে উঠল।
বীণু আমায় একবার বলেছিল—আমার সাথে যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে গেলে, সে মিথ্যে গল্প লিখতে শুরু করবে। তবুও, আমি জানি, ওর অনুভূতির শব্দে কেবল আমারই প্রতিধ্বনি বাজে।
আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও, সে আমায় নিয়ে লিখে গিয়েছে শতপৃষ্ঠা...যার কিছুই আজ সে ছুঁয়ে দেখতে পারে না।
আমাদের মাঝে যা-কিছু ছিল, তার সবটাই—কেমন যেন নীরব, ট্রেনে-চাপা-পড়া মৃত লাশের মতন। আমার এখন খুব করে মনে হয়, আমি নিজের হাতে বীণুর অনুভূতিগুলোকে গলা চেপে ধরেছিলাম—তার একমাত্র কারণ ছিল: মুক্তির নেশা। আমি মুক্তি চেয়েছিলাম।
প্রায়শই বীণুর অতিরিক্ত ভালোবাসার পিছুটান আমাকে অপরাধী করে দিত, আমার দমবন্ধ লাগত, ওর দেওয়া শান্তিটুকু একটা সময় বিষাদ মনে হতে শুরু করেছিল—এতে ওর কোনো দোষ ছিল না যদিও।
আমার এমন...একরোখা ভাবনাও বদলে গেল—বীণু চলে যাবার কিছুদিন পর থেকেই...আমি আবার তাকেই খুঁজতে শুরু করলাম; তবে পেলাম আর কই?
এই মুহূর্তে আমার শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, ভীষণ পিপাসায় বুকের একপাশে চাপা যন্ত্রণার রেখা স্পষ্ট; হঠাৎই আমার পিঠে কেউ একজন নিঃশব্দে হাত রাখল, আমার হৃদস্পন্দন যেন থমকে গেল!
কে?
সাহস করে পেছন ফিরে তাকালাম...
অন্ধকারে তার মুখটা আবছা লাগছে...
কে তুৃমি?