(পড়লে স্পয়লার পাবেন।)
পেরুর মাচু পিচু শহর। কাছের এক পাহাড়ে শুরুর দৃশ্যের শুটিং হবে। অভিনেতা, অভিনেত্রী ও কলাকুশলী মিলে প্রায় ৪৫০ জনকে নিয়ে ছবির নির্মাতা ভার্নার হারযগ চললেন পাহাড়ের গা ঘেঁষে। সাথে ছিল ঘোড়া, শুকর এবং লামা। খুব বৃষ্টি হচ্ছে, পাহাড়ের গা ভীষণ পিচ্ছিল। পাথরে খোদাই করে তৈরি-করা এক পুরনো সিঁড়ির দেখা মিলল, যেটা ইনকারা কয়েক শতাব্দী আগে বানিয়েছিল। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু মেঘ আর মেঘ। ঘন কুয়াশায় ঘেরা পথ দিয়ে দলটি পাহাড় বেয়ে উঠছে। তাদের অনেকের গায়ে প্রাচীন স্পেনীয় বিজেতাদের ভারি পোশাক, বর্ম। জায়গাটা অনেক উঁচুতে, উচ্চতার কারণে স্থানীয়রাই সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সিনেমা বানানোর জন্য দলটি যে যাত্রায় বেরিয়েছে, সে দুরূহ যাত্রাই যেন আরেকটা সিনেমা! দলটি আরও উঁচুতে উঠে গেল। এখন ওরা খাড়া ২০০০ ফুট উঁচুতে। একসময় গন্তব্য এলো। সেখানে ঘন কুয়াশা, এতটাই ঘন যে ক্যামেরায় চোখ রাখলে মাত্র কয়েক ফুট সামনের দৃশ্য দেখা যায়। হারযগ প্রমাদ গুনলেন। এতো কষ্ট করে এখানে আসা তবে বৃথা যাবে? এই পরিবেশে শুটিং করা অসম্ভব! হঠাৎ মেঘ হাল্কা হল, একটুএকটু করে দিনের আলো ফুটল। হারযগ শট নিলেন। পাহাড়ের গায়ের খাড়া ঢালুতে কুয়াশা ভেঙে আর্টিস্টরা উপরে উঠছেন, ক্যামেরা চলছে। যা হওয়ার কথা নয়, তা-ই হচ্ছে। যেন প্রকৃতিই সব করিয়ে নিচ্ছে। সিনেমার নায়ক আগুইয়ার চরিত্রে অভিনয়কারী ভার্নার হারযগের বন্ধু ক্লাউস কিন্স্কি সেই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন যেন! সিনেমাতেও তাঁর রোলটা ছিল এক একরোখা পাগলাটে দলনেতার। নির্দয় আবহাওয়া সদয় হল, সিনেমা সামনে এগোলো। “সেইদিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এই সিনেমা বানানোই আমার নিয়তিতে লেখা আছে।” অভিনেতা ক্লাউস কিন্স্কির সাথে তিক্ত সম্পর্কের গল্প নিয়ে নির্মিত ভার্নার হারযগের ডকুমেন্টারি ‘মাই বেস্ট ফিন্ড (১৯৯৯)’-এ দেখানো ‘আগুইয়ার, দ্য র্যাথ অব গড (১৯৭২)’ ছবিটি নির্মাণের পেছনের গল্পটা এরকমই।
বৈরী প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে জঙ্গল কেটেকেটে একটা দল এগিয়ে চলেছে সোনার শহর এল ডোরাডোর দিকে। ওরা জানে না কোনদিকে যেতে হবে কিংবা সে শহরটা আদৌ আছে কি না, শুধু জানে, সেখানে পৌঁছে যেতে হবে সবার আগে, সে ঐশ্বর্যকে নিজের করে নিতে হবে, নিজেদের সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করে দিতে হবে এল ডোরাডো পর্যন্ত। পথে নানা বিপদ, বাধাবিপত্তি, দুর্যোগ। সবকিছুকে জয় করে সেই সোনার রাজ্যে পৌঁছতেই হবে। মানুষের সাথে প্রকৃতির এই যে লড়াই, হোক তা অনর্থকই, তবু জাগতিক বিত্তের প্রতি লোভ আর ক্ষমতা বাড়ানোর স্বপ্ন, এই দুইয়ের মধ্যে আবর্তিত হয়ে কিছু মানুষের ক্রোধ, উন্মত্ততা ও সংকল্পের আখ্যান ‘আগুইয়ার, দ্য র্যাথ অব গড’। ইতিহাস বলে, আগুইয়ার ছিলেন একজন যোদ্ধা, যিনি অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পেতেন। তিনি যখন এল ডোরাডোর খোঁজে বেরিয়েছিলেন, তখন দলের নেতাকে উৎখাত করে নিজেই দলের নেতৃত্ব নিয়েছিলেন। স্বভাবে তিনি ছিলেন পাগলাটে, বেপরোয়া। নিজেই নিজের নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য র্যাথ অব গড—ঈশ্বরের ক্রোধ’। উনি ঘোষণা করেছিলেন, আমিই এল ডোরাডো এবং নতুন স্পেনের রাজা। একদল সহচর নিয়ে সেই অচেনা এল ডোরাডোর খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তিনি যখন আটলান্টিক মহাসাগরে পৌঁছলেন, তখন তাঁর অনুসারীদের কয়েকজন মাত্র বেঁচেছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি আর সে সোনার রাজ্যে পৌঁছতে পারেননি। তাঁর এই ঔদ্ধত্য, অলীকের স্বপ্ন, দূরের বৈরী প্রকৃতির সাথে অহেতুক সংগ্রাম-ই হারযগকে এ সিনেমা বানাতে উৎসাহিত করেছে। এক সাক্ষাৎকারে হারযগ বলেছেন, “আগুইয়ার হচ্ছে ইতিহাসের সবচাইতে বড়ো অভাগাদের অন্যতম।” তবে তিনি এ সিনেমায় ইতিহাসকে ফিল্মের ভাষায় ও আবরণে পুনর্নির্মাণ করেছেন। সত্য ঘটনা ও পারিপার্শ্বিক থেকে কিছুটা দূরে সরে কেবল একজন লোভী, অবিবেচক, খ্যাপাটে, সাম্রাজ্যবাদী যোদ্ধার অবয়ব এঁকেছেন, যে ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার খোঁজে মরিয়া হয়ে ওঠে, এবং এক ইওটোপিয়া জয়ের অভিযানে নেমে সে নিজের এবং অনুসারীদের মৃত্যু ডেকে আনে।
সিনেমা শুরু হয় একজন সন্ন্যাসীর ডায়রি থেকে। দলের নেতা পিজারো অভিযানের ধীরগতি দেখে সে জঙ্গলের মধ্যে হতাশ হয়ে পড়েন। ঘন কাদা ও ময়লা ভেঙেভেঙে ওরা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সাথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘোড়া, কামান। এক মহিলাকে পালকি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্লান্তিতে ও অবসাদে পিজারো কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সে সময় আগুইয়ার কৌশলে দলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেয়। গুজম্যান নামে এক সম্ভ্রান্ত লোককে লোকদেখানো দলনেতার আসনে বসিয়ে সে নিজেই পুরো দলের সব সিদ্ধান্ত দিতে থাকে। সে সাহসী, অদম্য, একরোখা। সে চায় সোনার শহরের পুরো নেতৃত্ব থাকবে তার হাতে, তাদের এই অভিযানকে সে তুলনা করে মেক্সিকোজয়ের অভিযানের সাথে। ওদের ভেলা যখন জঙ্গলের খাল দিয়ে এগোতে থাকে, তখন ওদের দেখে স্থানীয় নরখাদক আদিবাসীরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে: “ওই দেখো, মাংস ভেসে যাচ্ছে!” নরখাদকদের বিষমেশানো তীরের আঘাতে কয়েকজন মারা যায়। অনাহারে, অসুখে ভুগে আগুইয়ার এবং তার সঙ্গীরা অনেকটা পাগল হয়ে যেতে থাকে। ওরা সোনার শহর এল ডোরাডোর খোঁজে চলেছে, যে শহরের আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে কি না, সেটাই ওরা জানে না। দলের সবাই হতাশ হয়ে পড়লেও ঐশ্বর্য ও সাম্রাজ্য বিস্তারের ঘোরে আগুইয়ারের মনোবল সবসময়ই অটুট থাকে। দেখা যায়, সে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে, লাশের স্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচিয়ে বলে, আমরাই ইতিহাস লিখবো!
শুটিং শুরুর আগেই হারযগ পেরুর জঙ্গলে গিয়ে সেখানকার আদিবাসীদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলেন যে তিনি যা বানাবেন ভেবেছেন, তা বানানো সম্ভব। ওই লোকেশনে ২৭০ জন স্থানীয় পাহাড়িসহ ৪৫০ জন লোকের জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা করেছেন। হোম্ব্রেচিতো নামের এক চরিত্র সিনেমায় বাঁশি বাজায়, আগুইয়ার বাঁশি শুনতে ভালোবাসে। সে লোকটা ছিল স্থানীয়, হারযগ তাকে অনেক কষ্টে অভিনয় করতে রাজি করিয়েছিলেন। জঙ্গলের প্রতিকূলতার মধ্যে সিনেমার শুটিং হওয়ায় সে পরিবেশের সাথে আর্টিস্টদের মানিয়ে নিতে হয়েছিল, এবং তার একটা স্পষ্ট প্রভাব সিনেমায়ও পড়েছে। ফলে সিনেমা হয়ে উঠেছে বাস্তবানুগ। ওরা যেখানে তাঁবু খাটিয়ে ছিল, তার পাশেই ছিল নদী। হঠাৎ নদী থেকে পানির স্রোত এসে ওদের তাঁবুগুলি ভেঙে দেয়, তখন পুরো টিমের যে প্রতিক্রিয়া, সেটিকেই হারযগ ক্যামেরায় ধারণ করে সিনেমায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এমন-কী ভেলা তৈরির যে দৃশ্য সিনেমায় আছে, তাও পুরোপুরিই বাস্তব। নদীর স্রোত বেশি থাকায় ভেলায় ভেসে যাওয়ার দৃশ্যগুলি এক শটেই ধারণ করা হয়েছে, কিছু শট নেয়ার সময় আর্টিস্টদের জীবনই বিপন্ন হবার উপক্রম হয়েছিল। শেষ দৃশ্য নেয়ার সময় হারযগকে বানরের অসহ্য আক্রমণও সহ্য করতে হয়েছে!
একটা দৃশ্যে দেখা যায় এক লোক এক থেকে দশ গুনছে। দশ গোনার আগেই আরেকজন পেছন থেকে তলোয়ারের তীব্র আঘাতে তার মাথা ধড় থেকে আলাদা করে ফেলে, আমরা দেখি কাটামুণ্ডুটা একটু দূরে ছিটকে পড়ে, এবং তার গোনাটা শেষ করে: দশ! আরেক দৃশ্যে, উরসুয়ার স্ত্রী, যে পুরো সিনেমায় একটা নীল পোশাক পরে থাকে, আমাদের সামনে আসে সাদা ও সোনালী গাউন পরে, তাকে দেখায় ভূতের মতো। সে কীভাবে মারা যায়? যা দেখানো হয়েছে, সেটা কি তার অশরীরী আত্মা? নাকি সে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে স্বেচ্ছায় নরখাদকদের হাতে নিজেকে বলি দিয়েছে? আরেকটা দৃশ্যে আগুইয়ারের এক অনুসারী দেখে গাছের আগায় একটা পালতোলা নৌকা। ওটা ওখানে গেল কীকরে? অতো উঁচুতে পানির উচ্চতা ওঠার কথা না। তবে কি ওটা আকাশ থেকে পড়ল? নাকি জঙ্গলের কোনো বিশাল প্রাণী বা অতিপ্রাকৃত সত্তা ওটা ওখানে ফেলে রেখেছে? সিনেমার শেষে এসে ভেলায় আগুইয়ারের সাথে থাকা এক ক্রীতদাস মন্তব্য করে, ওই নৌকাটা সত্যিকারের নৌকা নয়, জঙ্গলটাও কল্পিত। সবকিছুই কল্পিত, অলীক। তার পায়ে যখন একটা তীর এসে বিদ্ধ করে, তখন সে বলে, এই তীরটাও অলীক। ওরা তীর ভয় পায় বলেই ওদের কল্পনায় তীর চলে আসে। শেষ দৃশ্য। সেই অভিশপ্ত ভেলার উপর আগুইয়ার একা দাঁড়িয়ে থাকে। সে বলতে থাকে, আমি সহ্য করবো, টিকে থাকবো, এই রাজ্য আমি জয় করবো। ভেলায় তার চারপাশে অসংখ্য বানর। সে একটা বানর হাতে তুলে নেয় এবং আকাশের দিকে কী এক আশায় কিংবা দম্ভে তাকায়। তার কল্পিত রাজ্যের বাস্তব বাসিন্দা ওইসব বানর, যেগুলি তার জয়ধ্বনির আড়ালে প্রকৃতপক্ষে তাকে তার চরম অসহায়ত্বের জন্য বিদ্রূপ করছে। কেউ তার কথা শুনছে না, হয়তোবা ঈশ্বরও শুনছেন না। সে ওই নদীতে একা পড়ে থাকে। হতাশ, অসহায়। ঐশ্বর্য এবং সাম্রাজ্যের স্বপ্নে আগুইয়ার পাগল হয়ে গিয়েছিল। সে এমন এক অলীক রাজ্যের অধিপতি হওয়ার জন্য জীবন বাজি রেখে অভিযানে নেমেছিল, যে রাজ্যের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। মানুষ এমন ভবিষ্যৎ মরীচিকার পেছনে ছুটেই বর্তমানটা নষ্ট করে।
সিনেমায় দেখানো বিদ্রোহের পর উরসুয়ার স্ত্রী ওদের সহযাত্রী পাদ্রীর কাছে যায় এবং আগুইয়ারের হাত থেকে উরসুয়াকে বাঁচানোর অনুরোধ জানায়। এ গল্পে পাদ্রীর অবস্থানটা রূপকাশ্রয়ী। মাঠে ফুল ফুটলে সবাই দেখে, ফুলের প্রশংসা করে। কখনো এক দমকা হাওয়া এসে সে ফুলকে উড়িয়ে নিয়ে গেলে এরপর কেউ আর সে ফুলের কথা মনেও আনে না। সাফল্যের সাথে টিকে থাকাই শেষকথা। পাদ্রী এমন একটা দলকে আলোর খোঁজ দিতে চেয়েছিলেন, যাদের কাছে অন্ধকারটাই আলোর মতো। ফলে পাদ্রীকেও নিয়তির কাছে হার মানতে হয়। এমনও হতে পারে, পাদ্রীকে অন্য সবার মতোই লোভ ও অলীক স্বপ্নের খেসারত দিতে হয়েছে। স্থানীয় এক রাজপুত্র, যে দুই স্থানীয় আদিবাসীর কথা অনুবাদ করে আগুইয়ারদের বলছিল, তার বয়ানে শুনি: আমি এই রাজ্যের যুবরাজ ছিলাম। কেউই আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারত না। কিন্তু এখন আমি শৃঙ্খলবদ্ধ, আমার রাজ্যের প্রজাদের মতোই আমাকে মাথা নুইয়ে থাকতে হয়। আমাদের কাছ থেকে সবই কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমি কিছুই করতে পারছি না, আমার কোনো ক্ষমতাই নেই। তবে আমি তোমাদের পরিণতি ভেবেও দুঃখ পাচ্ছি, কারণ এ জঙ্গল থেকে পালানোর কোনো পথ নেই।………এখানে জঙ্গলটা মনের ভেতরের জঙ্গল। আমাদের ভাবনা ও বিশ্বাস আমাদের পায়ে শেকল পরিয়ে রাখে। এমন দর্শন ও সতর্কবার্তাও আগুইয়ারের মনে কোনো নাড়া দেয়নি। অবশেষে তাকে তার উন্মত্ত জেদ আর অহেতুক লোভের চড়া দাম দিতে হয়েছে।
আচ্ছা, আগুইয়ার কেন গুজমানকে তাদের দলের নেতা বানিয়ে রেখেছিল? গুজমানের মধ্যে কোনো নেতৃত্বগুণ ছিল না, সে দলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিল না। আসলে এটা একটা কূটনৈতিক চাল, অনেকটা পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করার মতো। সকল ক্ষমতা যার হাতে থাকার কথা, তার কোনো ক্ষমতাই নেই। ফলে এল ডোরাডো পরিচালনার সকল দায়িত্ব ও ক্ষমতা থাকবে আগুইয়ারের হাতে, তবে তার কাজেকর্মে কোনো ভুল হলে রাজ্যের প্রধান হিসেবে তার সকল দায় প্রথমেই বর্তাবে গুজমানের ঘাড়ে। এতে আগুইয়ার নির্ভাবনায় কর্তৃত্বস্থাপন করতে পারবে। ফিল্মে নরখাদক আদিবাসীদের ভূমিকা কী? আগুইয়ার নিজেকে যতই পরাক্রমশালী মনে করুক না কেন, সে এবং তার দল ছিল আদিবাসীদের কাছে অসহায়। পৃথিবীতে পরম ক্ষমতা বলে কিছু নেই। কোনোকিছুকেই কখনো পুরোপুরি জয় করা যায় না। সেয়ানার উপরেও সেয়ানা আছে, বাপেরও বাপ আছে। কোনো এক মিথের কাহিনি থেকে স্থানীয়রা জানতোই যে বিদেশি কেউ আসবে তাদের রাজ্য জয় করতে। ওরা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। যথেষ্ট শক্তি এবং পরিকল্পনা ছাড়া কেবল আবেগ ও জেদের জোরে আগুইয়ার এবং তার দল পথ না চিনে, জায়গাটা সম্পর্কে না জেনেই নতুন রাজ্য জয় করতে গিয়েছিল, যা ছিল চরম বোকামি। লোভ এক অদ্ভুত জিনিস। এটা কোনো যুক্তির ধার ধারে না, বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নেয় না। তার সাথে যদি যুক্ত হয় অহেতুক জেদ, তবে তা ব্যক্তির অস্তিত্বকে একেবারে শেষ করে দেয়। ওদের যাত্রায় ক্ষুধা ছিল, রোগশোক ছিল, দৈহিক কষ্ট ছিল, আরও ছিল স্থানীয় আদিবাসীদের আক্রমণ। তবু ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল। সে গোঁয়ার্তুমির পেছনে একটাই প্রণোদনা: সোনার রাজ্য জয়ের আকাঙ্ক্ষা!
আগুইয়ারের লক্ষ্য স্বর্ণলাভ ছিল না, ছিল ক্ষমতা ও খ্যাতি অর্জন। তার মুখেই শোনা যাক: আমি, আগুইয়ার, যদি চাই তবে গাছ থেকে জ্যান্তপাখি মৃতপাখির মতো খসে মাটিতে পড়বে। আমি হচ্ছি ঈশ্বরের ক্রোধ! আমি যে মাটির উপর দিয়ে হেঁটে যাই, সে মাটি আমাকে দেখে ভয়ে কেঁপে ওঠে! কিন্তু যে আমাকে এবং আমার পথ অনুসরণ করবে, সে অসীম ঐশ্বর্যের অধিকারী হবে। আর যে আমাকে ছেড়ে যাবে………হ্যাঁ, আগুইয়ার ছিল ঈশ্বরের ক্রোধ, সে কারণেই তার অমন পরিণতি! ঈশ্বর তাঁর সন্তানের এমন প্রমত্ত আচরণে ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং সে ক্রোধই আগুইয়ারকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। পুরো সিনেমাজুড়ে ওদের সাথে থাকা এক স্থানীয় অধিবাসী বাঁশি বাজায়। এর অর্থ কী? বাঁশির সুর এখানে জীবনের সরল রূপের প্রতীক। অন্যের সম্পদের প্রতি অতি লোভের ফাঁদে না পড়ে নিজের যা আছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থেকে জীবনের ছোটছোট সুখ নিয়ে বেঁচে থাকাই শান্তি ও স্বস্তির মূল রহস্য। সিনেমায় উরসুয়া ক্ষমতা হারিয়ে যন্ত্রণা নিয়েও বেঁচে থাকে। সে কাউকেই কিছু বলে না। কেন? সে লোভের বশবর্তী হয়ে অহেতুক অভিযানের সূচনা করেছে, তার নিজের সাম্রাজ্যের নিশ্চিত সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যকে পেছনে ফেলে নতুন রাজ্য দখল করতে পথে নেমেছে, এক অনিশ্চিতের দিকে তার এ নির্বোধ যাত্রাই তার মৃত্যুযন্ত্রণা ডেকে এনেছে। এই যে অসীম কষ্ট, এটা তার প্রাপ্য।
সিনেমায় দেখি, অন্যরা সবাই না খেয়ে মরছে, তবু অথর্ব দলনেতা গুজমানের জন্য খাবারের কোনো অভাব নেই। তার ইচ্ছায় ঘোড়াটাকে ছেড়ে দেয়া হল, এরপর কেউ এসে তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করে। সে বেঁচে থাকতে উরসুয়াকে ফাঁসিতে ঝোলায়নি, ক্ষমা করে দিয়েছিল। তার মৃত্যুর পরপরই উরসুয়াকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। হাকিম নড়ল, হুকুমও নড়ল। এটাই বাস্তবতা। হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না, এমন তত্ত্বকথা কেবল সাধারণ অসহায় মানুষের জন্যই প্রযোজ্য। উরসুয়ার স্ত্রী জঙ্গলের দিকে হেঁটে চলে যায়। সে জানে, সেখানে নরখাদকরা আছে, তবু তার কাছে সম্ভাব্য সে মৃত্যু আগুইয়ারের হাতে অসম্মানের চাইতে শ্রেয়। আগুইয়ারের লোভের বলি হতে হয়েছে মুভিতে দেখানো তার একমাত্র আপনজন তার মেয়েকে। চোখের সামনে সন্তানের নির্মম মৃত্যু, সন্তানকে বাঁচানোর কোনো ক্ষমতাই অসহায় পিতার নেই, একজন পিতার জীবনে এর চাইতে বড়ো শাস্তি আর কী হতে পারে? মেয়ের মৃত্যুর পর আগুইয়ার বলে, আমি, ঈশ্বরের ক্রোধ, আমার নিজের মেয়েকেই বিয়ে করবো। এর মাধ্যমে আমি এ পৃথিবীর বিশুদ্ধতম রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করবো। আমরাই এই পুরো রাজ্য শাসন করবো। আমিই ঈশ্বরের ক্রোধ! আমার সাথে আর কে আছো?……তীব্র লোভ এবং একইসাথে চরম হতাশা, এই দুই মিলে তাকে অন্ধ করে দেয়। রক্তের বিশুদ্ধতায় গড়া এক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে বাঁচার স্বপ্ন সে কিছুতেই ছাড়তে পারে না। তার দম্ভ ও ঔদ্ধত্য তাকে একা করে দিয়েছে, তবু সে শেষ পর্যন্ত মাথানত করে না।